১৪. আবার আলোর ঝলকানি

১৪. আবার আলোর ঝলকানি

কাপ্তেন লাফায়েতের কামরায় ডাক পড়লো বাস্‌কেথ আর ডেভিসের। তাঁর প্রথম কথাটাই হ’লো, কোনোরকম সম্ভাষণেরও আগে—’এত দেরিতে আলো জ্বালানো হ’লো কেন, বাস্‌কেথ?’

—’ন-হপ্তার ওপর হ’লো বাতি আদৌ জ্বলেনি, সেনিওর! ন-হপ্তা বাদে আজই প্রথম আলো জ্বললো!’ কথার জবাব দিলে বাস্‌কেথ।

–’ন হপ্তা! তার মানে? ফিলিপ আর মরিসই বা–’

—’ফিলিপ আর মরিস খুন হয়েছে, কাপ্তেন! সান্তা-ফে এখান থেকে চ’লে যাবার পর থেকেই বাতিঘরের মাত্র একজন আলোকরক্ষীই বেঁচে আছে।’

তারপর ডেভিস আর বাস্‌কেথ কাপ্তেন লাফায়েৎকে সব কথা খুলে বললে। খুলে বললে, কীভাবে ফিলিপ আর মরিসকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে দস্যুরা; কীভাবে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছে বাস্‌কেথ, কীভাবে ধ্বংস হয়েছে সেনচুরি, কীভাবে রক্ষা পেয়েছে জন ডেভিস–সে-জাহাজের ফার্স্ট মেট, কীভাবে কামান ছুঁড়ে তারা বোম্বেটেদের যাত্রায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে, আর শেষে, গতরাতে, কীভাবে বাস্‌কেথ নিজের প্রাণ বিপন্ন ক’রে দস্যুদের যাত্রায় বাধা দেবার চেষ্টা করেছে।

ডেভিস বললে—’আজ রাতে বাতিঘরের লণ্ঠনটা জ্বালাবার ফন্দি বা কেথের মাথাতেই প্রথম এসেছিলো। এই বিপদের সময় সে যদি মাথা ঠাণ্ডা ক’রে লণ্ঠন জ্বালবার ফন্দিটা বার না-করতো, তবে দস্যুদল এর মধ্যেই অনেক দূরে চ’লে যেতো।’

সব শুনে কাপ্তেন লাফায়েৎ তাদের বাহবা দিয়ে হাত ধরে বললেন- ‘তোমরা যদি সাহস ক’রে বোম্বেটেগুলোকে বাধা দেবার চেষ্টা না-করতে, তাহ’লে ওদের কোনো সন্ধানই পাওয়া যেতো না। ভাগ্যিশ বাস্‌কেথ বুদ্ধি ক’রে লণ্ঠনটা জ্বেলেছে, না-হ’লে এতক্ষণে ওরা বারদরিয়ায় উধাও হয়ে যেতো; যা-ই হোক এবার শয়তানগুলিকে বাগে পেয়েছি। আর ওদের কোনোদিন এমন অবাধে লুঠতরাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে না! সাহস ক’রে বাস্‌কেথ যে আলো জ্বালতে পেরেছে সে জন্যে শাবাশি দিই! ‘

কিছুক্ষণের মধ্যেই সান্তা ফের নাবিকরা সবাই পুরো কাহিনীটা জেনে গেলো আর বাস্‌কেথ আর ডেভিসের ওপর অজস্র অভিনন্দন বৰ্ষিত হ’লো।

কথাবার্তার মধ্যেই রাত্রি কেটে গেলো। অনেক দিন বাদে নতুন ভোরের আলোকে মনে হ’লো প্রকৃতির আশীর্বাদ ব’লে। আকাশের রঙ হালকা নীল। দিগন্তে সমুদ্রে জল রাঙা ফুলের পাপড়ির মতো লাল-ভোরের আলোয় দ্বীপ আর আকাশ যেন ঝলমল ক’রে উঠেছে।

এরই মধ্যে বাস্‌কেথ নতুন তিনজন আলোকরক্ষীর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে।

বাহুল্য হবে বলা যে, রাত থাকতে-থাকতেই একদল সশস্ত্র মাঝিমাল্লা বোম্বেটেদের জাহাজ দখল করতে বেরিয়ে পড়েছিলো, কারণ কন্‌গ্রে আর তার দলবল যদি মরিয়া হ’য়ে ঐ জাহাজে উঠতে পারে তবে ভাঁটার দিনে জাহাজ ছেড়ে দিয়ে অনায়াসেই বারদরিয়ায় পৌঁছে যাবে।

নতুন আলোকরক্ষীদের নিরাপত্তার জন্যে—বিশেষ ক’রে ফিলিপ আর মরিসের হত্যার যথোচিত শাস্তি দেবার জন্যে—কাপ্তেন লাফায়েৎ বোম্বেটেদের ওপর চড়াও হবার মলব এঁটেছিলেন।

সের্‌সান্তে আর ভার্গাস অবিশ্যি গতরাতেই মারা গেছে, কিন্তু এখনও বেঁচে আছে পালের গোদা কন্‌গ্রে, আর অন্তত দশ-বারোজন শাগরেদ। কোথায় গিয়ে তারা লুকিয়েছে কে জানে? সারা দ্বীপটাই তন্নতন্ন ক’রে খুঁজে দেখতে হবে।

মস্ত দ্বীপ, তাই দস্যুদলকে খুঁজে বার করাটাও কঠিন। তাছাড়া দ্বীপের প্রত্যেকটা ইঞ্চি তোলপাড় করে দেখা মোটেই সহজ কাজ নয়! এত-বড়ো দ্বীপের কোনখানে কোন পাহাড়ের নিভৃত গুহায় যে বোম্বেটেরা লুকিয়ে আছে, তার হদিশ নেয়াটা বেশ মুশকিলই হবে। তবু কাপ্তেন লাফায়েৎ হাল ছাড়বেন না। তাঁরই ওপর দ্বীপের আলোকরক্ষীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যতদিন-না আলোকরক্ষীদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, যতদিন-না নিশ্চিত হওয়া যায় যে এবার থেকে বাতিঘরের কাজ নিয়মিতভাবে চলবে, ততদিন পর্যন্ত সান্তা-ফের পক্ষে দ্বীপ ছেড়ে চ’লে যাবার কোনো প্ৰশ্নই ওঠে না।

বোম্বেটেদের কাছে কোনো খাবারদাবার নেই। সেন্ট বার্থোলোমিউ অন্তরীপের আস্তানাটাও শূন্য, ইগোর উপসাগরের তীরে বোম্বেটে গুহাতেও কিছু নেই। ক-দিন আর তারা অনাহারে কাটাবে?

ভোরবেলাতেই ডেভিস আর বাস্‌কেথকে সঙ্গে নিয়ে কাপ্তেন লাফায়ে‍ বোম্বেটেগুহার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে গেলো একদল সশস্ত্র নাবিক। না, গুহাটা একদম ফাঁকা। অল্পকিছু শস্তা জিনিশপত্র ছাড়া এ-গুহায় আর-কিছুই নেই। খাবার-দাবার থেকে শুরু ক’রে সব দামি-দামি জিনিশপত্র করে লোকজন আগেই জাহাজে নিয়ে গিয়ে তুলেছিলো। রাত্রে যদি কন্‌গ্রে আর তার দলবল গুহাতে এসেও থাকে, তবে নিশ্চয়ই গুহার এই হাল দেখে নিরাশ হ’য়ে ফিরে গিয়েছে। সের্‌সান্তের ভাঁড়ারে যত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে, তাতে মনে হ’লো তাদের কাছে তেমন-কোনো অস্ত্রশস্ত্রও বোধহয় নেই।

এ-রকম পরিস্থিতিতে মনে হ’লো বোম্বেটেরা নিশ্চয়ই আত্মসমর্পণ করবে, উপোশ ক’রে মরার চাইতে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করাটাকেই তারা নিশ্চয়ই ভালো ব’লে মনে করবে। কিন্তু তারা কী করবে না-করবে, সে তো পরের কথা। যখন আত্মসমর্পণ করবে তখনই সে-কথা ভাবা যাবে। আপাতত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়াই উচিত।

একটুও ঢিলে না-দিয়ে পুরোদমে তল্লাশি চললো। কাপ্তেন লাফায়েৎ সেন্ট বার্থোলোমিউ অন্তরীপ অব্দি ধাওয়া ক’রে গেলেন। কিন্তু বোম্বেটেদের কোনো হদিশই পাওয়া গেলো না। লোকগুলো যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। কয়েকটা দিন এই নিষ্ফল অনুসন্ধানেই কেটে গেলো। কিন্তু বোম্বেটেদের কোনো পাত্তাই নেই।

অবশেষে দশই মার্চ ভোরবেলা যে ক-জন লোক হঠাৎ ধুঁকতে-ধুঁকতে এসে বাতিঘরের ফটকের ভেতরে ঢুকলো, তারা সবাই ফিজির লোক। দুর্দশায় কাতর লোকগুলো শেষটায় আত্মসমর্পণ করবে ব’লেই ঠিক করেছে। খাইয়ে-দাইয়ে তাদের চাঙ্গা করে তুলে হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাদের সান্তা-ফের গারদঘরে আটকে রাখা হলো।

আরো ক-দিন বাদে লেফটেনান্ট রীগাল যখন ওয়েবস্টার অন্তরীপে তল্লাশিতে গেছেন, তখন দেখতে পেলেন পাঁচটি মৃতদেহ প’ড়ে আছে, কিন্তু এদের মধ্যেও কনগ্রের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। পরীক্ষা করে দেখা গেলো, অনাহারেই লোকগুলো মারা গেছে।

এরও কয়েকদিন পরে দেখা গেলো বাতিঘর থেকে শ-পাঁচেক গজ দূরে একটা লোক টলতে টলতে বাতিঘরের দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না! বারে-বারে মুখ থুবড়ে প’ড়ে যাচ্ছে।

কন্‌গ্ৰে!

নতুন আলোকরক্ষীদের সঙ্গে গল্প করতে-করতে বাতিঘরের পাশেই হেঁটে বেড়াচ্ছিলো বাস্‌কেথ! কনগ্রেকে চিনতে পেরেই সে চেঁচিয়ে উঠলো :- কন্‌গ্রে! কন্‌গ্রে! ঐ-যে ওখানে!’

তার চীৎকার শুনে কাপ্তেন লাফায়েৎ আর লেফটেনান্ট রীগাল প্রায় ছুটেই সেখানে এসে হাজির হলেন।

ডেভিস আর জনকয়েক মাল্লা ততক্ষণে কন্‌গ্রের দিকে ছুটে গিয়েছে। কী চায় সে এখানে? কী জন্যে সে ধরা দিতে এসেছে? সে কি জানে না ধরা দিয়ে তার কোনো লাভ হবে না—তার ফাঁসি একেবারেই অবধারিত! পরমুহূর্তেই একটা রিভলভারের শব্দ সন্ধ্যার স্তব্ধতা ভেঙে দিলে।

কন্‌গ্রে কোমরের বেল্ট থেকে রিভলভার খুলে নিয়ে নিজের কপালে ঠেকিয়ে গুলি করেছে। ভেঙেছে বটে, তবু মচকায়নি। সকলকে দেখিয়ে-দেখিয়ে ফাঁসিকাঠকে সে ফাঁকি দিয়ে গেছে।

স্টটেন আইল্যাণ্ডে গত তিনমাস ধরে যে-রোমহর্ষক নাটক চলেছিলো, কন্‌গ্রের আত্মহত্যার সঙ্গে-সঙ্গে তার ওপর যবনিকা প’ড়ে গেলো।

তেসরা মার্চ রাত্রি থেকে নিয়মিত সময়মতোই জ্বলেছে বাতিঘরের আলো। বাস্‌কেথ নতুন আলোকরক্ষীদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। লণ্ঠনের আতসকাচ থেকে নিয়মমতোই ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র আলোর ছটা।

বোম্বেটেদের মধ্যে সাতজন বাদে আর কেউই বেঁচে নেই! যে-সাতজন বেঁচে আছে তারাও সান্তা-ফের অন্ধকার খুপরিতে বসে মৃত্যুর দিন গুনছে। বুয়েনোস আইরেসের আদালতে শিগগিরই যে-বিচার শুরু হবে, তার রায় তারা আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছে।

ডেভিস আর বাস্‌কেথ সান্তা-ফেতে ক’রে বুয়েনোস আইরেস ফিরে যাবার জন্যে তৈরি–ডেভিস সেখান থেকে যাবে মবিলে। ওখানে সে নিশ্চয়ই নতুন কোনো কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে। বাস্‌কেথ এবার দেশে ফিরে গিয়ে অবসর নেবে। তার সারাটা জীবন কেটেছে কঠোর সংগ্রামে, দুঃসাহসের কাজে। এই প্রৌঢ় বয়েসে আর ঐ বেপরোয়া কাজকর্ম নয়—এখন চাই বিশ্রাম, চাই অবসর। কিন্তু দেশে ফিরে যাবে সে একাই—তার হতভাগ্য দুই বন্ধু আর তার সঙ্গে ফিরে যাবে না।

আঠারোই মার্চ সান্তা-ফে থেকে তোপ দেগে বাতিঘরের মিনারকে বিদায় অভিনন্দন জানানো হ’লো।

সান্তা-ফে যখন চলতে শুরু করলো, তখন সূর্য ডুবছিলো।

আর তখনই অন্ধকারকে ধুয়ে দিলে তীব্র-একটি আলোর বন্যা। সান্তা ফের সামনে সমুদ্রে ঢেউগুলো আলো প’ড়ে ঝিকিয়ে উঠেছে। অন্ধকার যত ঘন হ’লো আলোর ঔজ্জ্বল্য ততই বাড়তে লাগলো। আর দূর সমুদ্রে ক্রমেই মিলিয়ে গেলো সান্তা-ফে।

লণ্ঠনের আতসকাচ তখন অন্ধকারের ওপর মস্ত এক তেকোনা আলো ফেলেছে! জোয়ারের জল ক্রমশ ফুলে-ফেঁপে বালিয়াড়িগুলো ঢেকে দিচ্ছে! আরো-গভীর আরো-যেন রহস্যময় হ’য়ে উঠেছে সমুদ্রের চাপা কণ্ঠস্বর….আর হাওয়ার একটানা শন শন শন আওয়াজ।