১৪৭. পাণ্ডবসমীপে বিদুরপ্রেরিত খনকের আগমন জতুগৃহমধ্যে সুড়ঙ্গ-খনন
সপ্তচত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন্! ইতিমধ্যে এক দিবস বিদুরের সখা একজন খনক পাণ্ডবগণের নিকটে সমুপস্থিত হইয়া নির্জনে নিবেদন করিল, হে মহাত্মগণ! আমি খনক, পরম হিতৈষী বিদুর প্রাণপণে পাণ্ডবগণের প্রিয়। কাৰ্য অনুষ্ঠান ও হিতসাধন করিতে আমাকে এস্থানে পাঠাইয়াছেন; এক্ষণে অনুমতি করুন, আপনাদের কি প্রিয় অনুষ্ঠান করিব? দুরাত্মা পুরোচন কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দশীতে রজনীযোগে গৃহদ্বারে অগ্নি প্রদান করিবে। দুর্মতি দুৰ্য্যোধন আপনাদিকে মাতৃসমভিব্যাহারে দগ্ধ করিবার মানসে পুরোচনকে কুমন্ত্রণা প্রদান করিয়াছে। আমার কথায় বিশ্বাস জন্মাইবার জন্য আপনাকে মহাত্মা বিদুর এই কথা কহিতে বলিয়াছেন যে, তিনি আগমনকালে ম্লেচ্ছভাষায় আপনাকে কিছু বলিয়াছিলেন, আপনিও ‘বুঝিলাম’ বলিয়া তাহাকে উত্তর দিয়াছিলেন।
সত্যপরায়ণ কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির খনকের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, সৌম্য! আমি তোমাকে দেখিয়াই দৃঢ়ভক্তিশালী, বিশুদ্ধান্তঃকরণ মহাত্মা বিদুরের প্রিয় বন্ধু বলিয়া বুঝিতে পারিয়াছি। তিনি সর্বজ্ঞ; সর্বজ্ঞ ব্যক্তির কিছুই অবিজ্ঞাত থাকে না। তুমি বিদুরের ন্যায় আমাদেরও পরম সুহৃৎ; সেই ধর্মাত্মা বিদুর যেমন আমাদিগকে রক্ষা করেন, সেইরূপ তুমিও আমাদের রক্ষা কর। দুরাত্মা পুরোচন দুর্যোধনের আদেশানুসারে আমাদিগকে দগ্ধ করিবার জন্য এই আগ্নেয়গৃহ নিৰ্মাণ করিয়াছে। দুর্মতি দুৰ্য্যোধন ধনবান্ ও সহায়বান্; সে চিরকাল আমাদিগের হিংসা করে; আমরা নিহত হইলেই তাহার মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ হয়। তুমি অনুগ্রহ করিয়া এই দারুণ অগ্নিভয় হইতে আমাদিগকে পরিত্রাণ কর। দুরাত্মা দুর্য্যোধন এই জতুগৃহের রন্ধ মধ্যে অস্ত্র শস্ত্র এরূপ কৌশলে রাখিয়াছে যে, আমরা এই গৃহে থাকিয়া কোনক্রমে অগ্নি হইতে যদি ও মুক্ত হইতে পারি, অস্ত্র হইতে কোন মতেই পরিত্রাণ পাইতে পারিব না। ধর্মশীল বিদুর দুর্যোধনের এই কুমন্ত্রণা জানিতে পারিয়া সঙ্কেতে আমার নিকটে ব্যক্ত করিয়াছিলেন। হে সৌম্য। এক্ষণে আমরা এই বিপদ্গ্রস্ত হইয়াছি; তুমি পুরোচনের অজ্ঞাতসারে এই আপদ হইতে আমাদিগকে উদ্ধার কর।
খনক যুধিষ্ঠিরের বচনন্তে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীকার করিয়া বহুযত্নসহকারে পরিখা খননচ্ছলে সেই গৃহের মধ্যে এক মহাগর্ত প্রস্তুত করিল। গর্ত প্রস্তুত হইলে পর পাছে পুরোচন উহা বুঝিতে পারে, এই ভয়ে কবাট দ্বারা উহার মুখ রুদ্ধ করিয়া তাহার উপরিভাগে মৃত্তিকা দিয়া এরূপ সমতল করিয়া রাখিয়াছিল সে, সহসা সন্দর্শন করিলে উহার নিম্নভাগে গর্ত আছে বলিয়া বুঝিতে পারা নিতান্ত দুঃসাধ্য।
পাণ্ডবগণ পুরোচনকে বঞ্চনা করিবার মানসে বিশ্বস্তের ন্যায় দিবাভাগে মৃগয়াচ্ছলে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেন; রজনীযোগে খনককৃত গহ্বরে শয়ন করিয়া শঙ্কিতচিত্তে সর্বদা অপ্রমত্ত হইয়া কালযাপন করিতেন। পাণ্ডবগণের ঐ গোপনীয় ব্যাপার বিদুরের পরম সুহৃৎ সেই খনকসত্তম ব্যতীত অন্য কেহই জানিতে পারে নাই।