ডাইরীখানা নিয়ে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর বসবার ঘরের সোফায় গিয়ে বসল কিরীটী একটা চুরেট ধরিয়ে।
বেশী দিন নয়–বৎসর খানেক আগের তারিখ থেকে ডাইরী লেখার শুরু, তাহলেও প্রথম পাতাতেই লিখেছে মিত্রানী—ডাইরা লিখতাম সেই কবে থেকে–কিন্তু মাঝখানে কয়েক বৎসর লিখিনি, লিখতে ইচ্ছাও হয়নি কিন্তু অার থেকে আবার লিখবো ভাবছি। চমৎকার ভাইরাটী পাঠিয়েছে সজল–এমন সুন্দর মরা লেদারে বাঁধানো ডাইরীটা– দেখলেই কিছু লিখতে লোভ জাগে মনে। কিন্তু কি লিখি! কাকে নিয়ে শুরু করি আমার এই ভাইরা–দৈনন্দিন জাব-কথা! ত্রিশ বৎসর বয়স হলে– অধ্যাপনা করছি। কলেজে যাই, মেয়েদের পড়াই, অবসর সময়টা বেশীর ভাগই বই নিয়ে কাটি-একা, বড় একা লাগে। মধ্যে মধ্যে মনে হয় যেন এক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। এ যাত্রার শেষ কোথায় কে জানে?
সুহাস–সুহাস কি আজও বুঝতে পারেনি কি বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে তারই প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে চলেছি! যার জন্য অপেক্ষা করে আছি তার সাড়া নেই-অথচ যার কথা মনে পড়ে না ভুলেও কখনো, সে একটার পর একটা চিঠি লিখে চলেছে।
সজল, আমি বুঝি, তুমি স্পষ্ট করে না লিখলেও বুঝতে পারি, তোমার ঐ কথার গাঁথুনির ফাকে ফাকে বিশেষ কোন কথার্টি তোমার মনের মধ্যে উঁকি দিতে চাইছে।
কিন্তু আমি যে অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে বসে আছি। কাউকেই আর দেবার মত যে অবশিষ্ট কিছুই নেই। বাবা এতদিন পর্যন্ত কখনো আমার বিয়ের কথা বলেননি—কিন্তু গতরাত্রে বলছিলেন, একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পেয়েছি মা–সন্ধানও ঠিক নয়, পাত্রপক্ষই এগিয়ে এসেছে, তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে তো কথা বলতে পারি।
বললাম, না বাবা—
ছেলেটি ভাল—
আমি তোমাকে ঠিক সময়ে জানাবো বাবা।
বাবা আর কোন কথাই বললেন না। অসন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে! আশ্চর্য! সুহাস, এখনো তোমার সময় হলো না!
কয়েক পৃষ্ঠা পরে—
বিদ্যুতের সঙ্গে সেদিন হঠাৎ দেখা–সে বললে, কেমন আছো মিত্রানী?
ভাল।
ভাবছিলাম একদিন তোমাকে ফোন করবো—
করেছিলে নাকি?
না।
করলেও কথা হতো না—আমার সাড়া পেতে না।
কেন?
ফোনটা আজ দশদিন আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে।
বিদ্যুৎ হো হো করে হেসে উঠলো।
তা আমার কথা হঠাৎ মনে পড়লো কেন বিদ্যুৎ?
আমার নায়িকার সন্ধানে–মানে আমার পরের বইতে মনে হচ্ছিল তোমাকে চমৎকার ফিট ইন করবে।
এবার হেসে উঠলাম আমি।
হাসলে যে?
শেষ পর্যন্ত আর মেয়ে খুঁজে পেলে না? আমার কথা ভাবছিলে?
সত্যি বল না, করবে অভিনয়?
না।
কেন?
আমি বিয়ে করবো—
সে তো অভিনয় করলেও বিয়ে করা যায়–
না, স্ত্রী আর অভিনেত্রী একসঙ্গে হওয়া যায় না।
কিন্তু তোমাকে অনেক উদাহরণ দিতে পারি
পারো হয়ত, কিন্তু অভিনেত্রীদের স্বামীর ঘর–কোনদিনই স্বামীর ঘর হয়ে ওঠে না, একটার গ্ল্যামার অন্যটার শান্তসুন্দর জীবনের গলা টিপে ধরতে শুরু করে পদে। পদে–যার ফলে বিক্ষোভ-অশান্তি—তারপর—
কি তারপর?
হয় দুঃসহ এক জীবন-যন্ত্রণা—না হয় অকস্মাৎ একদিন পরিসমাপ্তি। না বিদ্যুৎ, মেয়ে। হয়ে জন্মেছি—আমি মেয়ে হয়েই বেঁচে থাকতে চাই। গৃহিণী, সন্তানের জননী–
তা বসে আছো কেন আজো?
বসে আছি পথ চেয়ে—
কার পথ চেয়ে আমার নয় তো!
না—সে নহ তুমি—সে নহ তুমি—
তবে? কে সে ভাগ্যবান মিত্রা?
আচ্ছা বিদ্যুৎ–
বল।
সুহাসের খবর কি? তার সঙ্গে দেখা হয় তোমার?
হয় কদাচিৎ কখনো। জানোই তো, নিদারুণ সিরিয়াস টাইপের ছেলে সে।
অমন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করলো বি. এ.-তে অথচ এম. এ.-টা পড়লো না, কি এক সামান্য চাকরিতে ঢুকে গেল সাততাড়াতাড়ি।
তার সংসারের কথা তো তুমি জানো না–বাবা চাকরি করতে করতে হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন—দুটি বিবাহযোগ্যা বোন—একটিরও বিয়ে দিতে পারেনি, গায়ের রঙের জন্য বিয়ের বাজারে বিকোয়নি বলে তাদের পড়াচ্ছে—চাকরি করা ছাড়াও গোটা দুই টিউশনী করছে।
সত্যিই আমি জানতাম না ব্যাপারটা।