ইন্দ্ৰজাল বা জাদু
আমরা দেখেছি কীভাবে ইন্দ্ৰজাল সমগ্র অথর্ববেদ সংহিতার পরিব্যাপ্ত রয়েছে। তবে, এই ইন্দ্ৰজালের নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই; তার বহু লক্ষ্য ও প্রকরণ রয়েছে–যথোপযুক্ত আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াসহ অতিলৌকিক শক্তিযুক্ত মন্ত্রপূত শব্দ উচ্চারণের সাহায্যে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই ‘জাদু’ বা ‘ইন্দ্ৰজালে’র উদ্দেশ্য। পার্থিব সুখই এর লক্ষ্য–কখনো সাধারণ পদ্ধতিতে, কখনো বা সমস্যা ও মহামারীর উপশমের মাধ্যমে তা অর্জিত হয়। ঐন্দ্ৰজালিক মোহ বিস্তার করে এবং ওষধি-প্রয়োগ ও অপদেবতার সাহায্য নিয়ে ব্যাধি থেকে আরোগ্যলাভের চেষ্টা করা হত। নির্দিষ্ট কিছু জাদুক্ৰিয়ার সাহায্যে নানা নামে দানব, রাক্ষস, পিশাচ, অন্সরা ও ভূতপ্রেতকে আহ্বান ও নিয়ন্ত্রণ করা হত। বৃক্ষলতা ও ওষধি থেকে নানা ধরনের ঐন্দ্রজালিক ওষধি ও চিকিৎসার উপযোগী ভেষজ প্ৰস্তুতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এ ধরনের ক্রিয়ার আকাঙক্ষা থেকে পরিতৃপ্তিতে কাল্পনিক উত্তরণ লক্ষণীয়, –কৃমিবিনাশক অনুষ্ঠান কিংবা প্ৰণয়জাদুর ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানগুলির অন্তিম অংশে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
যৌন-শক্তিবর্ধক ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠান ‘বাজীকরণ’ নামে পরিচিত; এক্ষেত্রে আহুত দেবতার ‘শেপ অর্ক’ নামটিতে সূর্যের উর্বরতাশক্তির প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত। বেশ কিছু সুক্তে যৌনদক্ষতা ও আবেগনির্ভর মানসিক আদান-প্ৰদান, হৃদয়-বিনিময়, ক্ৰোধের উপশম ইত্যাদির ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠাপন, প্রতিসঞ্জানন, সন্মোহন, উচাটন ইত্যাদি নানাবিধ বশীকরণ জাতীয় জাদু অনুষ্ঠানের বহুল-প্রয়োগ লক্ষণীয়। গ্রামীন জাদু-পুরোহিত বা আদিম ইন্দ্ৰজালের প্রভাব স্বৰ্গ আরোহনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত জাদু-প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে নিহিত। আবার সত্যানুত পরীক্ষা-জাতীয় অনুষ্ঠান স্পষ্টতই নৈতিক ও পরমর্থিক বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল ছিল; প্রাচীন মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বজগৎ যেহেতু সর্বতিক্রমী সত্য বা ঋতের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেজন্যে পাপকৰ্মা বা অনৃতকালীকে নিশ্চিতই ইন্দ্ৰজাল-নিয়ন্ত্রিত অদৃশ্যশক্তি উপযুক্ত শাস্তি দেবে,–এ বিশ্বাস ছিল। শত্রুবিনাশের জন্যে সূক্ত উচ্চারণ করার সময় তদুপযোগী, ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠানে একটি ভেকের প্রতীকী ব্যবহার করা হত। তেমনি বিষক্রিয়া থেকে আরোগ্য লাভের জন্যে উইঢিবির মাটিকে জাদুক্ৰিয়ার ব্যবহার করা হ’ত ।
ঐন্দ্রজালিক সূক্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হ’ল কৃত্যা ও কৃতাপরিহরণ। যাতু কিংবা রক্ষোবিদ্যা বা অভিচার নামে পরিচিত বিশিষ্ট ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়ার তিনটি উপবিভাগ রয়েছে : কৃত্যা (মোহবিস্তারী যাদু), বলগ (সাধারণত কলস বা অন্ধকার গুহায় লুক্কায়িত গোপন জাদুক্ৰিয়া) ও মূল্যকর্ম (বৃক্ষমূল ইত্যাদির সাহায্যে অনুষ্ঠিত ইন্দ্ৰজাল)। এই ত্ৰিবিধ ইন্দ্ৰজােলই আঙ্গিরার সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের বিপরীত মেরুতে বয়েছে কৃত্যাপরিহরণ, কৃত্যাদূষণ বা প্রত্যাভিচার-এদের মূল উদ্দেশ্য হল কোনো ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া নিবারণ। অভিচারকে যেমন যাতুধান অর্থাৎ পিশাচ, দানব বা দুষ্টু আত্মার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়, প্রত্যাভিচার তেমনই শত্রুপক্ষের জাদুক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তিকে ধবংস করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। মোহন, বশীকরণ, উচাটন প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি ‘কৃত্যা’র অন্তর্গত; ‘বলগ’ জাতীয় ক্রিয়া পাতাললোকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষ ধবনের গোপন রহস্যানুষ্ঠান এবং বিশেষত শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত কবার জন্যেই ব্যবহৃত, ‘মূলকর্ম’ লোকরসায়নের উপর নির্ভরশীল, কেননা আপন উদ্দেশ্য পুরণের জন্যে এটি (অন্য দুই প্রকার ইন্দ্রজালের অন্তর্গত) বৃক্ষমূল ও ওষধিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করত।