আমাদের যে ঘরটিতে আটকে রেখেছে তার বাইরে একটা ছোট করিডোর, করিডোরটাতে আধো আলো এবং আধো অন্ধকার। করিডোরের দুই মাথায় যতদূর চোখ যায় কোনো গার্ড নেই। লিংলির এই ক্রেনিপিউটার প্রোজেক্টটি এত নৃশংস এবং অমানবিক যে, সে এটি কারো কাছে প্রচার করতে পারে না। সে যা করতে চায় সেটি গোপনে করতে হয়, তাই খুব বেশি মানুষের সাহায্য নিতে পারে না। নিরাপত্তার জন্য সে মানুষ থেকে বেশি নির্ভর করে যন্ত্রপাতির উপর। মানুষ যাদেরকে রেখেছে তাদের বেশির ভাগকেই ডিটিউন করে রেখেছে। এই ডিটিউন করা মানুষগুলো তাদেরকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটি-দুটি কাজ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। এইমাত্র আমরা একটা প্রহরীকে কাবু করে এসেছি, এই প্রহরীটি পুরোপুরি ডিটিউন করা নয়, কিন্তু তারপরেও পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষ মনে হয়নি। সে একটিবারও একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি।
লিরিনা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে, তার ঠিক পেছনে টিশা এবং তার থেকে কয়েক পা পেছনে আমি। আমি অস্ত্রটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি, সামনে থেকে হঠাৎ কেউ এলে সে আমাকে অস্ত্র হাতে দেখতে পাবে না এবং আমি কিছু একটা করার সময় পাব।
আমরা লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে শেষ মাথায় পৌঁছে যখন লিরিনার পিছু পিছু ডান দিকে হাঁটতে শুরু করেছি ঠিক তখন দেখতে পেলাম, সামনে দিয়ে একজন হেঁটে আসছে। আমি চমকে উঠলাম এবং আমার বুকটা ধক করে উঠল, আমি অস্ত্রটা উঁচু করে ধরলাম, যদি গুলি করতে হয় গুলি করব, কিন্তু আমি কখনো কোনো মানুষকে গুলি করিনি। মানুষকে হত্যা করা মোটেও সহজ কিছু নয়।
লিরিনা বলল, “ভয় নেই। এটি একজন ডিটিউন করা মানুষ।” আমি বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে অস্ত্রটা নিচে নামিয়ে আনি। ডিটিউন করা মানুষটি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।
আমরা আরো দুটি করিডোর পার হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সময় প্রথমবার আরেকজন সশস্ত্র প্রহরীর দেখা পেলাম। মানুষটি লিরিনাকে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছিল কিন্তু তার পেছনে টিশাকে আর আমাকে দেখে চমকে উঠল। কোনো কথা না বলে সে তার অস্ত্রটা আমাদের দিকে তাক করে ধরল, টিশা ফিসফিস করে বলল, “গুলি কর রিহি।”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “আমি কখনো কোনো মানুষকে গুলি করিনি।”
টিশা বলল, “কোনো ভয় নেই। তোমার অস্ত্রটি কোনো মানুষকে মেরে ফেলবে না। এটা ট্রাংকিউলাইজারে সেট করা। মানুষটি অচেতন হয়ে যাবে।”
আমি আর দেরি না করে গার্ডটাকে গুলি করলাম, “ধুপ” করে একটা চাপা শব্দ হলো আর সাথে সাথে মানুষটা একটু কেঁপে উঠে একটা আর্ত শব্দ করল। এক ধরনের বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ঘুরে গিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে গেল।
টিশা ছুটে গিয়ে গার্ডের গলায় ঝোলানো ব্যাজটা খুলে নিয়ে তার অস্ত্রটা হাতে নিয়ে বলল, “চমৎকার! এখন আমাদের দুটি অস্ত্র! আরো একজন গার্ডের সাথে দেখা হলে আমাদের তিনটি অস্ত্র হয়ে যাবে, আমরা তখন পুরোপুরি সশস্ত্র একটা দল হয়ে যাব।”
আমি বললাম, গার্ডটাকে লুকিয়ে ফেলা দরকার। টিশা বলল, “কোথায় লুকাবে?”
লিরিনা বলল, “কাছেই একটা ইউটিলিটি ঘর আছে, আমরা সেখানে লুকিয়ে ফেলতে পারি।”
তখন আমরা ধরাধরি করে গার্ডটাকে ইউটিলিটি ঘরে লুকিয়ে ফেলে আবার তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম। আমি টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার অস্ত্রটা যে ট্রাংকিউলাইজারে সেটা করা সেটা তুমি কখন দেখলে?”
টিশা বলল, “আমি দেখিনি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তাহলে?”
“আমি অনুমান করেছিলাম, জীবিত মানুষ লিংলির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। লিংলি কখনোই কাউকে মেরে ফেলতে চাইবে না। তাই ধরে নিয়েছিলাম অস্ত্রটা নিশ্চয়ই ট্রাংকিউলাইজারে সেটা করা থাকবে।”
“যদি না থাকত?”
“তাহলে একটু আগে তুমি জীবনে প্রথম একটা মানুষ খুন করতে। বিপদের সময় অনেক কিছু করতে হয়।”
আমি কোনো কথা বললাম না। টিশা খুবই বিচিত্র মেয়ে, তাকে বোঝা খুব কঠিন।
লিরিনা আমাদেরকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে একটা খাড়া দেয়ালের সামনে হাজির হলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ক্রেনিপিউটার।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু এখানে ঢুকব কেমন করে?”
লিরিনা বলল, “জানি না।”
টিশা খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালটি লক্ষ করে, সেটার উপরে হাত বুলায় কিন্তু ভেতরে ঢোকার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তখন একটু আগে গার্ডের গলায় ঝোলানো যে ব্যাজটি টিশা খুলে এনেছে সেটা দেয়ালের উপর রেখে ডানে বামে নাড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে ঘরঘর শব্দ করে দেয়ালটি সরে গিয়ে ভেতরে ছোট একটি ঘর বের হয়ে আসে। টিশার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “চমকার।”
ছোট ঘরটিতে ঢোকার পর দরজাটা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল–সেটি একদিক থেকে ভালো, হঠাৎ করে কেউ চলে এলে আমাদের দেখতে পাবে না।
সামনে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, দূর থেকে আমাদের কেউ দেখছে কি না বুঝতে পারছিলাম না। দেখতে পেলেও কিছু করার নেই। আমাদের কাছে এমন দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, দরকার হলে ছোটখাটো যুদ্ধ করা যাবে।
টিশা লিরিনাকে সামনের দরজাটা দেখিয়ে বলল, “লিরিনা, তোমাকে এই দরজাটা খুলে দিতে হবে।”
লিরিনা একটু ইতস্তত করে বলল, “কীভাবে?”
“দরজার প্যানেলে পাসওয়ার্ডটি ঢোকাতে হবে।”
লিরিনা দুর্বলভাবে হেসে বলল, “পাসওয়ার্ডটি আমাকে বের করতে হবে?”
টিশা মাথা নেড়ে তার পকেট থেকে একটা ক্রেনি-টিউব বের করে তার কোডটি পড়ে নিশ্চিত হয়ে বলল, “তোমার ক্রেনিয়ালে এটা ঢোকানো হলে তুমি অসাধারণ একজন গণিতবিদ হয়ে যাবে। তখন হয়তো পাসওয়ার্ডটি বের করতে পারবে।”
“যদি না পারি?”
“তাহলে আমাদের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলব। কিন্তু আগেই সেটা করতে চাই না। যত সম্ভব কম হৈ চৈ করে
ক্রেনিপিউটারে ঢুকতে চাই।”
লিরিনা বলল,”ঠিক আছে, বানাও আমাকে গণিতবিদ।”
টিশা লিরিনার মাথায় সাবধানে ক্রেনি-টিউবটা ঢুকিয়ে দিল। লিরিনা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ খুলে তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবকিছু ঠিক আছে?”
লিরিনা বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু বুঝতে পারছি মাথার ভেতর কিছু একটা হয়ে গেছে। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়ার মতো লাগছে। সংখ্যা ছাড়া আর কিছু দেখছি না।”
টিশা লিরিনার হাত ধরে বলল, “আমরা মোটেও তোমাকে এই অবস্থায় বেশিক্ষণ রাখব না। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো পাসওয়ার্ডটি ডিকোড করতে পার কি না–যদি না পার ক্ষতি নেই, এক্ষুনি আবার তোমার মাথায় নিউট্রাল টিউব দিয়ে তোমাকে ঠিক করে দেব।”
লিরিনা কোনো কথা বলল না, ভুরু কুঁচকে দরজার প্যানেলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে এবং মুখটি কেমন যেন লালচে হয়ে আসতে থাকে। সে দুই হাত দিয়ে তার মাথার চুলে হাত ঢুকিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করতে থাকে এবং তাকে দেখে আমাদের কেমন যেন ভয় করতে থাকে।
টিশা বলল, “লিরিনা, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে? তাহলে থাকুক আমরা গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলি।”
লিরিনা বলল, “না, আগে একটু চেষ্টা করে দেখি।”
লিরিনা দরজার সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। সে কিছুক্ষণ সংখ্যার প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সেটার উপর আলতো করে হাত বুলালো। তারপর হঠাৎ প্রায় ঝড়ের বেগে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে আবার কিবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল, হাত দিয়ে স্পর্শ করল এবং চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে প্যানেলের কিবোর্ডে খুব দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করায়, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর আবার কিবোর্ডে সংখ্যা প্রবেশ করায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আবার দ্রুত কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে ভারী দরজার মাঝে কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করে।
টিশা বলল, “তুমি কী করছ লিরিনা? যদি সমস্যা হয় বলো, গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলি।”
লিরিনা কথা শুনতে পেল কি না বুঝতে পারলাম না। সে কিছুক্ষণ দরজাটার দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে একটা একটা করে সংখ্যা প্রবেশ করাতে থাকে এবং কী আশ্চর্য হঠাৎ করে দরজাটা খুলে যায়। সাথে সাথে লিরিনাও মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে গেল।
আমি আর টিশা ছুটে গিয়ে লিরিনাকে ধরলাম, টিশা আতঙ্কিত হয়ে ডাকল, “লিরিনা! লিরিনা!”
লিরিনা চোখ খুলে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
আমরা ভয় পাচ্ছিলাম দরজাটা না আবার বন্ধ হয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ হলো না এবং লিরিনা কয়েক সেকেন্ড পর উঠে বসে বলল, “চলো, যাই।”
টিশা বলল, “তোমার ক্রেনিয়ালে নিউট্রাল টিউব দিয়ে তোমাকে ঠিক করে দিই?”
লিরিনা বলল, “আগে ভেতরে ঢুকে যাই, তারপর।”
আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম এবং তিনজন একসাথে আর্তনাদ করে উঠলাম।
.
ভেতরে বিশাল একটা হলঘর এবং সেখানে অসংখ্য মানুষের নগ্ন দেহ ছাদ থেকে ঝুলছে। সূক্ষ্ম এক ধরনের তার দিয়ে শরীরটাগুলো ঝোলানো হয়েছে, দেখে মনে হয় বুঝি মানুষগুলো শূন্যে ঝুলছে। মানুষগুলোর মাথার পেছন থেকে ইলেকট্রিক ক্যাবল বের হয়ে এসেছে। তাদের নাকের ভেতরে এক ধরনের নল। মুখের ভেতরে আরেকটি নল এবং শরীরের ভেতরে নানা জায়গায় ছোট-বড় নল লাগানো। কোনো কোনো নলের ভেতর দিয়ে শরীরের ভেতর এক ধরনের তরল পদার্থ ঢুকে যাচ্ছে। কোনো কোনো নলের ভেতর দিয়ে তাদের শরীর থেকে কিছু একটা বের করে নেওয়া হচ্ছে। হলঘরে যন্ত্রের এক ধরনের চাপা গুঞ্জন এবং সবচেয়ে যেটি ভয়ংকর সেটি হচ্ছে তীব্র এক ধরনের অপরিচিত অস্বস্তিকর গন্ধ।
আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, মনে হতে লাগল বুঝি ভুল করে নরকের ভেতর এসে ঢুকে পড়েছি। ছাদ থেকে তার দিয়ে ঝোলানো মানুষগুলোর মুখে যন্ত্রণার এক ধরনের অভিব্যক্তি। তাদের চোখ বন্ধ, কিন্তু মাঝে মাঝেই তাদের চোখ খুলে যাচ্ছিল কিন্তু সেই চোখে তারা কিছু দেখছিল বলে মনে হয় না। হঠাৎ হঠাৎ তাদের সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিল এবং মাঝে মাঝে তাদের গলা দিয়ে ঘর ঘর করে এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছিল। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত মানুষের দেহ। নারী-পুরুষ এবং কিশোর-কিশোরী। তাদের শরীরে একধরনের অপুষ্টির চিহ্ন, গায়ের রং বিবর্ণ। কারো মাথায় কোনো চুল নেই।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম। তারপর টিশার দিকে তাকিয়ে বললাম “টিশা।”
“বলো রিহি।”
“আমরা এখন কী করব?”
“মানুষগুলোর বাই-ক্রেনিয়াল থেকে ক্যাবলগুলো খুলে নিতে হবে।”
“এতগুলো মানুষ, একটা একটা করে খুলতে অনেক সময় নেবে। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী?”
আমি বললাম, “বাই-ক্রেনিয়ালগুলো অন্যরকম, মনে হয় মস্তিষ্কের ভেতর পাকাপাকিভাবে কানেকশন দেওয়া-টান দিয়ে মনে হয় না খোলা যাবে।”
টিশা কাছাকাছি ঝুলে থাকা একজন মানুষকে ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে কানেকশন পাকাপাকিভাবে দেওয়া।”
“তাহলে কী করব?”
“মনে হয় ইলেকট্রিক কানেকশনটা খুঁজে বের করে সেটা নষ্ট করতে হবে।”
আমি বিশাল হলঘরটার দিকে তাকালাম, অসংখ্য মানুষের মাথা থেকে বাই-ক্রেনিয়াল কানেকশন দিয়ে ইলেকট্রিক তারগুলো বের হয়ে এসেছে, কোনটা কোনদিকে গিয়েছে বোঝার উপায় নেই। এখান থেকে কানেকশন বের করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আমি তারপরও চেষ্টা করতে থাকি। ঝুলিয়ে রাখা মানুষগুলোর মাথা থেকে বের হওয়া ইলেকট্রিক ক্যাবলগুলো কোনদিকে গিয়েছে খুঁজে বের করে সেটাকে লক্ষ করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলাম।
তখন লিরিনা আমাকে থামাল, বলল, “রিহি।”
“বলো লিরিনা।”
“তোমরা আমাকে দুই মিনিট সময় দাও, আমি এই নেটওয়ার্কের সেন্ট্রাল নোডটা বের করে দিই।”
“তুমি পারবে?”
“অন্য সময় হলে পারতাম না। এখন মনে হয় পারব।”
লিরিনা মানুষগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে, তারগুলো লক্ষ করে, মনে মনে কিছু হিসাব করে তারপর হেঁটে হেঁটে মাঝামাঝি একটা জায়গায় থেমে গিয়ে আমাদের ডাকল। বলল, “টিশা আর রিহি। এদিকে এসো।”
আমরা ঝুলন্ত মানুষগুলোর ফাঁক দিয়ে হেঁটে লিরিনার কাছে গেলাম। লিরিনা হাত দিয়ে দেয়ালের একটা চতুষ্কোণ বাক্স দেখিয়ে বলল, “এই যে এখানে সবগুলো তার এসেছে। এটা হচ্ছে সেন্ট্রাল নোড।”
টিশা বলল, “তার মানে এখান থেকে সবার মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠানো হয়, আবার সবার মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল নিয়ে এখানে জমা করা হয়? প্রক্রিয়া করা হয়?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে এটা ধ্বংস করলে পুরো ক্রেনিপিউটার ধ্বংস হয়ে যাবে?”
“হ্যা! মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করার এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়।”
টিশা এবারে কোনো কথা না বলে হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে ধরে দেয়ালের চৌকোনা বাক্সটা লক্ষ করে গুলি করতে শুরু করে। প্রথম গুলিতেই সেটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু টিশা থামল না, হিংস্র মুখে সেটাকে গুলি করতে থাকল এবং গুলির ভয়ংকর শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে হলঘরে ফিরে আসতে থাকল।
আমি টিশার ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, “টিশা, থামো। এটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কেউ এটাকে ঠিক করতে পারবে না।”
টিশা থামল, আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “এখন আমার মরে গেলেও দুঃখ নেই।”
আমি বললাম, “না টিশা। এখন মরে যেতে পারবে না। এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে। লিংলিকে ধরিয়ে দিতে হবে। তারপর বলতে পার, মরে গেল দুঃখ নেই। এর আগে মরে গেলে অনেক দুঃখ থাকবে।”
কে যেন গমগমে গলায় বলল, “তোমাদের সেই দুঃখ নিয়েই মারা যেতে হবে।”
আমরা চমকে উঠলাম, মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি বিজ্ঞানী লিংলি, তার হাতে একটা বেঢপ অস্ত্র। আমাদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তোমরা আমার এত বড় ক্ষতি করতে পেরেছ। পুরো শহরটা এই ক্রেনিপিউটার নিয়ন্ত্রণ করত–এখন পুরো শহরটা নিয়ন্ত্রণহীন। তোমাদের জন্য।” হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, “শুধু তোমাদের জন্য।”
আমি হাতের অস্ত্রটা সোজাসুজি লিংলির দিকে তাক করে বললাম, “আমি কখনো কোনো মানুষ খুন করিনি। সব সময়েই মনে হতো কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানী লিংলি–কিংবা দানব লিংলি, তোমাকে খুন করার জন্য গুলি করতে আমার হাত এতটুকু কাঁপবে না।”
লিংলি বলল, “তাতে কিছু আসে যায় না নির্বোধ ছেলে। তোমাদের অস্ত্র থেকে এখন কোনো গুলি বের হবে না, আমি এইমাত্র সেইগুলো অকেজো করে দিয়েছি। বিশ্বাস না করলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করে দেখ।”
আমি চেষ্টা করলাম, খট করে একটা শব্দ হলো কিন্তু আর কিছু হলো না। বিজ্ঞানী লিংলি এক পা পিছিয়ে বলল, “এই ছেলে আর মেয়ে, তোমরা আমার মানুষগুলোর সামনে থেকে সরে এসো। আমি যখন গুলি করব তখন মানুষগুলোর কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমাকে আবার ক্রেনিপিউটার দাঁড় করাতে হবে। মানুষগুলো আমার দরকার।”
আমি আর টিশা যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। লিংলি বলল, “ঠিক আছে। তাহলে যেখানেই আছ সেখানেই থাকো, আমি ট্রাংকিউলাইজার দিয়ে গুলি করি। যখন তোমাদের জ্ঞান হবে তখন দেখবে, আমার ক্রেনিপিউটারের মানুষগুলোর পাশে তোমরা দুজনও কার্বন ফাইবারের তার দিয়ে ছাদ থেকে ঝুলছ।”
লিংলির মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে এবং সে তার মুখের ভয়ংকর হাসিটি ধরে রেখে ট্রিগারে হাত দিল। আমি আর টিশা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আমরা দেখছি খোলা দরজা দিয়ে আমাদের সাথে থাকা মানুষগুলো নিঃশব্দে ঢুকছে। সবার সামনে থাকা মাঝবয়সী মানুষটির হাতে একটা ধাতব দণ্ড, সে পেছন থেকে লিংলির মাথায় আঘাত করার জন্য দণ্ডটি মাথার উপরে তুলেছে।
লিংলি আগে গুলি করেছে নাকি মানুষটি লিংলির মাথায় আগে আঘাত করেছে আমরা জানি না, কিন্তু গুলির শব্দের সাথে সাথে দেখতে পেলাম লিংলি হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে গেল। গুলিটা আমাদের গায়ে লাগল না। ছাদের কোথাও আঘাত করে কিছু প্যানেল ভেঙ্গে নিচে এসে পড়ল। ধাতব দণ্ড হাতে মানুষটি কিছুক্ষণ লিংলির অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর টিশার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে, তোমার নামটি ভুলে গেছি।”
“টিশা।”
“টিশা, তুমি যখন বলেছিলে আমাদের সবাইকে মুক্ত করবে তখন আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। তোমাকে আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি, তুমি কিছু মনে করো না। আমাকে মাফ করে দিয়ো।”
টিশা কোনো কথা বলল না। মানুষটি বলল, “টিশা, মা, তোমার মতো আমার একটি মেয়ে ছিল।”
টিশা জিজ্ঞেস করল, “সে কোথায়?”
“জানি না, একদিন হারিয়ে গেল।”
লিরিনা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে একটু এগিয়ে এসে বলল, “তোমার মেয়ে হারিয়ে যায়নি।”
মানুষটি চমকে উঠল, বলল, “সে কোথায়?”
লিরিনা বলল, “সে এখানেই আছে। সবার হারিয়ে যাওয়া ছেলে আর মেয়ে এখানে আছে।”
মানুষটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
লিরিনা বলল, “আমি জানি। আমি এখানে কাজ করেছি। আমাকে ডিটিউন করার আগে আমি লিংলির সহকারী ছিলাম।”
আমরা হঠাৎ করে বাইরে অনেক মানুষের কোলাহল শুনতে পেলাম। ক্রেনিপিউটার ধ্বংস হবার পর মানুষ হঠাৎ করে কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। তারা সবাই আসছে।
আমি টিশার দিকে তাকালাম, টিশা আমার দিকে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “আমাদের কাজ শেষ।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ টিশা। আমাদের কাজ শেষ।”