১৪. খাড়া দেয়ালের মাঝে

খাড়া দেয়ালের মাঝে ছোট একটা ফুটো, ভিতরে খুব কষ্ট করে ঢুকতে হয়। রিশান প্রথমে ঢুকতে গিয়ে আবিষ্কার করল পিঠে ঝুলে থাকা যন্ত্রপাতি পাথরে আটকে যাচ্ছে। সে সেগুলো খুলে হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ভিতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তার মাথায় লাগানো ছোট একটা আলো কাছাকাছি খানিকটা আলোকিত করে রেখেছে, সেটা দূরের সবকিছুকে আরো গাঢ় অন্ধকারে আড়াল করে রেখেছে। দূরে কী আছে রিশান দেখার চেষ্টা না করে হামাগুড়ি দিয়ে বুকের উপর ভরে করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।

খানিকক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ খানিকটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল। রিশান সাবধানে এক হাতে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ এবং অন্য হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাথায় লাগানো আলোটি তার আশপাশে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে, রিশান সেই আলোতে সামনে তাকায়। চারপাশে পাথরের দেয়াল এবং সেখানে বিচিত্র থলথলে এক ধরনের জিনিস ঝুলছে। জিনিসটি জীবন্ত এবং সেটি ক্রমাগত নড়ছে, এক জায়গা থেকে ধীরে ধীরে অন্য জায়গায় সরসর করে সরে যাচ্ছে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সেখান থেকে হঠাৎ কিছু একটা তার দিকে ছুটে আসবে, অক্টোপাসের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে তার সমস্ত শরীরকে থলথলে শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, থলথলে জিনিসগুলো তার আশপাশে নড়তে থাকে, সরসর শব্দ করতে থাকে এবং ভিজে এক ধরনের তরল পদার্থ সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।

রিশান চাপা গলায় ডাকল, সানি তুমি কোথায়?

এই যে এখানে।

আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি না।

তুমি কোথায়?

আমি এইমাত্র ঢুকেছি, সুড়ঙ্গটার কাছে।

তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।

হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি আস। এই সুড়ঙ্গের মুখটা আমাদের বন্ধ করে দিতে হবে।

সানি সাবধানে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নামিয়ে সেখান থেকে কিছু পলিমার বের করতে থাকে। সুড়ঙ্গটা খুব বড় নয়, সেটাকে বন্ধ করে দেয়া খুব কঠিন হবে না।

রিশান পলিমারের আস্তরণটা দাঁড় করাতে করাতেই দূরে ছোট একটা আলো দেখা। গেল, সানি আসছে।

সানির সমস্ত পোশাকে চটচটে এক ধরনের তরল—

রিশান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে সানি? পড়ে গিয়েছিলে?

না।

তাহলে? আমাকে আমাকে ধরে ফেলেছিল।

ধরে ফেলেছিল?

হ্যাঁ। সানি ভয়ার্ত মুখে বলল, আমার মাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেছে আমার মা?

রিশান হাত বাড়িয়ে সানিকে স্পর্শ করে বলল, আছে নিশ্চয়ই আছে। তুমি ভয় পেয়ো না সানি, আগে আমার সাথে হাত লাগাও। এই যে আস্তরণটা তৈরি করেছি, শক্ত হয়ে যাবার আগে সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। তুমি এই পাশে ধর–

সানি কাঁপা হাতে রিশানের সাথে হাত লাগায়, কিছুক্ষণের মাঝেই সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেল। রিশান তার মনিটরে লক্ষ করে ভিতরে বাতাসের চাপ বেড়ে যাচ্ছে, সম্ভবত এই গুহাটায় আর বড় কোনো ফুটো নেই।

রিশান আবার সানির দিকে তাকাল, তার মুখে চাপা ভয়, সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। রিশানও আবার চারদিকে তাকাল। হঠাৎ তার বুকটা ধক করে ওঠে, মনে হয় চারপাশের থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সত্যিই কি এখন তাদের চেপে প্রবে? রিশান জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সানি, তুমি তোমার মায়ের সাথে কেমন করে কথা বল?

তোমার সাথে যেভাবে বলি সেভাবে।

রিশান একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি? এমনি বললেই শুনতে পায়?

সবসময় পায় না। তখন আমি আমার মাথাটা পাথরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে কথা বলি, চিৎকার করে কথা বলি–

তার মানে তোমার কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে যায়। রিশান তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ থেকে ছোট একটা এমপ্লিফায়ার বের করে সানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও তুমি এর মাঝে কথা বল, কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। তোমাকে তাহলে আর চিৎকার করে কথা বলতে হবে না

সানি এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কী কথা বলব?

তোমার মায়ের সাথে কিছু একটা বল। তাকে বল নিক্সিরল গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে, তাই আমরা এভাবে এসে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিচ্ছি। বল, বাইরে আমরা বিস্ফোরক বসিয়েছি, সুড়ঙ্গটা বন্ধ করে দিচ্ছি–যা তোমার মনে হয় বল। আমি জানতে চাই উত্তরে তোমার মা কী বলে।

সানি এমপ্লিফায়ারটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, মা আমি সানি।

সানির কণ্ঠস্বর বহুগুণ বেড়ে গিয়ে সমস্ত গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। রিশান অবাক হয়ে দেখল, থলথলে জিনিসগুলো হঠাৎ কেমন জানি কিলবিল করে নড়ে ওঠে। সানি এমপ্লিফায়ারটা সরিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। তারপর আবার বলল, মা, আমি সানি। তুমি কথা বল। আমার ভয় করছে।

রিশান হঠাৎ চমকে উঠে শুনল–কোথা থেকে জানি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, চলে যাও– চলে যাও সানি।

কণ্ঠস্বরটি ঠিক মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, শুনে মনে হয় কেউ যেন শব্দ না করে শুধু নিশ্বাস ফেলে কথা বলছে। একসাথে যেন শত সহস্র মানুষ হাহাকার করে নিশ্বাস ফেলছে।

সানি হতচকিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন মা? আমি কেন চলে যাব?

রিশান অবাক হয়ে দেখল চারদিকে ঘিরে থাকা থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো আবার সরসর করে নড়তে থাকে, বাতাসে আবার মানুষের হাহাকারের মতো শব্দ হতে থাকে। সানি আবার জিজ্ঞেস করল, কেন আমি চলে যাব মা?

বিপদ… অনেক বড় বিপদ…

রিশান ঠিক শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না, সানির দিকে তাকাল। সানিও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিশান এমপ্লিফায়ারটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিসের বিপদ?

রিশানের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী এমপ্লিফায়ারে করে গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে এবং তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। চারপাশের থলথলে জিনিসগুলো কাঁপতে শুরু করে। কিলবিল করে নড়তে শুরু করে। ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো হিসহিস শব্দ হতে থাকে এবং হঠাৎ পাথরের দেয়াল থেকে গলিত স্রোতধারার মতো কিছু একটা ছুটে আসে। কিছু বোঝার আগে কিছু একটা রিশানকে পেঁচিয়ে ধরে তাকে আছড়ে নিচে ফেলে দেয়। রিশান শক্ত হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দাও, না হয় গুলি করে শেষ করে দেব—

রিশানের কথার জন্যেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক, দেয়াল থেকে ছুটে আসা আধা তরল, আঠালো লকলকে জিনিসটা তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে দেয়ালের দিকে ফিরে গেল। রিশান সাবধানে উঠে বসতে চেষ্টা করে, সমস্ত শরীর প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরলে ঢেকে গেছে, কোনোমতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে সে সোজা করে দাঁড়া করায়। সানি গুহার এককোনা থেকে তার দিকে ছুটে এসে বলল, ওরা অনেক রেগে আছে। অনেক রেগে আছে।

কেন?

তুমি কথা বলেছ তাই। তোমার কথা ওরা শুনতে চায় না।

কেন আমার কথা শুনতে চায় না?

আমি জানি না।

কিন্তু ওদের আমার কথা শুনতে হবে, আমি ওদের বাঁচাতে এসেছি। রিশান এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি

রিশানের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ অন্ধকার গুহাটিতে যেন প্রলয় কাও শুরু হয়ে গেল। পাথরের দেয়ালে ঝুলে থাকা থলথলে জিনিসগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে, লকলকে জিভের মতো লম্বা লম্বা ঔড় বের হয়ে আসে, হিসহিস হিংস্র শব্দে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে–

রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে রেখে বলল, খবরদার কেউ আমার কাছে আসবে, আমি গুলি করে শেষ করে দেব–

সাথে সাথে আবার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যেতে থাকে, সমস্ত গুহা যেন থরথর করে কেঁপে ওঠে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি। আমি ছাড়া আর কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবে না। বিশ্বাস কর আমার কথা

রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত গুহাটি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, হিংস্র শব্দেও থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছু একটা যেন অসহ্য ক্রোধে ফেটে পড়তে চায়। রিশান মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে এটমিক ব্লাস্টারটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, পৃথিবী থেকে নিক্সিরল পাঠিয়েছে, সেখান থেকে বাচার একত্র উপায় অক্সিজেন। আমি তাই অক্সিজেনে ভাসিয়ে দিচ্ছি তোমাদের–

রিশান ভীত চোখে চারদিকে তাকাল, তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু হঠাৎ তার মনে হতে থাকে কেউ একজন তার কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। সে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি বাইরেও অসংখ্য অক্সিজেনের উৎস ছড়িয়ে এসেছি। তারা অক্সিজেন বের করছে এখন। তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে বিস্ফোরক রেখেছি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে কিছুক্ষণের মাঝেই, তোমরা ভয় পেয়ো না।

সানি খুব ধীরে ধীরে রিশানের কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করে। রিশান ঘুরে তার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলবে সানি?

তোমার কথা শুনছে!

হ্যাঁ।

আর রাগ করছে না, দেখেছ?

হ্যাঁ সানি। আর রাগ করছে না–

রিশানের কথা শেষ হবার আগেই বাইরে থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে, ভিতরে থলথলে জিনিসগুলো আবার হিসহিস করতে শুরু করে, সরসর করে নড়তে থাকে, স্থানে স্থানে প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরল ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রিশান গলা উচিয়ে বলল, তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি এই বিস্ফোরকগুলো দিয়েছি। একটু পরে আরো বড় একটা বিস্ফোরণ হবে, একটা আগ্নেয়গিরির মাথা উড়িয়ে দেয়া হবে অগ্ন্যুৎপাত শুরু করার জন্যে–আশপাশে তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে আমি ইচ্ছে করে করেছি।

খুব ধীরে ধীরে ভিতরের পরিবেশ একটু শান্ত হয়ে আসে এবং ঠিক তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণটি এসে তাদের আঘাত করে–

হান নিশ্চয়ই পারমাণবিক বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির চূড়োটি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছে। সমস্ত গুহাটি ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, উপর থেকে পাথরের টুকরো ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ধুলো উড়ছে, দেয়ালে থলথলে প্রাণীগুলো থরথর করে কাঁপছে, এক ধরনের জান্তব চিৎকার। দেয়াল থেকে ভয়ঙ্কর আক্রোশে কিছু একটা তাদের দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে, রিশান লাফিয়ে সরে গিয়ে সানিকে জাপটে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কিছু একটা আঘাত করল তখন এবং কিছু বোঝার আগেই রিশান জ্ঞান হারাল।