১৪তম অধ্যায়
কীচকবধপর্ব্বাধ্যায়—দ্রৌপদীদর্শনে কীচকের কামমোহ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারথ পাণ্ডবগণ প্রচ্ছন্ন হইয়া মৎস্যনগরে বাস করিতে লাগিলেন। দ্রুপদনন্দিনী পরিচারভাজন [দাসীসেবাপ্ৰাপ্তির যোগ্য] হইয়াও বিরাটমহিষী ও অন্যান্য রমণীগণের পরিচর্য্যা ও সন্তোষসাধনপূর্ব্বক অতি দুঃখে অন্তঃপুরে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহাদিগের দশ মাস অতিক্রান্ত হইল।
একদা বিরাট-ভূপতির সেনাপতি মহাবল কীচক দ্রুপদনন্দিনীর অলোকসামান্য রূপলাবণ্য অবলোকন করিয়া কন্দপশরের নিতান্ত বশবর্তী হইল এবং কামাকুলিত-চিত্তে সুদেষ্ণাসমীপে গমন করিয়া সহাস্যবদনে কহিল, “আমি এরূপ সুরূপা কামিনীকে বিরাট-রাজের ভবনে নয়নগোচর করি নাই। যেমন মদিরা গন্ধ দ্বারা উন্মাদিত করে, সেই ভাবিনীর মনোহর রূপ তদ্রূপ আমাকে নিতান্ত মোহিত করিয়াছে। হে শোভনে! এই দেবরূপিণী হৃদয়-গ্রাহিণী কামিনী কে, কাহার কামিনী এবং কোথা হইতে আগমন করিয়াছে, বল। এই বালা আমার চিত্ত উন্মথিত করিয়া আমাকে নিতান্ত বশংবাদ করিয়াছে। আহা এই অলৌকিকরূপলাবণ্যবতী যুবতী তোমার পরিচারিকা হইয়া কি অসদৃশ কর্ম্ম করিতেছে! অতএব এ আমার উপর আধিপত্য এবং হস্ত্যশ্বরথসুসমৃদ্ধ প্রভূত পানভোজনসম্পন্ন ও কাঞ্চনময় বিভূষণশালী মদীয় ভবনের শোভাসম্পাদন করুক।”
কীচক সুদেষ্ণাকে এই প্রকার আমন্ত্ৰণ করিয়া, জম্বুক যেমন সিংহকন্যার সমীপে গমন করে, তদ্রূপ দ্রুপদাত্মজার সমীপবর্তী হইয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিল, “হে কল্যাণি! তুমি কে, কাহার প্রিয়তমা এবং কি নিমিত্তই বা বিরাট-নগরে আগমন করিয়াছ, যথার্থকরিয়া বল। আহা! তোমার কি রূপমাধুরী! কি অনুপম কান্তি! কি মনোহর সুকুমারতা। তোমার মুখমণ্ডল শশাঙ্ক-সদৃশ সুনির্ম্মল, লোচন পদ্মপত্রের ন্যায় আয়ত ও বাক্য কোকিল-কূজিতের ন্যায় সুমধুর; ফলতঃ তোমার ন্যায় রূপবতী কামিনী কুত্ৰাপি নয়নগোচর করি নাই। হে সর্ব্বাঙ্গসুন্দরি! তুমি লক্ষ্মী কি ভূতি, হ্রী বা শ্ৰী, অথবা কীর্ত্তি কি কান্তি! সুন্দরি! এই জগতে এমন কে আছে যে, তোমার অনঙ্গবিলাসিনীর ন্যায় রূপ, চন্দ্রের ন্যায় মুখ ও চন্দ্ৰিকার ন্যায় ঈষৎ হাস্য নিরীক্ষণ করিয়া ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিতে পারে? তোমার হারভুষণোচিত কমলকলিকাসদৃশ, কামদেবের কশার ন্যায় পীন পয়োধরযুগল আমাকে নিরন্তর নির্য্যাতন করিতেছে। বলীবিভঙ্গচতুর [বলীদ্বারা বিভক্ত-উপরিভাগে বিন্যস্ত নুদিদ্বারা কাটির ক্ষীণতা], স্তনভারাবনত করাগ্রসম্মিত [গোলাকারে সন্নিবেশিত উভয় করের অঙ্গুষ্ঠ মধ্যমদ্বারা পরিমিত] মধ্যভাগ ও নদীপুলিনসন্নিভ মনোহর জঘনস্থল নয়নগোচর করিয়া আমি দুর্নিবার্য্য কামজ্বরে একান্ত জর্জরিত হইয়াছি। অধিক কি বলিব, দুঃসহ দাবানলসদৃশ কামানল তোমার সমাগম-সংকল্পে পরিবর্দ্ধিত হইয়া আমাকে দগ্ধ করিতেছে। অতএব হে বরারোহে! আত্মপ্ৰদানরূপ বারিধারা বর্ষণ করিয়া এই দুর্বিষহ মদনাগ্নি নির্ব্বাণ কর। হে অসিতাপাঙ্গি! তীব্রতর মন্মথশর আমার চিত্ত উন্মথিত করিয়াছে এবং হৃদয় বিদারণপূর্ব্বক অন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া আমাকে উন্মাদিত করিতেছে, তুমি আত্মপ্রদান করিয়া আমাকে পরিত্রণ কর। হে বিলাসিনি! তুমি বিচিত্র মাল্য ধারণ, বসন পরিধান এবং সমুদয় আভারণে বিভূষিত হইয়া আমার সহিত সমুদয় কাম্যবিষয় উপভোগ কর। তুমি সুখভাজন হইয়া কি নিমিত্ত ঈদৃশ অসুখে কালব্যাপন করিতেছ? এক্ষণে স্বচ্ছন্দে আমার নিকটে থাকিয়া সুস্বাদু পানভোজন প্রভৃতি সৌভাগ্যসুখসম্ভোগ কর। তোমার ঈদৃশ রূপ ও নবীন বয়স অপরিহিত মালার ন্যায় মনোহর হইয়াও নিরর্থক হইতেছে। হে চারুহাসিনি! আমি তোমার নিমিত্ত সমুদয় পুরাতন প্ৰণয়িনীগণকে পরিত্যাগ করিব, তাহারা তোমার দাসী হইয়া থাকিবে এবং আমিও দাসের ন্যায় তোমার আজ্ঞাকারী হইব।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “হে সূতপুত্র! আমি কেশসংস্কারিণী সৈরিন্ধ্রী, অতি হীন জাতিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, আমাকে প্রার্থনীয় বলিয়া মনে করিও না। বিশেষতঃ পরপত্নী দয়ার পাত্ৰ, অতএব ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। পরপত্নীতে অভিলাষ কদাপি কর্ত্তব্য নহে। অকাৰ্য্যপরিত্যাগই সৎপুরুষগণের প্রধান ব্ৰত। পাপাত্মা ব্যক্তি অন্যায্য বিষয়ে অভিলাষ করিয়া ঘোরতর অযশ ও মহাদাভয় প্রাপ্ত হয়।”
কীচক পরদারাভিমর্ষণ সর্ব্বলোকবিগাহিত বহুদোষের আকর জানিয়াও কন্দর্পশরের নিতান্ত বশীভূত হইয়া পুনরায় দ্রৌপদীকে কহিল, ‘চারুহাসিনি!! আমি তোমার একান্ত বশংবদ ও প্রিয়বাদী, আমাকে প্রত্যাখ্যান করা তোমার নিতান্ত অনুচিত; করিলে অবশ্যই তোমাকে অনুতাপ করিতে হইবে। হে সুভ্রু! আমি এই সমুদয় রাজ্যের অধীশ্বর ও অপ্রতিম শৌৰ্য্যশালী। রূপ, যৌবন, সৌভাগ্য ও ভোগে আমার সমকক্ষ ব্যক্তি কুত্ৰাপি বিদ্যমান নাই। হে কল্যাণি! এরূপ সমৃদ্ধ ভোগসকল বিদ্যমান থাকিতে তুমি কিজন্য দাস্যকাৰ্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছ? হে নিতস্বিনি! তুমি এক্ষণে আমার মনোরথ পরিপূর্ণ কর, আমি সমুদয় রাজ্য তোমাকে প্রদান করিলাম, তুমি এই রাজ্যে আধিপত্য করিয়া নানাবিধ সুখসম্ভোগ কর।”
কীচকের কু-প্ৰস্তাবে দ্ৰৌপদীর তিরস্কার
পতিপরায়ণা দ্রৌপদী কীচকের এবম্প্রকার দুর্ব্বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে ভৎসনাপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে সূতপুত্ৰ! মোহাবিষ্ট হইও না, কেন বৃথা জীবন পরিত্যাগ করিবে? দুৰ্দান্ত পঞ্চ গন্ধর্ব্ব সতত আমাকে রক্ষা করিয়া থাকেন, তাঁহারা আমার স্বামী। তুমি কখনই আমাকে লাভ করিতে পরিবে না। গন্ধর্ব্বগণ কুপিত হইলে অবশ্যই তোমাকে নিহত করিবেন। সাবধান! মৃত্যুমুখে প্রবিষ্ট হইও না। তুমি পুরুষগণের অগম্য পথে গমন করিতে ইচ্ছা করিতেছ। যেমন অজ্ঞান বালক এক কূল হইতে অপর কুলে উত্তীর্ণ হইতে ব্যগ্র হয়, তুমি সেইরূপ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছ। তুমি যদ্যপি পৃথিবীর অভ্যন্তরে বা উৰ্দ্ধপথে অথবা সমুদ্রপারে পলায়ন কর, তথাপি আমার স্বামীগণের সমীপে পরিত্রাণ পাইবে না। তাঁহারা গগনচারী দেবপুত্ৰ। হে কীচক! তুমি কেন বৃথা নির্ব্বন্ধ সহকারে আমাকে প্রার্থনা করিয়া শমনসদনে গমন করিতে বাসনা করিতেছ? যেমন মাতৃক্রোড়স্থিত বালক চন্দ্ৰকে গ্রহণ করিতে যায়, তদ্রুপ তুমি আমাকে গ্ৰহণ করিবার অভিলাষ করিতেছ। আমাকে প্রার্থনা করিয়া ভূগর্ভে প্রবেশ কিংবা অন্তরীক্ষে গমন করিলেও তোমার রক্ষা নাই। অতএব সৎপথে নেত্রনিয়োগ করিয়া জীবন রক্ষা কর।”