কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠিরাদির মিলিত-পরামর্শ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ধীমান! তুমি আমাকে যেরূপ পরামর্শ দিলে, অন্য কেহই এরূপ পারে না; তোমার ন্যায় সংশয়চ্ছেদক ভূতলে, আর কেহই নাই। এই ভূমণ্ডলের মধ্যে অনেকানেক রাজা আছেন; তাহারা কেবল আপনাদের প্রিয়কার্য্যই করিয়া থাকেন। তাঁহারা কেহই সম্রাজ্য প্রাপ্ত হয়েন নাই; সম্রাট [রাজসূয়যজ্ঞকারী রাজমণ্ডলীর অধীশ্বর] শব্দ অতিকষ্টে প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি পরের মৰ্য্যাদা জানে, সে কখন আত্মপ্রশংসা করে না। যেহেতু, অন্যে যাহার প্রশংসা করে, তিনিই যথার্থ পূজ্য। পৃথিবী অতি বিস্তৃত ও নানাবিধ মহারত্নে পরিপূর্ণ। হে বৃষ্ণিবংশাবতংশ! লোকে অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে কখনই শ্রেয়োলাভ করিতে পারে না। আমার মতে সমতাই সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, উহা অবলম্বন করিলেই মঙ্গললাভ হয়; যুদ্ধাদি দ্বারা কোনক্রমেই উৎকৃষ্ট ফল লাভ করিতে পারে না। আমাদের কুলে সমুৎপন্ন এই সমস্ত মনস্বিগণেরও এই মত, বোধ হয়, ইহাদের মধ্যে কেহই সর্ব্বজয়ী হইতে পারেন নাই। হে মহাভাগ! জরাসন্ধের দৌরাত্ম্য দর্শনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়াছি। কারণ, আমি তোমারই বাহুবল আশ্রয় করিয়া আছি, যখন তুমিই সেই জরাসন্ধকে ভয় কর, তখন আমি কি করিয়া আপনাকে বলবান জ্ঞান করিব? তুমি, বলভদ্ৰ, ভীমসেন ও অর্জ্জুন এই চারি জনের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাহাকে বিনষ্ট করিতে পারেন কি না, আমি পুনঃ পুনঃ এই চিন্তাই করিতেছি; এক্ষণে তোমার যাহা ইচ্ছা, আমি তোমার মতানুসারেই সমস্ত কাৰ্য্য করিয়া থাকি।”
যুধিষ্ঠিরের বাক্য-শ্রবণানন্তর ভীমসেন কহিলেন, “যে রাজা যুদ্ধচেষ্টা-পরাঙ্মুখ এবং যে দুর্ব্বল ও উপায়শূন্য হইয়া বলীর সহিত যুদ্ধ করিতে যায়, ইহারা উভয়েই অবসন্ন হয়। যে ব্যক্তি দুর্ব্বল, কিন্তু আলস্যশূন্য, সে সম্যক যুদ্ধাদি প্রয়োগ দ্বারা বলবান শক্রকে জয় করিতে পারে এবং নীতি দ্বারা আপনার হিতকর অর্থ লাভ করে। দেখ, কৃষ্ণে নীতি, আমাতে বল এবং অর্জ্জুনে জয় নিৰ্দ্ধারিত আছে, অতএব যেমন ত্রেতাগ্নি [গাৰ্হাপত্য, আহবনীয়, দক্ষিণাগ্নি] যজ্ঞসাধন করে, সেইরূপ আমরা তিন জনে একত্র হইয়া জরাসন্ধের বধ্যসাধন করিব।”
জরাসন্ধ-নিগ্রহের কৃষ্ণপ্রেরণা
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! অজ্ঞ ব্যক্তিরা পরিণাম বিবেচনা না করিয়া কাৰ্য্যারম্ভ করে, এই নিমিত্ত লোকে স্বার্থসাধনতৎপর, অবিজ্ঞ, শক্রকে নিবারণ করে না। পূর্ব্বে মহারাজ যৌবনাশ্বি করপরিত্যাগ, ভগীরথ প্রজাপালন, কর্তবীৰ্য্য তপোবল, ভরত বাহুবল ও মরুৎ অর্থবল দ্বারা সম্রাট হইয়াছিলেন। দেখ, ইঁহারা এক এক গুণ থাকতে সাম্রাজ্য লাভ করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু এক আপনাতে সেই সকল গুণ আছে। হে রাজন! সত্যযুগে পূর্বোক্ত ঐ সমস্ত ভূপতিগণ সুসাধ্য মন্ত্রের অনুষ্ঠান দ্বারা ধর্ম্ম, অর্থ ও নীতির সহিত সাম্রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। এক্ষণে বৃহদ্ৰথ-পুত্র জরাসন্ধ সম্রাট হইয়াছে; ভূপতিগণের একশত কুল তাহার কোন বিঘ্ন করিতে পারে না, এই নিমিত্ত সে বলপূর্ব্বক সাম্রাজ্য অধিকার করিতেছে। রত্নশীল ভূপতিগণ সতত তাহার উপাসনা করেন, কিন্তু সেই নীতিবিরুদ্ধাচারী অজ্ঞ নৃপাপসদ [নিন্দিত রাজা] তাহাতেও পরিতুষ্ট হয় নাই। মূৰ্দ্ধাভিষিক্ত ভূপতিগণকে বলপূর্ব্বক আয়ত্ত করিতেছে; তাহারাও স্বচ্ছন্দে তাহার বশীভূত হইতেছেন। হে ধৰ্মাত্মন! আপনি নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া কি প্রকারে তাহার সহিত সংগ্ৰাম করিবেন? কিন্তু হে ভরতকুলপ্ৰদীপ! বলি প্ৰদানার্থে সমানীত ভূপতিগণ প্রোক্ষিত [রুদ্র উদ্দেশ্যে স্থাপিত] ও প্রমৃষ্ট [রুদ্রের উদ্দেশে উৎসগীকৃত] হইয়া পশুদিগের ন্যায় পশুপতির গৃহে বাস করিয়া অতি কষ্টে জীবন ধারণ করিতেছেন। দুরাত্মা জরাসন্ধ তাহাদিগকে অচিরাৎ ছেদন করিবে, এই নিমিত্তই আমি তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে উপদেশ দিতেছি। ঐ দুরাত্মা ষড়শীতিজন ভূপতিকে আনয়ন করিয়াছে, কেবল চতুর্দশ জনের অপ্রতুল আছে। ঐ চতুর্দ্দশ জন আনীত হইলেই ঐ নৃপাধ্যম উহাদের সকলকে এককালে সংহার করবে। হে ধৰ্মাত্মন! এক্ষণে যে ব্যক্তি দুরাত্মা জরাসন্ধের ঐ ক্রূরকর্মে বিঘ্ন উৎপাদন করিতে পরিবেন, তাহার যশোরাশি ভূমণ্ডলে দেদীপ্যমান হইবে এবং যিনি উহাকে জয় করিতে পারিবে, তিনি নিশ্চয়ই সাম্রাজ্য লাভ করিবেন।