১৪১তম অধ্যায়
যুদ্ধজয়ী সাত্যকির অর্জ্জুন-অভিমুখে গমন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন সুবর্ণধ্বজসম্পন্ন ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় মহারথগণ সেই শিনিবংশাবতংস সাত্যকিকে ধনঞ্জয়ের জয়াভিলাষে দুঃশাসনের রথাভিমুখে সমুদ্যত ও অসীম কৌরবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট দেখিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে চতুর্দ্দিক হইতে রথসমুদয় দ্বারা তাঁহাকে পরিবৃত করিয়া নিবারণপূর্ব্বক শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন সত্যবিক্রম সাত্যকি একাকী অসি, শক্তি ও গদাসঙ্কুল, তলনিঃস্বনপূর্ণ, অপার জলধিসদৃশ সেই মহাসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া অনায়াসে ত্রিগৰ্ত্তদেশীয় পঞ্চাশৎ রাজপুত্রকে পরাজিত করিলেন। মহাবীর সাত্যকির এমনি অদ্ভুত ক্ষিপ্রগতি দেখিলাম যে, তাঁহাকে পশ্চিমদিকে অবলোকন করিয়া পুর্ব্বদিকে দৃষ্টিপাত করিবামাত্র পুনরায় তিনি নয়নপথে নিপতিত হইলেন। এইরূপে সেই মহাবীর সাত্যকি একাকী শতরথীর ন্যায় মুহুৰ্তকাল মধ্যে নৃত্য করিয়াই যেন সমস্ত দিগ্বিদিক্ বিচরণ করিতে লাগিলেন। ত্রিগৰ্তসেনারা সিংহবিক্রান্ত সাত্যকির দ্রুতগতিদর্শনে সন্তপ্ত হইয়া স্বজনসমীপে প্রস্থান করিল। তখন শূরসেনদেশীয় প্রধানতম বীরগণ অঙ্কুশদ্বারা যেমন মত্তমাতঙ্গকে নিবারণ করে, তদ্রূপ সাত্যকিকে শরনিপীড়িত করিয়া নিবারণ করিতে লাগিলেন। অচিন্ত্যবিক্রম সাত্যকি মুহূর্ত্তকাল তাঁহাদের সহিত সংগ্রাম করিয়া দুরতিক্ৰমণীয় কলিঙ্গদেশীয়দিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং অবিলম্বে তাঁহাদিগকে অতিক্রম করিয়া মহাবাহু ধনঞ্জয়কে প্রাপ্ত হইলেন। সন্তরণক্লান্ত ব্যক্তি স্থলভাগ প্রাপ্ত হইলে যেরূপ আহ্লাদিত হয়, সাত্যকি পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া তদ্রূপ আহ্লাদিত হইতে লাগিলেন।
“মহাত্মা কেশব সাত্যকিকে আগমন করিতে সন্দর্শন করিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘পার্থ! ঐ তোমার পদানুসারী শৈনেয় আগমন করিতেছে। ঐ মহাবীর তোমার শিষ্য এবং প্রাণাধিক প্রিয়সখা। উনি পুরুষ সমস্ত যোদ্ধৃগণকে তৃণতুল্য বোধ করিয়া পরাজিত করিয়াছেন। উনি কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধৃগণের প্রতি ঘোরতর উপদ্রব করিয়াছেন, উহার শরপ্রভাবে দ্রোণাচাৰ্য্য ও কৃতবর্ম্মা পরাজিত হইয়াছেন। ঐ মহাবীর অস্ত্রে সুশিক্ষিত ও সর্ব্বদা ধর্ম্মরাজের হিতসাধনে নিরত। উনি সৈন্যমধ্যে বহুতর যোধগণকে নিপাতিত করিয়া অতি দুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান এবং একাকী বাহুবল অবলম্বনপূর্ব্বক সৈন্যসমুদয় ভেদ করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যপ্রমুখ বহুতর মহারথীদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন। কৌরবদলে উহার সদৃশ যোদ্ধা কেহই নাই। সিংহ যেমন গোযূথ হইতে অনায়াসে বহির্গত হয়, তদ্রূপ ঐ মহাবীর অসংখ্য কুরুসৈন্য বিনাশ করিয়া তন্মধ্য হইতে বহির্গত হইয়াছেন। ইঁহার প্রভাবেই অসংখ্য নরপতিদিগের পঙ্কজসদৃশ বদনমণ্ডলে বসুধা সমাকীর্ণ হইয়াছে। উনি জলসন্ধকে বিনষ্ট, দুর্য্যোধন ও তাঁহার ভ্রাতৃগণকে পরাজিত এবং কৌরবগণকে সংহারপূর্ব্বক শোণিতনদী প্রবাহিত করিয়া এক্ষণে তোমার নিকট আগমন করিতেছেন।’
“মহাবীর অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণে বিমনায়মান হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! সাত্যকির আগমনে আমার কিছুমাত্র প্রীতি হইতেছে না। ধর্ম্মরাজ সাত্যকিবিহীন হইয়া জীবিত আছেন কি না, সন্দেহ। সাত্যকির উপর ধর্ম্মরাজের রক্ষার ভার অর্পিত হইয়াছিল; তবে উনি কিরূপে আমার নিকট আগমন করিতেছেন? অতএব বোধ হয়, ধর্ম্মরাজ দ্রোণকর্ত্তৃক নিগৃহীত হইলেন এবং জয়দ্ৰথবধেরও বিলক্ষণ ব্যাঘাত উপস্থিত হইল। হে কেশব! ঐ দেখ, ভূরিশ্রবা যুদ্ধার্থে সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইয়াছেন। আমি এক জয়দ্রথের নিমিত্ত গুরুতরভাবে আক্রান্ত হইলাম। এখন ধর্ম্মরাজের তত্ত্বাবধারণ ও সাত্যকিকে রক্ষা করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। এদিকে দিবাকর প্রায় অস্তাচলশিখরে গমন করিতেছেন, জয়দ্রথকে শীঘ্র বিনাশ করিতে হইবে। হে মাধব! সম্প্রতি মহাবাহু সাত্যকির শরসকল প্রায় নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। তিনি স্বয়ং অতিশয় শ্রান্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার অশ্বগণ ও সারথি অতিশয় ক্লান্ত হইয়াছে; কিন্তু সহায়সম্পন্ন ভূরিশ্রবা এখনও শ্রান্ত হয় নাই। সাত্যকি কি উহার সহিত সংগ্রামে জয়লাভ করিতে পারিবেন? মহাতেজস্বী সত্যবিক্রম সাত্যকি কি সমুদ্রপার হইয়া গোষ্পদে অবসন্ন হইবেন? হে কেশব! ধর্ম্মরাজের এ কি বুদ্ধিবিপর্য্যয় দেখিতেছি। তিনি দ্রোণাচার্য্যের ভয়ে শঙ্কিত না হইয়া সাত্যকিকে আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। দ্রোণাচাৰ্য্য আমিষগ্ৰহণার্থী শ্যেনপক্ষীর ন্যায় সতত ধর্ম্মরাজের গ্রহণে অভিলাষ করিয়া থাকেন; অতএব তাঁহার কুশলবিষয়ে আমার অত্যন্ত সন্দেহ জন্মিতেছে।”