তবে কত দিনান্তরে পার্থ নারায়ণ।
গ্রীষ্মকালে যান দোঁহে ক্রীড়ার কারণ।।
যমুনার জলে গিয়া করেন বিহার।
রুক্মিণী সুভদ্রা সঙ্গে বহু পরিবার।।
যমুনার কূলে করি উত্তম আলয়।
ভক্ষ্য ভোজ্য আনিলেন বহু দ্রব্যচয়।।
ক্রীড়ান্তেতে দুই জন বসিল আসনে।
হেনকালে বিপ্রবেশে আইল হুতাশনে।।
মাথায় ত্রিজটা শোভে পিঙ্গল নয়ন।
উত্তপ্ত কাঞ্চন জিনি অঙ্গের বরণ।।
কৃষ্ণার্জ্জুন অগ্রে দাঁড়াইল হুতাশন।
দোঁহার আশিস্ করি বলয়ে বচন।।
যদুকুলশ্রেষ্ঠ আর কুরুকুলসার।
ত্রিভুবনে নাহি দেখি সমান দোঁহার।।
এই হেতু আসিয়াছি দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
দুইজন মিলি মোরে করাহ ভোজন।।
হাসিয়া কহেন পার্থ, কহ বিচক্ষণ।
কোন ভক্ষ্য দিলে তৃপ্ত হইবা এক্ষণ।।
ভক্ষ্য হেতু এত চাটু বল কি কারণ।
যে কিছু মাগহ ভক্ষ্য দিব এইক্ষণ।।
আশ্বাস পাইয়া বলে অগ্নি মহাশয়।
আমি অগ্নি, বলি দিল নিজ পরিচয়।।
ব্যাধিযুক্ত বহুকাল আমার শরীর।
নির্ব্যাধি করহ মোরে পার্থ মহাবীর।।
খাণ্ডব বনেতে বহু জীবের আলয়।
সেই বন ভক্ষ্য মোরে দেহ ধনঞ্জয়।।
সুরাসুর যক্ষ রক্ষ পশু পক্ষিগণ।
যতেক আছয়ে তাহে, করাহ ভোজন।।
এত শুনি জিজ্ঞাসিল রাজা জন্মেজয়।
কহ মুনিরাজ, মম খন্ডাহ বিস্ময়।।
কি হেতু হইল ব্যাধিযুক্ত হুতাশন।
কিসের কারণে চাহে খাণ্ডব দাহন।।
মুনি বলে, শুন নৃপ পূর্ব্বের কাহিনী।
সত্যযুগে আছিল শ্বেতকী নৃপমণি।।
যজ্ঞ বিনা অন্য কর্ম্ম না জানে কখন।
নিরন্তর যজ্ঞ করে লেইয়া ব্রাহ্মণ।।
বহুকাল যজ্ঞ রাজা করে হেনমত।
সহিতে না পারে কষ্ট দ্বিজগণ যত।।
যজ্ঞ ত্যজি দ্বিজগণ করিল গমন।
বিনয় করিয়া রাজা বলিল বচন।।
পতিত নহি যে আমি, নহি কোন দোষী।
কোন হেতু মম যজ্ঞ না করহ ঋষি।।
দ্বিজগণ বলে, ভূপ না দূষি তোমারে।
শক্তি নাহি মো সবার যজ্ঞ করিবারে।।
অপ্রমিত যজ্ঞ তব, নাহি হয় শেষ।
সহিতে না পারি আর অগ্নিতাপ ক্লেশ।।
নয়ন নিরক্ত হৈল লোমহীন অঙ্গ।
শরীর নির্জীব হৈল, সদা অগ্নিসঙ্গ।।
দ্বিজগণ-বচন শুনিয়া নরপতি।
করিল অনেক বিধ সবিনয় স্তুতি।।
দ্বিজগণ বলে, রাজা বল অকারণ।
তব যজ্ঞ করে, হেন না দেখি ব্রাহ্মণ।।
ত্রিদশ ঈশ্বর শিবে সেবহ রাজন।
তাঁহা বিনা যজ্ঞ করে নাহি অন্য জন।।
দ্বিজগণ-বাক্যে রাজা তপ আরম্ভিল।
অনেক কঠোর করি মহেশে সেবিল।।
শিব তুষ্ঠ হইয়া বলেন, মাগ বর।
রাজা বলে, কৃপা যদি কৈলা মহেশ্বর।।
মম যজ্ঞ করে হেন নাহিক ব্রাহ্মণ।
আপনি আমার যজ্ঞ কর পঞ্চানন।।
হাসিয়া বলেন শিব, শুন মহারাজ।
মম কর্ম্ম নহে যজ্ঞ, ব্রাহ্মণের কাজ।।
যজ্ঞফল যাহা চাহ, মাগহ রাজন।
শুনিয়া নৃপতি বলে বিনয় বচন।।
না করিয়া যজ্ঞ, ফল নহে সুশোভন।
যজ্ঞের উপায় কিছু কহ ত্রিলোচন।।
মহেশ কহেন তব যজ্ঞে এত মন।
মম অংশে আছে এক দুর্ব্বাসা ব্রাহ্মণ।।
তাহারে লইয়া যজ্ঞ কর নরবর।
যজ্ঞের সামগ্রী গিয়া করহ সত্বর।।
দুর্ব্বাসার যোগ্য যজ্ঞ করহ বিধান।
যেই মতে রক্ষা পায় দুর্ব্বাসার মান।।
শিব-আজ্ঞা পেয়ে রাজা গেল নিজ ঘর।
যজ্ঞের সামগ্রী করে দ্বাদশ বৎসর।।
সম্পূর্ণ সামগ্রী করি জানাইল হরে।
শিব করিলেন আজ্ঞা দুর্ব্বাসা মুনিরে।।
শিবের আজ্ঞায় হৈল ক্রোধ তপোধনে।
ছিদ্র কিছু পেয়ে আজি নাশিব রাজনে।।
এত অহঙ্কার করে শ্বেতকী রাজন।
যজ্ঞ হেতু করিল আমারে আবাহন।।
মনে ক্রোধ করিয়া চলিল মুনিবর।
যজ্ঞ করিবারে গেল সহ দণ্ডধর।।
যজ্ঞ আরম্ভিল তবে মহাতপোধন।
যখন যে মাগে মুনি যোগায় রাজন।।
শ্বেতকী রাজার যজ্ঞ অতুল সংসারে।
দুর্ব্বাসা আহুতি দেয় মুষলের ধারে।।
দ্বাদশ বৎসর যজ্ঞ কৈল অবিরাম।
তিন লোক চমৎকার শুনে যজ্ঞনাম।।
সেই হবি খাইয়া হইল মন্দানল।
ব্যাধিযুক্ত দেহ অগ্নি হইল দুর্ব্বল।।
অগ্নিদেব চলিলেন ব্রহ্মার সদন।
ব্রহ্মারে আপন দুঃখ কৈল নিবেদন।।
বিরিঞ্চি বলেন, লোভে এ দুঃখ পাইলা।
বহু হবি খেয়ে তুমি ব্যাধিযুক্ত হৈলা।।
ইহার ঔষধ আছে শুন হুতাশন।
খাণ্ডব বনেতে আছে বহু জীবগণ।।
যদি পার সেই বনে দগ্ধ করিবারে।
তবেত না রবে রোগ তব কলেবরে।।
ব্রহ্মার বচন শুনি সুপ্রচণ্ড বেগে।
খাণ্ডব বনেতে অগ্নি চলিলেন বেগে।।
অতি শীঘ্র উপনীত হয়ে সেইখানে।
জ্বলিয়া উঠিল অগ্নি ভীষণ গর্জ্জনে।।
খাণ্ডবে আছিল বহু জীবের আলয়।
অনল দেখিয়া সবে মানিল বিস্ময়।।
কোটি কোটি মত্ত হস্তী সহিত হস্তিনী।
নিবাইল অগ্নি শুণ্ডে করি জল আনি।।
বড় বড় সর্প সব মহা ভয়ঙ্কর।
শত পঞ্চ সপ্ত অষ্ট দশ ফণাধর।।
মুখেতে করিয়া জল নিবারে অনল।
আর যত আছে জীব যার যত বল।।
নিবৃত্ত হইল অগ্নি নারিল দহিতে।
বহুবার উপায় করিল হেনমতে।।
খাণ্ডব দহিতে শক্ত নহে হুতাশন।
ক্রোধ চিত্তে গেল পুনঃ ব্রহ্মার সদন।।
বিনয় করিয়া বহু বলে বিরিঞ্চিরে।
না হৈল আমার শক্তি বন দহিবারে।।
মুহূর্ত্তেক থাকিয়া চিন্তিল মহামতি।
না কর হে ভয় অগ্নি স্থির কর মতি।।
ব্রহ্মা বলিলেন, আর না দেখি উপায়।
স্থির হৈয়া থাক তুমি কাল গতপ্রায়।।
ইহার বিধান এক কহি যে তোমায়।
সাবধান হয়ে শুন ইহার উপায়।।
নর নারায়ণ জন্মিবেন মহীতলে।
খাণ্ডব দহিবা দোঁহে সহায় হইলে।।
ব্রহ্মার বচনে অগ্নি স্থির করি মন।
বহুকাল রোগমুক্ত রহিল তেমন।।
হইলে দ্বাপর শেষে দোঁহে অবতার।
ব্রহ্মার সদনে অগ্নি গেল পুনর্ব্বার।।
ব্রহ্মার পাইয়া আজ্ঞা দেব হুতাশন।
অতি শীঘ্র গেল যথা দেব নারায়ণ।।
অগ্নির বচনে পার্থ করেন স্বীকার।
আশ্বাস পাইয়া অগ্নি বলে আরবার।।
সে বন দহিতে বিঘ্ন আছে বহুতর।
বনের রক্ষক সদা দেব পুরন্দর।।
অর্জ্জুন কহেন, দেবে নাহি মম ভয়।
বহু ইন্দ্র আসে, তবু করিব বিজয়।।
মম যোগ্য ধনুর্ব্বাণ নাহি হুতাশন।
ইন্দ্র সহ যুঝিতে নাহিক অস্ত্রগণ।।
অবশ্য বিরোধ হৈবে দেবরাজ সঙ্গ।
তার যুদ্ধ-যোগ্য রথ নাহিক তুরঙ্গ।।
দেবরাজ ইন্দ্র সহ বিরোধ হইবে।
ত্রিজগৎ লোক তার সাহায্য করিবে।।
সাহায্য করিতে হৈলে নাহি অস্ত্রগণ।
উপায় বিহনে সিদ্ধ নহে কদাচন।।
শ্রীকৃষ্ণের বাহুবল সহিবারে পারে।
হেন অস্ত্র নাহি তাঁরো হস্তের মাঝারে।।
আপনি চিন্তহ তুমি ইহার উপায়।
খাণ্ডব দহিতে মোরা হইব সহায়।।
এত শুনি ধ্যান করি চিন্তে হুতাশন।
সখা বরুণেরে তবে করিল স্মরণ।।
অগ্নির স্মরণে আইলেন জলেশ্বর।
বরুণে দেখিয়া নিবেদিল বৈশ্বানর।।
এমন সময়ে সখা কর উপকার।
চন্দ্রদত্ত রথ আছে আলয়ে তোমার।।
অক্ষয় যুগল তূণ গাণ্ডীব ধনুক।
এ সকল দিলে মম খণ্ডে সব দুখ।।
শুনিয়া বরুণ আনি দিল শীঘ্রগতি।
আরো আপনার পাশ দেন জলপতি।।
সুরাসুরে পূজিত গাণ্ডীব মহাধনু।
কপিধ্বজ রথজ্যোতি জিনি চন্দ্র ভানু।।
শুল্কবর্ণ চারি অশ্বরথে নিয়োজিত।
অক্ষয় যুগল তূণ অস্ত্রে সুশোভিত।।
বরুণ আনিয়া দিল অগ্নির বচনে।
অগ্নি তাহা সমর্পিল নর-নারায়ণে।।
অস্ত্র লভি হরষেতে কুন্তীর নন্দন।
প্রদক্ষিণ করি রথে কৈল আরোহণ।।
নিজ শক্তি তবে অগ্নি পার্থেরে অর্পিল।
যেই শক্তি তেজে অগ্নি দানব দহিল।।
কৃষ্ণেরে করিয়া স্তব দেব হুতাশন।
কৌমোদকী গদা দিল চক্র সুদর্শন।।
এই দুই অস্ত্র দিব্য অতুল সংসারে।
তোমা বিনা অন্য জনে শোভা নাহি করে।।
দোঁহে রথে চড়িলেন নিজ নিজ সাজে।
গোবিন্দ গরুড়ধ্বজে, পার্থ কপিধ্বজে।।
শতেক যোজন বন খাণ্ডব বিস্তার।
লাগিল অনল উঠে পর্ব্বত আকার।।
দুই ভিতে বনের থাকেন দুই জন।
নিঃশঙ্কে দহয়ে বন দেব হুতাশন।।
প্রলয়ের মেঘ যেন, শুনি গড়াগড়ি।
নানাজাতি বৃক্ষ পোড়ে, শুনি বড়বড়ি।।
নানাজাতি পশু পোড়ে, নানা পক্ষিগণ।
নানাজাতি পুড়িয়া মরয়ে নাগগণ।।
প্রাণভয়ে কোন জন পলাইয়া যায়।
অস্ত্রেতে কাটিয়া সবে অগ্নিতে ফেলায়।।
সিংহনাদ করি বলবন্ত কোন জন।
গর্জ্জিয়া বাহির হৈল করিবারে রণ।।
কৃষ্ণার্জ্জুন বাণ কাটি ফেলে ততক্ষণ।
আনন্দেতে হুতাশন করয়ে ভক্ষণ।।
যক্ষ রক্ষ কিন্নর দানব বিদ্যাধর।
অনেক পুড়িয়া মরে অরণ্য ভিতর।।
ভার্য্যা পুত্র সহ কেহ করে আলিঙ্গন।
ব্যাকুল হইয়া কেহ করয়ে রোদন।।
শীঘ্রগতি গিয়া কেহ পড়ে জলমাঝে।
জলজন্তু সহ ভস্ম হয় অগ্নিতেজে।।
জলেতে পুড়িয়া মরে শফরী কচ্ছপ।
বনেতে পুড়িয়া মরে বনবাসী সব।।
সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক বরাহ মৃগগণ।
মহিষ র্শাদ্দূল খড়্গী, না যায় লিখন।।
অসংখ্য কুঞ্জর পোড়ে দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ত।
জম্বূক শশক নকুলের নাহি অন্ত।।
নানাজাতি নাগ পোড়ে গর্জ্জিয়া আগুণে।
শত পঞ্চ দশ ফণা ধরে কোন জনে।।
পর্ব্বত আকার অঙ্গ, গমনে পবন।
নানাজাতি পুড়িয়া মরয়ে পক্ষিগণ।।
আকাশে উড়য়ে কেহ পবনেরে তেজে।
অর্জ্জুন কাটিয়া বাণে ফেলে অগ্নিমাঝে।।
আকুল যতেক জীব করে কলরব।
মহাশব্দ হৈল, যেন উথলে অর্ণব।।
পর্ব্বত আকার অগ্নি উঠিল আকাশে।
স্বর্গবাসী দেবগণ পলায় তরাসে।।
ভয়েতে লইল সবে ইন্দ্রের শরণ।
দেবরাজে জানাইল খাণ্ডব দাহন।।
তোমার পালিত বন দহে হুতাশন।
অগ্নির সহায় হৈল নর দুই জন।।
এত শুনি কুপিত হইল দেবরাজ।
যুঝিবারে চলে লয়ে দেবের সমাজ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহর।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
শ্রুতমাত্র কহি আমি রচিয়া পয়ার।
শুনি অবহেলে তরে ভব-পারাপার।।
শ্লোকচ্ছন্দে সংস্কৃতে বিরচিল ব্যাস।
খাণ্ডব দাহন কথা শ্রবণে উল্লাস।।
আদিপর্ব্ব ভারতের শুনে সাধুজনে।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস ভণে।।