আজ ২৩শে অক্টোবর; কাল সন্ধ্যার সময় প্যারিস হতে বিদায়। এ বৎসর এ প্যারিস সভ্যজগতে এক কেন্দ্র, এ বৎসর মহাপ্রদর্শনী। নানা দিগ্দেশ-সমাগত সজ্জনসঙ্গম। দেশ-দেশান্তরের মনীষিগণ নিজ নিজ প্রতিভাপ্রকাশে স্বদেশের মহিমা বিস্তার করছেন, আজ এ প্যারিসে। এ মহাকেন্দ্রের ভেরীধ্বনি আজ যাঁর নাম উচ্চারণ করবে, সে নাদ তরঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বদেশকে সর্বজনসমক্ষে গৌরবান্বিত করবে। আর আমার জন্মভূমি—এ জার্মান ফরাসী ইংরেজ ইতালী প্রভৃতি বুধমণ্ডলী-মণ্ডিত মহা রাজধানীতে তুমি কোথায়, বঙ্গভূমি? কে তোমার নাম নেয়? কে তোমার অস্তিত্ব ঘোষণা করে? সে বহু গৌরবর্ণ প্রাতিভমণ্ডলীর মধ্য হতে এক যুবা যশস্বী বীর বঙ্গভূমির—আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন, সে বীর জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জে সি বোস! একা যুবা বাঙালী বৈদ্যুতিক আজ বিদ্যুদ্বেগে পাশ্চাত্য-মণ্ডলীকে নিজের প্রতিভামহিমায় মুগ্ধ করলেন—সে বিদ্যুৎসঞ্চার, মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবন-তরঙ্গ সঞ্চার করলে! সমগ্র বৈদ্যুতিকমণ্ডলীর শীর্ষস্থানীয় আজ জগদীশ বসু—ভারতবাসী, বঙ্গবাসী, ধন্য বীর! বসুজ ও তাঁহার সতী সাধ্বী সর্বগুণসম্পন্না গেহিনী যে দেশে যান, সেথায়ই ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন—বাঙালীর গৌরব বর্ধন করেন। ধন্য দম্পতি!
আর মিঃ লেগেট প্রভূত অর্থব্যয়ে তাঁর প্যারিসস্থ প্রাসাদে ভোজনাদি-ব্যপদেশে নিত্য নানা যশস্বী ও যশস্বিনী নর-নারীর সমাগম সিদ্ধ করেছেন, তারও আজ শেষ। কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, নৈতিক, সামাজিক, গায়ক, গায়িকা, শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রী, চিত্রকর, শিল্পী, ভাস্কর, বাদক—প্রভৃতি নানা জাতির গুণিগণ-সমাবেশ মিষ্টর লেগেটের আতিথ্য-সমাদর-আকর্ষণে তাঁর গৃহে। সে পর্বতনির্ঝরবৎ কথাচ্ছটা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গবৎ চতুর্দিক-সমুত্থিত ভাববিকাশ, মোহিনী সঙ্গীত, মনীষি-মনঃসংঘর্ষ-সমুত্থিত চিন্তামন্ত্রপ্রবাহ সকলকে দেশকাল ভুলিয়ে মুগ্ধ করে রাখত!—তারও শেষ।
সকল জিনিষেরই অন্ত আছে। আজ আর একবার পুঞ্জীকৃতভাবরূপ স্থিরসৌদামিনী, এই অপূর্ব ভূস্বর্গ-সমাবেশ প্যারিস-এগজিবিশন দেখে এলুম।
আজ দু-তিন দিন ধরে প্যারিসে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রতি সদা সদয় সূর্যদেব আজ ক-দিন বিরূপ। নানাদিগ্দেশাগত শিল্প, শিল্পী, বিদ্যা ও বিদ্বানের পশ্চাতে গূঢ়ভাবে প্রবাহিত ইন্দ্রিয়বিলাসের স্রোত দেখে ঘৃণায় সূর্যের মুখ মেঘকলুষিত হয়েছে, অথবা কাষ্ঠ বস্ত্র ও নানারাগরঞ্জিত এ মায়া অমরাবতীর আশু বিনাশ ভেবে তিনি দুঃখে মেঘাবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকলেন।
আমরাও পালিয়ে বাঁচি—এগজিবিশন ভাঙা এক বৃহৎ ব্যাপার। এই ভূস্বর্গ, নন্দনোপম প্যারিসের রাস্তা এক হাঁটু কাদা চুন বালিতে পূর্ণ হবেন। দু-একটা প্রধান ছাড়া এগজিবিশনের সমস্ত বাড়ী-ঘর-দোরই, কাটকুটরো, ছেঁড়া ন্যাতা, আর চুনকামের খেলা বৈ তো নয়—যেমন সমস্ত সংসার! তা যখন ভাঙতে থাকে সে চুনের গুঁড়ো উড়ে দম আটকে দেয়; ন্যাতাচোতায়, বালি প্রভৃতিতে পথ ঘাট কদর্য করে তোলে; তার উপর বৃষ্টি হলেই সে বিরাট কাণ্ড!
২৪শে অক্টোবর সন্ধ্যার সময় ট্রেন প্যারিস ছাড়ল; অন্ধকার রাত্রি—দেখবার কিছুই নাই। আমি আর মস্যিয় বোওয়া এক কামরায়—শীঘ্র শীঘ্র শয়ন করলুম। নিদ্রা হতে উঠে দেখি, আমরা ফরাসী সীমানা ছাড়িয়ে জার্মান সাম্রাজ্যে উপস্থিত। জার্মানী পূর্বে বিশেষ করে দেখা আছে; তবে ফ্রান্সের পর জার্মানী—বড়ই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাব। ‘যাত্যেকতোঽস্তশিখরং পতিরোষধীনাং’—এক দিকে ভুবনস্পর্শী ফ্রান্স, প্রতিহিংসানলে পুড়ে পুড়ে আস্তে আস্তে খাক হয়ে যাচ্ছে; আর এক দিকে কেন্দ্রীকৃত নূতন মহাবল জার্মানী মহাবেগে উদয়শিখরাভিমুখে চলেছে। কৃষ্ণকেশ, অপেক্ষাকৃত খর্বকায়, শিল্পপ্রাণ, বিলাসপ্রিয়, অতি সুসভ্য ফরাসীর শিল্পবিন্যাস; আর এক দিকে হিরণ্যকেশ, দীর্ঘকার, দিঙ্নাগ জার্মানীর স্থূলহস্তাবলেপ। প্যারিসের পর পাশ্চাত্য জগতে আর নগরী নাই; সব সেই প্যারিসের নকল—অন্ততঃ চেষ্টা। কিন্তু ফরাসীতে সে শিল্পসুষমার সূক্ষ্ম সৌন্দর্য; জার্মানে, ইংরেজে, আমেরিকে সে অনুকরণ স্থূল। ফরাসী বলবিন্যাসও যেন রূপপূর্ণ; জার্মানীর রূপবিকাশ-চেষ্টাও বিভীষণ। ফরাসী প্রতিভার মুখমণ্ডল ক্রোধাক্ত হলেও সুন্দর; জার্মান প্রতিভার মধুর হাস্য-বিমণ্ডিত আননও যেন ভয়ঙ্কর। ফরাসীর সভ্যতা স্নায়ুময়, কর্পূরের মত—কস্তুরীর মত এক মুহূর্তে উড়ে ঘর দোর ভরিয়ে দেয়; জার্মান সভ্যতা পেশীময়, সীসার মত—পারার মত ভারী, যেখানে পড়ে আছে তো পড়েই আছে। জার্মানের মাংসপেশী ক্রমাগত অশ্রান্তভাবে ঠুকঠাক হাতুড়ি আজন্ম মারতে পারে; ফরাসীর নরম শরীর—মেয়েমানুষের মত, কিন্তু যখন কেন্দ্রীভূত হয়ে আঘাত করে, সে কামারের এক ঘা; তার বেগ সহ্য করা বড়ই কঠিন।
জার্মান ফরাসীর নকলে বড় বড় বাড়ী অট্টালিকা বানাচ্ছেন, বৃহৎ বৃহৎ মূর্তি—অশ্বারোহী, রথী—সে প্রাসাদের শিখরে স্থাপন করছেন, কিন্তু জার্মানের দোতলা বাড়ী দেখলেও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, এ বাড়ী কি মানুষের বাসের জন্য, না হাতী-উটের ‘তবেলা’? আর ফরাসীর পাঁচতলা হাতী-ঘোড়া রাখবার বাড়ী দেখে ভ্রম হয় যে, এ বাড়ীতে বুঝি পরীতে বাস করবে!
আমেরিকা জার্মান-প্রবাহে অনুপ্রাণিত, লক্ষ লক্ষ জার্মান প্রত্যেক শহরে। ভাষা ইংরেজী হলে কি হয়, আমেরিকা আস্তে আস্তে ‘জার্মানীত’৩৯ হয়ে যাচ্ছে। জার্মানীর প্রবল বংশবিস্তার; জার্মান বড়ই কষ্টসহিষ্ণু। আজ জার্মানী ইওরোপের আদেশদাতা, সকলের উপর! অন্যান্য জাতের অনেক আগে জার্মানী প্রত্যেক নরনারীকে রাজদণ্ডের ভয় দেখিয়ে বিদ্যা শিখিয়েছে; আজ সে বৃক্ষের ফল ভোজন করছে। জার্মানীর সৈন্য প্রতিষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ; জার্মানী প্রাণপণ করেছে যুদ্ধপোতেও সর্বশ্রেষ্ঠ হতে; জার্মানীর পণ্যনির্মাণ ইংরেজকেও পরাভূত করেছে! ইংরেজের উপনিবেশেও জার্মান পণ্য, জার্মান মনুষ্য ধীরে ধীরে একাধিপত্য লাভ করছে; জার্মানীর সম্রাটের আদেশে সর্বজাতি চীনক্ষেত্রে৪০ অবনত মস্তকে জার্মান সেনাপতির অধীনতা স্বীকার করছেন!
সারাদিন ট্রেন জার্মানীর মধ্য দিয়ে চলল; বিকাল বেলা জার্মান আধিপত্যের প্রাচীন কেন্দ্র—এখন পররাজ্য—অষ্ট্রীয়ার সীমানায় উপস্থিত। এ ইওরোপে বেড়াবার কতকগুলি জিনিষের উপর বেজায় শুল্ক; অথবা কোন কোন পণ্য সরকারের একচেটে, যেমন তামাক। আবার রুশ ও তুর্কীতে তোমার রাজার ছাড়পত্র না থাকলে একেবারে প্রবেশ নিষেধ; ছাড়পত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট একান্ত আবশ্যক। তা ছাড়া রুশ এবং তুর্কীতে, তোমার বইপত্র কাগজ সব কেড়ে নেবে; তারপর তারা পড়ে শুনে যদি বোঝে যে তোমার কাছে তুর্কীর বা রুশের রাজত্বের বা ধর্মের বিপক্ষে কোন বই-কাগজ নেই, তা হলে তা তখন ফিরিয়ে দেবে—নতুবা সে সব বইপত্র বাজেয়াপ্ত করে নেবে। অন্য অন্য দেশে এ পোড়া তামাকের হাঙ্গামা বড়ই হাঙ্গামা। সিন্দুক, প্যাঁটরা, গাঁটরি—সব খুলে দেখাতে হবে, তামাক প্রভৃতি আছে কি না। আর কনষ্টাণ্টিনোপল আসতে গেলে দুটো বড়—জার্মানী আর অষ্ট্রীয়া এবং অনেকগুলো ক্ষুদ্র দেশের মধ্য দিয়ে আসতে হয়; ক্ষুদেগুলো পূর্বে তুরস্কের পরগণা ছিল, এখন স্বাধীন ক্রিশ্চান রাজারা একত্র হয়ে মুসলমানের হাত থেকে যতগুলো পেরেছে, ক্রিশ্চানপূর্ণ পরগণা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষুদে পিঁপড়ের কামড় ডেওদের চেয়েও অনেক অধিক।