চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – নাগর বৃত্ত
সকল বৃহৎ নরগোষ্ঠীতে জলৌকা-জাতীয় এক শ্রেণীর লোক থাকে যাহারা কোনও কর্ম করে না, নিঃসাড়ে পরের রক্ত-শোষণ করিয়া উদরপূর্তি করে। কবি বিম্বাধর সেই শ্রেণীর লোক। সে রঙ্গ-রসিক ও বাক্পটু, ধনী ব্যক্তিদের অশ্লীল কবিতা ও গল্প শুনাইয়া কবিখ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। চাটুকার্য ও বিদূষক-বৃত্তি ছিল তাহার জীবিকা। অর্থের জন্য কোনও নিকৃষ্ট কার্য করিতে সে পশ্চাৎপদ ছিল না।
বজ্রের মধ্যে শাঁস আছে বুঝিয়া বিম্বাধর পরম আগ্রহে তাহাকে স্বর্ণকারের গৃহে লইয়া চলিল। বেশি দূর যাইতে হইল না, ঐ পথেরই কয়েকখানা বাড়ি পরে এক স্বর্ণকারের গৃহ। বিম্বাধর বজ্রকে সেখানে উপস্থিত করিয়া স্বর্ণকারকে বলিল— ‘ওহে অক্রূর, এই নাও, এক বিদেশী ভদ্র তোমার সঙ্গে ব্যাপার করতে চান।’
অক্রূরদাস পরিণতবয়স্ক ব্যক্তি, শান্ত মন্থর প্রকৃতি। সে প্রাতঃকালে নিজ কর্মকক্ষে বসিয়া দৈনন্দিন কাজ আরম্ভ করিয়াছিল, সোনায় সোহাগা দিয়া পিত্তলের নালিকা দ্বারা প্রদীপ শিখায় ফুঁ দিয়া সোনা গলাইতেছিল। বজ্র ও বিম্বাধরকে সে সমাদর করিয়া বসাইল।
বজ্র প্রগণ্ড হইতে প্রথমে শীলভদ্রের বস্ত্রবন্ধন মোচন করিল, তারপর অঙ্গদ খুলিয়া অক্রূরদাসকে দিল। বলিল— ‘এই অঙ্গদ থেকে এক মাষা কেটে নিয়ে তার দাম দাও।’
অক্রূর অঙ্গদ লইয়া গভীর অভিনিবেশ সহকারে দেখিতে লাগিল। পাথরের মত ভারী সুন্দর গঠন দেখিয়া বিম্বাধরের জিহ্বা লালায়িত হইয়াছিল, সে সংহত স্বরে বলিল— ‘সোনা নাকি?’
অক্রূরদাস অঙ্গদ হইতে চক্ষু তুলিয়া বজ্রের পানে চাহিল, বলিল— ‘হ্যাঁ, সোনা। — এ অঙ্গদ আপনি কোথায় পেলেন?’
অক্রূরের প্রশ্নের মধ্যে বিপজ্জনক কণ্টক আছে অনুভব করিয়া বজ্র তাচ্ছিল্যভরে বলিল— ‘উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। তুমি সোনা কিনতে রাজী থাক তো বল, নচেৎ অন্যত্র চেষ্টা করি।’
অক্রূর বলিল— ‘রাজী আছি। আপনি যদি গোটা অঙ্গদটা বিক্রি করেন আমি কিনতে রাজী আছি।’
বজ্র বলিল— ‘না, কেবল এক মাষা সোনা বিক্রি করব।’
অক্রূর বলিল— ‘ভাল। এমন সুন্দর অঙ্গদ কাটতে কিন্তু মায়া হচ্ছে। ত্রিশ বছর আগে কানসোনাতে এক কারুকর ছিলেন, তাঁর হাতের কাজ আমি চিনি। এ অঙ্গদ তাঁরই রচনা। তিনি ছিলেন শশাঙ্কদেবের রাজ-কারুকর।’
বজ্র ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল— ‘তা হবে। আমার পিতা যুদ্ধক্ষেত্রে এই অঙ্গদ লাভ করেছিলেন।’
‘গোটা অঙ্গদ আপনি বিক্রি করবেন না?’
‘না।’
অক্রূর তখন অতি সাবধানে এক মাষা সোনা কাটিয়া লইল, অঙ্গদের শিল্পশোভা ক্ষুণ্ণ হইল না। তারপর হিসাব কষিয়া সোনার মূল্য কয়েকটি রৌপ্য মুদ্রা, কিছু দ্রহ্ম ও কপর্দক বজ্রকে দিল।
মূল্য পাইয়া বজ্র গাত্রোত্থান করিলে অক্রূর সবিনয়ে বলিল— ‘আবার যদি সোনা বিক্রি করেন আমার কাছে আসবেন, আমি উচিত মূল্য দেব। আর যদি গোটা অঙ্গদ বিক্রি করেন আমি বেশি মূল্য দেব।’
‘ভাল।’ বলিয়া বজ্র বাহির হইল। বিম্বাধর তাহার সঙ্গে চলিল।
দুইজনে রাজপথে নামিয়া একদিকে চলিল। বজ্র বিম্বাধরের দিকে সহসা কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘কৈ, তুমি কবিতা লিখতে যাবে না?’
বিম্বাধর বলিল— ‘কবিতা! হাঁ হাঁ, লিখতে হবে বটে। — তা তুমি এখন কোনদিকে যাবে?’
বজ্র বলিল— ‘এবার একটা বাসস্থান খুঁজে নিতে হবে। কানসোনায় দু’চার দিন থাকব স্থির করেছি। কোথায় বাসস্থান পাওয়া যায় বলতে পার?’
বিম্বাধর বজ্রের বাহুর সহিত বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া বলিল— ‘বন্ধু, যার গাঁটে কড়ি আছে তার আবার বাসস্থানের চিন্তা! চল, তোমাকে ভাল বাসস্থানে নিয়ে যাব। পান ভোজন সব পাবে। ভাল কথা, তোমার নাম তো বললে না।’
একটু চিন্তা করিয়া বজ্র বলিল— ‘আমার নাম মধুমথন।’
বিম্বাধর বলিল— ‘বন্ধু মধুমথন, তোমার দেশ কোথায়?’
বজ্র বলিল— ‘উত্তরে, মৌরী নদীর তীরে।’
‘তুমি যে বংগাল নও তা তোমার কথা শুনেই বুঝেছি। — তা কি কাজে কানসোনায় এসেছ?’
‘কাজ কিছু নেই, ভ্রমণে বেরিয়েছি।’
‘বেশ বেশ। ভ্রমণ-রমণের এই তো বয়স। চল, তোমাকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যাই।’
উৎফুল্ল বিম্বাধর বজ্রকে লইয়া উত্তর দিকে চলিল।
এই সময় আবার বংশীরব শুনা গেল। রানী শিখরিণী পূজা দিয়া ফিরিতেছেন; আন্দোলিকার পাশে দাসী কুহু রিক্তহস্তে যাইতেছে। বজ্রের কাছাকাছি আসিয়া আবার দোলার দুকূল-আচ্ছাদন উঠিয়া গেল; রানী শিখরিণীর তপ্ত-তীব্র চক্ষু দুটি যুগ্মতীরের ন্যায় বজ্রকে বিদ্ধ করিল। বজ্র কিন্তু একবার চক্ষু তুলিয়াই দৃষ্টি ফিরাইয়া লইল, আর ওদিকে তাকাইল না।
দোলা দক্ষিণে রাজপুরীর দিকে চলিয়া গেল। বজ্র ও বিম্বাধর বিপরীত মুখে চলিল। তাহারা জানিতে পারিল না, দোলা কিছুদূর যাইবার পর রানী শিখরিণী কুহুকে চোখের ইশারা করিলেন; কুহু অমনি দোলার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া বজ্রের পিছু লইল। চাঁপা রঙের উত্তরীয়টি মাথার উপর টানিয়া একটু আড়-ঘোমটা দিয়া মিষ্ট-দুষ্ট হাসিতে হাসিতে সন্তর্পণে বজ্রের অনুসরণ করিল।
বিম্বাধর বজ্রকে লইয়া এপথ ওপথ ঘুরিয়া শেষে নগরের উত্তর-পশ্চিম কোণে এক জনবিরল পাটকে উপস্থিত হইল। পথটি অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ, গৃহগুলি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গৃহ। পথের শেষ প্রান্তে নগরপ্রাকারের কাছে একটি মদিরা-ভবন।
মদিরা-ভবনে দিনের পূর্বাহ্ণে গ্রাহকের ভিড় ছিল না, শৌণ্ডিক মেঝেয় বসিয়া পিঁড়ির উপর ছক কাটিয়া এক প্রতিবেশীর সহিত কড়ি চালিতেছিল। মদিরা-ভবনটি শুধু পানশালা নয়, অড্ঢ খেলার আড্ডাও বটে, আবার বহিরাগত পথিকের চটি। সম্মুখের ঘরটি বড়, আশেপাশে কয়েকটি ছোট ছোট কুঠুরী আছে।
শৌণ্ডিক লোকটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, শুষ্কদেহ, বিরলদন্ত। বিম্বাধর ও বজ্র প্রবেশ করিলে সে স্বভাব-রক্তবর্ণ চক্ষু তুলিয়া চাহিল। বিম্বাধর বলিল— ‘বটেশ্বর, তোমার জন্য গ্রাহক এনেছি। ইনি কানসোনায় নূতন এসেছেন, কিছুদিন থাকবেন। তাই তোমার আড্ডায় নিয়ে এলাম।’
বটেশ্বর উঠিয়া দাঁড়াইল, বজ্রকে আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া বিম্বাধরের পানে চক্ষু ফিরাইল। বিম্বাধর একটু ঘাড় নাড়িল। তখন বটেশ্বর পানের ছোপ-ধরা দাঁত বাহির করিয়া হাসিল, জাঁতার ঘর্ঘর শব্দের মত ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ঘষা-ঘষা গলায় বলিল— ‘আসতে আজ্ঞা হোক। আমার ঘর আপনার ঘর, যতদিন ইচ্ছা থাকুন।’
বজ্র একটি রৌপ্যমুদ্রা বটেশ্বরের হাতে দিয়া বলিল— ‘এতে কতদিন চলবে?’
সসম্ভ্রমে মুদ্রা কপালে ঠেকাইয়া বটেশ্বর বলিল— ‘এক মাস। স্বতন্ত্র ঘর পাবেন, তাছাড়া পান আহার শয়ন সেবা।’
বটেশ্বর বজ্রকে লইয়া গিয়া একটি প্রকোষ্ঠ দেখাইল। প্রকোষ্ঠটি গৃহের এক প্রান্তে, বাহিরে যাইবার স্বতন্ত্র দ্বার আছে। আকারে ক্ষুদ্র ও নিরাভরণ, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বজ্র কক্ষটি মনোনীত করিল। তখন বটেশ্বর ভৃত্য ডাকিয়া মেঝের উপর উত্তম শয্যা পাতিয়া দিল, জলের নূতন কলস ভরিয়া ঘরের এক কোণে রাখিল, দীপদণ্ডের শীর্ষে তৈলপূর্ণ প্রদীপ আনিয়া অন্য কোণে রাখিল। ব্যবস্থা দেখিয়া বজ্র প্রীত হইল।
বিম্বাধর বলিল— ‘ভাই মধুমথন, চিন্তা কোরো না, তুমি সুখে থাকবে। বটেশ্বর পাকা সহিআর, ওর বাপের নাম ঘটেশ্বর, ঠাকুর্দার নাম ষণ্ডেশ্বর— ওরা তিন পুরুষে আড্ডাধারী। তোমার কোনও অযত্ন হবে না, যখন যা চাইবে হাতের কাছে পাবে। এমন কি—’ বলিয়া অর্থপূর্ণভাবে চোখ টিপিল।
বিম্বাধরের সরস ইঙ্গিত বজ্র বোধহয় বুঝিল না, সে বলিল— ‘ভাল।’
বিম্বাধর বলিল— ‘এখন তবে চললাম। কিন্তু আবার আসব। তুমি নূতন মানুষ, নগরের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে তো।’
বিম্বাধর যে আবার আসিবে, তাহার এত সহৃদয়তা নিঃস্বার্থ নয়, তাহা বজ্র বুঝিয়াছিল, সে একটু হাসিল। তারপর বিম্বাধর গমনোদ্যত হইলে সে বলিল— ‘একটা কথা। কানসোনার দক্ষিণে গঙ্গার তীরে এক ব্রাহ্মণ থাকেন— নাম কোদণ্ড মিশ্র। তাঁকে চেন কি?’
বিম্বাধর বলিল— ‘বামুন? চালকলা? তার সঙ্গে তোমার কী প্রয়োজন?’
বজ্র বলিল— ‘প্রয়োজন নেই। পুরনো পরিচয় আছে।’
বিম্বাধর মাথা নাড়িল— ‘কোদণ্ড মিশ্র? কৈ না, কখনও নাম শুনি নি। বটেশ্বর, তুমি চেনো?’
বটেশ্বর বলিল— ‘না। ব্রাহ্মণ মহোদয়েরা আমার আড্ডায় পায়ের ধুলো দেন না, চিন্ব কি করে?’
অতঃপর বিম্বাধর আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া বিদায় হইল।
মদিরা-ভবনের বাহিরে একটি গাছের আড়ালে কুহু দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। সে দেখিল বিম্বাধর চলিয়া গেল, কিন্তু বজ্র বাহির হইল না। কুহু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিল, কিন্তু বজ্র আসিল না। তখন সে নিশ্চিন্ত হইয়া ফিরিল। বজ্র কোথায় থাকে এইটুকুই আপাতত তাহার জানার প্রয়োজন ছিল।
বজ্রের নাগরিক জীবনযাত্রা আরম্ভ হইল। কর্মহীন অলস দিনগুলি একে একে কাটিতে লাগিল।
মদিরা-ভবনের পিছনে অনতিদূরে ময়ূরাক্ষী ও ময়ূরীর মিলিত স্রোত বহিয়া গিয়াছে, নদীর ধারে ধারে প্রশস্ত বাঁধ। দুই চারিটি ঘাটও আছে, কিন্তু ঘাটের কোনও শোভা নাই। গঙ্গার ঘাট ছাড়িয়া স্বল্পতোয়া নদীতে বড় কেহ স্নান করিতে আসে না।
বজ্র মাঝে মাঝে নির্জন বাঁধে গিয়া বসিত। মৌরীর খাত আঁকিয়া বাঁকিয়া দূরে মিলাইয়া গিয়াছে, সেই দিকে চাহিয়া থাকিত। সে বেতসগ্রাম ত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু মৌরী নদী তাহাকে ত্যাগ করে নাই। বাঁধের উপর দিয়া সে নগরসীমা পার হইয়া ময়ূরাক্ষী ও মৌরীর সঙ্গমস্থলে যাইত, মৌরীর উপল-বিকীর্ণ তীরে হাঁটু গাড়িয়া অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিত। মৌরীর জলের চিরপরিচিত স্বাদ মুখে বড় মিষ্টি লাগিত। গ্রামের জন্য হঠাৎ প্রাণ কাঁদিয়া উঠিত।
কিন্তু তবু সে কর্ণসুবর্ণের মায়া কাটাইয়া বেতসগ্রামে ফিরিয়া যাইতে পারিত না। প্রত্যহ তাহার মনে হইত, কেন এই নির্বান্ধব পুরীতে পড়িয়া আছি? পিতার সংবাদ পাইয়াছি, তিনি জীবিত নাই; তবে এখানে থাকিয়া লাভ কি? ফিরিয়া যাই, যেখানে মা আছেন, গুঞ্জা আছে সেই স্নেহের নীড়ে ফিরিয়া যাই। — কিন্তু তবু সে যাইতে পারিত না; কর্ণসুবর্ণ নগর অদৃশ্য মায়াজাল বিস্তার করিয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিত।
কবি বিম্বাধর প্রথমে ঘন ঘন আসিত। বজ্রকে লইয়া সে রাজপুরী দেখাইল, নাটকের অভিনয় দেখাইল, বিদগ্ধ-স্ত্রীর নৃত্যগীত শুনাইল, নানাভাবে তাহাকে আমোদ-প্রমোদে আসক্ত করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু ক্রমে সে বিরক্ত হইয়া উঠিল। বজ্রের ললিত-বনিতার প্রতি লোভ নাই, মদ্যপানে আসক্তি নাই, দ্যূতক্রীড়ায় অনুরাগ নাই। এরূপ অরসিক অসামাজিক মানুষের পিছনে কতদিন ঘুরিয়া বেড়ানো যায়! বিম্বাধর আসা-যাওয়া কমাইয়া দিল! কিন্তু একেবারে বন্ধ করিতে পারিল না। বজ্রের বাহুতে পাথরের মত ভারী অঙ্গদটির কথা সে ভুলিতে পারে নাই।
বটেশ্বরের মদিরা-ভবনে বজ্রের অশন বসনের কোনও অসুবিধা ছিল না। অপরাহ্ণে মদিরা-ভবনে যখন জনসমাগম হইত, মদ্যপায়ীরা সুরাভাণ্ডসহ ভর্জিত পর্পট ও ইল্লীশ মৎস্য লইয়া বসিত, দ্যূত-ব্যসনীরা হলহল্ল করিয়া কড়ি চালিত ও বিতণ্ডা করিত, তখন বজ্র নিজ প্রকোষ্ঠের দ্বারে শিকল তুলিয়া দিয়া বাহির হইয়া পড়িত। কখনও পথে পথান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইত, কদাচ প্রাকারে উঠিয়া ইতস্তত বিচরণ করিত। প্রাকারে রক্ষী নাই, সংস্কারের অভাবে স্থানে স্থানে জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। কেহ কিছু দেখে না, নগর শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইলে নগর রক্ষার কথা কেহ চিন্তা করে না। সর্বত্র অবহেলার চিহ্ন।
বজ্র দুই একবার রাজপুরীর দিকেও গিয়াছিল। প্রাকারবেষ্টিত বিশাল পুরী; তোরণদ্বারে দুই চারিজন প্রহরী আছে বটে কিন্তু তাহারা নিজেদের মধ্যে রহস্যালাপ করিতেছে, যে-সকল নরনারী তোরণপথে যাতায়াত করিতেছে তাহাদের সহিত রঙ্গ পরিহাস করিতেছে। বজ্র পথে দাঁড়াইয়া ভীমকান্ত দুর্গপ্রাসাদ নিরীক্ষণ করিত আর ভাবিত— এই গড় আমার পিতামহ গড়িয়াছিলেন— আমার পিতা এই গড় রক্ষা করিতে প্রাণ দিয়াছিলেন! নিশ্বাস ফেলিয়া সে ফিরিয়া আসিত।
অধিকাংশ দিন বজ্র হাতিঘাটে গিয়া বসিত। সায়ংকালে হাতিঘাট বিচিত্র জনসমাবেশে মুখর ও বর্ণাঢ্য হইয়া উঠিত। পুরুষ নারী বালক বৃদ্ধ; কেহ স্নান করিতে আসিয়াছে, কেহ বায়ু সেবনের জন্য। কদাচিৎ রাজার হাতি স্নানের জন্য ঘাটে আনীত হইত। হাতিরা গভীর জলে জলক্রীড়া করিত, শুঁড়ে জল ভরিয়া পরস্পরের গায়ে জল ছিটাইত।
নানা লোকের নানা কথা বজ্রের কানে আসিত। বেশির ভাগ জল্পনা ব্যবসা-বাণিজ্য লইয়া। গৌড়ের সামুদ্রিক বাণিজ্য রসাতলে যাইতেছে, কেহ আর পণ্য লইয়া সমুদ্রে যাইতে সাহস করে না। রাজা ও রানী সম্বন্ধে কেহ কেহ শ্লেষপূর্ণ বক্রোক্তি করিত। বজ্র এই সব কথা শুনিত এবং দেশের অবস্থা সম্বন্ধে একটা ধারণা করিবার চেষ্টা করিত।
ঘাটে বাঁধা সমুদ্রতরীগুলিও বজ্র লক্ষ্য করিত। দিনের পর দিন বিপুলকায় বহিত্রগুলি ঘাটে পড়িয়া আছে; মাঝি-মাল্লা নাই, গুণবৃক্ষে পাল নাই। উত্তর হইতে দুই চারিটি বাণিজ্যপোত আসে বটে কিন্তু তাহারা আবার উত্তরে ফিরিয়া যায়, সমুদ্রের দিকে যায় না।
এইভাবে ঘাটে বসিয়া বজ্রের সন্ধ্যা কাটিয়া যাইত। অন্ধকার নামিয়া আসিলে ঘাটের জনসংঘ ছায়াবাজির ন্যায় মিলাইয়া যাইত। বজ্র শূন্য ঘাট হইতে ফিরিয়া চলিত।