১৪৪তম অধ্যায়
হিমদুৰ্গমপথে চলিতে দ্ৰৌপদীর অক্ষমতা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবগণ এক ক্ৰোশমাত্ৰ অতিক্রম করিলে দ্রৌপদী পদব্রজে গমন করিতে অক্ষম হইয়া পথিমধ্যে দণ্ডায়মান হইলেন। তিনি অগ্ৰেই স্বীয় সৌকুমাৰ্য্যবশতঃ শ্ৰান্ত ও প্রবল বায়ুবেগে একান্ত ক্লান্ত ছিলেন, অনন্তর মোহপ্রভাবে কম্পিত হইয়া ভূজলতাদ্বারা করিকরোপম [হাতীর শুঁড়ের মত] স্বীয় উরুযুগল অবলম্বনপূর্ব্বক কদরীতরুর ন্যায় সহসা ধরাতলে নিপতিত হইলেন। এই অবসরে নকুল অতিমাত্র ব্যস্তচিত্তে ধাবমান হইয়া ভগ্নলতার ন্যায় নিপতিত দ্রৌপদীকে ধারণপূর্ব্বক সত্বর রাজা যুধিষ্ঠিরকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! পাঞ্চালরাজনন্দিনী দ্রৌপদী একান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইয়াছেন, ইনি কদাচ দুঃখভোগ করেন নাই; এই নিমিত্ত এক্ষণে দুর্ব্বিষহ দুঃখে নিতান্ত বিহ্বল ও বিমোহিত হইয়া উঠিয়াছেন, আপনি শীঘ্ৰ আসিয়া ইহাকে আশ্বাস প্রদান করুন।”
রাজা যুধিষ্ঠির, ভীম ও সহদেব ইঁহারা এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র দুঃখিত হইয়া সত্বর তথায় উপস্থিত হইলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বিবর্ণবদনা দেখিয়া ক্ৰোড়ে করিয়া কাতরস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন, “হা! যিনি প্রহরিপরিরক্ষিত গৃহমধ্যে দুগ্ধফেননিভা কোমলশয্যায় পরমসুখে শয়ন করিতেন, এক্ষণে তিনি কিরূপে ধরাসনে শয়ান রহিয়াছেন? অদ্য আমার নিমিত্ত এই সুকুমার চরণ ও কমলোপম মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়াছে। আমি দ্যূতমদে মত্ত ও দুবুর্দ্ধিপরতন্ত্র হইয়া পশুপক্ষিসমাকুল ভীষণ অরণ্যে দ্রৌপদীর সহিত আগমন করিয়া কি কুকর্ম্মই করিয়াছি। পাণ্ডবদিগের ভাৰ্য্যা হইয়া দ্রৌপদী পরমসুখে জীবনকাল যাপন করিবেন, এই ভাবিয়া দ্রুপদরাজ আমাদিগকে কন্যাপ্ৰদান করিয়াছিলেন; কিন্তু এক্ষণে এই পাপাত্মার কর্ম্মদোষেই তিনি সকল সুখে বঞ্চিত ও শোকমোহে অবিভূত হইয়া ধরাসনে শয়ন করিয়া আছেন।”
ধর্ম্মরাজ এইরূপে বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন, এই অবসরে ধৌম্য প্রভৃতি দ্বিজাতিগণ তথায় উপনীত হইয়া আশীৰ্বাদ প্রয়োগপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করিয়া শান্তির নিমিত্ত রক্ষোঘ্নমন্ত্র জপ ও রক্ষোঘ্ন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে আরম্ভ করিলেন। এদিকে পাণ্ডবেরা বারংবার দ্রৌপদীগাত্রে করম্পর্শ ও সুশীতলজলার্দ্র ব্যজনদ্বারা বীজন করিতে লাগিলেন। তখন পাঞ্চালী কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া ক্রমশঃ চেতনালাভ করিলে পাণ্ডবেরা বিশ্রামার্থ তাঁহাকে অজিনশয্যায় সংস্থাপিত করিলেন। নকুল ও সহদেব কিণাঙ্কিত পাণিদ্বারা অল্পে অল্পে দ্রৌপদীর চরণসংবাহন করিতে লাগিলেন।
ভীমের স্মরণে ঘটোৎকচের আগমন
অনন্তর ধর্ম্মরাজ দৌপদীকে আশ্বস্ত করিয়া ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! পথিমধ্যে হিমদুৰ্গম ও সমবিষম বহুসংখ্যক পর্ব্বত আছে, দ্ৰৌপদী কি প্রকারে তাহা অতিক্রম করিবেন?” ভীম কহিলেন, “মহারাজ! আমি একাকী দ্রৌপদী, নকুল, সহদেব ও আপনাকে স্বয়ং বহন করিব, আপনি বিষণ্ন হইবেন না অথবা মহাবলপরাক্রান্ত খেচর হিড়িম্বানন্দন ঘটোৎকচ আসিয়া আপনার আদেশানুসারে আমাদিগকে বহন করিবে।” এই বলিয়া ভীমসেন তদীয় নির্দেশক্রমে স্বপুত্র ঘটৎকচকে স্মরণ করিবামাত্র তিনি তথায় উপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণগণকে অভিবাদন করিলেন; অনন্তর তাঁহাদিগের কর্ত্তৃক অভিনন্দিত হইয়া ভীমপরাক্রম নিজ পিতা ভীমসেনকে কহিলেন, “হে তাত! আপনি কি নিমিত্ত আমাকে স্মরণ করিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, কি করিতে হইবে?” পুত্রের কথা শ্রবণ করিবামাত্র ভীমসেন প্রীত হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন।