পুনর্জন্ম ও মুক্তি (উপনিষদ)
ঋগ্বেদের মানুষের কাছে এই পৃথিবীর জীবন ছিল মধুর আশীর্বাদ, তাই একটি সমস্যামুক্ত সমৃদ্ধ জীবনকে মৃত্যুর পরেও সম্প্রসারিত ও দীর্ঘায়িত করাই ছিল তার প্ৰধান উদ্দেশ্য। কিন্তু উপনিষদে জীবন এমন অমঙ্গলে পরিণত যে, পার্থিব অস্তিত্বের পুনরাবৃত্তি এখন ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে, পুনর্জন্মকে অতিক্রম করাই ধর্মের প্ৰধান লক্ষ্যে পরিণত-সম্ভবত এই মতবাদ প্ৰাগাৰ্য তপস্বী সম্প্রদায়দের (যেমন–মুনি যতি ও শ্রমণ) মধ্যে উদ্ভূত হয়েছিল। তৎকালীন মানুষ জীবনের পুনরাবৃত্তি এবং মৃত্যুর পরে পুনরুদ্ভবের প্রক্রিয়া চন্দ্ৰ, উদ্ভিদ ও জীবজগতের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখেছিল; কিন্তু মৃত্যুর পরে জীবনের উদ্ভব সম্পর্কে প্রবল বিশ্বাস থাকায় মানুষের কাছে তা অবিমিশ্র অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। কঠোপনিষদে আছে : ‘মানুষ শস্যের মতো মৃত্যুমুখে পতিত হয়, আবার শস্যের মতই পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করে।’ (১ : ১ : ৬) প্রথম দিকে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছিল; বিশেষভাবে পুনর্জন্মরূপ এই চুড়ান্ত অভিশাপটি নাস্তিক্যবাদীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, যারা বিশ্বাস করত যে, শুধুমাত্র এই পৃথিবীই বাস্তব এবং মৃত্যুর পরে আর কিছুই নেই। অর্থাৎ এটা ছিল সেই সময়, যখন প্রচলিত মতবাদ সম্পর্কে অবিশ্বাস খুব স্পষ্টভাবে মাথা তুলেছিল এবং তাই তাকে সর্বাধিক অকল্যাণপ্ৰদ যে পুনর্জন্ম তার দ্বারাই শাস্তি দিতে, হ’ল। ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ না করে যে ব্যক্তি মরে, পুনর্জন্ম তার নিশ্চিত ভবিতব্য এবং এরূপ ব্যক্তি মানুষ, ইতর প্রাণী কিংবা জড় পদার্থীরূপে পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করতে পারে (কঠ, ২ : ২ : ৭, ২ : ৩ : ৪); মুণ্ডক উপনিষদে কর্ম ‘অদৃঢ় তরণী’রূপে বৰ্ণিত; কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী ব্যক্তিদে্র জন্যই পুনর্জন্ম সংরক্ষিত। পরবর্তী জন্মগুলিতে কোনো ব্যক্তির অবস্থান তার আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও মর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয়। জীবজগতের জীবনের পুনর্নবায়ণ লক্ষ্য করে যে তৎকালীন মানুষ এই ধরনের তত্ত্বে উপনীত হয়েছিল, তার ইঙ্গিত রয়েছে—আম, বট বা পিপুল গাছের উল্লেখে (মুণ্ডক ১ : ২ : ৯)।
তবুও পুনর্জন্ম লাভের এই সম্ভাবনাকে কখনো কাম্য মনে করা হয় নি, মানবজীবনে প্ৰধান আশঙ্কা রূপেই তা বিবেচিত হয়েছে, যে আশঙ্কা শুধু চুড়ান্ত মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ অর্জনের দ্বারা জয় করা সম্ভব। এই মুক্তির তিনটি স্তর রয়েছেঃ পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে তা হ’ল মৌলিক ঐশ্যবোধের উপলব্ধি বা সকল বাস্তবতা যে-একে মিলিত হয়, সেই ব্ৰহ্মা এবং জীবাত্মার অন্তনিহিত সত্ত্বার একত্ব। এভাবে ব্যষ্টি মানুষের খণ্ডিত সত্তার বোধ থেকে আসে মুক্তির সংকেত। পরলোক তত্ত্বের স্তরে উন্মোচিত অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা একটি দীর্ঘস্থায়ী ফল পাওয়া যায়—তা পুনর্জন্মের শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। তৃতীয়ত, আধ্যাত্মিক স্তরে মুক্তি হ’ল অতীত কর্মের ও কর্মফলের বিলুপ্তিকর্মের ভয়াবহ ও অমোঘ। কার্যকরণ-শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তি। তৃতীয়ত, আধ্যাত্মিক স্তরে মুক্তি হ’ল অতীত কর্মের ও কর্মফলের বিলুপ্তিকর্মের ভয়াবহ ও অমোঘ। কার্যকরণ-শৃঙ্খল ও তার ফলাফলের উচ্ছেদসাধন। বিভিন্ন উপনিষদে বিশ্বে মৌলশক্তিকে বিশুদ্ধ, অমৃতস্বরূপ এবং জাগতিকতার স্পর্শরহিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জ্ঞান ও বোধই বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষকে প্রকৃত একত্ববোধের অন্তদৃষ্টি দিতে পারে—এই ভাবনা সর্বতোভাবে নতুন একটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সূচনা করেছিল। কঠোপনিষদ মুক্তিলাভের প্রক্রিয়াকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছে; সেখানে বলা হয়েছে যে, আত্মা ইন্দ্ৰিয়াতীত আদি ও অন্তহীন, ও গভীর ও অনন্ত শাস্তির আধার-আত্মাকে জানার পর মানুষ মৃত্যুর কবল থেকে নিস্তার পায় (১ : ৩ : ১৩, ১৫; ২ : ১ : ১; ২ : ২ : ১৩)। কখনো বা এই আত্মাকে পুরুষরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে জানার ফলে মানুষ মুক্তি পায়, অমৃতত্ত্ব ও নিত্য আনন্দের লোকে উত্তীর্ণ হয়। প্রশ্নোপণিষদে যে ‘প্ৰাণে’র উল্লেখ আছে, তাই আত্মতত্ত্বের প্রাথমিক স্তর। মুণ্ডক উপনিষদে বিশ্বজগতের সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল শক্তিরূপে পুরুষকে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়েছে; মুক্তির আনন্দময় অবস্থা এই উপনিষদে মনোজ্ঞ কাব্যিক পদ্ধতিতে অভিব্যক্ত হয়েছে। শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদেও আমরা এই ভাবনার অনুবৃত্তি লক্ষ্য করি; সেখানে শিব-বিষয়ক জ্ঞান মুক্তিপ্রদ ও বিশুদ্ধ চৈতন্যের অভিব্যক্তিরূপে বৰ্ণিত। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্ৰহ্মজ্ঞান এবং আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্যবোধই যে মুক্তি তা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। সেখানে যজ্ঞের অতীন্দ্ৰিয় রূপক ব্যাখ্যাকে অনুষ্ঠান-কেন্দ্ৰিক বিশ্বাস ও অধ্যাত্মবিদ্যার মধ্যবতী অস্থায়ী সেতুরূপে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি প্রাচীনতর প্রত্নকথাগুলির তাৎপর্য আমূল পরিবর্তিত হয়ে পড়েছে। সংহিতা যুগ থেকে উপনিষদের যুগে বিবর্তিত হওয়ার পথে ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ গঠন এমন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল যে দার্শনিক ভাবনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন সমস্যাসংকুল জটিলতা দেখা দিল, তাই বৃহদারণ্যক উপনিষদের বিশ্ববীক্ষায় ব্রহ্মবিদ জ্ঞানী নিজেকে ব্ৰহ্মা বলে উপলব্ধি করেন, পুনর্জন্মের হেতু সকল বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে মরণশীল মানুষ তখন অমরত্ব ও ব্ৰহ্মাত লাভ করে (৪ : ৪ : ৭)। বস্তু ও মন, দেহ ও আত্মার মধ্যে বিশ্বচ্ছদের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষে ভাববাদী দর্শনের প্রথম পদক্ষেপ। যদিও এটাই একমাত্র আধ্যাত্মিক পদ্ধতি নয়, তবুও একে আমরা তৎকালীন চিন্তাজগতে বিশিষ্ট একটি প্রবণতাররূপে গ্ৰহণ করতে পারি। অধিকতর বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দৰ্শন-প্ৰস্থানের অস্তিত্ব থাকলেও (উপনিষদে উন্দালকের ভূমিকা ও ভাবাদর্শে তার পরিচয়ও আছে) এদের অতি সামান্য নিদর্শন আমাদের হাতে পৌঁছতে পেরেছে।
শুধু যে মূল তত্ত্ব-সন্ধানের ক্ষেত্রে উপনিষদের যুগে সার্বিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তাই নয়; জীবন-সম্পর্কিত চূড়ান্ত দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও যে স্পষ্ট ও দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তারই ফলে উপাসনা-পদ্ধতির ক্ষেত্রেও অভিনব দিক পরিবর্তন অভিব্যক্ত হয়েছে। সর্বাপেক্ষা মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল পার্থিব অন্তিত্ব সম্পর্কে প্ৰতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে যা এই পর্যায়ে মানবজীবন অবিমিশ্র মন্দ ও দুঃখময, ও পূর্ববর্তী জন্মের পাপের শাস্তিরূপে পরিগণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তৎকালীন সমাজে দুটি মতবাদ বিশেষভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল; জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ যা পরবর্তী জন্মে মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুটি মতবাদ একত্রে পার্থিব অস্তিত্বের সামগ্রিক তাৎপর্যকেই আমূল পরিবর্তিত করেছিল; উপনিষদে মানবজীবন একটি অনন্ত কার্যকরণ-শৃঙ্খলে পরিণত হয়েছিল, কারণ এই জন্মের প্ৰত্যেকটি কাজের সমপরিমাণ ও সমানুপাতিক ফল যে পরবর্তী জন্মে ভোগ করতে হয়–এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ফলে, অস্তিত্বের দ্যোতনা অনন্ত হয়ে উঠল। উপনিষদ যুগ শুরু হওয়ার পূর্বে এবং পাবেও বহু তত্ত্বজ্ঞানী আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁরা কার্যকারণ নিয়মের অমোঘতা ঘোষণা করে জন্ম-শৃঙ্খলের আপাত-অবিনাশী স্বরুপকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন; মানুষের চূড়ান্ত ভাগ্য সম্পর্কে তিক্ত বিদুপ, নৈরাশ্যবাদ ও সংশয়ী মনোভাব এই চিন্তাধারার অধিকাংশ প্ৰবক্তাদের মধ্যেই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল।
বস্তুত এযুগের প্রায় প্রত্যেকটি চিন্তাধারার ক্ষেত্রে বুদ্ধির বিপুল দ্বন্দ্বজনিত অভিঘাত দার্শনিক ভাবনার তত্ত্বের উদ্দেশ্যবাদী ও স্বরূপবাদী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তিনটি, প্রধান দার্শনিক ধারা—জৈন, সে বন্ধ ও উপনিষদীয়— এসব সমস্যার তিনটি ভিন্ন সমাধান তুলে ধরেছিল। উপনিষদের মধ্যে প্রচলিত যজ্ঞসমূহের পুনর্বিশ্লেষণ, অতীন্দ্ৰিয়বাদী ভাবনার উপাদান এবং সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলিকে বিভিন্নভাবে আত্মসাৎ করে নেবার প্রবণতার ফলে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান শত্রুপক্ষের আক্রমণ বিশেষভাবে প্ৰতিহত হ’ল। সংহিতা ও ব্রাহ্মণের ধর্মের চরিত্র অনেকাংশে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। পরিবর্তনের মধ্যেও যে নিরবচ্ছিন্ন ৩। রক্ষিত হ’ল, তারই ফলে প্ৰতিবাদী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলির প্রভাব অনেকাংশে বিলুপ্ত হ’ল এবং বাহ্মণ্যধর্মের নতুন রূপ ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করল। তবে, সাধারণভাবে জীবন নানাবিধ দুঃখ, হতাশা, ব্যাধি, জরা ও মৃত্যু দ্বারা আকীর্ণ হওয়ায় অমঙ্গল রূপেই পরিগণিত এবং সেজন্য তার অবসান কাম্য : এই বিশ্বাস সে যুগের সমস্ত দর্শন প্ৰস্থানের দ্বারা সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল। তবে, বৌদ্ধধর্ম যেখানে সচেতন অস্তিত্বের মৌলিক বিনাশকে ঈপ্সিত মনে করেছে, জৈনধর্ম বিশ্বজগতের শীর্ষ-বিন্দুতে উন্নীত হওয়ার জন্য কর্ম থেকে আত্মার স্বাধীন অবস্থানের তত্ত্ব প্রচার করেছে। অন্যদিকে উপনিষদগুলিতে অধিকতর ইতিবাচক লক্ষ্য স্থাপিত হয়েছে–পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার একাত্মতা, যার মৌল স্বরূপ হ’ল অস্তিত্ব চৈতন্য, ও আনন্দ। তৎকালীন সাধকের কাছে সার্বিক ধ্বংসের চেয়ে এই একাত্মবোধ অধিকতর আকর্ষণীয় তত্ত্বরূপে প্রতিভাত হয়েছে; ব্রাহ্মণ্যধর্মের চূড়ান্ত বিজয় ও অন্যদুটি ধর্মচর্য অপেক্ষা দীর্ঘতর। পরমায়ু ও অধিক প্রাধান্য লাভের এটা একটা বড় কারণ। জীবনের পুনরাবৃত্তির শৃঙ্খল মোচন করে চৈতন্যময় আনন্দময় সত্ত্বা অর্থাৎ বিশ্বজগতের অন্তরতম আত্মার সঙ্গে সম্মিলিত হওয়াই জীবনের লক্ষ্যরূপে এতে গৃহীত হয়েছে। ঈশ, কেন ও কঠ উপনিষদে নতুন ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে জীবনের নতুন লক্ষ্য বিশ্লেষিত হয়েছে (ঈশ ৭; কেন ৪ : ৬; কঠ ১ : ২৭ : ২৮; ১ : ২ : ২) কর্মকাণ্ড ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রতিশ্রুতিগুলি এই পর্যায়ে হীনতর বলে বিবেচিত, ত্যাগ ও মুক্তি উন্নতরূপে প্ৰশংসিত। পূর্ববর্তী পর্যায়ের ধর্মীয় বিশ্ববীক্ষা অনুযায়ী যজ্ঞ, ধন-ক্রিয়া, সর্ববিধ ঐহিক সুখ, দীর্ঘ জীবন ও স্বৰ্গ অর্জনের জন্য প্ৰযুক্ত হত। উপনিষদের পর্যায়ে স্পষ্ট ঘোষিত হ’ল যে স্বরাপকে কখনো অস্থায়ী পার্থিব বস্তুদ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয় (কাঠ ১ : ২ : ২০)। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করাই প্রকৃত লক্ষ্যরূপে এখানে বিবেচিত হয়েছে। প্রশ্নোপণিষদের বিখ্যাত কাহিনীটিতে পিপ্পলাদ ঋষি জিজ্ঞাসু ব্ৰাহ্মণদের তপঃ ব্ৰহ্মচর্য ও শ্রদ্ধা আচরণের উপদেশ দিয়েছিলেন (২ : ২)। প্ৰাথমিক স্তরে শ্রদ্ধার চরিত্রে যেন একটি ঐন্দ্ৰজালিক শুদ্ধতা নিহিত ছিল, কিন্তু ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে উপনিষদে তা নৈতিক চরিত্র অর্জন করে। পিপ্পলাদের উপদেশ নতুন মূল্যবোধ এবং চরম আত্মোপলব্ধির উদ্দেশ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিতবাহ। লক্ষণীয় যে, পিপ্ল্যলাদের উপদেশে যজ্ঞানুষ্ঠান উল্লিখিত হয়নি, অর্থাৎ কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে অনুপযোগী বলে প্ৰতিপন্ন হয়েছে এবং ধর্মীয় জীবনের লক্ষ্যও ভিন্ন হয়ে পড়েছে। তাই দেবতারা আর পূর্বের মতো প্রাচুর্য, সুখ ও দীর্ঘজীবনের তাবৎ পার্থিব আনন্দের বিধানকর্তা নন, তারা এখন জীবন থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। এই উপনিষদে আরো লক্ষ্য করা যায় যে, ব্ৰহ্মজ্ঞানও বহুস্তরে বিন্যস্ত, তাই উচ্চতর উপলব্ধির জন্য একনিষ্ঠ আলোচনা ও তত্ত্বোপলব্ধি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সমাজে পুরোহিত অপেক্ষা জ্ঞানের উপদেষ্টা আচার্যের মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুণ্ডক উপনিষদেও যজ্ঞকে ক্ষয়শীলরূপে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, তা কখনও অবিনাশী মুক্তির সন্ধান দিতে পারে না।
মুণ্ডক উপনিষদে শৌনক আঙ্গিরাকে যে প্রশ্ন করেছেন, তাতে দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে (১ : ২ : ১-৭)। জীবনের নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী ব্ৰহ্মবিদ স্বয়ং ব্ৰহ্ম হয়ে ওঠেন–দুঃখ ও পাপের সীমা অতিক্রম ক’রে তিনি আসক্তি ও অজ্ঞতার অদৃশ্য বন্ধন ছিন্ন করে অমরত্ব লাভ করেন (৩ : ২ : ৯)। অনুরূপভাবে তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে এই যুগের নূতন চিন্তাধারার চূড়ান্ত ভাবাদর্শ বিবৃত হয়েছে। শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে যোগ-প্রনোদিত সংযমের মাধ্যমে ঈঙ্গিত ব্ৰহ্মা-সান্নিধ্য লাভের চিন্তার ফলে মায়া-মোহ দূরীভূত হয়। এই উপনিষদে দৈব অনুগ্রহ-লাভের যে প্রভাব বর্ণিত হয়েছে (৩ : ২০), তা একটি নুতন ভাবধারার সূচনা করে।
পাপ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং পাপমোচনের আকাঙ্ক্ষা এই যুগের একটি নূতন চরিত্র-লক্ষণ, কারণ, আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রাধান্যের সময় পাপ নিতান্ত অনুষ্ঠানগত ত্রুটি-বিচূতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। পাপ ও দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপর উপনিষদে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মবিদ। পাপকে জয় করেন; পাপ, ত্ৰিগুণ ও সংশয় থেকে মুক্ত হয়েই তিনি যথার্থ ব্ৰাহ্মণ হয়ে ওঠেন (৪ : ৪ : ২৩)। এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা পূর্বে ব্ৰহ্মাণত্ব শুধু জন্ম ও আচরণ দ্বারা নির্ধারিত হ’ত; কিন্তু এই পর্যায়ে এই প্ৰথম ব্ৰহ্মাণতের নির্ণায়করূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এই ধারণা ধর্মশান্ত্রের অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও ব্রহ্মবিদ ব্যক্তিকে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে (১ : ৪ : ৮, ৪ : ৪ : ১২ ইত্যাদি)। ব্ৰহ্মবিদ বহু পার্থিব সুখ উপভোগের পর মৃত্যুর পরে ব্রহ্মো লীন হন।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে তাৎপৰ্যপূর্ণ হল বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৪ : ৪ : ২২ অংশটি। “ব্রাহ্মণের প্রাত্যহিক স্বাধ্যায়, যজ্ঞ, দান, তপঃ এবং নিষ্কামভাবে জীবনযাপনের দ্বারা, এই (ব্ৰহ্ম)কে লাভ করতে প্ৰয়াসী। এই (ব্ৰহ্ম)কে জেনে মানুষ মুনি হয়, সন্ন্যাসীরা এই পদপ্রাপ্তির আশায় গৃহত্যাগ করে। এই (সন্ন্যাস) এমন ছিল কারণ পূর্বকাল ব্রহ্মবিদরা বংশবিস্তার চাইতেন না, তারা মনে করতেন। আমরা যাঁরা আত্মা-কে একমাত্র লভ্যবস্তু জ্ঞান করি, বংশবিস্তারে আমাদের কী হবে?’ পুত্র, ধন ও (ইহ এবং পরলোকে) উচ্চস্থানের লোভ পরিহার করে’ তাঁরা সন্ন্যাস গ্ৰহণ করতেন।” এখানে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করি (১) বেদনির্দিষ্ট জীবনধারাকে সন্ন্যাসজীবনের অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাখ্যা (২) ব্ৰাহ্মণ্যধর্মকে যজ্ঞসীমার বাইরে এনে অবৈদিক ধর্মচারকে স্বীকৃতি দেওয়া (৩) প্রাগ্বৈদিক ঋষিদের সম্পর্কে বিদ্বেষ পরিহার করে মুনির সংজ্ঞাকে বিস্তৃতিদান। আপাত-অসমঞ্জস জীবনধারাগুলিকে সামঞ্জস্যদান এই উপনিষদটির একটি উদ্দেশ্য, ধর্মাচরণের জীবনীশক্তির প্রাবল্য এতে ঘোষিত হয়। এবং এ প্ৰয়াস সার্থকও হয় : সাধারণ মানুষ, উৎসব সমারোহ প্ৰতি যাদের প্রবণতা, ক্রিয়াকাণ্ডে যাদের মন আশ্রিত তাদের কাছে যজীয় অনুষ্ঠানকে রূপকে পরিবেশন করে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। তাদের বলা হল যজ্ঞকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে, তার বস্তুগত দিকটির আত্মস্থ করে, রূপকায়িত আধ্যাত্মিকতার উন্নীত করতে বলা হল। মুনিদেরও এই বিধানের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বিপক্ষের প্রত্যাহ্বানের শাণিত শক্তিকে ক্ষীণ করে দেওয়া হল। বানপ্ৰস্থ ও সন্ন্যাসকে ‘আশ্রম’-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করে ব্রাহ্মণ্যধর্মী জয়ী হল, তার পরমায়ু বৃদ্ধি হল। পুরাতনের সঙ্গে নুতনের সীমা নির্ণীত হল। যাজ্ঞবল্ক্যের সেই বিখ্যাত উক্তিতে, “গার্গি, সেই অক্ষয়কে না জেনে যে পৃথিবী ত্যাগ করে যে কৃপার পাত্র, তাকে জেনে যে এই পৃথিবী থেকে প্ৰস্থান করে সে-ই ব্ৰাহ্মণ” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৩ : ৮ : ১০) ব্ৰাহ্মণের এই নূতন সংজ্ঞা ব্ৰাহ্মণ সম্বন্ধে সমাজের সঞ্চিত শ্রদ্ধাকে নূতন এক তাৎপর্যেমণ্ডিত করে, চিন্তাজগতে নূতন এক দিকনির্দেশ সূচিত করে।