দীপ্তেন ভৌমিক বলছিল, আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি ডলি। ইউরোপ–
–আমাকে সঙ্গে নেবে দীপু?
—তোমাকে! না বাবা, ওসবের মধ্যে আমি আর নেই, শেষটায় জীবন দত্ত আমার নামে কে ঠুকে দিক আর কি। একে সুরজিৎ ঘোষালের ঝামেলায় নাস্তানাবুদ হচ্ছি
—কেন, পুলিস তোমাকে মালঞ্চ-হত্যার ব্যাপারে খুব নাস্তানাবুদ করছে বুঝি?
—আর বল কেন—
-তুমি তো আমার কথা শোননি। কতবার বলেছি ওর সঙ্গে মিশো না অত, তা তুমি রোজই ওখানে যেতে–
—শুধু আমি কেন, তুমি যেতে না? ডাঃ সমীর রায় যেতেন না?
—তা তো সকলেই যেতাম। কিন্তু তোমার সঙ্গে মালঞ্চর ঘনিষ্ঠতা ছিল–।
–বাজে বকো না। একটা ক্যারেক্টারলেস উওম্যান–
তার জন্যেই তো তুমি হেদিয়ে মরতে দীপ্তেন।
–She was a fool! সে ভাবত আমি বুঝি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি, কিন্তু মোটেই তা নয়, আমি তাকে ঘৃণা করতাম।
–বাজে কথা বলো না। আমি জানি দীপ্তেন।
–কি জানো?
সেরাত্রে দু-দুবার গিয়েছিলে তুমি মালঞ্চর ঘরে—
–তুমি জানো?
-আমি জানি। মনে আছে, সেরাত্রে আমাকে নিয়ে তোমার দি রিট্রিটে ডিনার খাবার কথা ছিল, অথচ রাত সোয়া এগারোটা পর্যন্ত যখন তুমি এলে না–
-তুমি বিশ্বাস কর—আমি একটা বিশেষ কাজে আটকা পড়েছিলাম।
—তাও জানি বৈকি, আর সেই বিশেষ কাজে মালঞ্চর বাড়িতেই যে আটকা পড়েছ তাই ভেবেই তো আমি মালঞ্চর বাড়ি যাই–
—তুমি—তুমি মালঞ্চর বাড়িতে গিয়েছিলে ডলি!
-হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা হবে। তুমি আমায় দেখনি, আমি যখন পিছনের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বাথরুমের মধ্যে দিয়ে মালঞ্চর ঘরে গিয়ে ঢুকি, তখন she was dead!
–কি বলছ তুমি ডলি!
-হ্যাঁ, তার গলায় রুমালের ফাঁস লাগানো ছিল, and she was dead, আর যে চেয়ারটায় সে বসেছিল তারই সামনে, অল্প দূরে মালঞ্চর শয্যার ওপরে তোমার এই সিগারেট কেসটা আমি পাই। দেখ, চিনতে পারছ এই নাম এনগ্রেভ করা সোনার সিগারেট কেসটা? এটা বছর কয়েক আগে আমিই তোমার জন্মদিনে তোমাকে প্রেজেন্ট করেছিলাম। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম দীপ্তেন—-
—কি—কি তুমি বুঝতে পেরেছিলে?
—তুমি কিছুক্ষণ আগেও সেখানে ছিলে। রাত সাড়ে দশটায় তুমি আমাকে তোমার এই ঘর থেকে ফোন করেছিলে আধ ঘণ্টার মধ্যে তুমি ক্লাবে যাচ্ছ, আমি যেন সেখানেই চলে যাই। আমি চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার আগে রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ একবার তোমার বাড়িতে ফোন করে আমি তোমার চাকর বামাপদর কাছ থেকে জেনেছিলাম যে তুমি হিন্দুস্থান রোডে গিয়েছ। বলে গিয়েছ, তুমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরবে।
—কিন্তু ডলি—
—শোন, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি সোয়া এগারোটা পর্যন্ত ক্লাবে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে প্রথমে এখানে আসি, এসে শুনলাম সাড়ে নটা নাগাদ তুমি এসে আবার বের হয়ে গিয়েছ। তোমার এখান থেকে ট্যাক্সিতে দি রিট্রিট মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা, কাজেই ক্লাবে গেলে তোমার ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল—
–আমার অন্য জায়গায় কাজ ছিল, তাই–
-সে কাজ তোমার মালঞ্চর ওখানেই ছিল। সেই রকম সন্দেহ হওয়ায় আমি গাড়ি নিয়ে সেখানেই যাই। একটু দুরে গাড়িটা পার্ক করে পিছনের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে মালঞ্চর ঘরে যাই। এখন বুঝতে পারছ, তুমি যে সেরাত্রে দুবার মালঞ্চর ঘরে গিয়েছিলে কি করে আমি বুঝেছিলাম।
–কিন্তু তুমি–তুমি বিশ্বাস কর ডলি, আমি, মালঞ্চকে হত্যা করিনি–
—কিন্তু তোমার এই সিগ্রেট কেস সেখানে কি করে গেল দীপ্তেন! আমি যদি পুলিসকে এটা জানিয়ে দিই, তাদের তুমি কি বলে বোঝাবে?
-শোন, তাহলে সব কথাই তোমাকে বলছি। সেরাত্রে দ্বিতীয়বার বিশেষ একটা কারণে মালঞ্চর ঘরে আমাকে যেতে হয়। সেরাত্রে সাড়ে দশটা নাগাদ আমার ফ্ল্যাটে তার আসার কথা ছিল, কিন্তু সোয়া এগারোটা নাগাদও যখন সে এলো না, তখন আমি দ্বিতীয়বার তার ওখানে যাই
–So you did! তুমি দ্বিতীয়বার ওখানে গিয়েছিলে, স্বীকার করছ দীপ্তেন?
-হ্যাঁ গিয়েছিলাম, but she was dead at that time, বিশ্বাস কর, I found her dead, strangled, রুমাল বাঁধা তার গলায়, ঘটনার আকস্মিকতায় I was so much perturbcd যে আমি ধপ করে বিছানাটার ওপরে বসে পড়ি, now what to do! আর ঠিক সেই সময়ে ঘোরানো সিঁড়িতে আমি কার যেন পদশব্দ পাই, পাছে কেউ এসে আমাকে ঐ সময় ঘরের মধ্যে দেখতে পায় সেই ভয়ে আমি খাটের নীচে ঢুকে পড়ি।
–A nice story–বল-বলে যাও।
—Story! Its a fact, সত্যি। তুমি ঘরে এলে, মালঞ্চকে মৃত দেখে তুমি অর্ধস্ফুট গলায় চেঁচিয়ে উঠলে, তারপরেই বের হয়ে গেলে ঘর থেকে, যে পথে এসেছিলে সেই পথে। আমিও সেই পথে তোমার পিছু পিছু বের হয়ে আসি। তারপর সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে রাত বারোটার দুচার মিনিট আগে ক্লাবে যাই, তুমি তখন সেখানে বসে ড্রিংক করছিলে। বিশ্বাস কর ডলি, আমি তোমাকে যা বললাম তার একবর্ণও মিথ্যা নয়। কি হল, উঠছ কেন——ডলি, সত্যিই কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না, ডলি শোন—
টেপটা বাজিয়ে শুনছিলেন মিঃ চট্টরাজ, কিরীটী ও সুশীল চক্রবর্তী—লালবাজারে মিঃ চট্টরাজের অফিস কামরায়।
–শুনলেন তো সব মিঃ চট্টরাজ, কিরীটী বলল, এ থেকে অন্তত দুটো ব্যাপার প্রমাণিত হচ্ছে—প্রথমত, সোয়া এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই কোন এক সময় মালঞ্চ দেবীকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়। আর দ্বিতীয়ত, সেরাত্রে সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা বা পৌনে বারোটা পর্যন্ত দীপ্তেন ভৌমিকের movement suspicious, ঐ সময়টা ওকে ঘিরে একটা সন্দেহের কুয়াসা জমাট বেঁধে আছে।
—আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়, চট্টরাজের প্রশ্ন, ঐ দীপ্তেন ভৌমিক ডলি দত্তর কাছে মিথ্যা কথা বলেছে?
–শুধু সে কেন, ডলি দত্তও মিথ্যা বলে থাকতে পারে। যাক গে সে কথা আমার মনে হচ্ছে আমি যেন অন্ধকারের মধ্যে আলোর ইশারা দেখতে পাচ্ছি একটু।
–কি রকম?
—দেখা যাচ্ছে সেরাত্রে অকুস্থলে প্রথমে সুরজিৎ ঘোষালের আবির্ভাব ও নাটকীয় ভাবে প্রস্থান, তার আগে দীপ্তেন ভৌমিকের প্রথম আবির্ভাব ও পরে রাত্রি সোয়া এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে দ্বিতীয়বার আবির্ভাব ঘটেছিল, ঐ সময়েই আবির্ভাব ঘটেছিল আরো একজনের, যেটা আমরা শুনেছি একটু আগে টেপ থেকে, শ্ৰীমতী ডলি দত্তর এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্বিতীয়বার দীপ্তেন ভৌমিক ও ডলি দত্তর আবির্ভাব ঘোরানো সিঁড়ির পথে। এখন আমাদের দেখতে হবে সে রাত্রে ঘোরানো সিঁড়িপথে ঐ তিনজন ছাড়া আর কার ঐ ঘরে আবির্ভাব ঘটেছিল। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো জানবেন that is the person we are searching for, তাকেই আমরা খুঁজছি, মালঞ্চ হত্যারহস্যের মেঘনাদ।
—ঐ তিনজন ছাড়া সেরাত্রে ঐ ঘরে আর কে যেতে পারে বলে আপনার মনে হয় দাদা? হঠাৎ সুশীল চক্রবর্তী কিরীটীকে প্রশ্নটা করলেন।
কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয় সুশীল, who else–সুরজিৎ ঘোষাল?
—না, তিনি যাননি। তুমি নিশ্চিন্ত মনে তোমার ঐ তালিকা থেকে তাকে বাদ দিতে পারো! দেখ সুশীল, সাধারণ কমন সেন্স অনুযায়ী ভেবে দেখ—সেটা সুরজিৎ ঘোষালের রক্ষিতার ঘর, এবং মালঞ্চ সুরজিৎ ঘোষালেরই রক্ষিতা ছিল। সেক্ষেত্রে নিজের রক্ষিতাকে হত্যা করার প্রয়োজন হলে প্রথমত ঐ রকম crude ভাবে তিনি মালঞ্চকে হত্যা করতেন না এবং দ্বিতীয়ত সেজন্য নিজের রুমালটা তিনি নিশ্চয়ই ব্যবহার করতেন না, অন্যতম exhibit হিসাবে যেটি আদালতে পেশ করা যেতে পারে। তৃতীয়ত এবং lastly, ঐ ধরনের একটা কাজ সুরজিৎ ঘোষালের মত একজনকে দিয়ে সম্ভব হতে পারে বলে মন আমার সায় দেয় না। না, তুমি অন্য কাউকে ভাবো–
—তবে কি ঐ ডাঃ সমীর রায়?
সুশীল চক্রবর্তীর কথা শেষ হল না, তাকে একপ্রকার বাধা দিয়েই কিরীটী বললে, he is a doctor, মানুষকে হত্যা করবার অনেক উপায় জানা আছে তার, সুতরাং একজনকে ঐ ভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে সে মারবে না।
—তবে কি ডলি দত্ত?
–হতে পারে। She had a strong motive also, তার দিক থেকে imotive ও provocation দুই-ই ছিল—তারপরই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল কিরীটী।–মিঃ চট্টরাজ, আমি চলি; সুশীল তুমি যেমন এগোচ্ছিলে এগিয়ে যাও, ব্যাপারটা আদৌ খুব একটা জটিল কিছু নয়—
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আদালত কারোরই জামিন দেয়নি।
তদন্তসাপেক্ষে সুরজিৎ ঘোষাল ও মানদাকে জেলহাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আদালত এবং পরবর্তী শুনানীর তারিখ পড়েছে আবার দশদিন পরে।
সোমনাথ ভাদুড়ীর চেম্বারে বসে কিরীটীর সঙ্গে সোমনাথ ভাদুড়ীর আলোচনা হচ্ছিল মালঞ্চ হত্যা-মামলা নিয়েই।
সোমনাথ বলছিলেন, রায়মশাই, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, দীপ্তেন ভৌমিক
আর ডলি দত্তকে কেন আপনি সুশীল চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করবার পরামর্শ দিচ্ছেন না।
–প্রথমত, ওদের গ্রেপ্তার করলে উপযুক্ত প্রমাণ ও তথ্যাদির অভাবে ওদের আপনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবেন না।
—কিন্তু ঐ ট্রেপটা
–ওতে কেবল প্রমাণ করতে পারবেন দুর্ঘটনার দিন রাত্রে আগে ও পরে দীপ্তেন ভৌমিক দুবার হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে গিয়েছিল আর ডলি দত্ত একবার গিয়েছিল— তার দ্বারা প্রমাণ হবে না তারাই দুজন অথবা দুজনের একজন হত্যাকারী! ওদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে চোরাকারবারী বলে চিহ্নিত করে, এবং তারপর ঐ চোরাকারবারকে কেন্দ্র করে হত্যার ব্যাপারে আপনি আসতে পারবেন বটে, কিন্তু তখনো ঐ একই কথা থেকে যায়, প্রমাণ কই।
–আমার কিন্তু ওদের দুটিকেই সন্দেহ হয়, হত্যারহস্যের সঙ্গে ওরাও লিপ্ত।
—সেটা হতে পারে একমাত্র যদি প্রমাণ করা যায় যে ঐ চোরাকারবারকে কেন্দ্র করেই ঐ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
–সেটা কি আদালতে প্রমাণ করা যাবে না?
—সবটা আপনার জেরার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু একটা কথা তত আমাদের। ভুললে চলবে না ভাদুড়ীমশাই, দীপ্তেন ভৌমিক, ডাঃ সমীর রায় এবং ডলি দত্ত—কাউকেই এখনও আমরা চোরাকারবারী বলে প্রমাণ করবার মত উপযুক্ত তথ্যাদি পাইনি।
–আচ্ছা রায়মশাই, আপনি সুশান্ত মল্লিককে একেবারে বাদ দিচ্ছেন কেন?
—না, বাদ দিইনি। বরং বলতে পারেন আমার একটি চোখ সর্বক্ষণ তার ওপরে। রয়েছে। যেহেতু তার দিক থেকে হত্যার মোটিভ অত্যন্ত strong ছিল, তেমনি তার দিক। থেকে possibilityও যথেষ্ট ছিল, সর্বশেষে ওর একটা strong alibi রয়েছে—-হত্যার দুদিন আগে থাকতে ভদ্রকে হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতেই ছিলেন না, পুনরায় আবির্ভাব হয় তার হত্যার পরদিন সকালে রীতিমত নাটকীয় ভাবে–
–লোকটা এখন কি– ২ন রোডের বাড়িতেই আছে, তাই না রায়মশাই?
মৃদুহেসে কিরীটী বললে, যাবেই বা কোথায়, তার কোন আস্তানা নেই, সংস্থান নেই, দুমুঠো পেটের ভাতের, নেই কোন ভবিষ্যৎ, completely wrecked!