১৪৪তম অধ্যায়
কপোতীর বিরহে কপোতের শোক
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! ঐ বৃক্ষের শাখায় এক কপোত সুহৃঞ্জনে পরিবৃত্ত হইয়া বহুকাল বাস করিয়াছিল। ঐ দিন প্রাতঃকালে তাহার বনিতা আহারান্বেষণে গমন করিয়াছিল। রজনী সমাগত হইল, তথাপি প্রেয়সী প্রত্যাগত হইল না দেখিয়া পক্ষী অনুতাপপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, ‘হায়! আমার প্রণয়িনী কি নিমিত্ত এ পর্য্যন্ত প্রত্যাগত হইল না? ইতিপূৰ্ব্বে প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহিত ও ভয়ঙ্কর বারিধারা নিপতিত হইয়াছে। তন্নিবন্ধন এই কাননমধ্যে তাহার ত’ অমঙ্গল উপস্থিত হয় নাই? আজ প্রিয়াবিরহে আমার এই গৃহ শূন্যময় বোধ হইতেছে। গৃহস্থের গৃহ পুত্র, পৌত্র, বধূ ও ভৃত্যগণে পরিপূর্ণ থাকিলেও ভাৰ্য্যাবিরহে শূন্যপ্ৰায় হইয়া থাকে। পণ্ডিতেরা গৃহিনীশূণ্য গৃহকে গৃহ বলিয়া নির্দেশ করেন না। গৃহিণীই গৃহস্বরূপ কথিত হইয়া থাকে। গৃহিণীশূন্য গৃহ অরণ্যপ্রায়। আজ যদি আমার সেই অরুণনেত্রা [রক্তনয়না] বিচিত্রাঙ্গী মধুরভাষিণী ভাৰ্য্যা প্রত্যাগন না করে তাহা হইলে আমার জীবনে প্রয়োজন কি? আমার সেই প্রিয়তমা আমি অস্নাত ও অভুক্ত থাকিতে কদাপি স্নান-ভোজন করে না; আমি উপবেশন ও শয়ন করিলে শয়ন করিত। আমার দুঃখে তাহার দুঃখ ও পরিতোষেই তাহার পরিতোষ হইয়া থাকে। আমি বিদেশস্থ হইলে সে বিষণ্নবদনে কালহরণ এবং আমি ক্রূদ্ধ হইলে আমার প্রতি প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিত। এই পৃথিবীতে যাহার ভাৰ্য্যা এইরূপ পতিহিতৈষিণী ও পতিপরায়ণা সেই ধন্য। আমার সেই স্থিরস্বভাবা [অচঞ্চলা] যশস্বিনী প্রিয়তমা আমাকে ক্ষুধার্ত্ত ও পরিশ্রান্ত জানিয়াও কেন এ পর্য্যন্ত আগমন করিতেছে না? সস্ত্রীক ব্যক্তির বৃক্ষমূলও গৃহস্বরূপ ও ভাৰ্য্যাবিরহী পুরুষের অট্টালিকাও অরণ্যতুল্য বোধ হয়, সন্দেহ নাই। ভার্য্যাই পুরুষের ধর্ম্মার্থকামসাধন সময়ে একমাত্র সহায় ও বিদেশগমনকালে একমাত্র বিশ্বাসের আধার হইয়া থাকে। ইহলোকে ভার্য্যার তুল্য পরমধন আর কিছুই নাই। বনিতাই পুরুষের লোকযাত্রা [গৃহধর্ম্ম] সম্পাদন করিয়া থাকে। রোগাভিভূত আর্ত্তব্যক্তির ভার্য্যাই মহৌষধ। ভাৰ্য্যার তুল্য পরমবন্ধু আর নাই। ধৰ্ম্মসংগ্রহ[ধর্ম্মসঞ্চয়]বিষয়ে ভাৰ্য্যাই পুরুষের অদ্বিতীয় সহায় হইয়া থাকে। পতিব্রতা প্রিয়বাদিনী ভাৰ্য্যা যাহার গৃহে নাই, তাহার অরণ্যে গমন করাই কৰ্ত্তব্য। তাহার গৃহ ও অরণ্যে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই।”