১৪০তম অধ্যায়
দুৰ্গম পথ-গমনে পাণ্ডবগণের পরস্পর মন্ত্রণা
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে বৃকোদর! তথায় দুর্দান্ত ভূতগণ অন্তর্হিত হইয়া রহিয়াছে, অগ্নির সাহায্য ও তপঃপ্রভাব ব্যতিরেকে গমন করা অসাধ্য। অতএব ইচ্ছাপূর্ব্বক ক্ষুৎপিপাসার শান্তি করিয়া বল ও দক্ষতা অবলম্বন কর। মহর্ষি লোমশ কৈলাসপর্ব্বতের বিষয় যাহা কহিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়াছ, এক্ষণে দ্রৌপদী কি প্রকারে গমন করিবেন, তাহারও উপায় স্থির কর অথবা সহদেব, ধৌম্য, সারথি, পৌরগণ, ব্ৰাহ্মণ ও পরিচারক প্রভৃতি তোমরা সকলেই প্রতিনিবৃত্ত হও। আমি, নকুল ও মহাতপাঃ লোমশ আমরা তিনজন মিতাহার ও নিয়তাচার অবলম্বন করিয়া গমন করিব। তুমি সাবধানে দ্ৰৌপদীকে রক্ষা করিয়া আমার আগমন প্রতীক্ষাপূর্ব্বক গঙ্গাদ্ধারে অবস্থিতি কর।”
ভীম কহিলেন, “মহারাজ! রাজপুত্রী একান্ত শ্ৰান্ত বা দুঃখার্ত্ত হইলেও প্রতিনিবৃত্ত হইবেন না, তিনি অবশ্যই অর্জ্জুনের দর্শনলালসায় গমন করিবেন। বিশেষতঃ আপনি কেবল অর্জ্জুনকে অবলোকন না করিয়াই অতি প্ৰবল ঔদাস্য অবলম্বন করিয়াছেন; পুনরায় সহদেব, রাজপুত্রী ও আমার বিরহে কি করিবেন, বলিতে পারি না; অতএব ব্রাহ্মণ ও পরিচারক প্রভৃতি আর সকলেই নিবৃত্ত হউন, আমি এই বিষম দুৰ্গম রাক্ষসসঙ্কীর্ণ পর্ব্বতে আপনাকে কখনই পরিত্যাগ করিব না। পতিপরায়ণা রাজপুত্রীও আপনা ব্যতীত বিনিবৃত্ত হইবেন না। এই সহদেব সতত আপনার অনুগত, আমি ইঁহার অভিপ্ৰায় অবগত আছি, এই ব্যক্তিও কখনও বিনিবৃত্ত হইবেন না। বস্তুতঃ সকলেই সব্যসাচীকে দর্শন করিবার নিমিত্ত সমুৎসুক হইয়াছে, অতএব আমরা সকলেই আপনার সহিত গমন করিব। বহুবিধকন্দরদুৰ্গম [দুরারোহ শৃঙ্গদ্বারা দুৰ্গম] এই পর্ব্বতে রথারোহণে গমন করাও অসাধ্য, অতএব আমরা ইহাতে পদব্রজে গমন করিব, আপনি তজ্জন্য বিমনাঃ হইবেন না। আমি মনে মনে স্থির করিয়াছি, পাঞ্চালী ও সুকুমার মাদ্রীকুমারেরা যে যে স্থান অতিবর্ত্তন করিতে অসমর্থ হইবেন, আমি ইহাদিগকে বহন করিয়া সেই সকল দুৰ্গম স্থান হইতে উত্তীর্ণ করিব, অতএব আপনি তন্নিমিত্ত দুর্ম্মনায়মান হইবেন না।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভীমসেন! তুমি যে ইহাদিগকে বহন করিবে বলিয়া উৎসাহ প্ৰকাশ করিলে তাহাতে আমি সাতিশয় পরিতুষ্ট হইলাম। এরূপ কাৰ্য্য সম্পাদন করা আর কাহারও সাধ্য নহে; অতএব তোমার বল, যশ, ধর্ম্ম ও কীর্ত্তি পরিবর্দ্ধিত হউক। কদাপি যেন তোমার গ্রানি বা পরাভব না হয়।” অনন্তর দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে সহাস্যমুখে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “নাথ! আমিও আপনাদের সহিত গমন করিব। আমার নিমিত্ত কদাচ পরিতাপ করিবেন না।”
লোমশ কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! আমরা কেবল তপঃপ্রভাবে গন্ধমাদনপর্ব্বতে গমন ও সব্যসাচীর সহিত সাক্ষাৎকার করিতে সমর্থ হইব।”
সকলে এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে হিমালয়পরিসরস্থ সুবাহুরাজ্যে উপন্থিত হইয়া প্রভূত গজবাজী শত শত কিরাত, তক্ষণ [কারুকাৰ্য্যকারী দারুশিল্পী—সূত্রধ], পুলিন্দ ও অমরগণ এবং ভূরি ভূরি আশ্চৰ্য্য ব্যাপার অবলোকন করিলেন।
পুলিন্দাধিপতি সুবাহু স্বীয় রাজ্যমধ্যে তাঁহাদিগকে সমাগত সন্দর্শন করিবামাত্র অতিমাত্র প্রীতিসহকারে পূজাপূর্ব্বক আপন আলয়ে আনয়ন করিলেন। তাঁহারাও পূজাগ্রহণপূর্ব্বক তথায় সেই রাত্রি সুখে অতিবাহিত করিলেন। অনন্তর লোমশ ও মহারাথ পাণ্ডবগণ পরদিন প্ৰভাতে ভগবান মরীচিমালী উদয়াচলশিখরে আরোহণ করিলে ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি সমুদয় ভৃত্য, পৌরগণ, সুপকার, পরিবর্হ [পরিচারক] ও পাঞ্চালগণকে পুলিন্দাধিপতির সমীপে সমৰ্পণ করিয়া অর্জ্জুনদর্শনলালসায় দ্রৌপদীর সহিত ধীরে ধীরে সে স্থান হইতে পদব্রজে প্রস্থান করিলেন।