২৪৫*
[মিস ফার্মারকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
এই জগৎ—যেখানে কিছুই নষ্ট হয় না, যেখানে আমরা জীবনেই মৃত্যুর মধ্যে বাস করি, সেখানে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, জনাকীর্ণ নগরীর পথে বা আদিম যুগের নিবিড় নিভৃত অরণ্যে, যা-কিছু চিন্তা করা হয়েছে, তা-ই থেকে যায়। তারা ক্রমাগত রূপপরিগ্রহ করবার চেষ্টা করছে, এবং যতদিন না প্রকাশ পাচ্ছে, ততদিন অভিব্যক্ত হবার জন্য চেষ্টা করবেই এবং তাদের যতই চাপবার চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা কিছুতেই নষ্ট হবে না। কিছুরই বিনাশ নাই—যে-সকল চিন্তা অতীতে অনিষ্টসাধন করেছিল, তারাও রূপপরিগ্রহের চেষ্টা করছে, তারাও পুনঃ পুনঃ প্রকাশের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণ সৎ চিন্তায় রূপায়িত হবার চেষ্টা করছে।
সুতরাং বর্তমান কালেও এমন কতকগুলি ভাবরাশি বিদ্যমান, যেগুলি আত্মপ্রকাশে সচেষ্ট। এই অভিনব ভাবরাশি আমাদের বলছে যে, আমাদের অন্তরে যে দ্বৈতবাদের কল্পনা আছে, কোন বস্তু স্বরূপতঃ ভাল বা মন্দ এবংবিধ যে কল্পনা আছে ও তাদের দাবানর জন্য যে ততোধিক উৎকট বৃথা আশা রয়েছে—এ সমস্তকেই পরিহার করতে হবে। ঐ ভাবরাশি আমাদের শেখাচ্ছে, জগতে উন্নতির রহস্য প্রবৃত্তির উচ্ছেদ নহে, পরন্তু উচ্চতর দিকে তার মোড় ফিরিয়ে দেওয়া। ঐ ভাবরাশি শেখাচ্ছে, এই জগৎ ভাল ও মন্দ দিয়ে প্রস্তুত নয়; প্রত্যুত এর উপাদান হচ্ছে ভাল, তার চেয়ে ভাল এবং তার চেয়ে আরও ভাল। সকলে গ্রহণ না করা পর্যন্ত ঐ ভাব শান্ত হয় না। ঐ ভাব শিক্ষা দেয় যে, কোন অবস্থাতেই একেবারে হাল ছেড়ে দেবার দরকার নেই; সুতরাং যে-কোন মনোবৃত্তি, নীতি বা ধর্মকে ঐ ভাব যে-অবস্থায় পায়, সে-অবস্থাতেই সাদরে গ্রহণ করে, এবং সেগুলির উপর বিন্দুমাত্র দোষারোপ না করে বলে, ‘এ পর্যন্ত ভালই করেছ, এখন আরও ভাল করার সময় এসেছে।’ প্রাচীন- কালে চিন্তা করা হত—মন্দকে বর্জন করতে হবে, এই নতুন শিক্ষানুসারে বলা হয়, মন্দ রূপান্তরিত হবে—ভাল থেকে আরও ভাল করবার চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি এই ভাব শিক্ষা দেয়, যদি পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে দেখবে যে, স্বর্গরাজ্য আগে থেকেই বিদ্যমান; মানুষের যদি দেখবার সাধ থাকে, তবে সে দেখবে, সে পূর্ব থেকেই পূর্ণ।
বিগত গ্রীষ্মঋতুতে গ্রীনএকারে যে সভাগুলি হয়েছিল, সেগুলি যে এত চমৎকার হয়েছে, তার একমাত্র কারণ, তুমি পূর্বোক্ত ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত যন্ত্রস্বরূপ হয়ে অন্তরে ঐ ভাব যাতে অবাধে প্রবেশ করে, তার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রেখেছিলে, স্বর্গরাজ্য যে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান—নতুন চিন্তাপ্রণালীর এই সর্বোচ্চ শিক্ষারূপ ভিত্তির উপর তুমি দণ্ডায়মান ছিলে।
তুমি এই ভাব জীবনে পরিণত করে দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাবার উপযুক্ত আধাররূপে প্রভু কর্তৃক মনোনীত ও আদিষ্ট হয়েছ, এবং যে তোমাকে এই অদ্ভুত কার্যে সহায়তা করবে, সে প্রভুরই সেবা করবে।
আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ্যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি
তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৪৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
রিজলী ম্যানর
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
বক্তৃতার নকলগুলি ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই আপনার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। আশা করি সেগুলি কোন কাজে আসতে পারে।
আমার মনে হয়, প্রথমতঃ অনেক অসুবিধা অতিক্রম করতে হবে; দ্বিতীয়তঃ তারা নিজেদের কোন কাজেরই উপযুক্ত মনে করে না—এই হল ও-দেশের জাতীয় ব্যাধি; তৃতীয়তঃ তারা এখনই শীতের সম্মুখীন হতে সাহস করছে না; তিব্বতের লোকটিকে ইংলণ্ডে কাজ করার মত খুব শক্তসমর্থ বলে তারা মনে করে না। শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, কেউ না কেউ আসবে।
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমাদের বন্ধুদের আমার বড়দিনের অভিনন্দন জানাবেন—মিসেস ও মিঃ জনসন, লেডী মারগেসন (Lady Margesson), মিসেস ক্লার্ক, মিস হয়েস (Miss Hawes), মিস মূলার, মিস স্টীল (Miss Steel) এবং বাকী সকলকে।
শিশুকে আমার হয়ে চুম্বন ও আশীর্বাদ দিবেন। মিসেস স্টার্ডিকে আমার নমস্কার। আমরা কাজ করবই। ‘ওয়া গুরুজী কি ফতে।’
—বি
২৪৭
[মঠে সকলকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত]
১৮৯৫
প্রিয়বরেষু,
সাণ্ডেল যে যে পুস্তক পাঠাইয়াছিল, তাহা পৌঁছিয়াছে—এ-কথা লিখিতে ভুল হয়। তাহাকে জ্ঞাত করিবে। তোমাদের জন্য লিখি—
১| পক্ষপাতই সকল অনিষ্টের মূল কারণ জানিবে। অর্থাৎ যদ্যপি তুমি কাহারও প্রতি অধিক স্নেহ অন্যাপেক্ষা দেখাও, তাহা হইলেই ভবিষ্যৎ বিবাদের মূল পত্তন হইবে।
২| কেহ তোমার নিকট অপর কোন ভাইয়ের নিন্দা করিতে আসিলে তাহা বিলকুল শুনিবে না—শুনাও মহাপাপ, ভবিষ্যৎ বিবাদের সূত্রপাত তাহাতে।
৩| অধিকন্তু সকলের দোষ সহ্য করিবে, লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিবে এবং সকলকে তুমি যদি নিঃস্বার্থভাবে ভালবাস, সকলেই ধীরে ধীরে পরস্পরকে ভালবাসিবে। একের স্বার্থ অন্যের উপর নির্ভর করে, এ-কথা বিশেষরূপে বুঝিতে পারিলেই সকলে ঈর্ষা একেবারে ত্যাগ করিবে; দশজনে মিলিয়া একটা কার্য করা—আমাদের জাতীয় চরিত্রের মধ্যেই নাই, এজন্য ঐ ভাব আনতে অনেক যত্ন চেষ্টা ও বিলম্ব সহ্য করিতে হইবে। আমি তোমাদের মধ্যে তো বড় ছোট দেখিতে পাই না, কাজের বেলায় সকলেই মহাশক্তি প্রকাশ করিতে পারে, আমি দেখিতে পাইতেছি। শশী কেমন স্থান জাগিয়ে বসে থাকে; তার দৃঢ়নিষ্ঠা একটা মহাভিত্তিস্বরূপ। কালী ও যোগেন টাউন-হল মিটিং কেমন উত্তমরূপে সিদ্ধ করিল—কত গুরুতর কার্য! নিরঞ্জন সিলোন (সিংহল) প্রভৃতি স্থানে অনেক কার্য করিয়াছে। সারদা কত দেশ পর্যটন করিয়া বড় বড় কার্যের বীজ বপন করিয়াছে। হরির বিচিত্র ত্যাগ, স্থিরবুদ্ধি ও তিতিক্ষা আমি যখনই মনে করি, তখনই নূতন বল পাই। তুলসী, গুপ্ত, বাবুরাম, শরৎ প্রভৃতি সকলের মধ্যেই এক এক মহাশক্তি আছে। তিনি যে জহুরী ছিলেন, তাতে এখনও যদি সন্দেহ হয়, তাহলে তোমাতে আর উন্মাদে তফাত কি? দেখ এদেশে শত শত নরনারী প্রভুকে সকল অবতারের শ্রেষ্ঠ বলিয়া পূজা করিতে আরম্ভ করিতেছে। ধীরে ধীরে—মহাকার্য ধীরে ধীরে হয়। ধীরে ধীরে বারুদের স্তর পুঁতিতে হয়; তারপর একদিন এক কণা অগ্নি—আর সমস্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে!
তিনি কাণ্ডারী; ভয় কি? তোমরা অনন্তশক্তিমান্—সামান্য ঈর্ষাবুদ্ধি ও অহংপূর্ণবুদ্ধি দমন করিতে তোমাদের ক-দিন লাগে? যখনই ঐ বুদ্ধি আসিবে, প্রভুর কাছে শরণ লও। শরীর মন তাঁর কাছে সঁপে দাও দেখি, হাঙ্গাম মিটে যাবে একদম।
যে বাড়ীতে তোমরা আপাততঃ আছ, তাহাতে স্থান পূর্ণ হইবে না, দেখিতে পাইতেছি। একটা প্রশস্ত বাটীর দরকার, অর্থাৎ সকলে গুঁতোগুঁতি করে একঘরে শোবার আবশ্যক নাই। পারতপক্ষে একঘরে দুই জনের অধিক থাকা উচিত নহে। একটা বড় হল, সেখানে পুঁথি-পাটা রাখিবে।
প্রত্যহ প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে কালী, হরি, তুলসী, শশী প্রভৃতি অদল-বদল করে, যেন কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ শাস্ত্রপাঠ করে, ও পরে সন্ধ্যাকালে আর একবার পাঠ ও ধ্যান-ধারণা একটু ও সঙ্কীর্তনাদি হয়। একদিন যোগ, একদিন ভক্তি, একদিন জ্ঞান ইত্যাদি বিভাগ করিয়া লইলেই হইবে। এইমত একটা routine (পাঠের ক্রম) করিয়া লইলেই বড়ই মঙ্গলের বিষয়—সন্ধ্যাকালের পাঠাদির সময় সাধারণ লোকেরা যাহাতে আসিতে পারে; এবং প্রতি রবিবার দশটা হইতে নাগাত রাত্র ক্রমান্বয়ে পাঠ-কীর্তনাদি হওয়া উচিত, সেটা public-এর (সাধারণের) জন্য। এই নিয়মাদি করে কিছুদিন কষ্ট করে চালিয়ে দিলেই পরে আপনা হতে গড় গড় করে চলে যাবে। উক্ত হলে যেন তামাক খাওয়া না হয়। তামাক খাবার একটা যেন আলাহিদা জায়গা থাকে। এই ভাবটা তুমি যদি পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে আনতে পার, তা হলে বুঝতাম অনেক কাজ এগলো। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
পুনঃ—হরমোহন নাকি একটা কাগজ বার করবার যোগাড় করছিল, তার কি হল? কালী, শরৎ, হরি, মাষ্টার, G. C. Ghose (গিরিশবাবু) যোগাড় করে একটা যদি পার তো ভালই বটে।
—ন
২৪৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
১৮৯৫
অভিন্নহৃদয়েষু,
এইমাত্র তোমার পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। ভারতবর্ষে কার্য হোক না হোক, কার্য এদেশে। কাহারও এক্ষণে আসিবার দরকার নাই। আমি দেশে গিয়ে কয়েকজনকে তৈয়ার করে তুলব, তারপর পাশ্চাত্য দেশে কোন ভয় থাকিবে না। গুণনিধির কথাই লিখিয়াছিলাম। হরি সিং প্রভৃতি সকলকে বিশেষ প্রেম আশীর্বাদ দিবে। ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে থাকিবে না। কার সাধ্য খেতড়ির রাজাকে দাবায়? মা জগদম্বা তার শিয়রে। কালীরও চিঠি পেয়েছি—কাশ্মীরে যদি centre (কেন্দ্র) করতে পার তো বড়ই ভাল হয়। যেখানে পার একটা সেণ্টার কর। এখন এদেশে আর বিলেতে আমার গোড়া বেঁধে গেছে; কারু সাধ্যি কি তা টলায়? নিউ ইয়র্ক এবার তোলপাড়! আসছে গরমিতে লণ্ডন তোলপাড়! বড় বড় হাতী দিগ্গজ ভেসে যাবে। পুঁটি-পাঁটার কি খবর রে দাদা? তোরা কোমর বেঁধে লেগে যা দেখি, হুহুঙ্কারে দুনিয়া তোলপাড় করে দেব। এই তো সবে সন্ধ্যা রে ভাই!
দেশে কি মানুষ আছে? ও শ্মশানপুরী। যদি lower classদের education (নিম্নশ্রেণীদের শিক্ষা) দিতে পার, তা হলে উপায় হতে পারে। জ্ঞানবলের চেয়ে বল আর কি আছে—বিদ্যা শেখাতে পার? বড়-মানুষেরা কোন্ কালে কোন্ দেশে কার কি উপকার করেছে? সকল দেশেই বড় বড় কাজ গরীবরা করে। টাকা আসতে কতক্ষণ? মানুষ কই? দেশে কি মানুষ আছে? দেশের লোকগুলো বালক, ওদের সঙ্গে বালকের ন্যায় ব্যবহার করতে হবে। ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি দশ বছরের মেয়ে বে করে করে খরচ হয়ে গেছে।
কারুর সঙ্গে ঝগড়া না করে মিলেমিশে চলে যাও—এ দুনিয়া বড়ই ভয়ানক, কাউকেই বিশ্বাস নাই। ভয় নাই, মা আমার সহায়—এমন কাজ এবার হবে যে, তোরা অবাক হয়ে যাবি।
ভয় কি? কার ভয়? ছাতি বজ্র করে লেগে যাও। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—সারদা কি বাঙলা কাগজ বার করবে বলছে? সেটার বিশেষ সাহায্য করবে, সে মতলবটা মন্দ নয়। কারুর উৎসাহ ভঙ্গ করতে নাই। Criticism (বিরুদ্ধ সমালোচনা) একেবারে ত্যাগ করবে। যতদূর ভাল বোধ হয়, সকলকে সাহায্য করবে; যেখানটা ভাল না বোধ হয়, ধীরে বুঝিয়ে দিবে। পরস্পরকে criticise (বিরুদ্ধভাবে সমালোচনা) করাই সকল সর্বনাশের মূল! দল ভাঙবার ঐটি মূলমন্ত্র। ‘ও কি জানে?’ ‘সে কি জানে?’ ‘তুই আবার কি করবি?’—আর তার সঙ্গে ঐ একটু মুচকে হাসি, ঐগুলো হচ্ছে ঝগড়া-বিবাদের মূলসূত্র।
২৪৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
তোমার এক পত্র কাল পাই, তাহাতে কতকমত সমাচার পাই। সবিশেষ কিছুই নাই, এই মাত্র। আমার শরীর এক্ষণে অনেক ভাল। এ বৎসর প্রচণ্ড শীত প্রভুর কৃপায় কিছুই লাগে না; কি দোর্দণ্ড শীত! তবে এদের বিদ্যের জোরে সব দাবিয়ে রাখে। প্রত্যেক বাটীর নীচের তলা মাটির ভেতর, তার মধ্যে বৃহৎ বয়লার—সেখানে হতে গরম হাওয়া বা ষ্টীম ঘরে ঘরে রাতদিন ছুটছে। তাইতে সব ঘর গরম, কিন্তু ইহার এক দোষ যে, ঘরের ভেতর গরমি কাল আর বাইরে জিরোর (শূন্যের) নীচে ৩০|৪০ ডিগ্রী! এদেশের বড় মানুষেরা অনেকেই শীতকালে ইওরোপ পালায়—ইওরোপ অপেক্ষাকৃত গরম দেশ।
যাক, এক্ষণে তোমাকে গোটা-দুই উপদেশ দিই। এই চিঠি তোমার জন্য লেখা হচ্ছে। তুমি এই উপদেশগুলি রোজ একবার করে পড়বে এবং সেই রকম কাজ করবে। সারদার চিঠি পাইয়াছি—সে উত্তম কার্য করিতেছে—কিন্তু এক্ষণে organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করা) চাই। তাহাকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন, আশীর্বাদ—তারকদাদা প্রভৃতি সকলকে দিবে। তোমাকে আমার এই ক-টি উপদেশ দিবার কারণ এই যে, তোমাতে organization power (সঙ্ঘগঠন ও পরিচালন-শক্তি) আছে—এ-কথা ঠাকুর আমায় বললেন, কিন্তু এখনও ফোটে নাই। শীঘ্রই তাঁর আশীর্বাদে ফুটবে। তুমি যে কিছুতেই centre of gravity (ভারকেন্দ্র) ছাড়িতে চাও না, ইহাই তাহার নিদর্শন, তবে intensive and extensive (গভীর ও উদার) দুই হওয়া চাই।
১| এ জগতে যে ত্রিবিধ দুঃখ আছে, সর্বশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, তাহা নৈসর্গিক (natural) নহে, অতএব অপনেয়।
২| বুদ্ধাবতারে প্রভু বলিতেছেন যে, এই আধিভৌতিক দুঃখের কারণ ‘জাতি’, অর্থাৎ জন্মগত বা গুণগত বা ধনগত সর্বপ্রকার জাতিই এই দুঃখের কারণ। আত্মাতে স্ত্রী-পুং-বর্ণাশ্রমাদি ভাব নাই এবং যে-প্রকার পঙ্ক দ্বারা পঙ্ক ধৌত হয় না, সে-প্রকার ভেদবুদ্ধি দ্বারা অভেদ সাধন হওয়া সম্ভব নহে।
৩| কৃষ্ণাবতারে বলিতেছেন যে, সর্বপ্রকার দুঃখের কারণ ‘অবিদ্যা’। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়; কিন্তু ‘কিং কর্ম কিমকর্মেতি’ ইত্যাদি (কোন্টি কর্ম, কোন্টি অকর্ম—এই বিষয়ে জ্ঞানীরাও মোহিত হন)।
৪| যে কর্মের দ্বারা এই আত্মভাবের বিকাশ হয়, তাহাই কর্ম। যদ্দ্বারা অনাত্মভাবের বিকাশ, তাহাই অকর্ম।
৫| অতএব ব্যক্তিগত, দেশগত ও কালগত কর্মাকর্মের সাধন।
৬| যজ্ঞাদি প্রাচীন কালে উপযুক্ত ছিল, তথা জাত্যাদি কর্ম; আধুনিক সময়ের জন্য তাহা নহে।
৭| রামকৃষ্ণাবতারের জন্মদিন হইতেই সত্যযুগোৎপত্তি হইয়াছে।
৮| রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা নাস্তিকতারূপ ম্লেচ্ছনিবহ ধ্বংস হইবে এবং ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা সমস্ত জগৎ একীভূত হইবে। অপিচ এ অবতারের রজোগুণ অর্থাৎ নামযশাদির আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নাই, অর্থাৎ যে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করে, সেই ধন্য; তাঁহাকে মানে বা নাই মানে, ক্ষতি নাই।
৯| প্রাচীন কালে বা আধুনিক কালে সাম্প্রদায়িকেরা ভুল করে নাই। They have done well, but they must do better (তাহারা ভালই করিয়াছে, তবে তাহাদিগকে আরও ভাল করিতে হইবে)। কল্যাণ—তর—তম।
১০| অতএব সকলকে—যেখানে তাহারা আছে, সেইখানেই গ্রহণ করিতে হইবে, অর্থাৎ কাহারও ভাবে ব্যাঘাত না করিয়া উচ্চতর ভাবে লইয়া যাইতে হইবে। তথা সামাজিক অবস্থামধ্যে যাহা আছে, তাহা উত্তম, কিন্তু উৎকৃষ্ট-তর-তম করিতে হইবে।
১১| জগতের কল্যাণ স্ত্রীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে।
১২| সেইজন্যই রামকৃষ্ণাবতারে ‘স্ত্রীগুরু’-গ্রহণ, সেইজন্যই নারীভাবসাধন, সেইজন্যই মাতৃভাব-প্রচার।
১৩| সেইজন্যই আমার স্ত্রী-মঠ স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ। উক্ত মঠ গার্গী, মৈত্রেয়ী এবং তদপেক্ষা আরও উচ্চতরভাবাপন্না নারীকুলের আকরস্বরূপ হইবে।
১৪| চালাকি দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না। প্রেম, সত্যানুরাগ ও মহাবীর্যের সহায়তায় সকল কার্য সম্পন্ন হয়। তৎ কুরু পৌরুষম্ (সুতরাং পৌরুষ প্রকাশ কর)।
১৫| কাহারও সহিত বিবাদ-বিতর্কে আবশ্যক নাই। তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও—অন্যের খবরে আবশ্যক নাই। Give your message, leave others to their own thoughts (তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও, অপরে নিজ নিজ ভাব লইয়া থাকুক)। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং’—তদা কিং বিবাদেন? (সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার জয় কখনও হয় না; তবে বিবাদের প্রয়োজন কি?)
এক্ষণে তোমাকে কিঞ্চিৎ বিষয়কার্য শিখাই। প্রথমতঃ যখন আমাকে বা অন্য কাহাকেও পত্র লিখিবে, তখন পূর্বপত্র পাঠ করিয়া সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে। বাজে খবর দিবে না। গম্ভীর ভাব রাখিতে হইবে। বাল্যগাম্ভীর্যভাব মিশ্রিত করিবে। সকলের সহিত মিশিয়া চলিবে। অহংভাব দূর করিবে, সম্প্রদায়-বুদ্ধিবিহীন হইবে, বৃথা তর্ক মহাপাপ।
ম্যাক্সমূলার তোমাদের এক পুস্তক পাঠাইয়াছেন। তাঁহাকে বিনয়পূর্ণ উত্তর দিয়াছ কিনা, এ-কথা লেখ নাই। আমি কাহাকে টাকা পাঠাইব, তাহা লেখ নাই। কেমন করিয়া পাঠাইব? … প্রায় দেড় মাসে একখানা পত্র আসে, একটা ভুল শোধরাইতে তিন মাস লাগে। এই কথা সদা মনে রাখিবে। সারদার পত্রে অবগত হইলাম N. Ghose (ঘোষ) আমাকে যীশুখ্রীষ্টাদির সহিত তুলনা করিয়াছেন। ও-সকল আমাদের দেশে ভাল বটে; কিন্তু এদেশে ছাপাইয়া পাঠাইলে আমার অবমানের সম্ভাবনা। আমি কাহারও ভাবে ব্যাঘাত করি না, আমি কি মিশনরী? যদি কালী ঐ-সকল কাগজ এতদ্দেশে না পাঠাইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইতে নিষেধ করিবে। কেবল Address (অভিনন্দন) পাঠাইলেই যথেষ্ট, proceedings-এ (কার্য বিবরণীতে) কোন আবশ্যক নাই। এক্ষণে এতদ্দেশের অনেক মান্যগণ্য নরনারী আমায় শ্রদ্ধা করেন। মিশনরী প্রভৃতিরা বহু চেষ্টা করিয়া এক্ষণে হার মানিয়া শান্তি অবলম্বন করিয়াছে। সকল কার্যই নানা বিঘ্নের মধ্যে সমাধান হয়। শান্তভাব অবলম্বন করিলেই সত্যের জয় হয়। হাড্সন (Hudson) নামক কে কি বকিয়াছে, তাহাকে আমার জবাব দিবার কোন আবশ্যক নাই। প্রথমতঃ অনাবশ্যক, দ্বিতীয়তঃ তাহা হইলে আমি হাড্সন প্রভৃতি ফেরুপুঞ্জের সমদেশবর্তী হইব। তুমি উন্মাদ নাকি? আমি এখান হইতে কে এক হাড্সনের সহিত লড়াই করিব? প্রভুর কৃপায় হাড্সন বাড্সনের গুরুর গুরুরা আমার কথা ভক্তিভাবে গ্রহণ করে। তুমি কি পাগল নাকি? খবরের কাগজ প্রভৃতি আর পাঠাইও না। ও-সকল দেশে চলুক, হানি নাই। ও-সকল কাগজে নামের প্রয়োজন ছিল, প্রভুর কার্যের জন্য। যখন তাহা সমাহিত হইয়াছে, তখন আর আবশ্যক নাই। আমার প্রত্যেক পত্রাদি গোপন করিবে, ঝট করিয়া কাগজে ছাপাইবে না। নামযশের ঐ দায়—কিছু গোপন রাখা যায় না। আমার চিঠি পূর্বের ভাবের মত হাটের মাঝে পড়িবে না। কথা কানে হাঁটে, মনে রাখিবে। মা-ঠাকুরাণীর জন্য পত্রপাঠ জায়গা অনুসন্ধান করিবে।
ঠাকুরের কাছে সকল কার্যের প্রারম্ভে প্রার্থনা করিবে। তিনি সৎ পন্থা দেখাইবেন। একটা বড় জমি প্রথমে চাই; তার পর বাড়ী ঘর সব হবে। আমাদের মঠ ধীরে ধীরে হবে, ভাবনা নাই। যখন আমাকে চিঠি লিখিবে, বিশেষ চিন্তা করে আবশ্যক সমাচার বিস্তারিতভাবে দিবে—অনাবশ্যক অর্থাৎ ঝগড়াঝাঁটি আমার শুনিবার সময় নাই।
কালী প্রভৃতি সকলেই উত্তম কার্য করিতেছে। সকলকেই আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মান্দ্রাজীদের সহিত মিলে মিশে কাজ করিবে এবং মধ্যে মধ্যে একজন তথায় যাইও। নামযশ কর্তৃত্বের বাসনা জন্মের মত ত্যাগ করিবে। আমি যতদিন পৃথিবীতে আছি, তিনি আমার মধ্যে কার্য করিতেছেন—ইহাতে তোমাদের যতদিন বিশ্বাস থাকিবে, ততদিন কোন অমঙ্গলের সম্ভাবনা নাই।
শাঁকচুন্নী যে ঠাকুরের পুঁথি পাঠাইয়াছে, তাহা পরম সুন্দর। কিন্তু প্রথমে শক্তির বর্ণনা নাই, এই মহাদোষ। দ্বিতীয় edition (সংস্করণ)-এ শুদ্ধ করিতে বলিবে। এই কথা মনে সদা রাখিবে যে, আমরা এক্ষণে জগতের সমক্ষে দণ্ডায়মান। আমাদের প্রত্যেক কার্য, প্রত্যেক কথা লোকে দেখিতেছে, শুনিতেছে—এই ভাব মনে রাখিয়া সকল কার্য করিবে।
যদি তুমি—কাহাকে টাকা পাঠাইব অর্থাৎ—কাহার নামে লিখিতে, তাহা হইলে আজই আমি টাকা পাঠাইতাম। টাকা পাইবামাত্রই জমি খরিদ করিবে। আপাততঃ আমার নামে খরিদ করিবে। পরে আমাদের মঠের জন্য একটা জমি দেখিতে থাক। কাছাকাছি হওয়া চাই, অর্থাৎ দুইটা জমি যাহাতে অতি নিকটে হয়, এমত চেষ্টা করিবে। কলিকাতা হইতে কিছু দূরে হয়, চিন্তা নাই; যেখানে আমরা মঠ বসাইব, সেথাই ধুম মাচিবে।
মহিম চক্রবর্তীর কথায় আমি পরম আনন্দিত হইলাম—এণ্ডিস্ পর্বতে এক্ষণে গয়াক্ষেত্র বনিয়া গেল যে! সে কোথায়? তাহাকে, বিজয় গোস্বামীকে ও আমাদের বন্ধুবর্গকে আমার বিশেষ প্রণয়-সম্ভাষণ দিবে। … পরকে মারিতে গেলে ঢাল খাঁড়া চাই, অতএব ইংরেজী ও সংস্কৃত বিশেষরূপে অধ্যয়ন করিবে। কালীর ইংরেজী দিন দিন বেশ পরিষ্কার হইতেছে। সারদার ইংরেজীর অধোগতি হইতেছে; তাহাকে flowery style (ফেনান ভাষা) পরিত্যাগ করিতে হইবে। বিজাতীয় ভাষায় flowery style লেখা বড়ই দুষ্কর। তাহাকে আমার লক্ষ ‘সাবাস্’—ওহি মরদ্কা কাম; তারকদাদাকেও grammar (ব্যাকরণ)-টা একবার উল্টে নিতে বলবে। তারকদাদার ইংরেজী ক্রমশঃ দুরস্ত হয়ে আসছে। সকলেই well done, ‘সাবাস্, বাহাদুরোঁ’। আরম্ভ অতি সুন্দর হয়েছে। ঐ ডৌলে চল। ঈর্ষা-সর্পিণী যদি না আসে তো কোন ভয় নাই, মাভৈঃ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’। সকলে একটু গম্ভীরভাব ধারণ করিবে।
আমি হিন্দুধর্মের উপর কোন পুস্তক এক্ষণে লিখিতেছি না। তবে আমার মনের ভাব লিপিবদ্ধ করিতেছি। Every religion is an expression, a language to express the same truth, and we must speak to each in his own language.৮৮ —সারদা এ কথা বুঝিয়াছে বেশ। হিন্দুধর্ম পরে দেখা যাইবে। হিন্দুধর্ম বললে কি এদেশের লোক আসে? সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির নামে সকলে পালায়। আসল কথা, তাঁর ধর্ম; হিন্দুরা বলুক হিন্দুধর্ম—তদ্বৎ সর্বে (সেইরূপ সকলে)। তবে ধীরে ধীরে—শনৈঃ পন্থাঃ। নবাগন্তুক দীননাথকে আমার আশীর্বাদ দিও। লিখিবার সময় বড়ই অল্প, সর্বদাই লেকচার, লেকচার, লেকচার। Purity-patience-perseverance (পবিত্রতা, ধৈর্য, অধ্যবসায়)! মহেন্দ্র মাষ্টার প্রভৃতি সকলকে আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মা-ঠাকুরাণীকে আমার কোটি সাষ্টাঙ্গ। গোলাপ-মা, যোগীন-মা প্রভৃতি সকলকে আমার নমস্কার। অনেকে যে তাঁর কথা এক্ষণে শুনছে, তাদের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্য করিতে বলিবে; কিছু কিছু ‘পেলা’ না নিলে মঠ চলবে কি প্রকারে? এ-কথা সকলকে খুলে বলতে হবে বৈকি!
বিদেশ হতে যদি কেউ কিছু আমার নামে পাঠায়, তাদের চিঠির জবাব দিবে। ওটা একটা সাধারণ ভদ্রতা। ভবনাথ, কালীকৃষ্ণবাবু প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। সাণ্ডেল অর্থাভাব লিখছেন, তথাহি তারকদাদা। বলি এতগুলো লোক তাঁকে মানে, আর একটা মঠ চলে না? তোমাদের কারুর কারুর মধ্যে একটা গুজোগুজি ভাব এখনও আছে; সেটা যেদিন একেবারে অপসৃত হবে, সেদিন হতেই সকলবিধ কল্যাণ হবে।
এদেশ হতে শীঘ্র দেশে যাওয়ায় কোন লাভ নাই। বলি, প্রথমতঃ এদেশে একটু বাজলে, দেশে মহাধ্বনি হয়; তারপর এদেশের লোকেরা মহাধনী ও ছাতিওয়ালা! দেশের লোকের পয়সাও নাই এবং ছাতি একেবারেই নাই!
ক্রমশঃ প্রকাশ্য। তিনি কি শুধু ভারতের ঠাকুর? ঐ সঙ্কীর্ণ ভাবের দ্বারাই ভারতের অধঃপতন হয়েছে। তার বিনাশ না হলে কল্যাণ অসম্ভব। আমার যদি টাকা থাকিত, তোমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবী-পর্যটনে পাঠাতাম। কোণ থেকে না বেরুলে কোন বড় ভাব আসে না। ক্রমে দেখা যাবে। প্রভুর ইচ্ছা। সকল বড় কাজ ধীরে ধীরে হয়। দুটো জমির কথা ভুলবে না এবং তোমাদের মধ্যে কে এ কার্যের ভার লইবে, তাহা লিখিবে; অপিচ গিরিশ ঘোষ ও অতুলের সহিত পরামর্শ করিবে। জমি আমার নামে খরিদ করিবে, অর্থাৎ মোট কথা এই—‘অর্থমনর্থম্’; যার হাতে থাকিলে কারুর মনে ঈর্ষা হবে না, তারই হাতে থাকা ভাল। সাণ্ডেলকে—লাটুকে গরম কাপড় (তার মনের মত) কিনে দিতে বলেছি, এবং গোপালদাদাকে টাকা পাঠাতে বলেছি এবং হুটকোকে টাকা দিতে বলেছি—তার ঋণ-পরিশোধের জন্য।
দক্ষ ও হরিশের কথা কেউ লেখ নাই কেন? তাদের তোমরা খবর নাও কিনা? সাণ্ডেল দুঃখ পাচ্ছে, তার কারণ তার মন এখনও গঙ্গাজলের মতন হয় নাই, নিষ্কাম এখনও হয় নাই, ক্রমে হবে। যদি বাঁকটুকু একদম সিধে করে তো আর কোন দুঃখ থাকিবে না। রাখালকে, হরিকে আমার বিশেষ আলিঙ্গন প্রণাম জানাইবে। তাদের বিশেষ যত্ন করিবে। তোমরা রাখালকে দিন-দুই জবরদস্ত ব্রত করিয়ে দিয়েছ নাকি? কাজটা ভাল কর নাই। যাক, চর্বি মারা যাবে। রাখাল ঠাকুরের ভালবাসার জিনিষ—এ কথা ভুলো না।
কিছুতেই ভয় খেও না। যতদিন তিনি আমার মাথায় হাত রাখছেন, ততদিন কি কারুর দাবাবার যো আছে? ভবেয়ুঃ কণ্ঠাগতাঃ প্রাণাঃ (প্রাণ কণ্ঠাগত হউক), তথাপি ডর পাবে না। সিংহ-বিক্রমের সহিত অথচ ‘কুসুমমিব’ (ফুলের মত) কোমলতার সহিত কার্য করিবে। এবারকার মহোৎসবে খুব ধুম মাতাইবে। খাওয়া দাওয়া অতি সাধারণ—মহাপ্রসাদ, সরাভোগ, দাঁড়াপ্রসাদ ইতি। পরমহংসদেবের জীবনচরিত-পাঠ। বেদ বেদান্ত পুঁথি একত্র করে আরতি করবে, এবং কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পেলা আদায় করিবে। পুরানো ডৌলে নিমন্ত্রণ ত্যাগ করিবে। ‘আমন্ত্রয়ে ভবন্তং সাশীর্বাদং ভগবতো রামকৃষ্ণস্য বহুমানপুরঃসরঞ্চ’ ইত্যাকার একটা লাইন লিখে তারপর লিখবে যে, ঠাকুরের জন্মতিথি-মহোৎসব এবং মঠ চালাইবার খরচের জন্য আপনার সহায়তা প্রয়োজন। যদি আপনার অভিমত হয় তো অমুক স্থানে অমুকের নিকট টাকা পাঠাইবেন—ইত্যাদি। যদি মনে কর যে, আমার নামে সই করলে লোকে টাকা দেবে তো সই করে দিও অর্থাৎ ছাপিয়ে দিও। যদি না হয়, তো যেমন ordinarily (সাধারণতঃ) ‘রামকৃষ্ণসেবকাঃ সন্ন্যাসিনঃ’ অথবা ঐ প্রকার কোন রকম। আর এক পাতা ইংরেজীতে লিখিবে। ‘লর্ড (প্রভু) রামকৃষ্ণ’ শব্দের কোন অর্থ নাই; উক্ত নাম ত্যাগ করিবে, ইংরেজী অক্ষরে ‘ভগবান্’ লিখিবে। তারপর এক আধ লাইন ইংরেজী লিখিয়া দিবে।
The Anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna
Sir,
We have great pleasure in inviting you to join us in celebrating the —th anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna Paramahamsa. For the celebrating of this great occasion and for the maintenance of the Alambazer Math, funds are absolutely necessary. If you think that the cause is worthy of your sympathy, we shall be very grateful to receive your contribution to the great work.
Yours obediently
(Name)৮৯
(Place)
(Date)
যদি যথেষ্ট অর্থসংগ্রহ হয়, কিয়দংশ খরচ করে বাকী একটা ফাণ্ড করে রাখবে এবং তোমাদের খরচ তা হতে চালাবে।
ভোগের নাম করে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না। দুটো ফিল্টার তৈয়ার করবে। সেই জলে রান্না ও খাওয়া দুই-ই। ফিল্টার করবার পূর্বে জল ফুটিয়ে নেবে, তা হলে ম্যালেরিয়ার বাপ পলায়ন। সকলের স্বাস্থ্যের উপর প্রথম দৃষ্টি রাখিবে। মাটিতে শোওয়া ত্যাগ করিবে, পার যদি—অর্থাৎ যদি পয়সা জোটে তো বড়ই ভাল। ময়লা কাপড় ব্যারামের প্রধান কারণ। ঐ সকল টাকার কাজ। সারদা তার বন্ধুদের পত্র লিখুক, ঐ প্রকার সকলে চেষ্টা কর। আমি এখানে চেষ্টা করছি বৈকি! কিন্তু খালি আমার উপর কোন কাজে নির্ভর করিবে না। ভোগের বিষয় তোমাকে লিখি—কেবলমাত্র কিঞ্চিৎ পায়সান্ন চড়াইবে; তিনি তাহাই ভালবাসিতেন। ঠাকুরঘর অনেকের সহায়তা করে বটে, কিন্তু রাজসিক তামসিক খাওয়া-দাওয়ার কোন কাজ নাই। আঙুল-বাঁকান এবং ঘণ্টার বিকট আওয়াজ কিঞ্চিৎ কমি করে কিঞ্চিৎ গীতা-উপনিষদাদি পাঠ করিবে। অর্থাৎ Materialism (জড়োপাসনা) যত কম হয় এবং Spirituality (আধ্যাত্মিকতা) যতই বাড়ে, এই কথা আর কি। সাণ্ডেল লিখছেন যে, হাজার হাজার লোক খালি ঘণ্টানাড়া দেখতে আসে। যদি এ কথা সত্য হয় তো ও-প্রকার লোক না আসাই ভাল। ওরা মেঠাই খেতে আসে; এদিকে মঠের লোক না খেতে পেয়ে মারা যায়, তখন হাজার হাজার লোক কোথায়? আর আমরা কি সর্বত্যাগ করে সাণ্ডেলের জন্য ঘণ্টা বাজাতে এসেছি? সাণ্ডেল কাঁসারীপাড়ায় বাস করুক গে, যদি ঘণ্টানাড়া তার এতই ভাল লাগে। অর্থাৎ তিনি তাঁর ছেলেদের মুখে খাচ্ছেন—তোমার ঘণ্টানাড়ার মধ্যে নয়। তাদের একচুল কষ্ট দিয়ে তোমার ঘণ্টানাড়া সমস্তই বিফল হয়, অপিচ অমঙ্গল হয় তোমার নিজের। এ কথাটা রোজ একবার মনে রেখো। তিনি তোমার একলার জন্য বা সাণ্ডেলের জন্য এসেছিলেন, কি জগতের জন্য? যদি জগতের জন্য, তা হলে জগৎসুদ্ধ লোক যাতে তাঁকে বুঝতে পারে, এই ভাবে তাঁকে present করতে (লোকের কাছে ধরতে) হবে। সেইজন্য সুরেশ দত্তের পুঁথিতে যে আবোল-তাবোলগুলো আছে, সেগুলো দূর করে দিতে হবে—বুঝতে পেরেছ কি? ওগুলো ‘—’বাবুর বুদ্ধিতে বোধ হয় সুরেশ দত্ত লিখেছে—হরিবোল হরি! যাক্, তার উদ্দেশ্য ভাল, কেবল সেই ছোট বুদ্ধি। দক্ষিণেশ্বরের ভট্চায্যির জীবনচরিত—মাষ্টার মহাশয় জানে, সুরেশ বাবু লেখে, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ তারা এখনও দেখতে পায় নাই। দুনিয়া তাদের দক্ষিণেশ্বরের কুটুরি। হে প্রভু, হে প্রভু! তবে you must not identify yourself with any life of Him written by anybody, nor give your sanction to any.৯০ যতক্ষণ আমাদের নামের সঙ্গে না যায়, ততক্ষণ কোন ভয় নেই। এ সকল কথা তোমরা কাউকে বলো না—অর্থাৎ সুরেশ দত্তের উদ্দেশ্য ভাল, বইও বেশ লিখেছে—চলুক, কিছু কাজ হবে। তবে তারা তাঁকে কি ঘোড়ার ডিম বুঝেছে? সাণ্ডেল আমাকে তিন পাতা লেকচার দিয়েছে যে, মা-ঠাকুরাণীকে ভক্তি করতে হবে এবং তিনি আমায় কত দয়া করেন। সাণ্ডেলের এই মহা আবিষ্ক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ! তাঁর [বিষয়ে] একটা কিছু লিখব মনে করি; কিন্তু ভয়ে পেছিয়ে যাই। যাক্, তাঁর ইচ্ছা হয় তো কালে কালে হবে। মহেন্দ্রবাবু মঠ একপ্রকার চালাচ্ছেন; তাঁকে শত শত ধন্যবাদ; তিনি অতি মহৎ। সাণ্ডেলকে বলবে, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তার সাড়ে পাঁচ সিকের চাকরি আর তিন কড়ার বুদ্ধি শীঘ্রই ঘুচবে। তবে তার কর্ম বাজার-হাট ইত্যাদি করা; সেই কর্ম মন দিয়ে করলে—অর্থাৎ তাঁর ছেলেপুলের সেবা করলেই তার পরম কল্যাণ হবে। লেকচার-ফেকচার সে এ জন্মের মত সিকেয় তুলে রাখুক, আসছে বারে দেখা যাবে। তাকে নিজের বুদ্ধি খরচ করতে বারণ করো। যেমনটি বলি দাগা বুলিয়ে যাক্, নইলে উল্টো উৎপত্তি করে বসবে। ‘হাঁ জী হাঁ জী করতে রহিও বৈঠি আপনা ঠাম্।’
যোগেন কেমন আছে? হুটকো কি চাকরি করতে যাচ্ছে—কি করছে? হুটকোকে একটু লেখাপড়া শেখাবে—এখনও বয়স আছে। সব খবর খুলে লিখতে হয়—এ-কথা খুব মনে রেখো। গুপ্ত পড়ছে শুনছে কেমন? তুলসী, লেটোকে ঘুমুতে দিও, যা খেতে চায় দিও, তাড়া দিও না বিলকুল। বাবুরাম কি করছে; হরি, রাখাল কেমন আছে ইত্যাদি বিলকুল লিখবে। সকল কথা খোলসা করে শুনবে—আবোল-তাবোল কে কি বললে হরমোহনী ডৌলে লেখবার দরকার নাই। হরমোহনের সাংসারিক অবস্থা কেমন? তারকদাদা খুব কাজ করছে; বাঃ! বাঃ! সাবাস! ঐ-রকম চাই। এক-একটা নক্ষত্রের মত ছুটে পড় দিকি! গঙ্গা কি করছে? রাজপুতানায় কতকগুলো জমিদার তাকে মানে; তাদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে মঠের জন্য টাকা পাঠাতে বলো …।
শাঁকচুন্নীর বই এইমাত্র পড়লাম। তাকে আমার লক্ষ-লক্ষাধিক প্রেমালিঙ্গন দিবে। তার কণ্ঠে তিনি আবির্ভাব হচ্ছেন। ধন্য শাঁকচুন্নী! শাঁকচুন্নী ঐ পুঁথি সকলকে শোনাক। মহোৎসবে শাঁকচুন্নীর পুঁথি সকলের সামনে যেন পড়ে। পুঁথি অতি বড় যদি হয় তো চুম্বক চুম্বক করে যেন পড়ে। শাঁকচুন্নী একটাও আবোল-তাবোল তো লিখে নাই। আমি তার পুঁথি পড়ে যে কি আনন্দ পেয়েছি, তা আর কি বলব! শাঁকচুন্নীর পুঁথি যাতে খুব বিক্রী হয়, সকলে পড়ে (মিলে) চেষ্টা করবে। তারপর শাঁকচুন্নীকে গাঁয়ে গাঁয়ে প্রচার করতে যেতে বলো। বাহবা, সাবাস, শাঁকচুন্নী! সে তাঁর কাজ করছে। গাঁয়ে গাঁয়ে যাক, লোককে তাঁর কথা শোনাক—এর চেয়ে তার আর কি ভাগ্য হবে? … শশী, শাঁকচুন্নীর পুঁথি and শাঁকচুন্নী himself (নিজে) must electrify the masses (জনসাধারণের শক্তিসঞ্চার করবে)। আরে মোর শাঁকচুন্নী, তোকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি ভাই। প্রভু তোর কণ্ঠে বসুন, দ্বারে দ্বারে তাঁর নাম শুনাও। সন্ন্যাসী হবার আবশ্যক কিছুই নাই। শশী, mass (জনসাধারণ)-এর মধ্যে সন্ন্যাসী হওয়া উচিত নয়। শাঁকচুন্নী is the future apostle for the masses of Bengal (বাঙলার জনসাধারণের নিকট ভাবী বার্তাবহ)। শাঁকচুন্নীকে খুব যত্ন করবে! তার বিশ্বাস-ভক্তির ফল ফলেছে। শাঁকচুন্নীকে এই ক-টা কথা লিখতে বলো—তার তৃতীয় খণ্ডে, প্রচার খণ্ডেঃ
‘বেদবেদান্ত, আর আর সব অবতার যা কিছু করে গেছেন, তিনি একলা নিজের জীবনে তা করে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন না বুঝলে বেদবেদান্ত অবতার প্রভৃতি বোঝা যায় না—কেন না, He was the explanation (তিনি ব্যাখ্যাস্বরূপ ছিলেন)। তিনি যেদিন থেকে জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে। এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, পণ্ডিত-বিদ্বান-ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর তিনি বিবাদভঞ্জন—হিন্দু-মুসলমান-ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল। ঐ যে ভেদাভেদে লড়াই ছিল, তা অন্য যুগের; এ সত্যযুগে তাঁর প্রেমের বন্যায় সব একাকার।’
এই ভাবগুলো তার ভাষায় বিস্তার করে লিখতে বলবে। যে তাঁর পূজা করবে, সে অতি নীচ হলেও মুহূর্তমধ্যে অতি মহান্ হবে—মেয়ে বা পুরুষ। আর এবারে মাতৃভাব—তিনি মেয়ে সেজে থাকতেন, তিনি যেন আমাদের মা—তেমনি সকল মেয়েকে মার ছায়া বলে দেখতে হবে। ভারতে দুই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলান, আর ‘জাতি জাতি’ করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা। He was the Saviour of women, Saviour of the masses, Saviour of all high and low.৯১আর শাঁকচুন্নী ঘরে ঘরে তাঁর পূজা করাক। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মেয়ে বা পুরুষ—তাঁর পূজায় সকলের অধিকার। যে ঘটস্থাপনা বা প্রতিমা করে তাঁর পূজা করবে—মন্ত্র হোক বা না হোক—যেমন করে যে-ভাষায় যার হাত দিয়ে হোক—খালি ভক্তি করে যে পূজা করবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে।—এই ডৌলে লিখতে বলো। কুছ পরোয়া নাই; প্রভু তার সহায় হবেন। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
পুঃ—ম্যাক্সমূলারকে—তিনি ভারতের পরম সহায়—এইভাবে পত্র লিখিবে। বোধ হয় লিখিয়াছ। … সে বই আমি অনেক দিন দেখেছি, তাতে আমার ভাবের আভাসও আছে।
যে অভিধানের বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দিয়েছিলে, তা দু-চার জন বন্ধুকে পাঠিয়েছি—কি ফল হবে, তা জানি না। তুমি একখানা নারদ-আর শাণ্ডিল্যসূত্র এবং একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ’—যা কলকেতায় তর্জমা হয়েছে—তা পাঠিয়ে দিতে সাণ্ডেলকে বলবে। ‘যোগবাশিষ্ঠে’র ইংরেজী তর্জমা, বাঙলা নয়। ইতি
শাঁকচুন্নী যেন আমার opinion (মত) in his book (তাঁর পুঁথিতে) না ছাপে। তাঁকে মুখে তুমি বলবে—অথবা পড়ে শুনাবে। যাকে তাকে আমার correspondence (চিঠিপত্র) পড়তে দিবে না। এ-সমস্ত private (ব্যক্তিগত)। কথা কানে হাঁটে। ইতি
নরেন্দ্র
২৫০*
আমেরিকা
১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমাদের কোন সঙ্ঘ নেই—আমরা কোন সঙ্ঘ গড়তেও চাই না। স্ত্রী বা পুরুষ যে-কেহ যা কিছু শিক্ষা দিতে, যা কিছু প্রচার করতে চায়, সে-বিষয়ে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
যদি তোমার ভিতরে শক্তি থাকে, তবে তুমি কখনই অপর পাঁচজনকে আকর্ষণ করতে অসমর্থ হবে না। আমরা কখনই থিওসফিষ্টদের কার্যপ্রণালী অনুসরণ করতে পারি না—তার সোজা কারণ এই যে, তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ সম্প্রদায়, আর আমরা তা নই।
আমার মূলমন্ত্র হচ্ছে—ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এক-একটি ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা ছাড়া আমার অন্য কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি অতি অল্পই জানি—সেই অল্পস্বল্প যা জানি, তার কিছু চেপে না রেখেই শিক্ষা দিয়ে যাই। যে বিষয়টা জানি না, স্পষ্টই স্বীকার করি যে, সেটা আমার জানা নেই। আর থিওসফিষ্ট, খ্রীষ্টান, মুসলমান বা জগতের অপর যার কাছ থেকেই হোক, লোক কিছু সাহায্য পাচ্ছে জানলে আমার এত আনন্দ হয়, তা কি বলব। আমি তো সন্ন্যাসী—সুতরাং এ জগতে আমি কারও গুরু বা প্রভু নই, আমি নিজেকে সকলের দাস মনে করি। … যদি লোকে আমায় ভালবাসে বাসুক, তাদের খুশী; ঘৃণা করে করুক—তাদের খুশী।
প্রত্যেককেই নিজের উদ্ধারসাধন নিজেকে করতে হবে—প্রক্যেককেই নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে। আমি কোন সাহায্য খুঁজি না, পেলে তা ত্যাগও করি না; আর জগতে কোন সাহায্য দাবী করবার অধিকারও আমার নেই। কেউ যে আমায় সাহায্য করেছে বা করবে, আমার প্রতি সে তার দয়া, তাতে আমার দাবীদাওয়া কিছু নেই; এ জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
যখন সন্ন্যাসী হই, তখন বুঝেসুঝেই এ পথ বেছে নিয়েছিলাম; বুঝেছিলাম, অনাহারে মরতে হবে। তাতে কি হয়েছে? আমি তো ভিখারী; আমার বন্ধুরা সব গরীব; গরীবদের আমি ভালবাসি; দারিদ্র্যকে সাদরে বরণ করি। কখনও কখনও যে আমায় উপবাস করে কাটাতে হয়, তাতে আমি খুশী। আমি কারও সাহায্য চাই না—তার প্রয়োজন কি? সত্য নিজের প্রচার নিজেই করবে, আমার সাহায্যের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে না। ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব’—সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়, সব সমান মনে করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও (গীতা)।
এইরূপ অনন্ত ভালবাসা, সর্বাবস্থায় এইরূপ অবিচলিত সাম্যভাব থাকলে এবং ঈর্ষা দ্বেষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলে তবে কাজ হবে। তাতেই কেবল কাজ হবে, আর কিছুতেই নয়। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৫১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
জানুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় সারদা,
… তোর কাগজের idea (সঙ্কল্প) অতি উত্তম বটে এবং উঠে পড়ে লেগে যা, পরোয়া নেই। ৫০০ টাকা পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেব, ভাবনা নাই টাকার জন্য। আপাতত এই চিঠি দেখিয়ে কারুর কাছে ধার করে নে। এই চিঠির জবাব—চিঠির উত্তরে আমি ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেব। ৫০০ টাকায় কিছু আসে যায় কি? খ্রীষ্টিয়ান, মুসলমান ধর্ম প্রচারের ঢের লোক আছে, তুই আপনার দেশী ধর্মের প্রচার এখন করে ওঠ দিকি। তবে কোন আরবী জানা মুসলমান-ভায়া ধরে যদি পুরানো আরবী গ্রন্থের তর্জমা করাতে পারে, ভাল হয়। ফার্সী ভাষায় অনেক Indian History (ভারতীয় ইতিহাস) আছে। যদি সেগুলো ক্রমে ক্রমে তর্জমা করাতে পার, একটা বেশ regular item (নিয়মিত বিষয়) হবে। লেখক অনেক চাই। তার পর গ্রাহক যোগাড়ই মুশকিল। উপায়—তোরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াস, বাঙলা ভাষা যেখানে যেখানে আছে, লোক ধরে কাগজ গতিয়ে দিবি। … চালাও কাগজ, কুছ্ পরোয়া নাই। শশী, শরৎ, কালী প্রভৃতি সকলে পড়ে (মিলে) লিখতে আরম্ভ কর। ঘরে বসে ভাত খেলে কি হয়? তুই খুব বাহাদুরি করেছিস। বাহবা, সাবাস! গুঁজগুঁজেগুলো পেছু পড়ে থাকবে হাঁ করে, আর তুই লম্ফ দিয়ে সকলের মাথায় উঠে যাবি। ওরা নিজেদের উদ্ধার করছে—না হবে ওদের উদ্ধার, না হবে আর কারুর। মোচ্ছব (মহোৎসব) এমনি মাচাবি যে, দুনিয়াময় তার আওয়াজ যায়। অনেকে আছেন, যাঁরা কেবল খুঁত কাড়তে পারেন; কিন্তু কাজের বেলা তো ‘খোঁজ খবর নহি পাওয়ে।’ লেগে যা, যত পারিস। পরে আমি ইণ্ডিয়ায় (ভারত) এসে তোলপাড় করে তুলব। ভয় কি? ‘নাই নাই বললে সাপের বিষ উড়ে যায়।’—নাই নাই বলে যে নাই হয়ে যেতে হবে!
গঙ্গাধর খুব বাহাদুরি করছে। সাবাস! কালী তার সঙ্গে কাজে লেগেছে। খুব সাবাস! একজন মান্দ্রাজে যা, একজন বোম্বে যা। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর দুনিয়া। কি বলব আপসোস—যদি আমার মত দুটা তিনটা তোদের মধ্যে থাকত—ধরা কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যেতুম। কি করি, ধীরে ধীরে যেতে হচ্ছে। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর। একটাকে চীন দেশে পাঠিয়ে দে, একটাকে জাপান দেশে পাঠা। গৃহস্থদের কাজ নয়। … সন্ন্যাসীর দলকে হুঙ্কার দিতে হবেঃ ‘হ—র্, হ—র্, শ—ম্ভো!’ ইতি—
বিবেকানন্দ
২৫২*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৬ জানুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
নববর্ষে তোমার প্রীতিসম্ভাষণের জন্য বহু ধন্যবাদ। বিশিষ্ট ভদ্রমহোদয়টির ওখানে ছয় সপ্তাহ তোমার বেশ আনন্দে কেটেছে জেনে সুখী হলাম, যদিও তারা কেবল গল্ফ্ই খেলত। ইংলণ্ডে দেখলাম—আমি যথার্থ শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইংরেজরা আন্তরিক অভ্যর্থনা করেছে; এই ইংরেজ জাত সম্বন্ধে আমার ধারণাও অনেকখানি বদলেছে। প্রথমেই দেখলাম লাণ্ড্ (Lund) প্রভৃতি যারা আমার সঙ্গে বিরোধের জন্য ইংলণ্ড থেকে এখানে এসেছিল, ওখানে তাদের কোন পাত্তাই নেই। ইংরেজরা তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত উপেক্ষা করে। যারা ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের ভদ্র বলে মনে করা হয় না। ঐ চার্চভুক্ত কয়েকজন যথার্থ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠা ও পদমর্যাদায় অগ্রণীদের কেউ কেউ আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছেন। আমার ইংলণ্ডের অভিজ্ঞতা আমেরিকার তুলনায় একেবারে অন্য রকমের।
এখানে প্রেসবিটেরিয়ান প্রভৃতি গোঁড়াদের সঙ্গে হোটেলগুলিতে আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে ইংরেজরা তো হেসেই অস্থির। উভয় দেশের মধ্যে শিক্ষা দীক্ষা ও আচার-ব্যবহার প্রভেদ লক্ষ্য করতে দেরী হল না। বুঝলাম কেন আমেরিকার মেয়েরা দলে দলে ইওরোপীয় বিবাহ করতে যায়। সকলের কাছে সদয় ব্যবহার পেয়েছি। স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে অনেক উদারহৃদয় বন্ধু এখন সেখানে বসন্তকালে আমার ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায় আছে।
সেখানকার কাজ সম্বন্ধে বলি, বেদান্তের ভাব ইংরেজ সমাজের উচ্চ স্তরে প্রবেশ করেছে। বহু শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে ধর্মযাজকের সংখ্যাও কম নয়, আমাকে বলেন যে, এ যেন গ্রীস কর্তৃক রোম-বিজয়ের পুনরভিনয় হচ্ছে ইংলণ্ডে।
ভারতে বাস করেছে এমন ইংরেজদের মধ্যে দুটি শ্রেণীঃ এক শ্রেণীর চোখে ভারতীয় যা কিছু সবই হেয়; এরা কিন্তু অশিক্ষিত। অপর শ্রেণীর নিকট ভারত পুণ্যভূমি, ভারতের বায়ু পর্যন্ত পবিত্র; এদের হিন্দুয়ানী হিন্দুদেরও হার মানায়, এরা ঘোর নিরামিষাশী, এমন কি স্বদেশে জাতিভেদ-প্রবর্তনেও উদ্যত। ইংলণ্ডের অধিকাংশ লোকই জাতিভেদের দারুণ পক্ষপাতী। সাধারণ বক্তৃতা ছাড়া সপ্তাহে আরও আটটি করে ক্লাস নিতাম; এত লোকসমাগম হত যে, অনেকে—এমন কি অভিজাত মহিলাগণও নিঃসঙ্কোচে মেজের উপরই বসতেন। ইংলণ্ডে দৃঢ়সঙ্কল্প নরনারী দেখতে পেলাম, তারা দায়িত্ব নিয়ে তাদের জাতি-সুলভ উদ্যম ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ চালাতে থাকবে। এ বৎসর নিউ ইয়র্কে আমার কাজ চমৎকার চলেছে। মিঃ লেগেট নিউ ইয়র্কের একজন সেরা ধনী, তিনি আমার একান্ত অনুরাগী। এদেশে নিউ ইয়র্কবাসীরা অধিকতর দৃঢ়চিত্ত, এবং তাই এখানেই আমার কেন্দ্রস্থাপনের সঙ্কল্প করেছি। এখানকার মেথডিষ্ট ও প্রেসবিটেরিয়ান সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আমার উপদেশাদি অসঙ্গত মনে করেন। ইংলণ্ডের ধার্মিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে এগুলি উচ্চতম দার্শনিক তত্ত্বরূপে পরিগণিত।
তা ছাড়া মার্কিন নারীর স্বভাবসুলভ পরচর্চা ইংলণ্ডে অজ্ঞাত। ইংরেজ মেয়েরা দেরীতে ভাব গ্রহণ করে, তবে একবার ঠিকমত গ্রহণ করতে পারলে তা আয়ত্ত করে নেবেই। ওখানে ওরা যথারীতি কাজ চালাচ্ছে ও প্রতি সপ্তাহে আমাকে কাজের বিবরণ পাঠাচ্ছে। বুঝে দেখ! আর এখানে সপ্তাহখানেকের জন্য যদি অনুপস্থিত থাকি তো কাজের দফা রফা। সকলকে আমার শুভেচ্ছা জানিও—স্যাম এবং তুমি জেনো। ভগবান্ তোমাকে চিরসুখী করুন। ইতি
তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৫৩*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, W. 39th St. নিউ ইয়র্ক
১৬ জানুআরী, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
বই-কয়খানির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। ‘সাংখ্যকারিকা’ অতি সুন্দর গ্রন্থ, এবং ‘কূর্মপুরাণে’ আশানুরূপ সব না পেলেও ওতে যোগ সম্বন্ধে কয়েকটি শ্লোক আছে। আমার পূর্বের চিঠিতে ‘যোগসূত্র’ এই শব্দটি বাদ পড়েছিল। বহু প্রামাণিক গ্রন্থ থেকে পাদটীকা সংযুক্ত করে আমি ঐ গ্রন্থখানি অনুবাদ করছি। ‘কূর্মপুরাণে’র পরিচ্ছেদটি আমার টীকার মধ্যে দিতে চাই। আমি মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকে তোমার ক্লাসগুলির খুব উৎসাহপূর্ণ বিবরণ পেয়েছি। মিঃ গলস্ওয়ার্দি এখন খুব আকৃষ্ট হয়েছেন বলে মনে হয়।
এখানে আমার ক্লাসগুলি ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আরম্ভ করেছি। দুটি কাজই খুব উৎসাহ জাগিয়েছে। এই দুই কাজের জন্য আমি টাকা নিই না; তবে হলের খরচ চালাবার জন্য (সভাদিতে) কিছু চাঁদা ওঠাই। গত রবিবারের বক্তৃতাটি খুব প্রশংসা অর্জন করেছে, এবং সেটি খবরের কাগজে বেরিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমি তোমায় কয়েক সংখ্যা পাঠিয়ে দেব। ওতে আমাদের কাজের একটা সাধারণ পরিকল্পনা ছিল।
আমার বন্ধুরা একজন সাঙ্কেতিক লেখক (গুডউইনকে) নিযুক্ত করায় এই সমস্ত ক্লাসের পাঠগুলি ও বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকটির এক এক কপি তোমাকে পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা আছে। ঐসব থেকে তুমি হয়তো কিছু চিন্তার খোরাক পেতে পার। এখানে আমি তোমার মত এমন একজন শক্তিশালী লোক চাই—যার বুদ্ধি, কর্মে দক্ষতা ও অনুরাগ আছে। এই সর্বজনীন শিক্ষার দেশে সকলকেই যেন একটা সাধারণ মাঝারি স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে; যে কয়জন যোগ্য ব্যক্তি আছে, তারা যেন গতানুগতিক অর্থ-উপার্জনের গুরুভারে পীড়িত।
এবার পল্লী অঞ্চলে আমার একটি জমি পাবার সম্ভাবনা আছে; তাতে কয়েকটি বাড়ী, বহু গাছ ও একটি নদী আছে। গ্রীষ্মকালে ওটিকে ধ্যানের স্থানরূপে ব্যবহার করা চলবে। অবশ্য আমার অনুপস্থিতিতে ওটার দেখাশুনার জন্য এবং টাকাকড়ি লেনদেন, ছাপা ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি কমিটির প্রয়োজন হবে।
আমি নিজেকে টাকাকড়ির ব্যাপার থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছি, অথচ টাকাকড়ি না হলে কোন আন্দোলন চলতে পারে না। সুতরাং বাধ্য হয়ে কার্যপরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব একটি কমিটির হাতে দিতে হয়েছে; তারা আমার অনুপস্থিতিতে এই সব চালিয়ে যাবে। স্থিরভাবে কাজ করে যাওয়া আমেরিকানদের ধাতে নেই; তারা কেবল দলবেঁধেই কাজ করে। সুতরাং তাদের তাই করতে দিতে হবে। প্রচারের দিকটার ব্যবস্থা এই হয়েছে যে, আমার বন্ধুরা প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে এদেশের জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াবে; এবং তারা স্বতন্ত্র দল গঠন করতে পারবে। ঐ হচ্ছে বিস্তারের সব চেয়ে সহজ উপায়। অতঃপর যখন আমরা যথেষ্ট বলশালী হব, তখন আমাদের শক্তিরাশিকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য আমরা বাৎসরিক সম্মেলন করব।
কমিটি নিছক কাজ চালানর জন্য এবং তা নিউ ইয়র্কেই সীমাবদ্ধ।
সতত স্নেহপরায়ণ ও আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ
২৫৪
[মঠে লিখিত, শেষাংশ স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে]
228 W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১৭ জানুআরী, ১৮৯৬
অভিন্নহৃদয়েষু—
তোমার দুইখানি পত্র আসিয়াছে ও রামদয়ালবাবুর দুইখানি পত্র পাইয়াছি। Bill of Lading (বিল) পৌঁছিয়াছে, পরন্তু মাল আসিবার অনেক দেরী। শীঘ্র পৌঁছিবার বন্দোবস্ত না করিয়া পাঠাইলে মাল আসিতে ছয় মাস লাগিয়া যায়। হরমোহন চার মাস পূর্বে লিখেন যে, রুদ্রাক্ষ ও কুশাসন পাঠান হইয়াছে; তাহার খোঁজ-খবর এখনও পাওয়া যায় নাই। অর্থাৎ মাল ইংলণ্ডে পৌঁছিলে এখানকার Agent of the Company (কোম্পানীর এজেণ্ট) আমাকে notice (খবর) দেয়, তারপর মাসখানেক পরে মাল পৌঁছায়। তোমাদের Bill of Lading (বিল) প্রায় তিন সপ্তাহ এসেছে, এখনও notic-এর (খবরের) দেখা নাই! কেবল খেতড়ির রাজার মাল শীঘ্রই পৌঁছায়, বোধ হয় তিনি অনেক খরচ করে পাঠান। যাহা হউক, এ দুনিয়ার অপরদিকে, পাতালপুরে যে মাল নির্ঘাত পৌঁছে যায়, এই পরম ভাগ্য। মাল পৌঁছলেই তোমাদের খবর দেব। এখন তিন মাস অন্ততঃ চুপ করে থাক।
তুমি খবরের কাগজ এখন বার করতে লেগে যাও। রামদয়ালবাবুকে বলিবে যে, তিনি যে-ব্যক্তির কথা লিখিয়াছেন, তিনি উপযুক্ত হইলেও আমেরিকায় এক্ষণে কাহাকেও আনিবার আমার সাধ্য নাই। L’argent, mon ami, l’argent—টাকা, ইয়ার, টাকা কোথায়?
… তোর টিবেটের (তিব্বতের) কি খবর? ‘মিররে’ ছাপা হলে আমাকে একখানা পাঠিয়ে দিস। … হুটোপাটিতে কি কাজ হয়? … লোহার দিল চাই, তবে লঙ্কা ডিঙ্গুবি। বজ্রবাঁটুলের মত হতে হবে, পাহাড় পর্বত ভেদ হয়ে যাতে যায়। আসছে শীতে আমি আসছি। দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দেব—যে সঙ্গে আসে আসুক, তার ভাগ্যি ভাল; যে না আসবে, সে ইহকাল পরকাল পড়ে থাকবে, থাকুক। তুই কোমর বেঁধে তৈয়ার থাক। তুই শশী আর গঙ্গাধর—এই তিনজন দেখছি faithful. … তোদের মুখে হাতে বাগ্দেবী বসবেন—ছাতিতে অনন্তবীর্য ভগবান্ বসবেন—তোরা এমন কাজ করবি যে দুনিয়া তাক হয়ে দেখবে। তোর নামটা একটু ছোটখাট কর দেখি বাবা, কি নাম রে বাপ! একখানা বই হয়ে যায় এক নামের গুঁতোয়। ঐ যে বলে হরিনামের ভয়ে যম পালায়, তা ‘হরি’—এই নামে নয়। ঐ যে গম্ভীর গম্ভীর নাম ‘অঘভগনরকবিনাশন, ত্রিপুরমদভঞ্জন, অশেষ-নিঃশেষকল্যাণকর’ প্রভৃতি নামের গুঁতোয় যমের চৌদ্দপুরুষ পালায়।—নামটা একটু সরল করলে ভাল হয় নাকি? এখন বোধ হয় আর হবে না, ঢাক বেজে গেছে, কিন্তু কি জাঁহাদারি যমতাড়ানে নামই করেছ! কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
পুঃ—বাঙলাদেশটা আর ভারতবর্ষটা চেলে ফেল দেখি। জায়গায় জায়গায় Centre (কেন্দ্র) কর।
ভাগবত এসে পৌঁছেছে—Edition (সংস্করণ) বড়ই সুন্দর—কিন্তু এ-দেশের লোকের সংস্কৃত পড়বার ইচ্ছা আদৌ নাই। এজন্য বিক্রী হবার আশা বড়ই কম। ইংলণ্ডে হতে পারে, কারণ সেখানে অনেক লোকে সংস্কৃত চর্চা করে। প্রণেতাকে আমার বিশেষ ধন্যবাদ দিবে। আশা করি তাঁহার মহৎ উদ্যম সুসম্পন্ন হবে। আমরা যথাসাধ্য যত্ন করব, তাঁর বই যাতে এখানে বিক্রী হয়। তাঁর Prospectus (গ্রন্থাভাস) সমস্ত জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। দয়ালবাবুকে বলবে যে, মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলণ্ড ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলিতে পারে। দাল-soup will have a go if properly introduced. (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের যূষের বেশ কদর হবে)। যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার direction (প্রণালী) দিয়ে বাড়ীতে বাড়ীতে পাঠান যায়—আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠান যায় তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই—ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা Company form (কোম্পানী গঠন) করে, ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলণ্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়। নিরুদ্যম হতভাগার দল—দশবৎসরের মেয়ের গর্ভাধান করতে কেবল জানে, আর জানে কি?