কালো রঙের গ্রেট কোটটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল বাগানের মধ্যে।
বাগানে একটা গাছের ডালের সঙ্গে বুলিছিল, একজন পুলিসেরই বাগানটা অনুসন্ধান করতে করতে চোখে পড়ে। কোটটা হাতে পুলিসটা কিরীটীর ঘরেই এসে ঢুকল।
চৌবেজীও ওই সময় কিরীটীর ঘরের মধ্যে বসেছিল। চিত্রাঙ্গদা দেবীর হত্যার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিল।
ইতিমধ্যে আরো একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। পুলিস-প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ গতরাত্রে সুধন্য ইন্দ্ৰালয় থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেচারা বেশি দূরে যেতে পারেনি। কাতরাসগড় ছাড়িয়ে তেতুলিয়া হল্টের কাছাকাছি পরের দিনই সন্ধ্যায়ই সুধন্য ধরা পড়ে যায়।
সুধন্যকে পুলিস ধরে নিয়ে এসেছে।
চৌবেজীর ইচ্ছা ছিল সুধন্যকে নিয়ে গিয়ে একেবারে হাজতে পোরেন; কারণ তাঁর ধারণা চিত্রাঙ্গদা দেবীর হত্যাকারী আর কেউ নয়—এই সুধন্যই।
কিন্তু কিরীটী বলেছে, না চৌবেজী, তাড়াহুড়ো করে কিছু করবেন না।
আপনি বুঝতে পারছেন না মিস্টার রায়,–চৌবেজী বলেছিলেন, ওকে ছেড়ে রাখলে বিপদ হবে।
কিছু হবে না। আমি বলছি। কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে।
কিন্তু গ্যারান্টিই বা কি?
গ্যারান্টি ওর নিজের চরিত্র।
বুঝলাম না। আপনার কথাটা মিস্টার বায়!
ও পালিয়ে যেতে পারে না-পালাবার মত শক্তি ওর নেই।
কিন্তু–
আমি আপনাকে আগেই বলেছি। চৌবেজী—আবারও বলছি, হত্যাকারী ও নয়।
তাই যদি নয় তো ওকে ছেড়ে দিলেই তো হয়, নজরবন্দী করে রাখবারই বা দরকার কি?
দরকার আছে। যে দাবাখেলা আমরা শুরু করেছি, সেই দাবার ছকেরই ও জানবেন মোক্ষম একটি ঘুটি—একটি বোড়ে। সেই বোড়ের চালটি ঠিক সময়মত যখন দেব, দেখবেন সমস্ত কুয়াশা কেটে গেছে।
কুয়াশা!
হ্যাঁ—লক্ষ্য করেছেন, আজ কদিন থেকেই ভোরের দিকে কি ঘন কুয়াশা নামছে! হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে।
হ্যাঁ, দেখেছি। কথাটা বলে চৌবেজী কেমন যেন বোকার মত ফ্যালি-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কিরীটীর মুখের দিকে।
আজও চৌবেজী আবার এসেছিল সুধন্যকে হাজতে নিয়ে গিয়ে পোরবার জন্য, কারণ ধরা পড়বার পর সুধন্যকে আবার এনে ইন্দ্ৰালয়ের মধ্যে নজরবন্দী রাখা হয়েছিল কিরীটীরই অনুরোধে। যদিও চৌবেজীর এতটুকু ইচ্ছা ছিল না। সুধন্যকে আবার ইন্দ্ৰালয়ে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করতে তিনি পারেননি। ওখানকার এস. পি. মিঃ সুন্দরায় চৌবেজীকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, কিরীটী যেমন বলবে, তাই যেন চৌবে করেন।
চৌবেজী বলেছিলেন, খুনীকো এই কোঠিমে রাখনা আচ্ছা নেহি!
লেকিন চৌবেজী, ম্যায়নে ত বহুত দফে কহা চুকা, উয়ো মুজলিম নেহি হ্যায়। কিরীটী বলে।
ম্যায়নে ভি ত ইতনা সাল বহি কাম কর রাহা হ্যায়—আগর উয়ো মুজলিম নেহি হোগা তো—ম্যায় পুলিসকো নোকরি ছোড় দুঙ্গা।
কিরীটী হাসে।
আর ঠিক সেইসময় পুলিসটা কোটটা নিয়ে ঘরে ঢোকে, হুজুর, দেখিয়ে ইয়ে পেরকা উপর সে মিলা!
চৌবেজী বিশেষ কোন আগ্রহ দেখান না ব্যাপারটায়। ওভারকেটটা কিরীটী যখন অনুসন্ধানের কথা বলেছিল, তখনো বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করেননি চৌবেজী।
চৌবেজী বলেন, রাখি দো-আভি—
পুলিসটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কিরীটী বাধা দিল। ডাকল, দেখি, দাও তো কোটাটা।
পুলিসটা কোটা কিরীটীর হাতে তুলে দিল।
কিরীটী প্রথমেই কোটটার পকেটগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে একটার পর একটা–উল্লেখযোগ্য কিছুই মেলে না।
মেলে–একটা রুমাল, একটা দেশলাই আর একটা সিগারেট-কেস।
চৌবেজী চেয়ে চেয়ে কিরীটির ব্যাপারটা দেখছিলেন-ঠোঁটের কোণে একটা অবজ্ঞার হাসির ক্ষীণ বিদ্যুৎ যেন।
কেয়া রায় সাহাব, কুছ মিলা?
কিরীটী কোন জবাব দেয় না। ওভারকেটটার কলারের কাছ থেকে একটা চুল টেনে বের করছে তখন সে।
চুলটা টেনে বের করে নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ সোঁকে।
কি দেখছেন চুলটা নিয়ে অত রায় সাহেব,-চৌবেজী আবার বলে ওঠেন, বহি বালসেই কেয়া আপকো মালুম হো জায়গা খুনী কৌন?
কিরীটী ফিরে তোকাল এবার চৌবেজীর মুখের দিকে। কিরীচীর দু-চোখের দৃষ্টিতে যেন বিদ্যুতের আলো ক্ষণেকের জন্য ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
শান্ত গলায় সে বলে, বেশখ, এই চুলটা থেকেই খুনীর পাত্তা আমি পেয়ে গেছি। চৌবেজী।
সাচ?
হ্যাঁ, মুঝে মিল গিয়া।
কোন থা উয়ো?
দো দিন বাদ আপকো বাতায়েঙ্গে।
সাচ?
জরুর।
কেয়া ম্যায়নে হ্যাণ্ডকাফ লাউ?
আগর আপকো দিল চাহে ত— আচ্ছা চৌবেজী, আমার একটু কাজ আছে। বলতে
চৌবেজীকেও অগত্যা উঠে দাঁড়াতে হয়।
তাহলে ওই কথাই রইল, কাল আসবেন—সকলেই-আচ্ছা নমস্তে।
কিরীটী আর দাঁড়াল না, মধ্যবর্তী দরজাপথে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। চৌবেজী তারপরও কয়েক সেকেণ্ড ঘরের মধ্যে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে দরজার দিকে অগ্রসর হল।
ওই দিনই সন্ধ্যার দিকে কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে বসে একটা বই পড়ছিল, মণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল।
এদিকে ওদিকে চাইতে চাইতে মণীন্দ্র ঘরে এসে ঢুকল।
মিস্টার রায়!
আসুন মণীন্দ্রবাবু, আমি গত দুদিন ধরে আপনারই অপেক্ষা করছিলাম। কিরীটী হাতের বইটা মুড়তে মুড়তে মণীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল।
আমার অপেক্ষা করছিলেন?
মণীন্দ্র কেমন যেন একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, আপনারই পথ চেয়ে ছিলাম বলতে পারেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
মণীন্দ্র বসে না, কেমন যেন ইতস্তত করে।
আমি জানতাম মণীন্দ্রবাবু, আপনি আসবেন—বসুন।
আপনি জানতেন আমি আসব?
হ্যাঁ, জানতাম। কিন্তু–
বসুন। মণীন্দ্র মুখোমুখি বসল চেয়ারটায়। সে যেন কেমন চিন্তিত মনে হয়।
কি ভাবছেন—যা বলতে এসেছেন, বলুন। ভয় নেই। আপনার, নিৰ্ভয়ে বলুন।
মিস্টার রায়, ফণী এসেছিল আপনার কাছে, তাই না?
হ্যাঁ
কি বলেছে সে?
অনেক কিছুই বলেছেন, যা পুলিসের কাছে জবানবন্দিতে সে-সময় তিনি বলেননি। তাহলে সে সব কিছু বলে দিয়েছে। আপনাকে?
হ্যাঁ, সব।
উইল বদলের কথা?
উইল!
হ্যাঁ, বড়মা যে সেদিন তাকে বলেছিলেন, তিনি তঁর আগের উইল বদলে ফেলবেন! বলেছেন বৈকি।
কথাটা অবিশ্যি বড়মা আমাদের তিন ভাইকেই জানিয়েছিলেন।
কিরীটীর চোখের মণি দুটো সহসা যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু মণীন্দ্রর সেটা নজরে এড়ায় না।
আপনাকে কবে বলেছিলেন কথাটা তিনি?
যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে, সেদিনই সন্ধার সময়, যখন স্বাতীর জন্য আমি বড়মাকে অনুরোধ জানাতে যাই—
কি বলেছিলেন তিনি ঠিক?
স্বাতীর বিয়ের কথা বলতেই হঠাৎ তিনি চটে উঠলেন। বললেন, তোমাদের যার যা খুশি তোমরা করতে পার—যেখানে যার খুশি তোমরা এই মুহুর্তে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পার। পথের ভিখারী—তোমাদের এনে ক্ষীর আর ঘিয়ের বাটি মুখে তুলে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি সে দয়াটা তোমাদের প্রতি দেখানেই আমার ভুল হয়েছে। পথের কুকুর চিরদিন পথের কুকুর থাকে—তাই সব থাকো গে। দূর হয়ে যাও সব এখান থেকে, তোমাদের কারো সঙ্গেই আমার কোন সম্পর্ক নেই—“কালই আমি নতুন উইল করে তোমরা কেউ যাতে একটি কপর্দকও না পাও সে ব্যবস্থা করছি।
তারপর?
আমারও হঠাৎ রাগ হয়ে গেল—আমিও কড়া কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলাম বড়মাকে।
কি বলেছিলেন তাতে তিনি?
বলেছিলেন, তোমাদের সব চাবুক মারা উচিত থামের সঙ্গে বেঁধে, নিমকহারাম কুত্তার দল! তাতে আমি বলেছিলাম–
কি?
তাহলে তোমাকে জ্যান্ত রাখব না জেনো।
বলেছিলেন আপনি?
হ্যাঁ—যা কোনদিন হয় না—হঠাৎ যেন মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলে উঠেছিল। পরে নিজেই অবাক হয়েছি কি করে বলতে পারলাম ও কথাগুলো বড়মাকে!
মারতে মারতে নিরীহ একটা বিড়ালছনাকে কোণঠাসা করলে, সেও শেষ পর্যন্ত থাবা তুলে নখর বের করে শেষবারের মত ঝাঁপিয়ে পড়বার চেষ্টা করে মণীন্দ্রবাবু, আপনিও ঠিক তাই করেছিলেন।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আমার মনের কথা নয়-রাগের মাথায় যাই বলে থাকি না কেন—
কিরীটী মৃদু হাসে।
মণীন্দ্র বলে, তাকে হত্যা করব আমাদের স্বপ্নেরও অতীত।
মণীন্দ্রবাবু, একটা কথা–
মণীন্দ্র কিরীটীর দিকে তাকাল।
সে-সময় ঘরে আর কে ছিল মনে আছে আপনার?
সুরুতিয়া ছিল।
আর কেউ না?
না, তবে বের হয়ে যাবার মুখে জয়ন্তদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে দরজার কাছেই। দাঁড়িয়েছিল, তাই মনে হয়–
কি?
সেও আমাদের সব কথা শুনেছিল।
ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন।
কিরীটীবাবু!
বলেন?
আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, আমাদের ভাইদের মধ্যেই কেউ একজন–
সেটা ভাবাই তো স্বাভাবিক।
কেন?
কারণ তাঁর পূর্বের উইল বদল করবার ইচ্ছাটা। সেই আশঙ্কায় তাঁকে আপনাদের হত্যা করাটা খুবই তো স্বাভাবিক।
না না, তাই বলে হত্যা করব?
মানুষ মানুষকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, একমাত্র দুর্ধর্ষ ক্রিমিন্যাল ছাড়া, চরম কোন উত্তেজনার মুহুর্তেই হত্যা করে বসে বা চরম আঘাত হেনে বসে।
মণীন্দ্র আর কোন কথা বলে না।
ধীরে ধীরে একসময় নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আর কিরীটীও যেন নিজের চিন্তায় নিজে ড়ুবে যায়।
তার পরদিনই ভোরবেলা কিরীটী কলকাতায় চলে গেল এবং একদিন পরে আবার সন্ধ্যায় ফিরে এল।
কাল—আগামী কালই, কিরীটী চৌবেজীকে বলেছে আততায়ীকে ধরিয়ে দেবে।
কিরীটী ফিরে এসেছে শুনে জয়ন্ত চৌধুরী তার ঘরে এসে ঢোকে।
আসুন জয়ন্তবাবু।
মিস্টার রায়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এলাম।
কি বলুন তো?
এভাবে কতদিন আর নজরবন্দী হয়ে এই ইন্দ্ৰালয়ে থাকতে হবে?
দুঃখের রাত্রি অবসান-প্রায়?
অবসান-প্রায়?
হ্যাঁ। বসুন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
তারপর কিরীটী ও জয়ন্তর মধ্যে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কথাবার্তা হল এবং রাত পৌনে আটটা নাগাদ জয়ন্ত কিরীটীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী তার ক্লান্ত দেহটা আরামকেদারার ওপর শিথিল করে দেয়।