জন্মেজয় বলে মুনি কহ বিবরণ।
অগ্নিতে পাইল রক্ষা কোন্ ছয় জন।।
শুনিলাম ভুজঙ্গ দানব বিবরণ।
অগ্নিতে বাঁচিল কেবা আর চারি জন।।
মুনি বলে, শুন রাজা কথা পুরাতন।
মন্দপাল নামে এক ছিল তপোধন।।
ধার্ম্মিক তপস্বী জিতেন্দ্রিয় মহাধীর।
তপ করি সদাকাল ত্যজিল শরীর।।
তপঃক্লেশ ফলে দ্বিজ গেল স্বর্গবাস।
স্বর্গে বসি সর্ব্ব সুখে হইল নিরাশ।।
আর যত স্বর্গবাসী নানা সুখে সুখী।
স্বর্গেতে থাকিয়া দ্বিজ চিত্তে বড় দুঃখী।।
দুঃখচিত্তে দ্বিজ জিজ্ঞাসিল পুণ্যজনে।
স্বর্গে মম দুঃখ দূর নহে কি কারণে।।
কোন্ কর্ম্ম আমি না করিলাম ক্ষিতিতলে।
কি হেতু স্বর্গেতে মম সুখ নাহি মিলে।।
দেবগণ বলে, পুণ্যভূমি ভূমণ্ডল।
সেথা যাহা করে, স্বর্গে ভুঞ্জে সেই ফল।।
ভূমিতে জন্মিয়া কর্ম্ম বহুল করিলা।
তাই আজি তুমি স্বর্গবাসী যে হইলা।।
কিন্তু মর্ত্ত্যে পুত্রোৎপতি যে জন না করে।
পুণ্যনাশে অন্তে যায় নরক ভিতরে।।
বহু পুণ্যকর্ম্ম করে বহু করে দান।
নরকে প্রবেশে যদি নহে পুত্রবান।।
স্বর্গবাসে দুঃখ তুমি পাও সে কারণ।
অন্য পাপ নাহি ইথে, শুন তপোধন।।
এত শুনি মন্দপাল চিন্তিল অন্তরে।
স্বর্গবাসে দুঃখ মম না সহে শরীরে।।
পুনঃ গিয়া জন্ম লব পৃথিবী ভিতর।
পুত্র জন্মাইয়া স্বর্গে আসিব সত্বর।।
কোন্ জীব হৈলে হবে ঝটিতে সন্তান।
পক্ষী জাতি হৈব বলি চিন্তে মতিমান।।
ততক্ষণ দেবদেহ ত্যজি দ্বিজবর।
পক্ষী গর্ভ প্রাপ্ত হৈল সংসার ভিতর।।
শারঙ্গের মূর্ত্তি ধরি শারঙ্গী উদরে।
চারিপুত্র মন্দপাল উৎপাদন করে।।
কতদিনে খাণ্ডবেতে লাগিল দহন।
ধ্যানেতে জানিল মন্দপাল তপোধন।।
চারি পুত্র শিশু তারা, পক্ষ নাহি উঠে।
হেনকালে অগ্নিমধ্যে ঠেকিল সঙ্কটে।।
অগ্নিতে তরিতে শিশু না দেখি উপায়।
পুত্ররক্ষা হেতু মুনি ধ্যানেতে ধেয়ায়।।
সঙ্কল্প করিল আজি শ্রীকৃষ্ণ-পাণ্ডবে।
এক জীব না রাখিবে এই ত খাণ্ডবে।।
অগ্নি যদি রাখে, তবে জীয়ে পুত্রগণ।
এত ভাবি করে দ্বিজ অগ্নিরে স্তবন।।
তুমি ধাতা, তুমি ইন্দ্র, তুমি বৃহস্পতি।
সকল দেবের মুখ্য সর্ব্বদেব স্থিতি।।
চরাচরে যত বৈসে তোমাতে বিদিত।
হব্য কব্য যত কিছু ত্রিগুণ ব্যাপিত।।
তুমি ক্রুদ্ধ হৈলে কারো নাহিক নিস্তার।
তিলমাত্রে ভস্ম কর সকল সংসার।।
ব্রাহ্মণের ইষ্ট তুমি হও কৃপাবান।
চারি গুটি পুত্রে মোর দেহ প্রাণদান।।
দ্বিজ-স্তুতিবশে অগ্নি দিলেন অভয়।
শুনি মন্দপাল হৈল সানন্দ হৃদয়।।
খাণ্ডবে লাগিল অগ্নি মহাভয়ঙ্কর।
শারঙ্গী পুত্রের সহ চিন্তিত অন্তর।।
বালক অজাতপক্ষ এই চারি জন।
কি উপায়ে পুত্র সবে করিব রক্ষণ।।
সকরূণে বলে তবে চারি পুত্রগণে।
এই গর্ত্তে প্রবেশ করহ এইক্ষণ।।
প্রচণ্ড অনল উঠে পর্ব্বত আকার।
আর কোন উপায়েতে না দেখি নিস্তার।।
নাহিক এমন শক্তি আমার শরীরে।
চারিজনে লয়ে আমি পলাই অচিরে।।
অশক্ত অজাতপক্ষ তোরা চারি জন।
গর্ত্তমধ্যে প্রবেশিয়া রাখহ জীবন।।
শিশুগণ বলে গর্ত্তে প্রবেশি কেমনে।
গর্ত্ত মধ্যে মূষা আছে বিকট বদনে।।
শারঙ্গী বলিল, মূষা লইল সঞ্চানে।
ক্ষণমাত্রে নিল এই মাত্র বিদ্যমানে।।
পুত্রগণ বলে, গর্ত্তে বড়ই সংশয়।
একে ঘোর অন্ধকার তাহে সর্পভয়।।
অদৃশ্য স্থানেতে যাই মন নাহি সরে।
কপালে আছয়ে যাহা, কে লঙ্ঘন করে।।
বাহিরে থাকিলে যদি পুড়িব অনলে।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হৈব, শাস্ত্রে ইহা বলে।।
কর্ম্ম-অনুসারে ফল ভুঞ্জিব এক্ষণ।
তুমি অন্য স্থানে যাহ লইয়া জীবন।।
অনেক মধুর বাক্য শারঙ্গী বলিল।
তথাপি এ চারি শিশু গর্ত্তে নাহি গেল।।
শিশু সব কহে, মাতা কেন কর দ্বন্দ্ব।
তোমায় আমার মাতা কিসের সম্বন্ধ।।
মায়ামোহে পড়ি কেন হারাও জীবন।
আপনি থাকিলে কত পাইবে নন্দন।।
নিজ শক্তি থাকিতে মরহ কেন পুড়ি।
আইসে অনল দেখ শীঘ্র যাহ উড়ি।।
অনল হইতে যদি পাই প্রতিকার।
তোমার সহিত দেখা হবে পুনর্ব্বার।।
পুত্রের বচন শুনি শারঙ্গী উড়িল।
কানন দহিয়া তবে পাবক আইল।।
প্রচণ্ড অনল, তাতে মহাবায়ু বহে।
পর্ব্বত আকার জীবজন্তুগণ দহে।।
দেখিয়া কাতর সবে মুনির নন্দন।
জরিতরি নামে জ্যেষ্ঠ সারিসৃক্ক, দ্রোণ।।
স্তম্ভমিত্র নামে চারি মুনির নন্দন।
অগ্নি প্রতি যোড়করে করে নিবেদন।।
আকুল হইয়া চারি জনে করে স্তুতি।
বালক অজাত পক্ষ মোরা চারি জন।
উপায় না দেখি কিছু রাখিতে জীবন।।
সঙ্কটে ছাড়িয়া চলি গেল মাতা তাত।
তুমি কৃপা কর প্রভু দেখিয়া অনাথ।।
অনেক করিল স্তুতি শিশু চারি জন।
তুষ্ট হৈয়া বলিলেন দেব হুতাশন।।
না করিহ ভয় মন্দপালের তনয়।
পূর্ব্বে তোমাদের আমি দিয়াছি অভয়।।
আমা হৈতে ভয় না করিহ চারি জন।
যে বর মাগহ দিব করিলাম পণ।।
শিশুগণ বলে যদি হৈলা কৃপাবান।
মনোমত বর দেহ, মাগি তব স্থান।।
এখানেতে আছয়ে মার্জ্জার দুষ্টগণ।
আমাদের গ্রাসিবারে আসে অনুক্ষণ।।
সে সকল ভস্ম যদি কর দয়াময়।
তবেত আমরা সবে হইব নির্ভয়।।
সহাস্যে কহেন তবে দেব হুতাশন।
নির্ভয়ে করহ সবে জীবন যাপন।।
এত বলি সর্ব্বভুক শিশু চারিজনে।
প্রাণ রাখি দহে বন ব্রহ্মার বচনে।।
কৃষ্ণার্জ্জুন-বিক্রমে বিমুখ দেবগণ।
নিবারিতে না পারিল খাণ্ডব দাহন।।
আশ্চর্য্য মানিয়া তবে দেব পুরন্দর।
দেবগণ সঙ্গে লৈয়া গগন উপর।।
কহিলেন কৃষ্ণ আর অর্জ্জুনে ডাকিয়া।
তোমরা উভয়ে আজ একত্র মিলিয়া।।
যে কর্ম্ম করিলা তাহা অদ্ভুত কথন।
দেবের দুষ্কর ইহা, ছার নরগণ।।
তোমাদের পরাক্রম করি দরশন।
হইলাম সাতিশয় আনন্দিত মন।।
এই হেতু এক বাক্য বলি যে এখন।
মনোনীত বর মাগ, তোমা দুই জন।।
অর্জ্জুন বলেন, বর দিবে সুরেশ্বর।
দিব্য অস্ত্র তূণ তবে দেহ পুরন্দর।।
ইন্দ্র বলে, দিব অস্ত্র কত দিন গেলে।
শিবে তুষ্ট যখন করিবে তপোবলে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, বর মাগি যে তোমায়।
অর্জ্জুনের সনে যেন বিচ্ছেদ না হয়।।
হৃষ্ট হয়ে বর দিয়া গেল পুরন্দর।
কৃষ্ণার্জ্জুনে বিদায় করিল বৈশ্বানর।।
বর দিয়া নিজস্থানে গেল হুতাশন।
হৃষ্ট হয়ে মম সহ যান কৃষ্ণার্জ্জুন।।
ব্যাস বিরচিত এই ভারত সুন্দর।
কাশী কহে, শ্রবণে পাপহীন হয় নর।।