ফোন এল রাত দশটার কিছু পরে।
কিরীটীকে ডাকতে হল না। সে সজাগ ছিল। তাড়াতাড়ি ঘরে এসে রিসিভারটরা তুলে নিল।
অন্য পক্ষ কি কথা বললে বোঝা গেল না ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, কেবল কিরীটীর একটিমাত্র জবাব শোনা গেল, ঠিক আছে, মল্লিক সাহেবকে ফোন করে দিন।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, খাবার হয়েছে কৃষ্ণা?
হ্যাঁ। দেব?
হ্যাঁ, আমাদের খাবার দিতে বল।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আধঘণ্টার মধ্যেই দুজনে বেরুল।
হীরা সিং?
জী সাব!
শ্যামবাজার চল।
শ্যামবাজারে সুভদ্রার গৃহে পৌঁছতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগে না।
কিরীটী আর সুব্রত গলির মধ্যে ঢুকে দরজার কলিংবেলটা টিপল কিরীটী।
একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল।
সুভদ্রাই দরজা খুলে দিয়েছিল, কিরীটীবাবু! এত রাত্রে, কি ব্যাপার?
চলুন ভিতরে, আপনাকে একটা সংবাদ দিতে এসেছি।
সুভদ্রা কিন্তু দরজা ছাড়ে না, কেমন যেন একটা ইতস্ততঃ ভাব।
আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন কিরীটীবাবু।
জানি আপনি কি ব্যাপারে ব্যস্ত। কিন্তু আমার প্রয়োজনটা অনেক বেশি।
আপনি কাল আসবেন–বলতে বলতে সুভদ্রা কিরীটীর মুখের উপরই যেন দরজাটা বন্ধ করবার উপক্রম করে।
কিরীটী কিন্তু হাত দিয়ে দরজার পাল্লা দুটো ঠেলে শান্ত গলায় বললে, কোন লাভ হবে না সুভদ্রা দেবী। আপনার যত কাজই থাক এখন, এবং আপনি যত ব্যস্তই থাকুন, আমাকে ঘরে যেতে দিতেই হবে, আমার কথাও আপনাকে শুনতেই হবে।
কিন্তু আপনি কি জোর-জবরদস্তি করবেন নাকি?
সে রকম করবার কোন ইচ্ছা, বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমার নেই, তবে আপনি যদি আমাকে বাধ্য করেন–
এটা আমার বাড়ি কিরীটীবাবু!
সুভদ্রার গলার স্বর তীক্ষ্ণ এবং কঠিন।
অবশ্যই, এবং সেটা না জানার তো কোন হেতু নেই। চলুন ভিতরে।
না।
সুভদ্রা দেবী, পুলিস আশপাশেই আছে, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না আশা করি, তাদের সাহায্য আমি নিই!
পুলিস!
হ্যাঁ, চলুন ভিতরে।
সহসা সুভদ্রার কণ্ঠস্বরের যেন পরিবর্তন ঘটল।
সে বললে, আপনি পুলিস নিয়ে এসেছেন? কিন্তু কেন, কি করেছি আমি?
ভিতরে চলুন সব বলছি।
সুভদ্রা মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে যেন কি ভাবল। তারপর বললে, বেশ। আসুন।
বসবার ঘরেই বসাতে যাচ্ছিল সুভদ্রা কিরীটীকে, কিন্তু কিরীটী বললে, না, আপনার শোবার ঘরে চলুন।
শোবার ঘরে?
হ্যাঁ, চলুন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখা গেল, সুভদ্রার শয্যার উপরে বসে আছে সুজিতকুমার, বুকে ও হাতে তার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।
নমস্কার সুজিতবাবু, চিনতে পারছেন?
হ্যাঁ, কিরীটীবাবু। সুজিত বললে।
ভালই হল সুজিতবাবু, আপনাকে কয়েকটা কথা আমার জিজ্ঞাসা করার ছিল, দেখা হয়ে গেল এখানেই, আপনার কালীঘাটের বাড়িতে আর ছুটতে হল না।
হ্যাঁ, আজ দুপুরে গিয়ে সুভদ্রা এখানে আমায় নিয়ে এসেছে।
ভালই করেছেন উনি, ওখানে তো সেবা করার মত কেউ আপনার ছিল না। কিরীটী বললে।
বসুন না কিরীটীবাবু, দাঁড়িয়ে কেন? সুজিত বললে।
আপনি তো বসতে বলছেন, সুভদ্রা দেবী তো ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না বাড়িতে।
সে কি! কেন সুভদ্রা? সুজিত প্রশ্নটা করে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
আপনার এ সময়ে এখানে উপস্থিতিটা হয়তো বাইরের লোক কেউ জানুক সুভদ্রা দেবীর ইচ্ছা ছিল না, তাই না কি সুভদ্রা দেবী?
কথাটা বলে আড়চোখে তাকাল কিরীটী সুভদ্রার দিকে।
সুভদ্রা চুপ। কোন কথা বলে না।
কিরীটী আবার বললে, যাক, একপক্ষে ভালই হল, দুজনের সঙ্গে একই জায়গায় দেখা হয়ে গেল। তারপর, কেমন আছেন? হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল?
হ্যাঁ। বললে ডাক্তাররা আঘাতটা অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যে নেহাত অপঘাতে মৃত্যু ছিল না বলেই হাসতে হাসতে বললে সুজিত।
হ্যাঁ, ভাগ্য নিশ্চয়ই বলতে হবে। তা কে পিছন থেকে আপনাকে আঘাত করল জানতেই পারলেন না? দেখতেও পেলেন না লোকটাকে সুজিতবাবু?
অন্ধকারে ছোরাটা মেরেই ছায়ার মত অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেল কিরীটীবাবু! তাছাড়া রক্তে তখন আমার সারা জামা ভিজে গিয়েছে, প্রায় ফেণ্ট হবার যোগাড়। ঐ অবস্থায় আততায়ীকে দেখবার মত অবস্থা কি থাকতে পারে!
তা সত্যি।
তা উনি—সুব্রতকে দেখিয়ে সুজিত বললে, ওঁকে তো চিনতে পারছি না!
উনি আমার এক ছোটবেলার বন্ধু, কৃষ্ণনগরে চাষাপাড়ায় ওঁর বাড়ি।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, আপনারও কৃষ্ণনগরে ঐ পাড়াতেই বাড়ি সুজিতবাবু, তাই না? ভাল কথা, রঞ্জিত বিশ্বাসকে আপনি চেনেন?
রঞ্জিত বিশ্বাস! কে বলুন তো?
চিনতে পারছেন না, অথচ তিনি বলছিলেন, একসঙ্গে এক বছর আপনারা আর্ট স্কুলে পড়েছিলেন। কিরীটী বললে।
ও! হা হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা তাকে আপনি চেনেন নাকি?
চিনতাম না, তবে–
তবে?
সেদিন চেনা-পরিচয় হল, তাঁর কাছেই শুনছিলাম—
কি শুনেছেন?
আপনি ছোটবেলা থেকেই ভাল অভিনয় করতে পারতেন, শেষ পর্যন্ত তাই বোধ হয় আঁকার লাইন ছেড়ে অভিনয়ের লাইনটাই বেছে নিলেন।
হ্যাঁ, ও হল কমাশিয়াল আর্টিস্ট আর আমি হলাম অভিনেতা। তা রঞ্জিত বিশ্বাস এখন কোথায়? অনেক দিন তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না।
এবারে হয়তো হবে।
কলকাতায় থাকলে হবে বৈকি। কিন্তু আপনি একটু আগে যেন বলছিলেন আমাকে আপনার কি জিজ্ঞাসা করবার আছে?
হ্যাঁ, দুটো কথা।
কি বলুন তো?
দুর্ঘটনার রাত্রে—অর্থাৎ যে রাত্রে হরিদাস সামন্তকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়—মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে–
বলেন কি! সত্যি নাকি ব্যাপারটা?