১৪৪তম অধ্যায়
সূৰ্য্যানুরোধ সত্ত্বেও কর্ণের কুন্তীবাক্যে উপেক্ষা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরনাথ! কুন্তীর বাক্য অবসান হইলে ভগবান ভাস্কর গগন হইতে কর্ণকে কহিলেন, “বৎস কর্ণ! কুন্তী সত্য কহিয়াছেন, তুমি স্বীয় মাতার বচনানুরূপ সমুদয় কাৰ্য্য কর, তাহা হইলেই তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে।”
সত্যপরায়ণ কৰ্ণ মাতা কুন্তী ও পিতা দিবাকরের বাক্য শ্রবণ করিয়াও কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। তিনি তখন কুন্তীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ক্ষত্ৰিয়ে! আমি আপনার বাক্যে আস্থা করি না, আপনার বাক্যানুরূপ কাৰ্য্য করিলে আমার ধৰ্মহানি হইবে। দেখুন, আপনা হইতেই আমার জাতিভ্ৰংশ হইয়াছে; আপনি তৎকালে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া নিতান্ত অযশস্য ও কীর্ত্তিলোপকর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন। আমি ক্ষত্ৰকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম; কিন্তু আপনার নিমিত্তই ক্ষত্ৰিয়ের ন্যায় সৎকারপ্রাপ্ত হই নাই, অতএব আর কোন শক্ৰ আপনা অপেক্ষা আমার অধিক অপকার করিবে? আপনি ক্ষত্রসংস্কারপ্রাপ্তকালে আমার প্রতি তাদৃশ নির্দয় ব্যবহার করিয়া এক্ষণে আমাকে আপনার কার্য্যসাধনে অনুরোধ করিতেছেন। আপনি পূর্ব্বে মাতার ন্যায় আমার হিতচেষ্টা না করিয়া এক্ষণে স্বকীয় হিতবাসনায় আমাকে পুত্ৰ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন। দেখুন, কৃষ্ণসমভিব্যাহারে অর্জ্জুনকে অবলোকন করিলে কোন্ ব্যক্তি ভীত ও ব্যথিত না হয়? অতএব আজি যদি আমি পাণ্ডবগণের সমীপে গমন করিয়া তাহাদের পক্ষ হই, তাহা হইলে সকলেই আমাকে ভীত জ্ঞান করিবে। অদ্যাপি কেহই আমাকে পাণ্ডবগণের ভ্রাতা বলিয়া জানে না; অতএব যদি আমি এই যুদ্ধকালে তাঁহাদের সমীপে গমন করি, তাহা হইলে ক্ষত্ৰিয়গণ আমাকে কি বলিবেন?
“হে ক্ষত্ৰিয়শ্রেষ্ঠ! ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ আমাকে সর্ব্বপ্রকার ভোগ্য প্রদান ও সুখোচিত সৎকার করিয়া আসিতেছেন, আজি আমি কিরূপে উহা বিফল করিব? যাহারা শত্রুদিগের সহিত বৈরভাব অবলম্বন করিয়া প্রতিনিয়ত আমার উপাসনা ও আমাকে নমস্কার করে, যাহারা আমার বাহুবলে নির্ভর করিয়া সংগ্রামে শক্রগণকে পরাজয় করিবার প্রত্যাশা করে, আমি কিরূপে তাহাদিগের আশালতা ছেদন করিব? যাহারা আমাকে আশ্রয় করিয়া অপার সমরসাগরে পরপারপ্রাপ্ত হইতে বাসনা করে, আমি কিরূপে তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিব? যাহারা ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের নিকট জীবিকানির্ব্বাহ করে, তাহাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই উপযুক্ত সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, এই সময় আমিও তাঁহাদের ঋণ পরিশোধ করিব। যাহারা স্বামীর নিকট কৃতকাৰ্য্য হইয়া তাহার কাৰ্য্যকলাপ উপস্থিত হইলে উপেক্ষা করে, সেইসকল ভর্ত্তূপিণ্ডাপহারী [প্রভুর অন্নভোজী অথচ অকৃতজ্ঞ] পাতকিগণের ইহলোক বা পরলোকে সম্পত্তিলাভ হয় না।
“অতএব হে আৰ্য্যে! আমি সত্য করিয়া কহিতেছি, ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের হিতার্থ স্বীয় সাধ্যানুসারে আপনার পুত্ৰগণের সহিত সংগ্রাম করিয়া সৎপুরুষোচিত অনৃশংস [অনির্দয়] কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিব, আপনার বচনানুরূপ কাৰ্য্য অর্থকরা হইলেও তদনুষ্ঠানে কদাপি সম্মত হইব না। পাণ্ডবগণের উপর আমার যে ক্ৰোধ আছে, তাহা কদাপি বিফল হইবে না। আমি যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেব-আপনার এই চারিপুত্রকে সংগ্রামে সংহার করিব না। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যমধ্যে কেবল অর্জ্জুনের সহিত আমার সংগ্রাম হইবে। অতএব হয় অর্জ্জুনকে সংগ্রামে নিহত করিয়া স্বামীর উপকার করিব, না হয় তাহার হস্তে প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক উৎকৃষ্ট যশোভাজন [কীর্ত্তিমান] হইব। হে পুত্রবৎসলে! আপনার পঞ্চপুত্ৰ কদাপি বিনষ্ট হইবে না; কারণ, অর্জ্জুন আমার হস্তে নিহত হইলে আমি জীবিত থাকিব, অথবা আমি অর্জ্জুনের হস্তে নিহত হইলে অর্জ্জুন জীবিত থাকিবে; এইরূপে আপনি চিরকাল পঞ্চপুত্রের মাতা হইয়া স্বচ্ছন্দে কালব্যাপন করিবেন।”
যশস্বিনী কুন্তী অতি ধীর মহাবীর কর্ণের বাক্যশ্রবণে দুঃখে কম্পিত হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৎস! তুমি যেরূপ কহিলে, ইহাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, কৌরবগণ নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইবে; কি করি, দৈবই বলবান। কিন্তু তুমি যে অর্জ্জুন ভিন্ন যুধিষ্ঠিরাদি ভ্ৰাতৃচতুষ্টয়কে অভয় প্রদান করিলে, ইহা যেন তোমার মনে থাকে।” কুন্তী ও কর্ণ এইরূপে কথোপকথন সমাপন করিয়া পরস্পর অনাময় [কুশলবাক্য] ও স্বস্তিবাক্য [আশীর্ব্বাদবাক্য] প্রয়োগপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।