১৪১. অধৰ্ম্মনষ্টরাজ্যকথা—বিশ্বামিত্র-চণ্ডালসংবাদ

১৪১তম অধ্যায়

অধৰ্ম্মনষ্টরাজ্যকথা—বিশ্বামিত্র-চণ্ডালসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! পরম ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্নপ্রায় ও সকল লোককর্ত্তৃক উল্লঙ্ঘিত, অধৰ্ম্ম ধৰ্ম্মের ন্যায় ও ধৰ্ম্ম অধৰ্ম্মের ন্যায় লক্ষিত, নিয়মবিনষ্ট প্রজাবর্গ ভূপাল ও তস্করগণকর্ত্তৃক নিতান্ত নিপীড়িত, সমস্ত আশ্রম পাপভারে অভিভূত, দুরাত্মাদিগের কাম, লোভ ও মোহপ্রভাবে সকলেই শঙ্কিত ও অবিশ্বস্ত, ছলপ্রভাবে পরস্পর নিহত ও বঞ্চিত, গ্রামনগরাদি বহ্নির দ্বারা প্রদীপ্ত, ব্রাহ্মণগণ একান্ত সন্তপ্ত, পরস্পরের ভেদবুদ্ধি সমুৎপন্ন এবং বৃষ্টির অভাবে শস্যসমুদয় শুষ্কপ্রায় হইলে ব্রাহ্মণগণ অনুকম্পপ্রভাবে পুত্র-পৌত্রাদি পরিত্যাগ করিতে অসমর্থ হইয়া জীবিকানির্ব্বাহাৰ্থ কিরূপ অনুষ্ঠান করিবেন; আর ভূপতিই বা ঐরূপ অবস্থায় কিরূপে জীবনধারণ করিবেন এবং কি প্রকারে ধর্ম্ম ও অর্থ আপনার আয়ত্ত করিয়া রাখিবেন? আপনি এই সমস্ত বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! রাজ্যের যোগক্ষেম [প্রজাগণের নির্ব্বিঘ্নে সংসারযাত্রা] অভিলাষানুরূপ বৃষ্টি এবং প্রজাবর্গের মধ্যে ভয়, ব্যাধি ও মৃত্যুর প্রাদুর্ভাব সমস্তই রাজার পাপপুণ্যপ্রভাবে ঘটিয়া থাকে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারি যুগের আবির্ভাবও ভূপালের দোষগুণমূলক সন্দেহ নাই। প্রজাবর্গের উচ্ছেদের নিদানভূত পূর্ব্বোক্তরূপ বিপদের অবস্থা উপস্থিত হইলে লোকে বিজ্ঞানবল অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবিকানির্ব্বাহ করিবে। এইস্থলে বিশ্বামিত্র-চণ্ডালসংবাদ নামে এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর।

দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত রাজ্যের অবস্থা

“পূৰ্বে ত্রেতা ও দ্বাপরের সন্ধিতে দৈবের প্রতিকূলতানিবন্ধন দ্বাদশ বৎসর ঘোরতর অনাবৃষ্টি হইয়াছিল। ঐ সময় বৃহস্পতি প্রতিকূলগমন ও শশধর দক্ষিণদিক্‌ অবলম্বন করিলেন। মেঘের কথা দূর থাকুক, রাত্রিশেষে বিন্দুমাত্র নীহার দর্শন করাও লোকের প্রার্থনীয় হইয়া উঠিল। নদীর জল শুষ্কপ্রায় হইয়া গেল। সরোবর, কুপ ও প্রস্রবণের শোভা এককালে তিরোহিত হইল। সলিলসাগর উচ্ছিন্ন হইয়া গেল; ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বষট্‌কার [দেবপূজাদি কার্য্যের অভাব-পূজাভাবে পূজাঙ্গ ন্যাসাদি কাৰ্য্যকলাপ] ও অন্যান্য মাঙ্গলিক কাৰ্য্যসমুদয় পরিত্যাগ করিলেন। লোকে কৃষি ও পশুপালনকার্য্যে এককালে পরাঙ্মুখ হইল। বিপণি ও আপণ উন্মূলিত [দোকান, বাজার বন্ধ] হইয়া গেল। সকল লোকের আমোদপ্রমোদ তিরোহিত হইল। চতুর্দ্দিক্‌ কঙ্কাল[মড়ার হাড়]সঙ্কুল ও ভূতগণের চীৎকারে একান্ত আকুল হইয়া উঠিল। গ্রামনগরাদিসমুদয় শূন্যপ্ৰায় হইল। চারিদিকে গৃহদাহ হইতে লাগিল। প্রজারা কোনস্থলে তস্কর, কোনস্থলে অস্ত্রশস্ত্র, কোথাও বা নৃপতির ভয়ে ভীত হইয়া গ্রামনগরাদি পরিত্যাগ ও পরস্পর পরস্পরের প্রতি উপদ্রব করিতে লাগিল। দেবালয়সমুদয় বিনষ্ট হইয়া গেল। বৃদ্ধলোকসকল পৌত্র-পুত্ৰাদিকর্ত্তৃক গৃহ হইতে নিষ্কাশিত এবং গো, অজ, মেষ ও মহিষসকল বিনষ্ট হইতে লাগিল। ওষধিসমুদয় নিঃশেষিত ও মনুষ্যসকল মৃতপ্রায় হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণেরা কালকবলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। কেহই কাহাকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইল না। তৎকালে পৃথিবীতে এইরূপ বিবিধ ভয়ঙ্কর ব্যাপার উপস্থিত হইলে মনুষ্যেরা ক্ষুধায় একান্ত কাতর হইয়া পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণপূৰ্ব্বক ভ্ৰমণ করিতে আরম্ভ করিল। মহর্ষিগণ নিয়ম, হোম, দেবাৰ্চ্চনা ও আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইলেন।

ক্ষুধাক্লিষ্ট বিশ্বামিত্রের চণ্ডালগৃহেগমন

“ঐ সময় মহর্ষি বিশ্বামিত্র অতিশয় ক্ষুধার্থ হইয়া গৃহ ও পুত্ৰকলত্র প্রভৃতি পরিত্যাগ এবং খাদ্যাখাদ্যের বিচার ও জপহোমাদি কাৰ্য্যে এককালে জলাঞ্জলি প্রদানপূৰ্ব্বক লোকালয়ে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। একদা তিনি এক অরণ্যমধ্যে প্রাণীঘাতক হিংস্র চণ্ডালদিগের পল্লী অবলোকনপূৰ্ব্বক তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন যে, ভগ্ন কলস, কুক্কুরের চর্ম্মখণ্ড, বরাহ ও উষ্ট্রের অস্থি ও কপাল এবং মৃত মনুষ্যের বস্ত্রে উহার চতুর্দ্দিক্‌ সমাচ্ছন্ন রহিয়াছে; গৃধ্রসমুদয় নির্ম্মাল্যদ্বারা সুসজ্জিত এবং কুটির ও মঠসকল ভুজঙ্গনির্ম্মোকমাল্যে সমলঙ্কৃত হইয়াছে। কোন স্থানে কুক্কুটরব ও কোন স্থান গর্দ্দভের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হইতেছে। কোন স্থানে চণ্ডালেরা পরস্পর কলহে প্রবৃত্ত হইয়াছে। কোন স্থলে উলূক ও নানাবিধ পক্ষীর প্রতিরূপে [চিত্রে] সমলঙ্কৃত দেবালয়সকল বর্ত্তমান রহিয়াছে। কোন স্থলে লৌহঘণ্টা অনবরত ধ্বনিত হইতেছে এবং কোন স্থলে কুক্কুরসমুদয় দলবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিতেছে।

“মহর্ষি বিশ্বামিত্র ক্ষুধায় একান্ত কাতর হইয়া সেই চণ্ডালপল্লীমধ্যে খাদ্যদ্রব্যের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু বারংবার প্রার্থনা করিয়াও মাংস-অন্ন ও ফল-মূল প্রভৃতি কোন বস্তুই প্রাপ্ত হইলেন না। তখন তিনি শারীরিক দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন হা কি কষ্ট! এই কথা বলিয়া এক চণ্ডালের আলয়ে নিপতিত হইলেন এবং যাহাতে আপনার বৃথা মৃত্যু না হয় ও যাহাতে দুরবস্থা দূর হয়, তদ্বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই চণ্ডালগৃহে সদ্যোনিহত [টাটকা] কুক্কুরের মাংসখণ্ড তাহার দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল। তখন তিনি যারপরনাই আনন্দিত হইয়া মনে মনে স্থির করিলেন, “আমাকে যে-কোন প্রকারে হউক, ঐ মাংসখণ্ড অপহরণ করিতে হইবে। ইহা ব্যতীত এক্ষণে প্রাণধারণের উপায়ান্তর নাই। আপৎকালে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করিলেও সাধুব্যক্তির গৌরবের কিছুমাত্র ত্রুটি হয় না। আর শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে, আপৎকালে ব্রাহ্মণ প্রাণরক্ষাৰ্থ চৌর্য্যবৃত্তিও অবলম্বন করিবেন। অগ্রে নীচ, পরে তুল্য ব্যক্তির দ্রব্য অপহরণ করিবে। উহাদিগের নিকট দ্রব্য প্রাপ্ত না হইলে আপনার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধার্ম্মিকের দ্রব্য গ্রহণ করাও অবিধেয় নহে। অতএব অগ্রে আমি এই নীচ ব্যক্তির দ্রব্য অপহরণ করিব। এই অপহরণনিবন্ধন আমাকে কখনই চৌর্য্যদোষে দূষিত হইতে হইবে না।’ মহর্ষি বিশ্বামিত্র মনে মনে এইরূপ অবধারণপূৰ্ব্বক তথায় শয়ন করিয়া রহিলেন।

মাংসগ্রহণে বিশ্বামিত্র-চণ্ডালের উক্তি-প্রত্যুক্তি

“অনন্তর বিভাবরী [রাত্রি] ক্রমশঃ গাঢ় ও চণ্ডালগণ নিদ্রায় অভিভূত হইলে মহর্ষি কৌশিক নিঃশব্দে গাত্রোত্থান করিয়া সেই চণ্ডালের কুটিরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। ঐ সময়ে সেই ভীষণদর্শন শ্লেম্মাজড়িতলোচন চণ্ডাল জাগরিত ছিল। সে কুটিরমধ্যে মনুষ্য প্রবিষ্ট হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া রুক্ষস্বরে কহিল, ‘এক্ষণে সমস্ত চণ্ডালেরাই নিদ্রিত হইয়াছে, কেবল আমিই জাগরিত রহিয়াছি; আমার গৃহে কোন্ ব্যক্তি কুক্কুরমাংস অপহরণ করিতে আসিয়াছে? অদ্য নিশ্চয়ই তাহার জীবনসংশয় উপস্থিত।’ তখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র নিতান্ত ভীত এবং স্বীয় দুষ্কৰ্ম্মনিবন্ধন একান্ত লজ্জিত হইয়া চণ্ডালকে কহিলেন, ‘আমি বিশ্বামিত্র; ক্ষুধায় অতিমাত্র কাতর হইয়া তোমার গৃহে উপস্থিত হইয়াছি। যদি তুমি সাধুদর্শী হও, তাহা হইলে আমাকে বধ করিও না।’

‘চণ্ডাল বিশ্বামিত্রের কথা শ্রবণ করিবামাত্র ব্যস্তসমস্ত হইয়া শয্যা হইতে গাত্রোত্থান ও নেত্র হইতে অমার্জ্জনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, ‘ভগবন্! আপনি এই রাত্রিকালে কোন্ কাৰ্য্যসাধনার্থ এইস্থানে উপস্থিত হইয়াছেন?’ তখন মহর্ষি চণ্ডালকে সান্ত্ববাক্যে কহিলেন, ‘আমি ক্ষুধিত ও মৃতকল্প হইয়া তোমার এই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস অপহরণ করিব বলিয়া আসিয়াছি। বুভুক্ষিত [ক্ষুধিত] ব্যক্তির লজ্জা কিরূপে সম্ভবপর হইতে পারে? দেখ, আমি অতিশয় ক্ষুধার্ত্ত হইয়াছি; ক্ষুধাপ্রভাবে আমার জীবন অবসন্ন ও জ্ঞান বিলুপ্ত হইয়াছে এবং আমি অতিশয় দুর্ব্বল ও খাদ্যাখাদ্যবিচারশূন্য হইয়া পড়িয়াছি। এই নিমিত্তই তস্করকাৰ্য্য অধৰ্ম্ম জানিয়াও কুক্কুরের এই পৃষ্ঠমাংস অপহরণ করিতে আমার প্রবৃত্তি জন্মিয়াছে। আমি তোমাদিগের পল্লীমধ্যে ভিক্ষাৰ্থ বিস্তর, পৰ্য্যটন করিয়াছি, কিন্তু কুত্রাপি কিছুমাত্র ভক্ষ্যদ্রব্য প্রাপ্ত না হইয়া আমি এই পাপকার্য্যে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছি। দেখ, অগ্নি দেবগণের মুখ ও পুরোহিতস্বরূপ; সুতরাং তাঁহার পবিত্র বস্তু ভিন্ন অপবিত্র বস্তু গ্রহণ করা কর্ত্তব্য নহে। কিন্তু তথাচ তাঁহাকে অগত্যা সকল বস্তুই গ্রহণ করিতে হয়। অতএব অগ্নি যেমন খাদ্যাখাদ্যের বিচার করেন না, আমাকেও এক্ষণে তদ্রূপ খাদ্যাখাদ্যবিচারপরাঙ্মুখ হইতে হইয়াছে।’ তখন চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! যাহাতে ধৰ্ম্মের কোন হানি হয়, আমার নিকট সেইরূপ উপদেশ শ্রবণ ও তদনুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করা আপনার অবশ্যই কর্ত্তব্য হইতেছে। পণ্ডিতগণ কহেন যে, কুক্কুর শৃগাল অপেক্ষাও অপকৃষ্ট আর উহার অন্যান্য স্থানের মাংস অপেক্ষা পৃষ্ঠমাংস অতিশয় অপবিত্র। বিশেষতঃ অভোগ্য চণ্ডালধন অপহরণ করা নিতান্ত ধর্ম্মগর্হিত, সুতরাং এই বিষয়ে অধ্যবসায় প্রদর্শন করা আপনার কর্ত্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে জীবনধারণের নিমিত্ত অন্য উৎকৃষ্ট উপায় অবধারণ করুন। মাংসলোভে তপস্যা বিনষ্ট করিবেন না। শাস্ত্রোক্ত ধৰ্ম্ম অবগত হইয়া ধর্ম্মসঙ্কর বিধানে [ধর্ম্মের বিপর্য্যয়বিধানে—অধর্ম্মাচারণে] প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নহে। আপনি ধার্ম্মিকপ্রধান; অতএব পরম ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা আপনার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত হইতেছে না।’

‘মহর্ষি বিশ্বামিত্র চণ্ডালকওক এইরূপ অভিহিত হইয়া পুনরায় কহিলেন, ‘আমি অনাহারে বহুদিন ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিতেছি, কিন্তু প্রাণধারণের কোন উপায় অবলম্বন করিতে পারি নাই। লোকে নিতান্ত অবসন্ন হইলে যে-কোন প্রকারে হউক প্রাণধারণ করিবে এবং তৎপরে সমর্থ হইলে ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত হইবে। ক্ষত্রিয়দিগের ইন্দ্রের ন্যায় এবং ব্রাহ্মণগণের অগ্নির ন্যায় ধৰ্ম্ম অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ। বেদ বহ্নিস্বরূপ, সেই বেদই আমার প্রধান বল। আমি সেই বলপ্রভাবেই এই কুক্কুরপৃষ্ঠমাংস ভক্ষণ করিয়া ক্ষুধাশান্তি করিব। যাহাতে জীবন রক্ষা হইতে পারে, অবিচারিতচিত্তে তাহার অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। মৃত্যু অপেক্ষা প্রাণরক্ষা সৰ্ব্বতোভাবে শ্রেয়। লোকে জীবিত থাকিলে অনায়াসেই ধৰ্ম্ম লাভ করিতে সমর্থ হয়। অতএব আমি জীবনধারণের অভিলাষ করিয়াই বুদ্ধিপুর্ব্বক অভক্ষ্য বস্তু ভক্ষণ করিতে বাসনা করিয়াছি। তুমি এক্ষণে এই বিষয়ে অনুমোদন কর। আমি জীবিত থাকিলে অনায়াসে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে সমর্থ হইব এবং আলোক যেমন গাঢ়তর অন্ধকার বিনষ্ট করিয়া থাকে, দ্রুপ তপঃ ও বিদ্যাপ্রভাবে অশুভসমুদয় উচ্ছিন্ন করিব।

“চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন। এই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস ভক্ষণ করিলে আপনার সুদীর্ঘ আয়ু বা অমৃতপানের ন্যায় তৃপ্তিলাভ হইবে না। অতএব আপনি অন্য বস্তু ভিক্ষা করিবার নিমিত্ত পর্য্যটন করুন। কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংসভক্ষণে কদাচ প্রবৃত্ত হইবেন না। শাস্ত্রে উহা ব্রাহ্মণগণের নিতান্ত অভক্ষ্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘এই দুর্ভিক্ষকালে অন্য মাংস নিতান্ত সুলভ নহে; আমারও কিছুমাত্র অর্থসংস্থান নাই। বিশেষতঃ এক্ষণে অতিশয় ক্ষুধার্ত্ত ও ভোজনলাভের উপায়ান্তর অবধারণে অসমর্থ হইয়াছি; সুতরাং এই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস অতি সুখাদ্য বলিয়া আমার বিলক্ষণ অনুমান হইতেছে।’ চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের পঞ্চনসম্পন্ন শল্লকী প্রভৃতি পাঁচ জন্তু [শশক, সজারু, গোধা, গণ্ডার ও কচ্ছপ] ভক্ষণ করাই শাস্ত্রসঙ্গত; অতএব আপনি এই অভক্ষ্যভক্ষণে কদাচ মনোনিবেশ করিবেন না।’

“বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘মহর্ষি অগস্ত্য ক্ষুধার্ত্ত হইয়া বাতাপি অসুরকে ভক্ষণ করিয়াছিলেন। অতএব আমি এই দুর্ভিক্ষকালে কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস ভক্ষণ করিলে কখনই পাপে লিপ্ত হইব না।’ চণ্ডাল কহিল, তপোধন! আপনি অন্য বস্তু ভিক্ষা করিবার নিমিত্ত পর্য্যটন করুন। কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস গ্রহণ করা আপনার কোনমতেই কর্ত্তব্য হইতেছে না।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘অগস্ত্য প্রভৃতি মহর্ষিগণ ধর্ম্ম প্রবর্ত্তক। আমি তাঁহাদিগেরই নির্দ্দিষ্ট ধর্ম্মের অনুসরণ করিতেছি। অতএব ঐ উৎকৃষ্ট পবিত্র বস্তুর অভাবে এই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস খাদ্য বলিয়া বিবেচনা করা আমার অকৰ্ত্তব্য নহে।’ চণ্ডাল কহিল, ‘ভগবন্! অসাধু লোকে যাহার অনুষ্ঠান করিয়া থাকে, তাহা কদাচ নিত্যধৰ্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। বিশেষতঃ অকাৰ্য্যসাধন করা সাধুলোকের কর্ত্তব্য নহে। অতএব আপনি ছলক্রমে এই অশুভ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন না।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘ঋষি হইয়া অশ্রদ্ধেয় ও পাপজনক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা নিতান্ত নিন্দনীয়; কিন্তু আমার মতে পশুজাতিত্বনিবন্ধন মৃগ ও কুক্কুর উভয়ই তুল্য; অতএব আমি অবশ্যই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস ভক্ষণ করিব।’ চণ্ডাল কহিল, মহর্ষি অগস্ত্য ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক প্রার্থিত হইয়া তাঁহাদের জীবনরক্ষার নিমিত্ত তৎকালে অসুরকে ভক্ষণ করিয়াছিলেন, সুতরাং উহা ধৰ্ম্মকাৰ্য্য বলিয়াই গণনা করিতে হইবে। উহাতে পাপের লেশমাত্র নাই। যেকোন উপায়ে হউক, ব্রাহ্মণগণকে রক্ষা করা সকলেরই কৰ্ত্তব্য।’

“বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘দেহ আমার মিত্র, প্রিয়তম ও পূজ্য; সেই দেহকে রক্ষা করিবার নিমিত্তই এই কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস অপহরণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে; নৃশংস চণ্ডালগণকে দেখিয়াও আমার কিছুমাত্র ভয় হইতেছে না।’ চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! সাধুব্যক্তিরা বরং প্রাণ পরিত্যাগ করেন, কিন্তু অভক্ষ্যভক্ষণে তাঁহাদিগের কদাচ প্রবৃত্তি জন্মে না। অনেকে ক্ষুধাকে পরাজিত করিয়া স্ব স্ব অভিলাষ সুসম্পন্ন করিয়াছেন; অতএব আপনি ক্ষুধা পরাজয় করিতে যত্নবান হউন।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘প্রায়োপবেশনে প্রাণ পরিত্যাগ করা শ্রেয়স্কর বটে, কিন্তু যাহার জীবিত থাকিবার অভিলাষ থাকে, অনাহারদ্বারা দেহ শুষ্ক করা তাহার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। উহাতে নিশ্চয়ই ধৰ্ম্ম-লোপ হইয়া থাকে। ফলতঃ দেহরক্ষা করা অবশ্যই কৰ্ত্তব্য। এক্ষণে যদিও কুক্কুরের পৃষ্ঠমাংস ভক্ষণ করিয়া আমাকে অল্প পাপে লিপ্ত হইতে হয়, আমি পরিশেষে তাহা ব্ৰতাদিদ্বারা নিরাকৃত করিতে সমর্থ হইব। সূক্ষ্মবুদ্ধি পরিচালনা করিয়া দেখিলে আপৎকালে কুক্কুরপৃষ্ঠমাংস-ভক্ষণ নির্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন করা যায়; আর মোহবুদ্ধিপ্রভাবে এই বিষয়ের বিচার করিতে প্রবৃত্ত হইলে উহা সদোষ বলিয়া প্রতিপাদিত হইয়া থাকে। যাহাই হউক, এক্ষণে আমি যে কুক্কুরের মাংসভক্ষণে দোষ নাই বলিয়া স্থির করিয়াছি, উহা যদি আমার ভ্রান্তিমূলক হয়, তথাপি কুক্কুরমাংস ভোজন করিলে আমাকে তোমার ন্যায় চণ্ডাল হইতে হইবে না। ঐ পাপের প্রতিবিধান করিতে আমার বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে।’ চণ্ডাল কহিল, ‘আমার মতে ব্রাহ্মণের এই কুক্কুরমাংস-ভক্ষণজনিত পাপ নিতান্ত নিন্দনীয়, এই নিমিত্তই আমি দুষ্কর্ম্মান্বিত চণ্ডাল হইয়াও আপনাকে ভৎসনা করিতেছি।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘যদিও গো-সমুদয় সলিলের উপরিভাগে বিচরণ এবং মঞ্জুকেরা বাক্য প্রয়োগ করিতে পারে, তথাপি তোমার ধৰ্ম্মে অধিকার হইবার সম্ভাবনা নাই; অতএব ধৰ্ম্মজ্ঞ বলিয়া আত্মপ্রশংসা করা তোমার উচিত নহে।’

“চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! আপনার প্রতি আমার অতিশয় দয়া উপস্থিত হইয়াছে, এই নিমিত্তই আমি মিত্রভাবে আপনাকে শাসন করিতেছি; অতএব আপনি লোভপ্রভাবে কুক্কুরমাংস ভক্ষণ করিয়া পাপে লিপ্ত হইবেন না।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘তুমি যদি আমার সুখাভিলাষী মিত্র হও, তাহা হইলে অবিলম্বে আমাকে এই উপস্থিত বিপদ হইতে উদ্ধার করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে। আমি ধৰ্ম্মপথ বিলক্ষণ অবগত আছি; অতএব তুমি আমাকে এই কুক্কুরমাংস প্রদান কর; ইহা ভক্ষণ করিলে আমাকে কিছুমাত্র অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হইবে না।’ চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! এই কুক্কুরমাংস আমার ভোজ্যদ্রব্য, অতএব আমি ইহা আপনাকে দান করিতে পারি না এবং আপনি ইহা অপহরণ করিলেও সহ্য করিতে সমর্থ হইব না। বিশেষতঃ আমি কুক্কুরমাংসদাতা ও আপনি উহার গৃহীতা হইলে আমাদের উভয়কেই ঘোরতর পাপে লিপ্ত হইতে হইবে।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘আমি নিশ্চয়ই এই পাপাচরণপূৰ্ব্বক জীবন রক্ষা করিয়া পরিশেষে পুণ্য অনুষ্ঠান ও ধৰ্ম্মোপাৰ্জন করিব। এক্ষণে তুমিই বল দেখি, অনাহারে প্রাণপরিত্যাগ ও অভক্ষ্য ভক্ষণপূৰ্ব্বক প্রাণরক্ষা করিয়া ধৰ্ম্মোপার্জ্জন, এই দুইটির মধ্যে কোনটি উৎকৃষ্ট?’

“চণ্ডাল কহিল, ‘ধৰ্ম্মকার্য্যবিষয়ে আত্মাই সাক্ষী; অতএব এই দুইটির মধ্যে কোনটি অপকৃষ্ট, আপনিই তাহা বিলক্ষণ অবগত হইতেছেন। কিন্তু আমার মতে যে ব্যক্তি কুক্কুরমাংস ভক্ষ্য বলিয়া বিবেচনা করে, তাহার আর অখাদ্য কিছুই নাই।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘অনাহারে প্রাণনাশ উপস্থিত হইলে অভোজ্য বস্তুও ভক্ষণ করা কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ যাহাতে হিংসার লেশমাত্র নাই, আপৎকালে সেই অভোজ্য ভোজন করা কখনই দোষাবহ হইতে পারে না। উহাদ্বারা জনসমাজেও নিতান্ত নিন্দনীয় হওয়ার সম্ভাবনা নাই।

“চণ্ডাল কহিল, ‘তপোধন! যদি প্রাণধারণই প্রধান কার্য্য বলিয়া আপনি কুক্কুরমাংসভক্ষণ দুষ্কৰ্ম্ম জ্ঞান না করেন, তাহা হইলে ত’ আপনার বেদ ও আৰ্য্যধৰ্ম্মকে গ্রাহ্য করা হইল না এবং খাদ্যাখাদ্যের কিছুমাত্র বিচার রহিল না।’ বিশ্বামিত্র কহিলেন, ‘বস্তু ভোজ্য বা অভোজ্যই হউক, তাহা ভোজন করিলে প্রাণীহিংসার ন্যায় ঘোরতর পাতকে লিপ্ত হইতে হয় না। সুরাপান করিলে পতিত হয়, ইহা শাস্ত্রের শাসনমাত্র। অবৈধ মৈথুন প্রভৃতি অন্যান্য কাৰ্য্যসমুদয় লোককে এককালে পুণ্যচ্যুত ও ঘোরতর পাপে লিপ্ত করিতে সমর্থ হয় না।’ চণ্ডাল কহিল, যিনি অস্থান হইতে বা আগ্রহাতিশয় সহকারে চৌর্য্যবৃত্তিদ্বারা কুক্কুরমাংস গ্রহণ করেন, তাঁহাকেই তন্নিবন্ধন পাপভাগী হইতে হয়। যাহার গৃহ হইতে উহা অপহৃত হয়, তাহার কিছুমাত্র দোষ নাই।’

বিশ্বামিত্রের কুক্কুরমাংসগ্রহণ

“চণ্ডাল এই কথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিল। তখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র সেই কুক্কুরমাংস গ্রহণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইয়া, সহধর্ম্মিণীসমভিব্যাহারে সেই বনমধ্যে প্রাণরক্ষাৰ্থ উহা ভক্ষণ করিবেন বিবেচনা করিয়া অগ্নি আহরণপূর্ব্বক ঐন্দ্রাগ্নেয় বিধি অনুসারে চরু প্রস্তুত করিলেন। অনন্তর তিনি সেই চরুর অংশ প্রস্তুত করিয়া ইন্দ্রাদি দেবগণকে আহ্বানপূর্ব্বক দৈব ও পিতৃকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। বিশ্বামিত্র দৈব কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবামাত্র দেবরাজ ইন্দ্র প্রজাগণের জীবন রক্ষাৰ্থ প্রচুর পরিমাণে বারিবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই জলপ্রভাবে বিলক্ষণ শস্য উৎপন্ন হইয়াছিল। অনন্তর ভগবান বিশ্বামিত্র বিধিপূৰ্ব্বক দৈবকাৰ্য্য ও পিতৃকাৰ্য্য সমাধানপূৰ্ব্বক দেবতা ও পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধন করিয়া স্বয়ং সেই কুক্কুরমাংস ভক্ষণ করিলেন। ঐ মহাত্মা পরিশেষে তপঃপ্রভাবে আপনার পাপ অপনীত করিয়া পরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে বুদ্ধিমান ব্যক্তি ঘোরতর দুঃখে নিপতিত হইলে যে-কোন উপায়ে হউক, আপনাকে উদ্ধার করিবেন। বিশ্বামিত্রের ন্যায় বুদ্ধি অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবনরক্ষা করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। মনুষ্য জীবিত থাকিলে অশেষবিধ মঙ্গল ও পুণ্যলাভে সমর্থ হয়। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা স্ব স্ব বুদ্ধি প্রভাবেই ধৰ্ম্মাধৰ্ম্মের যথার্থ নির্ণয় করিয়া থাকেন।”