নীল সাগর ভূমধ্য
ফ্রেব্রুআরি মাসের নয় তারিখে নটিলাস-এর প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে ক্যাপ্টেন নেমোর দেয়া চুরুট টানছি, আর দেখছি লোহিত সাগরের উপর দিয়ে নটিলাস কেমন করে আস্তে ভূমধ্য সাগরের দিকে ভেসে যাচ্ছে, এমন সময় ক্যাপ্টেন নেমো আমার পাশে এসে দাড়ালেন।
মঁসিয় আরোনা, হঠাৎ হাসিমুখে তিনি জিগেস করলেন, জানেন পরশু দিন আমরা ভূমধ্য সাগরে পৌঁছবে?
তাহলে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে আসার জন্য নটিলাসকে বাতাসের চেয়েও দ্রুত ছুটতে হবে।
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরতে হবে কেন? আফ্রিকার পাশ দিয়েই যে যাব তা কে বললে?
নটিলাস যদি ডাঙার উপর দিয়ে না-যায়-–
কেন? ডাঙার নিচে দিয়েও তো যেতে পারে।
নিচে দিয়ে?
লোকে এখন সুয়েজ খাল কাটছে বটে, কিন্তু প্রকৃতি ঠাকরুন অনেক আগেই সে-কাজ সেরে রেখেছেন। সুয়েজের তলা দিয়ে পোর্ট সয়ীদ পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ গেছে, আমি তার নাম করেছি আব্রাহাম সুড়ঙ্গ।
সত্যি? সুড়ঙ্গটা কি দৈবাৎ আপনার চোখে পড়ে যায়?
অবশ্য একটু কাণ্ডজ্ঞানও খাটাতে হয়েছে। ওই সুড়ঙ্গ না-থাকলে আমি লোহিত সাগরে ঢুকতুম না।
সুড়ঙ্গটাকে কীভাবে আবিষ্কার করলেন, জানতে পারি? অবশ্য যদি আপনার কোনো আপত্তি না-থাকে?
ভাগ্য যাদের চিরকালের মতো এক সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কোনো কথাই গোপন থাকা উচিত নয়। ক্যাপ্টেন নেমে বললেন, সুড়ঙ্গটার খোঁজ পেয়েছিলুম মাছ দেখে।
অর্থাৎ?
লক্ষ্য করেছিলুম যে একই জাতের কতগুলো মাছ ভূমধ্য সাগরে আর লোহিত সাগরে পাওয়া যায় অথচ আমরা জানতুম এই দুই সমুদ্রের কোনো যোগসূত্ৰই নেই। তাহলে এর এই দুই সমুদ্রে যাতায়াত করে কীভাবে? এ-রকম কোনো সুড়ঙ্গ থাকলে লোহিত সাগর থেকেই তা উত্তরমুখো যাবে, কারণ লোহিত সাগরের। উচ্চতাই বেশি। আমার অনুমান ঠিক কিনা বোঝবার জন্য রাশি রাশি মাছ ধরে ল্যাজে পিতলের আংটি বেঁধে আবার সমুদ্রে ছেড়ে দিলুম। কয়েক মাস পরে সিরিয়ার কাছে এই আংটি বাঁধা মাছগুলোকেই খুঁজে পেলুম। তখন আর আমার কোনো সন্দেহই রইলো না। ফলে নটিলাস জলের তলায় সরেজমিনে তদন্তে বেরোলো, আর সহজেই সন্ধান পাওয়া গেলো। আপনিও শিগগিরই সুড়ঙ্গটা দেখতে পাবেন, আমি ছাড়া যার হদিশ আর-কেউ জানে না।
পরের দিন সন্ধেবেলায় নটিলাস সুয়েজের কাছে পৌঁছেই জলের তলায় ডুব দিলে।।
সেই আরব্য সুড়ঙ্গ দেখতে পাবার প্রত্যাশায় আমি চঞ্চল ও অধীর হয়ে উঠেছিলুম। বোধহয় আমার চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেই ক্যাপ্টেন নেমো জিগেস করলেন, প্রফেসর, আপনি কি আমার সঙ্গে চালকের ঘরে যেতে রাজী আছেন?
এই কথাটিই জিগেস করবো কিনা ভাবছিলুম, কিন্তু কিছুতেই আর সাহস পাচ্ছিলুম না।
তাহলে আসুন।
ক্যাপ্টেন নেমো আমাকে নিয়ে চালকের খাঁচায় গিয়ে হাজির হলেন। চৌকো একটি ঘর, লম্বা-চওড়ায় ছ-ফুট–মিসিসিপি কিংবা হাডসন নদীর জাহাজের সারেঙের ঘরটা যেমন হয় তেমনি দেখতে। ঘরটার ঠিক মধ্যখানে রয়েছে চাকাটা, চারদিকের দেয়ালে চারটে কাঁচের জানলা, যাতে সারেঙের পক্ষে চারপাশ দেখা সম্ভব হয়।
সারেঙের কামরাটা অন্ধকার, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখ আবছায়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেলো। কামরার পিছনে যে লণ্ঠনটা জ্বলছিলো তার আলো এসে পড়েছে জলে, আর ঝলমল করে উঠেছে সিন্ধুতল।।
এবার সুড়ঙ্গের মুখটা খুঁজে বার করতে হবে, বলে বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে ইঞ্জিন-ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন ক্যাপ্টেন নেমো, যাতে একই সঙ্গে নটিলাস-এর বেগ আর দিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। একটি ধাতুনির্মিত হাতলে চাপ দিয়ে চাকার গতিটা অনেক কমিয়ে ফেললেন তিনি।
চুপ করে দাড়িয়ে চোখের সামনেই আধো-আলো আধো-আবছায়ার মধ্যে সুয়েজের তীরের খাড়া পাথুরে দেয়াল দেখতে পেলুম। দিগ,দশিকায় সজাগ চোখ রেখে ক্যাপ্টেন নেমে একের পর এক নির্দেশ পাঠাতে লাগলেন ইঞ্জিন-ঘরে।
রাত সোয়া দশটার সময় ক্যাপ্টেন নেমো এসে নিজেই হাল ধরলেন। হঠাৎ দেওয়াল সরে গিয়ে সামনে গভীর কালো এক বিকট গহবরকে হা করে থাকতে দেখলুম, নটিলাস সেই পাথুরে মুখের ভিতর নিয়ে ঢুকে পড়লো। চারপাশ থেকে প্রবল জলকল্লোল উঠছে— ঢালু বেয়ে লোহিত সাগরের জল ছুটে চলেছে ভূমধ্য সাগরের দিকে, আর তারই জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে থরো থরো, নটিলাস দ্রুতবেগে এগিয়ে চললো।
টেরচাভাবে আলো পড়ে পাথরের দেয়ালে, মাঝে-মাঝে দেয়ালগুলো যেন দ্রুত এগিয়ে আসে নটিলাস-এর দিকে, আর আমার বুকে যেন দুমদাম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ে। শেষকালে এই পাথরের দেয়ালে প্রচণ্ড দা খেয়ে যদি নটিলাস-এর সলিল সমাধি হয়।
দশটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় সারেঙের চাকা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন নেমো, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভূমধ্য সাগর।
বিশ মিনিটও লাগলো না, প্রবল জলোচ্ছ্বাস নটিলাসকে বহন করে নিয়ে এলো ভূমধ্য সাগরে, সুয়েজ যোজক তার কাছে কোনো বাধা বলেই গণ্য হলো না।