গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৪. গিরিলঙ্ঘন

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – গিরিলঙ্ঘন

রট্টা ও চিত্রক অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলে জম্বুক ছুটিয়া আসিয়া চিত্রকের অশ্বাসনে একটি বস্ত্রের পোট্টলি বাঁধিয়া দিল। চিত্রক প্রশ্ন করিল— ‘এ কী?’

জম্বুক বলিল— ‘কিছু খাদ্য। সঙ্গে থাকা ভাল। হয়তো প্রয়োজন হইবে।’

চিত্রক বলিল— ‘ভাল। তুমিও আর বিলম্ব করিও না।’

জম্বুক বলিল— ‘না। কিন্তু আমার অশ্ব নাই, গর্দভপৃষ্ঠে যাইতে হইবে। পৌঁছিতে বিলম্ব হইতে পারে।’

রট্টা জম্বুকের হস্তে একটি স্বর্ণদীনার দিয়া বলিলেন— ‘তোমার পারিতোষিক। ভিক্ষুদের কথা ভুলিও না।’

জম্বুক স্বর্ণমুদ্রা সসম্ভ্রমে ললাটে স্পর্শ করিয়া বলিল— ‘আজ্ঞা, ভিক্ষুদের জন্য গোধূম লইয়া যাইব। সঙ্গে ভৃত্য থাকিবে, সে সংঘে গোধূম পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিবে। আমি কপোতকূটে চলিয়া যাইব।’

অতঃপর জম্বুকের কর্মকুশলতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া উভয়ে পশ্চিমদিকে অশ্বের মুখ ফিরাইলেন। সম্মুখে উপত্যকা; তাহার পরপ্রান্তে পাহাড় আছে, কিন্তু এখান হইতে দেখা যায় না। সেই পাহাড় পার হইয়া স্কন্দগুপ্তের স্কন্ধাবারে পৌঁছিতে হইবে।

রট্টা বায়ুকোণ হইতে নৈর্ঋতকোণ পর্যন্ত চক্ষু ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কোন্‌ স্থানে যাইতে হইবে? দিগ্‌দর্শন হইবে কি প্রকারে?’

চিত্রক বলিল— ‘ওই যে-স্থানে চিল্ল-শকুন উড়িতেছে উহাই আমাদের গন্তব্য স্থান। উহা লক্ষ্য করিয়া চলিলে স্কন্ধাবারে পৌঁছিব।’

বিস্মিতা রট্টা বলিলেন— ‘কি করিয়া বুঝিলেন?’

চিত্রক একটু হাসিয়া বলিল— ‘অনেক দেখিয়াছি। যুদ্ধের প্রাক্কালে সৈন্য-শিবিরের মাথায় চিল্ল-শকুন উড়ে; উহারা বোধহয় জানিতে পারে। — আসুন, আর বিলম্ব নয়, আজ দ্রুত অশ্ব চালাইতে হইবে।’

দুইটি অশ্ব নদীর বাম তীররেখা ধরিয়া ছুটিয়া চলিল। রট্টা একবার চক্ষু ফিরাইয়া পান্থশালার পানে চাহিলেন; তাঁহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। মনে হইল, চির পরিচিত গৃহ ছাড়িয়া কোন্‌ অজানা নিরুদ্দেশের পথে চলিয়াছেন।

দ্বিপ্রহরের সূর্য মধ্যাকাশে উঠিয়াছে।

চিত্রক ও রট্টা এক বিশাল শিংশপা বৃক্ষের তলে আসিয়া অশ্ব থামাইলেন। নদীটি এইখানে ঈষৎ বক্র হইয়া নৈর্ঋতকোণে চলিয়া গিয়াছে; পরপারের ভূমি শিলাবন্ধুর ও উচ্চ হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহা উপত্যকার পশ্চিমপ্রান্ত বলা যাইতে পারে।

চিত্রক চারিদিক অবলোকন করিয়া বলিল— ‘এবার নদী পার হইতে হইবে।’

রট্টা বলিলেন— ‘নদীর জল যদি গভীর হয়?’

চিত্রক নদীর অর্ধস্বচ্ছ জলের ভিতর দৃষ্টি প্রবিষ্ট করাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল— ‘না, নদীগর্ভ প্রস্তরময়, স্রোতও মন্দ, সুতরাং অগভীর হইবার সম্ভাবনা। যা হোক, তাহা পরে পরীক্ষা করা যাইবে, আপাতত আহার ও বিশ্রামের প্রয়োজন।’

রট্টা যেন এই প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, তিনি অশ্ব হইতে নামিয়া তরুচ্ছায়ার শষ্পাসনে বসিলেন। চিত্রক অশ্ব দুইটিকে বল্‌গা ধরিয়া নদীর তীরে লইয়া গিয়া জলপান করাইল; তারপর তাহাদের যথেচ্ছ বিচরণ করিবার জন্য ছাড়িয়া দিয়া খাদ্যের পোট্টলি লইয়া রট্টার কাছে আসিয়া বসিল।

পোট্টলি খুলিয়া দেখা গেল জম্বুক অনেক খাদ্য দিয়াছে; যবের পিষ্ঠক ও তণ্ডুলের পৌলিক; কয়েকটি শঙ্খাকৃতি শর্করাকন্দ; এক কুঞ্চি চণক ও কিছু গুড়। চিত্রক সহাস্যে বলিল— ‘জম্বুক বিচক্ষণ ব্যক্তি। এত দিয়াছে যে দুই দিনেও ফুরাইবে না।’

পোট্টলি মধ্যস্থলে রাখিয়া উভয়ে তাহা হইতে তুলিয়া তুলিয়া আহার করিতে লাগিলেন। চিত্রক রট্টার প্রতি একটি সকৌতুক কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘খাদ্য কেমন লাগিতেছে?’

রট্টা অর্ধমুদিত নেত্রে বলিলেন— ‘বড় মিষ্ট।’

চিত্রক তরবারি দ্বারা শর্করাকন্দ কাটিতে কাটিতে বলিল— ‘ক্ষুধায় চায় না সুধা। বৈশ্বানর জ্বলিলে তিন্তিড়ীও মিষ্ট লাগে।’

আহার শেষ হইলে চিত্রক পোট্টলি আবার সযত্নে বাঁধিয়া রাখিল। দুইজনে নদীতীরে গিয়া অঞ্জলি ভরিয়া জলপান করিলেন। তারপর আবার তরুচ্ছায়া তলে আসিয়া বসিলেন। রট্টা তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিয়া অজিনের ন্যায় ঘন শষ্পশয্যায় অর্ধ-শয়ান হইলেন।

চিত্রক জিজ্ঞাসা করিল— ‘আপনার কি ক্লান্তি বোধ হইতেছে?’

‘না, আমি প্রস্তুত।’ বলিয়া রট্টা উঠিবার উপক্রম করিলেন।

চিত্রক বলিল— ‘ত্বরা নাই। অশ্ব দু’টির আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম প্রয়োজন।’

অশ্ব দুইটি ইতিমধ্যে শষ্পাহরণ করিতে করিতে নদীতীর হইতে কিছু দূর চলিয়া গিয়াছিল; অলস নেত্রে তাহাদের একবার দেখিয়া লইয়া চিত্রকও শ্যামল তৃণশয্যায় অঙ্গ প্রসারিত করিয়া দিল।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর রট্টা ধীরে ধীরে যেন আত্মগতভাবে বলিলেন— ‘পৃথিবীতে যদি যুদ্ধবিগ্রহ স্বার্থপরতা কুটিলতা না থাকিত।’

চিত্রক চক্ষু মুদিত করিয়া একটু হাসিল।

রট্টা বলিলেন— ‘কেন এই হিংসা? কেন এত লোভ? এত কাড়াকাড়ি? আর্য চিত্রক, আপনি বলিতে পারেন?’

চিত্রক উঠিয়া বসিল; কিছুক্ষণ নতনেত্রে চিন্তা করিয়া বলিল— ‘না। বোধহয় ইহাই মানুষের নিয়তি। মানুষ যাহা চায় তাহা পাইবার অন্য উপায় জানে না বলিয়াই যুদ্ধ করে, হিংসা করে।’

‘কিন্তু অন্য উপায় কি নাই?’

চিত্রক ধীরে ধীরে মাথা নাড়িল— ‘জানি না। হয়তো আছে—’

নদীর দিকে চক্ষু তুলিয়া চিত্রক সহসা নীরব হইল। রট্টা তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলেন, নদীর পরপারে প্রায় ত্রিশ দণ্ড দূরে একটি সুন্দর শৃঙ্গধর মৃগ মদগর্বিত পদক্ষেপে আসিতেছে। নদীর কূলে আসিয়া সে জলপান করিল, তারপর নির্ভয়ে নদী উত্তরণ করিয়া এপারে আসিয়া উপস্থিত হইল, নদীর জল তাহার উদর স্পর্শ করিল না। সে বৃক্ষচ্ছায়ায় মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ্য করে নাই, প্রত্যাশাও করে নাই। তীরে উঠিয়া সহসা তাহাদের দেখিতে পাইয়া নিমেষমধ্যে অতি দীর্ঘ লম্ফ প্রদানপূর্বক বিদ্যুদ্বেগে পলায়ন করিল।

চিত্রক হাসিয়া উঠিল, পোট্টলি হস্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া সে বলিল— ‘চলুন, এবার যাত্রা করি। নদীর গভীরতা সম্বন্ধে প্রশ্নের সমাধা হইয়াছে।’

পশ্চিম দিগ্বলয় সুরঞ্জিত করিয়া সূর্য অস্ত যাইতেছে। চারিদিকে পাহাড়; দীর্ঘশায়িত অনুচ্চ পর্বতশ্রেণী, মাঝে মাঝে প্রস্তরের স্কন্ধ উচ্চ হইয়া আছে। পর্বতগাত্রে সর্বত্র বর্বুর ও বন-বদরীর গুল্ম। এই দৃশ্যের মধ্যস্থলে অশ্বারূঢ় চিত্রক ও রট্টা দাঁড়াইয়া।

রট্টা নীরবে চিত্রকের পানে চাহিলেন; তাঁহার মুখে এক বিচিত্র হাসি ফুটিয়া উঠিল। তাঁহাদের পর্বত-লঙঘনের চেষ্টা বহু পথে বিপথে আবর্তিত হইয়া এই কুটিল গিরিসঙ্কটের চক্রে আবদ্ধ হইয়াছে। রাত্রি আসন্ন; গন্তব্য স্থান এখনও সুদূর পরাহত।

এই সময় দূরাগত দুন্দুভির ডিণ্ডিম শব্দ তাঁহাদের কর্ণে আসিল; শব্দ নয়, স্থির বায়ুমণ্ডলে একটা অস্পষ্ট স্পন্দন মাত্র। চিত্রক উৎকর্ণ হইয়া শুনিল; তারপর রট্টার দিকে ফিরিয়া বলিল— ‘স্কন্ধাবারে সন্ধ্যার ভেরী বাজিতেছে। শুনিলেন?’

রট্টা বলিলেন— ‘হাঁ। এখান হইতে কতদূর অনুমান হয়?’

চিত্রক ললাট কুঞ্চিত করিয়া বলিল— ‘সিধা আকাশ পথে অন্তত এক যোজন। আজ স্কন্ধাবারে পৌঁছানো অসম্ভব।’

‘তবে-?’

চিত্রক চারিদিকে চাহিল।

‘এই স্থানেই রাত্রি কাটাইব। এখানে জল আছে।’ বলিয়া সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল।

কিছু দূরে নগ্ন পর্বতগাত্র প্রাচীরের ন্যায় ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে; তাহার অঙ্গ বহিয়া ক্ষীণ ধারায় জল গড়াইয়া পড়িতেছে।

‘আসুন, আলো থাকিতে থাকিতে রাত্রির জন্য একটা আশ্রয়স্থল খুঁজিয়া লইতে হইবে।’ বলিয়া চিত্রক অশ্ব চালাইল।

গিরি-স্রুত জলধারা যেখানে সঞ্চিত হইয়াছে তাহার চারিপাশে তৃণ জন্মিয়াছে। চিত্রক ও রট্টা অশ্ব দু’টিকে এই স্থানে ছাড়িয়া দিয়া পদব্রজে এই পর্বতস্কন্ধের পাদমূলে ইতস্তত খুঁজিয়া দেখিতে লাগিলেন। অল্প দূরে গিয়া একটি গুহা দেখা গেল। ঠিক গুহা নয়, দুইটি বিশাল পাষাণ খণ্ড পরস্পরের অঙ্গে হেলিয়া পড়িয়া অধোদেশে ক্ষুদ্র একটি কোটর রচনা করিয়াছে। পর্বতের তুলনায় কোটর ক্ষুদ্র হইলেও দুইটি মানুষ তাহার মধ্যে স্বচ্ছন্দে রাত্রি যাপন করিতে পারে। রন্ধ্রমুখ ক্ষুদ্র বটে কিন্তু ভিতরে বেশ পরিসর।

গুহামধ্যে প্রবেশ করিয়া রট্টা সানন্দে বলিয়া উঠিলেন— ‘এই তো সুন্দর গৃহ পাওয়া গিয়াছে।’

চিত্রক হাসিল— ‘সুন্দর গৃহই বটে! আদিম যুগের মানব মানবী বোধকরি এমনই গৃহে বাস করিত। যা হোক, মুক্ত আকাশের তলে রাত্রিযাপন অপেক্ষা এ ভাল। আপনি অপেক্ষা করুন।’ বলিয়া সে ছুটিয়া গিয়া অশ্বের পৃষ্ঠ হইতে কম্বলাসন দুইটি লইয়া আসিল, রট্টার পদপ্রান্তে রাখিয়া বলিল— ‘আপনি গৃহের সাজসজ্জা করুন, আমি অন্য চেষ্টা করিতেছি।’

দিনের আলো দ্রুত ফুরাইয়া আসিতেছে। চিত্রক ত্বরিতে বর্বুর-গুল্ম ও বদরী বনের মধ্য হইতে শুষ্ক শাখাপত্র কুড়াইয়া আনিয়া গুহার ভিতর জমা করিতে লাগিল। এইরূপে শুষ্ক পত্র ও কাষ্ঠের স্তূপ প্রস্তুত হইলে সে একখণ্ড প্রস্তরের উপর তরবারির লৌহ পুনঃপুনঃ আঘাত করিয়া অগ্নি উৎপাদনে প্রবৃত্ত হইল।

কিছুক্ষণ মন্থনের পর অগ্নি জ্বলিল; চড়্‌চড়্‌ পট্‌পট্‌ শব্দ করিয়া শুষ্ক শাখাপত্র জ্বলিতে লাগিল।

রট্টা করতালি দিয়া বলিয়া উঠিলেন— ‘আর আমাদের অভাব কি? অগ্নিদেবতাও উপস্থিত।’ বলিয়াই তিনি সহসা লজ্জায় রক্তমুখী হইয়া উঠিলেন।

অগ্নির দুই পাশে দুইটি কম্বল পাতিয়া চিত্রক বলিল— ‘আপনি বসুন, আমি অশ্ব দু’টির ব্যবস্থা করিয়া আসি।’

চিত্রক বাহির হইয়া গেল। বাহিরে তখন দিবা-দীপ্তি প্রায় নির্বাপিত হইয়াছে।

রট্টা প্রোজ্জ্বল অগ্নিশিখার পানে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, জীবন কী অদ্ভুত, কী ভয়ঙ্কর, কী সুন্দর! এতদিন তিনি কেবল বাঁচিয়া ছিলেন, আজ প্রথম জীবনের স্বাদ পাইলেন।

চিত্রক ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, রট্টা মস্তক হইতে উষ্ণীষ মোচন করিয়াছেন। অগ্নিশিখার চঞ্চল আলোকে ছদ্মবেশমুক্ত সুন্দর সুকুমার মুখখানি দেখিয়া চিত্রকের চিত্ত ক্ষণকালের জন্য যেন স্ফুলিঙ্গের মত চারিদিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল; কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ মনকে সংহত করিয়া সহজভাবে বলিল— ‘ঘোড়া দু’টিকে বল্‌গা খুলিয়া ছাড়িয়া দিলাম। এদিকে যদি শ্বাপদ থাকে— সম্ভবত নাই— তাহারা পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে পরিবে।’

শ্বাপদ! এই পার্বত্য বনানীর মধ্যে শ্বাপদ থাকিতে পারে একথা রট্টার মনে আসে নাই।

চিত্রক রট্টার সম্মুখে খাদ্যের পুঁটুলি রাখিয়া বলিল— ‘এইবার আহার।’

দুইজনে এক কম্বলাসনে বসিয়া আহার আরম্ভ করিলেন। পিষ্টক পৌলিক কিছু অবশিষ্ট ছিল, চিত্রক সেগুলি রট্টাকে দিয়া নিজে শুষ্ক চণক চিবাইতে লাগিল। রট্টা তাহা লক্ষ্য করিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া মৃদু হাসিলেন; কিছু বলিলেন না। তিনিও দুই চারিটি চণক লইয়া মুখে দিলেন।

কিছুক্ষণ নীরবে আহার চলিবার পর চিত্রক বলিল— ‘আপনার এই দুর্দশার জন্য আমি বড় কুন্ঠাবোধ করিতেছি।’

রট্টা বলিলেন— ‘আপনার কুন্ঠা কেন? আমি তো স্বেচ্ছায় আসিয়াছি।’

চিত্রক বলিল— ‘কিন্তু আমি প্রস্তাব করিয়াছিলাম।’

রট্টা দৃঢ়স্বরে বলিলেন— ‘অন্যায় প্রস্তাব করেন নাই। এ পর্বত যে এত দুর্গম তাহা আপনি জানিতেন না।’

চিত্রক অগ্নিতে একটি শাখাখণ্ড নিক্ষেপ করিয়া বলিল— ‘তাহা সত্য। তবু ভয় হয়, আপনি সন্দেহ করিতে পারেন আমার কোনও দুরভিসন্ধি আছে—’

‘আর্য চিত্রক!’ রট্টার চক্ষু দু’টি দীপ্ত হইয়া উঠিল— ‘আমার অন্তঃকরণ এত নীচ মনে করিবেন না।’

চিত্রক দীনকণ্ঠে বলিল— ‘ক্ষমা করুন, রাজকুমারী। কিন্তু আপনার ক্লেশের নিমিত্ত হইয়া আমি প্রাণে শান্তি পাইতেছি না।’

রট্টা তেমনই উদ্দীপ্তস্বরে বলিলেন— ‘আপনি আমার ক্লেশের নিমিত্ত হন নাই। আর ক্লেশ! স্ত্রীজাতির কিসে ক্লেশ হয় তাহা আপনি কি বুঝিবেন?’

চিত্রকের বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল। সে আর কথা কহিল না। স্ত্রীলোকের কিসে ক্লেশ হয়— কিসে সুখ হয়, তাহা অধম যুদ্ধজীবী কি করিয়া বুঝিবে? স্ত্রীজাতির চরিত্র এবং পুরুষদের ভাগ্য দেবতারাও জানেন না, মানুষ কোন্‌ ছার। কিন্তু তবু রট্টা যশোধরা নাম্নী এই যুবতীটির চরিত্র যতই রহস্যময় হোক, তাহা যে অনন্য অনিন্দ্য এবং অনবদ্য তাহাতে চিত্রকের মনে সংশয়মাত্র রহিল না।

আহারের পর দুইজনে গুহার বাহিরে জলাধারে গিয়া জলপান করিলেন। চিত্রক একটি জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড হাতে লইয়া আলো দেখাইল। বাহিরে তখন গাঢ় অন্ধকারে চারিদিক ছাইয়া গিয়াছে; কেবল এখানে ওখানে কয়েকটি জ্যোতিরিঙ্গণ নীল নেত্রানল জ্বালিয়া কোন্‌ অলক্ষ্য বস্তুর সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে।

গুহায় ফিরিয়া আসিয়া চিত্রক অবশিষ্ট কাষ্ঠগুলি অগ্নিতে সমর্পণপূর্বক বলিল— ‘এইবার শয়ন।’

এক পাশে রট্টা শয়ন করিলেন, অন্য পাশে চিত্রক। মধ্যস্থলে অগ্নিদেবতা জাগ্রত রহিলেন।

শয়ন করিয়া চিত্রক চক্ষু মুদিত করিল। আজিকার এই অপরূপ পরিস্থিতি, রট্টার সহিত এই কোটরে দুই হস্ত ব্যবধানে শয়ন, চিত্রকের স্নায়ুমণ্ডলে আলোড়নের সৃষ্টি করিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার চিন্তাগুলি মস্তিষ্কের মধ্যে পূর্ণতা লাভ করিবার পূর্বেই ছায়াবাজির ন্যায় মিলাইয়া যাইতে লাগিল। দুই দিন অশ্বপৃষ্ঠে এবং এক রাত্রি বিনিদ্র চক্ষে যাপন করিয়া তাহার লৌহময় শরীরেও ক্লান্তি প্রবেশ করিয়াছিল। সে অচিরাৎ গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইল।

মধ্য রাত্রির পর চিত্রক জাগিয়া উঠিল। একেবারে পরিপূর্ণ চেতনা লইয়া উঠিয়া বসিল। অগ্নি নিঃশেষ হইয়া নিভিয়া গিয়াছে, চতুর্দিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। তাহার মধ্যে চিত্রক অনুভব করিল, রট্টা আসিয়া তাহার বাহু চাপিয়া ধরিয়াছেন, তাহার কানে কানে বলিতেছেন — ‘ঐ দেখুন— গুহার দ্বারের দিকে দেখুন—’

গুহামুখের দিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া চিত্রক দেখিল, অঙ্গারের ন্যায় রক্তবর্ণ দুইটি চক্ষু তাহাদের পানে তাকাইয়া আছে। অন্ধকারে এই অঙ্গার-চক্ষু জীবের শরীর দেখা যাইতেছে না; মাঝে মাঝে চক্ষুর পলক পড়িতেছে—

চিত্রক জানিত হিংস্র জন্তুর চক্ষু অন্ধকারে রক্তবর্ণ দেখায়; সুতরাং এই জন্তুটা তরক্ষু হইতে পারে, আবার ব্যাঘ্রও হইতে পারে। বোধহয় গুহার মধ্যে প্রবেশ করিতে সাহস পাইতেছে না। কিন্তু ক্রমে সাহস পাইবে; রক্তলোলুপতার কাছে ভয় পরাজিত হইবে।

চিত্রকের দেহের পেশীগুলি শক্ত হইয়া উঠিল। রট্টা তাহার পাশে বসিয়া পড়িয়া তাহার বাহু জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন; কম্পিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘উহা কি ব্যাঘ্র?’

চিত্রক রট্টার কথার উত্তর দিল না। তৎপরিবর্তে তাহার কণ্ঠ হইতে একটি দীর্ঘ-বিকট শব্দ বাহির হইল। শব্দ এত বিকট ও ভয়ঙ্কর যে কোনও হিংস্র জন্তুর কণ্ঠ হইতে এরূপ শব্দ বাহির হয় না; অশ্বের হ্রেষা, হস্তীর বৃংহিত এবং তূর্যনিনাদ মিশাইয়া এইরূপ ঘোর শব্দ সৃষ্টি হইতে পারে।

এই নিনাদ থামিবার পূর্বেই গুহামুখ হইতে রক্তচক্ষু দুইটি সহসা অন্তর্হিত হইল; বাহিরে শুষ্ক পত্রাদির উপর পলায়মান জন্তুর দ্রুত পদধ্বনি ক্ষণেক শুনা গেল। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ।

চিত্রকের মুখ-নিঃসৃত রোমহর্ষণ শব্দ শুনিয়া রট্টার সংজ্ঞা প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছিল। চিত্রক এখন তাঁহাকে কোমলস্বরে বলিল— ‘রাজকুমারি, আর ভয় নাই, জন্তুটা পলাইয়াছে।’

রট্টা মুখ তুলিলেন। অন্ধকারে কেহ কাহাকেও দেখিতে পাইল না। রট্টা ক্ষীণস্বরে বলিলেন— ‘ও কী ভয়ানক শব্দ! আপনি করিলেন?’

চিত্রক বলিল— ‘হাঁ। উহার নাম সিংহনাদ। যুদ্ধকালে ঐরূপ হুঙ্কার ছাড়িবার প্রথা আছে।’— বলিয়া লঘুকণ্ঠে হাসিল।

রট্টা একটি অতি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তাঁহার অঙ্গুলিগুলি নামিয়া আসিয়া চিত্রকের অঙ্গুলি জড়াইয়া লইল, তাঁহার কপোল চিত্রকের বাহুর উপর ন্যস্ত হইল।

চিত্রক উদ্গত হৃদয়াবেগ দমন করিয়া বলিল— ‘রাজকুমারি—’

অস্ফুটকণ্ঠে রট্টা বলিলেন— ‘রাজকুমারী নয়, বলো রট্টা।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া চিত্রক কম্পমানকণ্ঠে বলিল— ‘রট্টা!’

‘বলো রট্টা যশোধরা।’

‘রট্টা যশোধরা।’

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর রট্টা বলিল— ‘আজ অন্ধকার আমার লজ্জা ঢাকিয়া দিয়াছে তাই বলিতে পারিলাম। আমি তোমার। জন্ম-জন্মান্তরে আমি তোমার ছিলাম, এ জন্মেও তোমার। পরজন্মেও তোমার হইব।’

হৃদয়তন্তু ছিঁড়িয়া চিত্রক বলিল— ‘রট্টা, তুমি জান না আমি কে! যদি জানিতে—’

রট্টার অন্য হস্তটি আসিয়া চিত্রকের অধর স্পর্শ করিল! সে পূর্ববৎ শান্ত অস্ফুট স্বরে বলিল— ‘আমি আর কিছু জানিতে চাহি না। তুমি ক্ষত্রিয়, তুমি বীর, তুমি মানুষ— কিন্তু এ সকল অবান্তর কথা। তুমি আমার, ইহাই আমার কাছে যথেষ্ট।’ চিত্রকের স্কন্ধের উপর মাথাটি সুবিন্যস্ত করিয়া বলিল— ‘এখন আমি ঘুমাইব; আমার চক্ষু ঢুলিয়া আসিতেছে—’ অন্ধকারে ক্ষুদ্র একটি জৃম্ভণের শব্দ হইল।

‘তুমি কি আজ ঘুমাও নাই?’

‘না। তুমি ঘুমাইলে, আমার ঘুম আসিল না। কী অদ্ভুত মানুষ তুমি, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে জাগিয়া রহিলাম। তাই তো ঐ শ্বাপদের চক্ষু দেখিতে পাইলাম। — কিন্তু এখন ঘুমাইব। তুমি কাল রাত্রে যেমন জাগিয়া ছিলে আজও তেমনি জাগিয়া থাক।’ একটু হাসির শব্দ হইল; তারপর রট্টা চিত্রকের স্কন্ধে মাথা রাখিয়া ঘুমাইল। তাহার নিশ্বাস ধীরে ধীরে পড়িতে লাগিল।

চিত্রক উদ্বেল হৃদয়ে জাগিয়া রহিল।

ঊষার আলোক গুহার রন্ধ্র-মুখ পরিস্ফুট করিলে রট্টার ঘুম ভাঙ্গিল; সে হাসিভরা চোখ তুলিয়া চাহিল। চিত্রকের বিনিদ্র চক্ষু তাহাকে নূতন দিনের অভিবাদন জানাইল।

‘রট্টা যশোধারা!’

‘আর্য!’

দুইজনের মধ্যে দীর্ঘ গভীর দৃষ্টি বিনিময় হইল। তারপর তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইল। চিত্রক বলিল— ‘চল, এখনও অনেক কাজ বাকি।’

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাহারা বাহির হইল।

জটিল শিলাবন্ধুর পথ; তাহাও কণ্টকগুল্মে আবৃত। কখনও একটি পথ বহুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করিয়া দেখা যায় আর অগ্রসর হইবার উপায় নাই, দুর্ভেদ্য কণ্টকগুল্ম কিম্বা দুরারোহ শৈল-প্রাচীর পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। আবার ফিরিয়া আসিয়া নূতন পথ ধরিতে হয়।

পর্বতশ্রেণীরও যেন শেষ নাই; একটির পর আর একটি। অতি কষ্টে এক পর্বতপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া দেখা যায় সম্মুখে আর একটি পাহাড়। গন্তব্য স্থানের চিহ্ন নাই।

দ্বিপ্রহর অতীত হইল। অবশেষে বহু আয়াসে কয়েকটি পর্বতপৃষ্ঠ অতিক্রম করিবার পর একটির শীর্ষে উঠিয়া তাহারা হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল। সম্মুখেই উপত্যকা।

উপত্যকাটি সুচিত্রিত পারসিক গালিচার মত তাহাদের নেত্রতলে প্রসারিত হইয়া আছে। আয়তনে অনুমান দশ বর্গ ক্রোশ হইবে। এই সুবিশাল ভূমিখণ্ডের উপর তিল ফেলিবার স্থান নাই। যতদূর দৃষ্টি যায় অগণিত শিবির— বস্ত্রাবাস, তালপত্রের ছত্রাবাস, তাহাদের ফাঁকে ফাঁকে পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় মানুষ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্কন্ধাবারের বাম প্রান্ত বেষ্টন করিয়া অশ্বের আগড়; শ্বেত কৃষ্ণ পিঙ্গল নানা বর্ণের অসংখ্য অশ্ব; কম্বোজ সিন্ধু আরট্ট বনায়ু— নানাজাতীয় তীক্ষ্ণ-বীর্য রণঅশ্ব। অন্য প্রান্তে স্কন্ধাবারের দক্ষিণ দিকে নিদাঘের মেঘাড়ম্বরবৎ হস্তীর পাল; মদশ্রাবী হস্তীপুঞ্জ গল-ঘণ্টা বাজাইয়া দুলিতেছে, শূন্যে শুণ্ড আস্ফালন করিতেছে, বৃংহিতধ্বনি করিতেছে।

এই বিক্ষুব্ধ সমুদ্র তুল্য সৈন্যাবাস দেখিয়া রট্টার মুখ শুকাইল। চিত্রক তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিল— ‘ভয় নাই, আমার কাছে মন্ত্রপূত কবচ আছে। — ঐ যে মধ্যস্থলে রক্তবর্ণ বৃহৎ পট্টাবাস দেখিতেছ, উহাই সম্রাটের শিবির। ঐখানে আমাদের পৌঁছিতে হইবে।’

অতঃপর তাহারা পর্বতগাত্র অবরোহণ করিয়া উপত্যকায় নামিল। কিন্তু এখনও তাহাদের পথের প্রতিবন্ধক শেষ হয় নাই। একদল অশ্বারোহী শিবির-রক্ষী আসিয়া তাহাদের ঘিরিয়া ধরিল। কে তোমরা? কি অভিপ্রায়?

চিত্রক স্কন্দগুপ্তের অভিজ্ঞান-মুদ্রা দেখাইয়া পরিত্রাণ পাইল। তারপর আরও কয়েকবার রক্ষীরা তাহাদের গতিরোধ করিল; সাধারণ সৈনিকরা নূতন লোক দেখিয়া রঙ্গ তামাসা করিল। কিন্তু ভাগ্যবলে রট্টাকে নারী বলিয়া চিনিতে পারিল না।

অবশেষে তাহারা স্কন্দগুপ্তের প্রহরী-বেষ্টিত শিবির সম্মুখে উপস্থিত হইল; অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া শূলধারী প্রধান দ্বারপালের সম্মুখে দাঁড়াইল।

দ্বারপাল বলিল— ‘কি চাও?’

চিত্রক বলিল— ‘ইনি বিটঙ্ক রাজ্যের রাজদুহিতা কুমারী রট্টা যশোধরা— পরমভট্টারক সম্রাট স্কন্দগুপ্তের সাক্ষাৎপ্রার্থিনী।’ বলিয়া রট্টার মস্তক হইতে উষ্ণীষ খুলিয়া লইল। বন্ধনমুক্ত বিসর্পিল বেণী রট্টার পৃষ্ঠে লুটাইয়া পড়িল।