১৪২তম অধ্যায়
সংসারনির্ব্বাহের লৌকিক নীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যদি মিথ্যাবাক্যের ন্যায় নিতান্ত অশ্রদ্ধেয় ঘোরতর কাৰ্য্যসমুদয়ও কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইল, তবে কোন্ কাৰ্য্যকে অকাৰ্য্য বলিয়া পরিত্যাগ করা যাইবে? আর দস্যুরাই বা কি নিমিত্ত জনসমাজে নিন্দনীয় হইবে? আপনার বাক্যশ্রবণপুৰ্ব্বক ধৰ্ম্ম নিতান্ত শিথিলবদ্ধ[ধর্ম্মের বাঁধ শিথিল] হইল বিবেচনা করিয়া আমার মন একান্ত অবসন্ন ও মোহজালে জড়িত হইতেছে এবং কোনক্রমেই আপনার উপদেশানুরূপ কৰ্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্তি জন্মিতেছে না।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধর্ম্মরাজ আমি কেবল বেদাদি বাক্যের উপর নির্ভর করিয়া তোমাকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতেছি না। বিদ্বান ব্যক্তিরা লোকাচার ও বেদাদি শাস্ত্র উভয় হইতেই জ্ঞানসঞ্চয় করিয়া থাকেন। নরপতিদিগের নানা বিষয় হইতে জ্ঞান উপার্জ্জন করা আবশ্যক। পরে একমাত্র শাখা অবলম্বন করিলে কখন লোকযাত্রা নির্ব্বাহ হইতে পারে না। বুদ্ধিজনক ধর্ম্ম ও সজ্জনদিগের আচার পরিজ্ঞাত হইয়া ভূপালগণের সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। নরপতি স্ব স্ব বুদ্ধিবলেই জয়লাভ ও ধর্ম্মসংস্কারে সমর্থ হইতে পারেন। রাজধর্ম্ম বহুশাখাসঙ্কুল। অধ্যয়নকালে যত্নপূৰ্ব্বক শিক্ষা না করিলে অথবা উহার একদেশমাত্র শিক্ষা করিলে উহাতে সম্যক জ্ঞানলাভের সম্ভাবনা নাই। একমাত্র কার্য্য কখন ধৰ্ম্ম ও কখন অধৰ্ম্ম বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ইহা বিশেষ অবগত হইতে অসমর্থ, তার পদে পদে সংশয় উপস্থিত হইয়া থাকে; অতএব প্রথমতঃ বুদ্ধিপ্রভাবে ধর্ম্মের যথার্থ অবগত হইয়া, পরে বিশেষ অনুসন্ধানপূর্ব্বক কার্য্য করা আবশ্যক।
‘নরপতি আপৎকালে শাস্ত্রোক্ত ধর্ম্ম লঙ্ঘনপূর্ব্বক স্বীয় বুদ্ধি অনুসারে কাৰ্য্য করিলে মূঢ়েরাই তাঁহার নিন্দা করিয়া থাকে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কখনই তাহার দোষকীর্ত্তনে প্রবৃত্ত হয়েন না। কেহ কেহ যথার্থজ্ঞানী এবং কেহ কেহ বৃথাজ্ঞানসম্পন্ন হয়। যাঁহারা জ্ঞানের যাথার্থ্য অনুসন্ধান করেন, তাঁহারাই সাধুসম্মত জ্ঞানোপার্জ্জন করিতে পারেন। অধার্ম্মিক ব্যক্তিরাই যথার্থ ধর্ম্ম পরিত্যাগ ও অর্থশাস্ত্রের অপ্রমাণতা প্রতিপাদন। যাহারা, কোন জীবিকানির্ব্বাহ বিদ্যালাভের কামনা করে। তাহারা মনুষ্যসমাজে পাপী ও ধৰ্ম্মলোপী বলিয়া পরিগণিত হয়। শাস্ত্রজ্ঞানবিহীন অপরিণতবুদ্ধি মূঢ়ব্যক্তিদিগের কোন বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান বা যুক্তি অনুসারে কোন কার্য্যানুষ্ঠানের ক্ষমতা জন্মে না। তাহারা শাস্ত্রের দোষানুসন্ধানপূৰ্ব্বক উহা মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা এবং অর্থশাস্ত্রের জ্ঞানলাভ করা অতি অকিঞ্চিৎর বলিয়া বোধ করে। যাহারা মূখের ন্যায় বাক্যবারণপূৰ্ব্বক অন্যের অপবাদদ্বারা স্বীয় বিদ্যার গৌরব প্রকটিত করিবার চেষ্টা করে, তাহাদিগকে নররাক্ষস ও বিদ্যার [ব্যবসাদারী বিদ্বান] বণিক বলিয়া পরিগণিত করা উচিত। ছলপূৰ্ব্বক ধর্ম্মানুষ্ঠান করিলে নিশ্চয়ই ধর্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে হয়। দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং কহিয়াছে যে, বৃহস্পতির মতে কেবল অন্যের সহিত তর্কবিতর্ক বা কেবল স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে ধর্ম্ম নির্ণয় করা যায় না। ধৰ্ম্ম-নিৰ্ণয় করিতে হইলে অন্যের সহিত তর্ক ও স্বীয় বুদ্ধি উভয়েরই সাহায্য গ্রহণ করিতে হয়। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, ধৰ্ম্মশাস্ত্রের কোন বচনই অনর্থক নহে। লোকে কেবল যথার্থ মর্ম্ম বোধগম্য করিতে না পারিয়াই সংশয়াসম্পন্ন হয়। কেহ কেহ লোকযাত্রানির্ব্বাহকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করেন। পণ্ডিত ব্যক্তি সাধুনির্দ্দিষ্ট যুক্তিযুক্ত ধৰ্ম্মানুসারেই কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। বিজ্ঞ ব্যক্তিও যদি ক্রোধপরবশ বা ভ্রান্তিযুক্ত হইয়া সভামধ্যে ধর্ম্মশাস্ত্র কীৰ্ত্তন করেন, তাহা হইলে কেহই তাহার বাক্য যুক্তিসঙ্গত বলিয়া জ্ঞান করে না। অনেকে বেদাৰ্থৰ্ঘটিত তর্কযুক্ত বাক্যের এবং কেহ কেই বা কেবল অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞানলাভনিবন্ধন তর্কবিহীন বচনের প্রশংসা করিয়া থাকেন। আর কেহ কেহ বা যুক্তিপ্রদর্শনদ্বারা শাস্ত্ৰদূষিত বলিয়া তাহার অনর্থকতা সম্পাদন করে; অতএব যাহাতে তর্ক ও শাস্ত্র উভয়ই দূষিত না হয়, এরূপ বিবেচনা করিয়া কাৰ্য্য করাই উচিত। পূৰ্ব্বে শুক্রাচার্য্য দৈত্যগণের সংশয়নাশার্থে তাহাদিগকে ঐরূপ অনুষ্ঠান করিতে কহিয়াছিলেন।
“সন্দেহসঙ্কুল জ্ঞান থাকা আর না থাকা উভয়ই সমান; অতএব তুমি অচিরাৎ সংশয়কে সমূলে উনূলিত করিবার চেষ্টা কর।
“আমি এক্ষণে তোমাকে যে যে উপদেশ প্রদান করিলাম, তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিতে স্বীকার না করা তোমার কখনই উচিত নহে। তুমি যে অতি উগ্ৰ কৰ্ম্ম-সম্পাদনের নিমিত্ত জন্মপরিগ্রহ করিয়াছ, ইহা কি তোমার বোধগম্য হইতেছে না? আমি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, এই নিমিত্ত অনেকে আমাকে নৃশংস বলিয়া নিন্দা করিয়াছিল; কিন্তু তাহাদের বাক্যে কর্ণপাত না করিয়া সংগ্রামে পুরুষকারপ্রদর্শনপূর্ব্বক ঐশ্বৰ্য্যলোলুপ অসংখ্য ভূপতিকে স্বর্গলোকে প্রেরণ করিয়াছি। ব্রহ্মা ছাগ, অশ্ব ও ক্ষত্রিয়গণকে সাধারণের হিতসাধনার্থ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। প্রাণীগণের লোকযাত্রা অনায়াসে নির্ব্বাহ হইতেছে। আর দেখ, অবধ্যকে বিনাশ করিলে যে পাপ হয়, বধ্যকে বিনাশ না করিলেও সেই পাপ জন্মিয়া থাকে। উগ্রমূর্ত্তি ধারণ করিয়া প্রজাগণকে স্ব স্ব ধৰ্ম্মে স্থাপন করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহা না হইলে প্রজাগণ বৃকের ন্যায় পরস্পরকে ভক্ষণ করিয়া বিচরণ করে। যে রাজার অধিকারমধ্যে দস্যুগণ পরবিত্ত অপহরণ করিয়া ভ্রমণ করে, তিনি ক্ষত্রিয়কুলের কলঙ্কস্বরূপ। এক্ষণে বেদজ্ঞানসম্পন্ন সংকুলোদ্ভব ব্যক্তিদিগকে অমাত্যপদে অভিষেক করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালনপূৰ্ব্বক পরমসুখে রাজ্যশাসন করাই তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে মহীপতি প্রজাপালনের পদ্ধতি বিশেষরূপে অবগত না হইয়া অন্যায়পূৰ্ব্বক করগ্রহণ করেন, তিনি ক্লীব বলিয়া পরিগণিত হয়েন এবং যিনি উগ্রতা ও মৃদুতা এই উভয় অতিক্রম না করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করেন, তিনি যারপরনাই প্রশংসা লাভ করেন, অতএব প্রথমতঃ উগ্রমূৰ্ত্তি ধারণ, ও পরিশেষে মৃদুতা অবলম্বন করা তোমার-কর্ত্তব্য। ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম নিতান্ত ক্লেশকর। তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট স্নেহ আছে বলিয়াই আমি তোমাকে সদুপদেশ প্রদান করিতেছি। দেখ, ভগবান বিধাতা তোমাকে উগ্রকর্ম্মসাধনের নিমিত্ত নির্ম্মাণ করিয়াছেন; অতএব রাজ্যশাসন করাই তোমার উচিত। ধীমান্ শুক্রাচার্য্য নিয়ত দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিতে আদেশ করিয়াছেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজধর্ম্মে এমন কোন্ নিয়ম আছে, যাহা কোন কালে কাহারও লঙ্ঘন করা বিধেয় নহে?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি বিদ্যাবৃদ্ধ, তপস্যানিরত, সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণগণের নিয়ত সেবা করিবে। উহাই অতি উৎকৃষ্ট পবিত্ৰধৰ্ম্ম। তুমি দেবগণের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাক, ব্রাহ্মণগণের প্রতিও সেইরূপ ব্যবহার করা তোমার কর্ত্তব্য। ব্রাহ্মণগণ ক্রুদ্ধ হইলে নানাবিধ অনিষ্টসাধন করিতে পারেন। উহাদের প্রীতি অমৃত ও ক্রোধ বিষতুল্য। উহাদের প্রতিনিবন্ধন লোকের মহীয়সী কীৰ্ত্তিলাভ হয় এবং উহারা ক্রুদ্ধ হইলে দারুণ ভয় উপস্থিত হইয়া থাকে।”