এটাও গেল? বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালে হেলান দিল লিলি। দাঁড়িয়ে থাকার জোর পাচ্ছে না যেন।
বেশিক্ষণ হয়নি, কিশোর বলল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল আরেকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড় জেসন। ওকে বলল সে, ইউনিকর্ন আর হারিকেন দুটোকেই চুরি করেছে বেনি।
হারিকেনের খালি স্টলটার দিকে তাকাল ব্রড়। কি বলছ?
লিলি বলল, কিশোরের ধারণা, ঘোড়াদুটোকে অদলবদল করা হয়েছিল। হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, বেনি, ইউনিকর্নকে হারিকেনের স্টলে ঢুকিয়ে রেখে। যেটাকে হারিকেন ভাবা হয়েছে আসলে সেটা ছিল ইউনিকর্ন।
অসম্ভব! দুটো ঘোড়ার স্বভাবই আলাদা!
কিশোর যা বলেছে সব ব্রডকে খুলে বলল লিলি। শেষে বলল, কিশোর বলছে, এসবে তুমিও জড়িত আছ।
ওকে আগেই বলেছি আমি এসবে নেই, জোর গলায় বলল ব্রড়। বেনিও নেই।
বেশ, তাহলে প্রমাণ করুন, এগিয়ে এল কিশোর। কোথায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখেছে বেনি, আন্দাজ করার চেষ্টা করছে সে। চলুন, ঘোড়াগুলোকে বের করে আনি।
বলতে দ্বিধা করল না ব্ৰড়, চলো।
গুড। এবার বলুন তো, বেনির প্রাইভেট কোরালটা কোথায়? যেখানে সে প্র্যাকটিস করে?
কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে এই বার দ্বিধা করল ব্ৰভ। বেনি রাগ করবে। আমি ওকে ঘোড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও বলেছে দেখেনি।
প্র্যাকটিস কোথায় করে? ব্রডের কথার গুরুত্বই দিল না কিশোর।
আবার দ্বিধা করল ব্রড। মিস্টি ক্যানিয়নের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ের ভেতরে। একটা প্রাকৃতিক ঘের রয়েছে, একেবারে বেড়া দেয়া কোরালের মতই।
ওদিকটায় তো গিয়ে খুঁজে এসেছে লুক, কিশোরকে জানাল লিলি, পায়নি। বেনির সাথেও কথা বলেছে…
শুনল না কিশোর। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়া রাখার কোন জায়গা আছে ওখানে? ঘরটর?
খড়ের একটা ছাউনি শুধু, ব্রড জবাব দিল। তবে দুটো ঘোড়া সহজেই জায়গা হয়ে যাবে।
রবিন বলল, হয়তো ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল হারিকেনকে বেনি। লুকের লোকেরা খেয়াল করেনি। কিংবা কল্পনাই করতে পারেনি বেনি নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবে। অনুমতি ছাড়া প্রাইভেট এলাকায় ঢুকে বিপদে পড়তে চায়নি।
শোনো… বলতে গিয়ে বাধা পেল ব্রড।
কিশোর তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেখানে কি করে যেতে হয়?
তুমি পারবে না। রাস্তা নেই। ঝড়বাদলার রাত। খুঁজেই পাবে না।
ও ঠিকই বলেছে, লিলি বলল কিশোরকে। পাহাড়গুলো তো আমি চিনি। এমন রাতে যাওয়াই মুশকিল। বনের ভেতর দিয়ে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, নদীর ধার দিয়ে যেতে হয়।
কোন নদী? জানতে চাইল কিশোর, যেটার কাছে গিয়ে হারিকেনকে হারিয়ে যেতে দেখেছি?
হ্যাঁ। ওটার কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা খড়িমত আছে, ওখানেই।
আর কিছু জানার নেই আমার। বলেই রবিনের দিকে ঘুরল কিশোর, শেরিফের অফিসে ফোন করো। বলবে এখানে আর কুপার র্যাঞ্চে যেন অফিসার পাঠান।
তুমি কি করবে? জিজ্ঞেস করল ব্রড।
আমি যাচ্ছি বমাল চোর ধরতে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, মুসা, চলো জলদি।
ওদের পিছে পিছে এল লিলি। কিশোর, দাঁড়াও। এখন যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ওই পাহাড়গুলোকে তোমরা চেনো না। সাংঘাতিক বিপদে পড়বে।
বিপদকে ভয় করলে চোর ধরতে পারব না। তাছাড়া এরকম কাজ করে অভ্যাস আছে আমাদের। আকাশ চিরে দিল বিদ্যুৎ শিখা। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কিশোর বলল, এমনিতেই হয়ত দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়াসহ চোর ধরতে না পারলে আর তাকে ধরা যাবে না। প্রমাণও করতে পারব না কিছু। এই একটাই সুযোগ আমাদের।
আস্তাবলে ঢুকল কিশোর আর মুসা। যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগল। আগেরগুলোই নিল, কিশোরের জেনারেল উইলি, মুসার ক্যাকটাস। বেল্টের বাকলস আঁটতে আঁটতে কিশোর বলল, তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের। একটাই ভরসা, ইউনিকনের পিঠে চড়তে পারবে না চোর। যতই ওষুধ খাওয়ানো হোক।
ইউনিকর্নকে মেরেটেরে ফেলবে না তো?
কিছুই বলা যায় না। রাশ ধরে টেনে জেনারেলকে বাইরে নিয়ে এল। কিশোর। পিঠে চেপে বসল।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ছুটল দুই ঘোড়সওয়ার। আগে আগে চলেছে কিশোর, হাতে টর্চ। মুসার কাছেও টর্চ আছে, কিন্তু জ্বালছে না। তেমন প্রয়োজন না পড়লে জ্বালবে না। অহেতুক ব্যাটারি খরচ করতে চায় না।
বৃষ্টি ভেজা মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকল দুটো ঘোড়া। বনের ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চেনা পথ, তবুও ভুল হয়ে যেতে চায়। এসব কাজে মুসা কিশোরের চেয়ে পারদর্শী। কাজেই এখন আগে আগে চলল সে।
গাছের ডালে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। পাহাড়ের ঢালে উঠে কয়েকবার করে। পা পিছলাল দুটো ঘোড়াই। বন পেরিয়ে খোলা জায়গা। চলে এল ওরা সেই শৈলশিরাটায়, যেখানে অদৃশ্য হয়েছিল হারিকেন। ঢাল বেয়ে নদীর পাড়ে নামাটাই হল সবচেয়ে কঠিন। জেনারেল উইলির মত ভাল ঘোড়াও নামতে রাজি হতে চাইল না। জোরজার করেই নামাতে হলো।
তবে নামল নিরাপদেই।
নদীর পাড়ে ঘোড়ার পায়ের তাজা ছাপ দেখে আশা বাড়ল কিশোরের। তবে পাশে মানুষের পায়ের ছাপ নেই। অবাক কাণ্ড! তাহলে কি ইউনিকনের পিঠে চড়েই গেছে? সেটা করে থাকলে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে। যেভাবেই যাক, তার অনুমান। ঠিক, বেনির কোরালের দিকেই গেছে চোর।
নদীর পাড় ধরে পশ্চিমে এগোল দুজনে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে পাহাড়ের মাথায়। মুষল ধারে ঝরছে বৃষ্টি। কিশোরের মনে হলো হাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। ঠাণ্ডা।
নদীর কাছ থেকে সরে এল পথ। তবে চিহ্ন দেখে এগোতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে গেছে মাটি। তাতে স্পষ্ট বসে আছে খুরের তাজা দাগ।
ঘন বনের ভেতরে ঢুকল আবার ওরা।
হঠাৎ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাকটাস। জেনারেল উইলি থামল তার পেছনে। নিশ্চয় কিছু আঁচ করেছে। টর্চের আলোয় কিছু দেখা গেল না। ঘোড়া। দুটোকে আবার আগে বাড়ার নির্দেশ দিল দুজনে।
তবে বেশি দূর আর যেতে হলো না। গিরিখাতের ভেতরে বেড়া আর গেট দেখা গেল। তিনপাশে পাহাড়ের দেয়াল, আরেক পাশে বেড়া দিয়ে ঘিরে কোরাল তৈরি করা হয়েছে। গাছপালা নেই ভেতরে। জানা না থাকলে জায়গাটা সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কল্পনাই করবে না কেউ এখানে এরকম একটা কোরাল রয়েছে।
আরও কাছে গিয়ে র্যাসিংট্রাক দেখা গেল। কিছু তেলের খালি ড্রাম রয়েছে, ব্যারেল রেসিঙে ব্যবহারের জন্যে। আর একধারে পাহাড়ের গা ঘেষে ঘন গাছের জটলার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ল খড়ের ছাউনির চালার সামান্য একটুখানি।
ফোঁস ফোঁস করছে জেনারেল। ঘোড়াটাকে আর এগোতে বলল না কিশোর। নেমে পড়ে লাগাম বাধল বেড়ার একটা খুঁটিতে। মুসাও নামল।
পা টিপে টিপে এগোল দুজনে কাদা মাড়িয়ে।
গাছগুলোর কাছাকাছি আসতেই ভেতরে শোনা গেল ঘোড়ার ডাক। আর। কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে। তেলচিটে গন্ধ এসে লাগল নাকে।
প্রথমেই টর্চের আলো পড়ল একটা কালো ঘোড়ার ওপর। ভেজা শরীর। টপটপ করে পানি ঝরে পড়ছে গা থেকে। ইউনিকর্ন। মুসার টর্চের আলো পড়ল আরেকটা ঘোড়ার ওপর। ওটার গা শুকনো। হারিকেন। আরও একটা ঘোড়া দেখা গেল, ওটাও পরিচিত, ওটারও গা ভেজা।
একটা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল একজন মানুষ।
ডেকে বলল কিশোর, আর লুকিয়ে লাভ নেই, বেনি, বেরিয়ে আসুন।
বেরিয়ে এল বেনি। পরনে সাধারণ জিন্স আর শার্ট। ঘোড়সওয়ারের পোশাক নয়, যাতে লোকের সন্দেহ হতে পারে। তবে কোমরের বেল্টটা নজর এড়াল না। কিশোরের। রুপার বাকলসওয়ালাটাই পরেছে।
মুখের পানি মুছে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এটা দিয়েই আমাকে বাড়ি মেরেছিলেন, তাই না?
জবাব দিল না বেনি। বিমূঢ় হয়ে গেছে। চোখে ভয়। কল্পনাই করতে পারেনি এই বাদলার রাতে তার পিছু নেবে দুই গোয়েন্দা।
.
পালানর চেষ্টা করেনি বেনি। বুঝতে পেরেছে, পালিয়ে লাভ নেই। দুর্ভাগ্যটা মেনে নিল। তাকে আর চোরাই ঘোড়াদুটোকে নিয়ে ফিরে চলেছে কিশোর আর রবিন। নদীর পাড় থেকে ওপরে উঠতেই চোখেমুখে এসে পড়ল উজ্জ্বল আলো। দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল ঘোড়সওয়ার।
রবিন এসেছে স্যাণ্ডির পিঠে চড়ে, অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে পা ঠুকছে ঘোড়াটা। বড় একটা ঘোড়ায় চড়ে এসেছে লিলি। ব্রড আর লুকও এসেছে ওদের সাথে। আরও একজন আছেন, ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড।
ব্রড বলল, বেনি, আমি কল্পনাই করতে পারিনি… কথা আটকে গেল তার।
জবাব দিল না বেনি। পাথর হয়ে গেছে যেন। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
লিলি বলল ব্রডকে, থাক, এখন আর কথা বলে লাভ নেই। বাড়ি চলো।
.
পরদিন ডাবল সিতে আবার এলেন ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড। আকাশে মেঘ আছে এখনও, তবে আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। মাটি ভেজা। বাতাস খুবই তাজা আর পরিষ্কার। সামনের বারান্দায় বসে আছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা। লেমোনেড খাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলেন ফোর্ড। ভাবলাম, তোমাদেরকে খবরটা দিয়েই যাই। শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছ হয়তো। বেনিকে ধরা হয়েছে। সব কথা স্বীকার করেছে সে। ব্রড জেসন এতে জড়িত নেই।
আমি জানতাম, খুশি হলো লিলি। ও আমাকে সত্যি কথাই বলেছে।
ঘোড়াগুলোকে অদলবদল লিলি একাই করেছে, হারিকেনের পিঠে চড়ে নিয়ে গেছে, ঠিক কিশোর যা সন্দেহ করেছিল। গাড়ির নিচে বাজিও সে-ই রেখেছে, কিশোরের ব্যাগে সাপ ঢুকিয়েছে। রোজই এখানে আসত ব্রডের সাথে দেখা করতে, ওই সময়ই করেছে অকাজগুলো। ঘোড়াকে ওষুধ খাওয়ার সময় আরেকটু হলেই ওকে ধরে ফেলেছিল কিশোর, বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরে যদি তোমাকে বেহুশ করে না ফেলত সে।
ব্যানারদের জিনিসগুলো কে চুরি করেছিল? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ও-ই। তোমরা সবাই তখন বাইরে ছিলে। নোটটাও সে-ই টাইপ করেছে। তার বাবার টাইপরাইটার দিয়ে। স্বীকার করেছে।
ফিলিপ নিরেক আর ডবসি কুপার তার মানে কিছুই করেনি?
গ্লাসে লেমোনেড ঢেলে বাড়িয়ে দিল লিলি। হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন। ফোর্ড। করেনি কথাটা ঠিক না। শয়তানী তো কিছু করেছেই লিলির সঙ্গে। তবে ঘোড়া চুরির ব্যাপারে ওদের কোন হাত ছিল না। নিরেকের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন ব্যাংকের ম্যানেজার। সে যেভাবে যা করছিল পছন্দ হচ্ছিল না তার। আরও অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, কানে এসেছে ম্যানেজারের। দুএকজন গিয়ে রিপোর্টও করেছে। এমনিতেই নিরেকের ওপর একটা অ্যাকশন নিতেন ম্যানেজার, এখন তো কথাই নেই। পাইকও অনেক শত্রু তৈরি করে। ফেলেছে এই এলাকায়। শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা সন্দেহ। এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক, গ্লাস খালি করে ফেললেন ডেপুটি। লিলির দিকে ফিরলেন। বেনি কুপারের বিরুদ্ধে নালিশ করতে চাও?
কাল রাতে ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে, লিলি বলল। নালিশ করলেই তাকে জেলে ভরবেন। প্রতিযোগিতায় আর নামতে পারবে না। আমি চাই, ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। জিততে পারলে জিতবে।
হাসলেন ডেপুটি। বড় বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হয় তোমার?
কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল লিলি। ওর সাথে একটা বোঝাঁপড়া করার ইচ্ছে আছে আমার। সেটা রোডিওতেই ভাল হবে। হারিকেনকে ফিরে পেয়েছি যখন, আমার বিশ্বাস ভালমতই একটা মার দিয়ে দিতে পারব। সুযোগটা করে দেয়ার জন্যে কিশোরের কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকলাম।