১৪৬তম অধ্যায়
কপোতের অতিথিসৎকার
ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! তখন সেই কপোত স্বীয় পত্নীর ধর্ম্মার্থযুক্ত বাক্যশ্রবণে মহা আহ্লাদিত হইয়া বাষ্পকুলনয়নে ব্যাধকে নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক পরমসমাদরে তাহার যথাবিধি পূজা করিল এবং স্বাগতপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া কহিল, ‘মহাশয়! এখানে আপনার কিছুমাত্র আশঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই, আপনি আপনার গৃহেই-উপস্থিত হইয়াছেন, এক্ষণে আপনার অভিপ্রায় কি এবং আমাকেই বা আপনার কি কাৰ্য্য করিতে হইবে, তাহা শীঘ্র ব্যক্ত করুন। আপনি আমাদিগের গৃহে আসিয়াছেন; অতএব আপনার প্রতি প্রীতিপ্রদর্শন করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। গৃহাগত ব্যক্তি শত্রু হইলেও অচিরাৎ তাহার সমুচিত সৎকার করা উচিত। লোকে বৃক্ষচ্ছেদনের নিমিত্ত গমন করিলেও বৃক্ষ কখন তাহাকে ছায়া সেবনে বঞ্চিত করে না। অতএব অতিথি গৃহে আগমন করিলে যত্নপূর্ব্বক তাহার পূজা করা সকলেরই, বিশেষতঃ পঞ্চযজ্ঞ প্রবৃত্ত গৃহস্থদিগের সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। যে ব্যক্তি গৃহী হইয়া মোহবশতঃ পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান না করে, সে কি ইহলোক, কি পরলোক, কুত্রাপি সদগতিলাভে সমর্থ হয় না। যাহা হউক, এক্ষণে আপনার যাহা অভিলাষ থাকে, প্রকাশ করুন, আমি সাধ্যানুসারে তাহা করিব।’ তখন নিষাদ কপোতের সেই সজ্জনোচিত বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিল, পারাবত! আমি শীতে নিতান্ত কাতর হইয়াছি, অতএব যাহাতে আমার শীতনিবারণ হয়, তাহার উপায়বিধান কর।’
“লুব্ধক এই কথা কহিলে কপোত তৎক্ষণাৎ যত্নপূৰ্ব্বক ভূতলে শুষ্কপত্রসমুদয় একত্র করিয়া দ্রুতবেগে অগ্নি আহরণার্থ গমন করিল এবং অনতিবিলম্বে অঙ্গারশালা হইতে অগ্নি গ্রহণপূৰ্ব্বক তথায় প্রত্যাগমন করিয়া সেই পত্ররাশি প্রজ্বলিত করিয়া দিল। হুতাশন উত্তমরূপে প্রজ্বলিত হইলে কপোত নিষাদকে কহিল, ‘মহাশয়! এক্ষণে আপনি নিরুদ্বেগে অগ্নিসন্তাপ[আগুনের তাপ]দ্বারা শীত নিবারণ করুন। তখন ব্যাধ তাহার বচনানুসারে হুতাশনে স্বীয় গাত্রসন্তপ্ত করিতে লাগিল এবং অনতিবিলম্বে শীতনির্ম্মুক্ত হইয়া হৃষ্টচিত্তে ব্যাকুলনয়নে কপোতের প্রতি দৃষ্টিপাতপূৰ্ব্বক কহিল, ‘বিহঙ্গম! আমি ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়াছি; অতএব আমাকে কিঞ্চিৎ আহার প্রদান কর।’
অতিথিসেবার্থ কপোতের দেহদান—ব্যাধের ধিক্কার
“কপোত ব্যাধের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিল, “মহাশয়! আমার এমন কোন সঞ্চিত দ্রব্য নাই যে, তদ্বারা আপনার ক্ষুধা নিবারণ করি। আমরা এই বনে বাস করিয়া দৈনন্দিনলব্ধ আহারসামগ্রীদ্বারাই জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া থাকি। তপোবনবাসী মুনিদিগের মত আমাদিগের কিছুমাত্র সঞ্চয় থাকে না। কপোত ব্যাধকে এই কথা বলিয়া স্বীয় জীবিকার প্রতি ধিক্কার প্রদানপূর্ব্বক ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া ম্লানমুখে চিন্তা করিতে লাগিল এবং কিয়ৎক্ষণ পরে স্বীয় মাংসঘারা অতিথিসকার করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়া লুব্ধককে কহিল, ‘মহাশয়! ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি আপনার তৃপ্তি সম্পাদন করিতেছি।’ সদাশয় কপোত এই কথা বলিয়া শুষ্কপত্ৰদ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া হৃষ্টচিত্তে পুনরায় ব্যাধকে কহিল, ‘মহাশয়! আমি পূৰ্ব্বে দেবতা, ঋষি ও পিতৃলোকদিগের নিকট শ্রবণ করিয়াছি যে, অতিথিসেবা অতি প্রধান ধর্ম্ম। অতএব এক্ষণে আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করুন। আপনাকে সেবা করিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত বাঞ্ছা হইয়াছে। কপোত ব্যাধকে এই কথা কহিয়া তিনবার সেই প্রজ্বলিত হুতাশন প্রদক্ষিণপূর্ব্বক অবলীলাক্রমে তন্মধ্যে প্রবেশ করিল।’
“কপোত হুতাশনে প্রবিষ্ট হইবামাত্র ব্যাধের মনে দিব্যজ্ঞান সঞ্চারিত হইল। তখন সে মনে মনে চিন্তা করিল, হায়! আমি কি করিলাম, আমি নিতান্তই নিষ্ঠুর, লোকে আমার ব্যবসায়[চেষ্টা]দর্শনে প্রতিনিয়ত আমাকে নিন্দা করিয়া থাকে। এক্ষণে এই গর্হিত আচরণনিবন্ধন আমাকে ঘোরতর অধৰ্ম্মে নিপতিত হইতে হইবে, সন্দেহ নাই।’ হে মহারাজ! ব্যাধ কপোতকে তদবস্থ অবলোকনপূৰ্ব্বক এইরূপে আপনার কৰ্ম্মের নিন্দা করিয়া নানাপ্রকার বিলাপ করিতে লাগিল।”