১৪৬. গোপনে জতুগৃহে বাসমন্ত্রণা
ষটাচত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর বারণাবতবাসী প্রজারা পাণ্ডুপুত্রগণের শুভাগমন বার্তা শ্রবণে পরম প্রীত হইয়া দর্শনমানসে হস্তি, অশ্ব, রথ প্রভৃতি নানা যানে আরোহণ করিয়া আগমন করিতে লাগিল। ক্রমে সকলে রাজকুমারদিগের নিকটে উপস্থিত হইয়া জয়াশীৰ্বাদ প্রয়োগপুরঃসর তাঁহাদের চতুর্দিকে দণ্ডায়মান হইল। নরশ্রেষ্ঠ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বারণাবতবাসী জনগণে পরিবৃত হইয়া অমরসমাজমধ্যবর্তী সুরাজের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। পৌরবর্গ পাণ্ডবগণের সমুচিত সম্মান ও সৎকার করিল। তাঁহারাও তাহাদিগকে যথোচিত বিনয় সম্ভাষণে পরিতৃপ্ত করিয়া পরম রমণীয় জনাকীর্ণ বারণবিত নগরে প্রবেশ করিলেন। পুরপ্রবেশানন্তর তাঁহারা প্রথমতঃ স্বকাৰ্য্যনিরত ব্রাহ্মণগণের নিকেতনে, পরে নগরাধিকারিদিগের ভবনে, তৎপরে রখিদিগের নিলয়ে, পরিশেষে বৈশ্য ও শূদ্রগণের গৃহে গমন করিলেন। তাঁহারা সকলেই, ‘পাণ্ডবগণকে যথোচিত সমাদর পুরঃসর পূজা করিলেন। তখন মাতৃসমবেত পাণ্ডুনন্দনগণ পুরোচন সমভিব্যাহারে বাসোপযোগী নির্দিষ্ট সুরম্য হৰ্ম্মে গমন করিলেন। পুরোচন তাহাদিগকে অত্যুৎকৃষ্ট ভক্ষ্য, পেয়, আসন ও শয্যা প্রভৃতি সমুদায় রাজভোগ্য দ্রব্য প্রদান করিল। এইরূপে পুরোচনকর্তৃক সংকত হইয়া সমাতৃক পাণ্ডবগণ দশ দিন তথায় বাস করিলেন। পৌরবর্গ প্রত্যহ তাহাদিগকে উপাসনা এবং পরিচৰ্য্যায় প্রীত ও প্রসন্ন করিল।
একাদশ দিনে পাপাত্মা পুরোচন স্বীয় অভিপ্রায় সিদ্ধ করিবার মানসে কৌতুকেৎপাদন কবিয়া পাণ্ডবগণকে স্বনিৰ্ম্মিত জতুগৃহে লইয়া তথায় বাস করিবার অনুরোধ করিল। ঐ অশিব-বিধায়ক গৃহের নাম শিব রাখিয়াছিল। মাতৃসমভিব্যাহারী পাণ্ডবগণ পুরোচনের বচনানুসারে উহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির গৃহ প্রবেশপূর্বক ভীমসেনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেখ ভাই! এই গৃহ ঘূত ও জতু মিশ্রিত বসাগন্ধে পরিপূর্ণ; আমার স্পষ্ট বোধ হইতেছে, ইহা আগ্নেয়। গৃহনির্মাণদক্ষ বিপক্ষের পক্ষে বিশ্বস্ত শিল্পিগণ শণ, সজ্জরস এবং ঘৃতাক্ত মুঞ্জ, বজ ও বংশ প্রভৃতি উপাদানে ইহা নির্মাণ করিয়াছে। দুৰ্য্যোধনবশবর্তী দুরাত্মা পুরোচন তুষ্টিকর ব্যবহার দ্বারা বিশ্বাস জন্মাইয়া দগ্ধ করিবার বাসনায় আমাদিগকে এই বিষম আগ্নেয়গৃহে অনিয়ন করিয়াছে। অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন পিতৃব্য বিদুর শত্রুগণের আকারেঙ্গিত দ্বারা তাহাদের দুষ্টাভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়াছিলেন।
ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, মহাশয়! যদি এই গৃহ আগ্নেয় বলিয়া স্পষ্ট বোধ হইয়া থাকে, তবে আসুন, আমরা যেখানে ছিলাম, এক্ষণে সেই স্থানেই গমন করিয়া বাস করি। যুধিষ্ঠির কহিলেন, ভ্রাতঃ! উত্তমরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিলে আমাদের এইখানেই বাস করা কর্তব্য, কিন্তু আমরা অব্যক্তকার ও অপ্রমত্ত হইয়া এ স্থান হইতে পলায়ন করিবার নিমিত্ত সর্বদা যত্নবান্ থাকিব; নচেৎ যদি পুরোচন অনুপরিমাণেও আমাদের ইঙ্গিত বুঝতে পারে, তাহা হইলে অতি শীঘ্রই আমাদিগকে ভস্মসাৎ করিবে। ঐ পাপাত্মা, পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের বশবর্তী; ও কি অধর্ম, কি লোকনিন্দা কিছুতেই ভীত নহে। হে বৃকোদর! দেখ, এই শত্ৰুনিৰ্ম্মিত জতুগৃহ দগ্ধ হইলে পর পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য কুরুবংশীয় মহাত্মারা, “এই অধর্ম অস্বর্গ কর্ম কে করিল? এবং কি নিমিত্তই বা এ ঘটনা ঘটিল” বলিয়া অবশ্যই সাতিশয় ক্রোধান্বিত হইবেন; কিন্তু যদি আমরা দাহভয়ে ভীত হইয়া এ স্থান পরিত্যাগ করিয়া হস্তিনাপুরে পুনর্বার প্রস্থান করি, তাহা হইলে রাজ্যলুব্ধ দুরায়। দুৰ্য্যোধন বলপূর্বক আমাদিগকে সংহার করিবে, সন্দেহ নাই। এক্ষণে সেই দুরাত্মা পদস্থ, আমরা অপদস্থ; সে সহায়বান, আমরা অসহায়; সে ধনবান, আমরা নির্ধন; সে মনে করিলেই কোন না কোন উপায় দ্বারা আমাদিগকে বধ করিতে পারিবে; অতএব আমরা দুরাত্মা! দুৰ্য্যোধন ও পুরোচনকে বঞ্চনা করিয়া এস্থান হইতে গোপনীয়ভাবে পলায়ন করিয়া প্রচ্ছন্নরূপে ইতস্ততঃ বাস করিব! সম্প্রতি মৃগয়াচ্ছলে নানাদেশ ভ্রমণ করিলে পলায়নকালে কোন পথই আমাদের অবিদিত থাকিবে না। আমরা অদ্যাবধি এই গৃহমধ্যে এক গহবর প্রস্তুত করিয়া তন্মধ্যে গঢ়োচ্ছাস হইয়া বাস করিব, তথায় প্রদীপ্ত হুতাশন কখনই আমাদিগকে স্পর্শ করিতে পারিবে না। ঐ গমধ্যে এরূপ গোপনীয়ভাবে আমাদিগকে থাকিতে হইবে, যেন পাপাত্মা পুরোচন বা অত্রস্থ অন্য কেহ জানিতে না পারে।