১৩-১৪. একটু পর পর কিছু একটা

একটু পর পর কিছু একটা সেরিনার পেটে ঢুশ মারছে, সেরিনা আধো ঘুমে হাত দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল কিন্তু সেটি সরল না। সেরিনা শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে তাকালো, প্রাণীটি টুশকি, একটি ডলফিনের বাচ্চা। ডলফিনের যে দলটির সাথে সেরিনা সময় কাটায় এই শিশুটা সেই দলের। সেরিনা এর নাম দিয়েছে টুশকি, ডলফিন শিশুটা এই নামে সাড়া দেয়।

সেরিনা চোখ খুলে বলল, “টুশকি, তোমার সমস্যাটা কী? পানির ভেতর সেরিনার কণ্ঠস্বর অন্য রকম শোনায় কিন্তু তাতে টুশকির কোনো সমস্যা হলো বলে মনে হলো না। টুশকি একটা শীষ দেওয়ার মতো শব্দ করল তারপর মুখ দিয়ে টিক টিক করে শব্দ করতে লাগল।

সেরিনা ডলফিনের ভাষা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটা ডলফিনের নিজের একটা শীষ আছে সে শীষের শব্দ শুনে বুঝতে হয় কে কথা বলছে। টিক টিক শব্দ করে তারা কথা বলে, যখন মাছ ধরতে যায় তখন এক ধরণের শব্দ যখন খেলতে চায় তখন অন্য ধরণের শব্দ।

সেরিনা বলল, “কেন এতো ভোরে তুমি জ্বালাতন করছ? তোমার বেশীক্ষণ ঘুমাতে হয় না তার মানে এই না যে আমাকে ঘুমাতে হবে না।”

টুশকি কী বুঝল কে জানে, তার মাঝে এক ধরণের আনন্দ আর উত্তেজনা দেখা গেল। সেটি কয়েকবার সামনে পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে একবার উপরে উঠে নিশ্বাস নিয়ে আবার নিচে নেমে এল! সেরিনাকে না। নিয়ে সেটি যাবে না। সেরিনা তখন বাধ্য হয়ে পাথরের খাঁজ থেকে বের হয়ে আসে তারপর ডলফিল শিশু টুশকির সাথে পানির উপরে উঠে এল।

পানির নিচের আবছা অন্ধকার থেকে উপরে উঠে সেরিনার চোখ ধাঁধিয়ে যায়, চারদিকে যতদূর চোখ যায় সমুদ্রের নীল পানি, উপরে নীল আকাশ। এক দল ডলফিন নিশ্বাস নেবার জন্যে তাদের মাথাটা বের করে ঘুমুচ্ছে। নিজেদের ভাসিয়ে রাখার জন্যে ঘুমর মাঝেই খুব ধীরে ধীরে তাদের লেজ নাড়ছে।

টুশকি সেরিনাকে ঘিরে সাঁতার দিতে দিতে ঘুরপাক খেতে লাগল। মাঝে মাঝে পানি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে যেতে লাগল। টুশকির দাপাদাপিতে অন্য ডলফিনগুলোও জেগে উঠে নড়তে শুরু করল। সেরিনা তাদের শীষের শব্দ শুনতে পায়।

ডলফিনগুলো একে অন্যের সাথে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে কথা বলতে থাকে। একটু পরেই তারা মাছ ধরতে বের হবে, সেরিনা সব সময়েই তাদের সাথে যায়। যাবার আগে তার একটু খাওয়া দরকার। সদ্য বাচ্চা দেয়া মা ডলফিনটার শীষের শব্দ অনুসরণ করে সে কয়েকবার শব্দ করল, তখন একটা মাঝারী সাইজের ডলফিন তার দিকে এগিয়ে এসে মাথার উপরের ফুটো দিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। সেরিনা ডলফিনটাকে চিনতে পারল, সে এটাকেই খুঁজছে।

সেরিনা পানিতে ডুবে গিয়ে মা ডলফিনটার পেটের নিচে দুধের বোঁটা খুঁজে মুখ লাগিয়ে দুধ খেতে শুরু করে। ডলফিনের দলটা তাকে গ্রহণ করার পর সে প্রায় নিয়মিতভাবে ডলফিনের দুধ খায়। সুস্বাদু গাঢ় দুধ একটু খানি খেলেই তার পেট ভরে যায়। ডলফিনের দলে যোগ দেয়ার পর এটা তার সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে। ডলফিনগুলো তাকে খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে দলের সবচেয়ে বদরাগী ধরণের পুরুষ ডলফিনটাও তাকে মেনে চলে।

তার কারণ আছে। এই দলটার সাথে তার পরিচয়টা হয়েছে প্রায় হঠাৎ করে। সমুদ্রে যখন প্রায় প্রথম এসেছে তখন হঠাৎ করে একদিন সে একটা জাহাজের শব্দ পেল। নিচ থেকে দেখল মাঝারি সাইজের একটা জাহাজ জাল ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে। জাল ফেলে কেমন করে মাছ ধরে দেখার জন্যে সে পিছু পিছু গেল। জাহাজটা আস্তে আস্তে যখন জাল গুটিয়ে আনছে তখন দেখতে পেলো টুনা মাছের বিশাল একটা ঝাক জালের ভেতর আটকা পড়েছে, মাছগুলো জালের ভেতর খল-বল করছে। হঠাৎ করে দেখল জালের আশেপাশে অনেকগুলো ডলফিন ছুটোছুটি করছে, মুখ দিয়ে শীষ দেওয়ার শব্দ করছে। ক্লীক ক্লীক শব্দ করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ডলফিনগুলো কোনো একটা কারণে খুবই বিচলিত, তাদের মাঝে এক ধরণের উত্তেজনা আর ভয়। কেন ডলফিনগুলো এরকম করছে দেখার জন্যে সেরিনা আরেকটু কাছে এগিয়ে গেল তখন ডলফিনগুলোর উত্তণ্ঠার কারণটা বুঝতে পারল। জালের ভেতরে টুনা মাছের সাথে ছোট বড় অনেকগুলো ডলফিনও আটকা পড়েছে। সেগুলো ভেতরে আতংকিত হয়ে ছুটোছুটি করছে, বের হওয়ার চেষ্টা করছে, একটু পরে পরে জালে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু বের হতে পারছে না।

মাছ ধরার জাহাজটা তখন গুটিয়ে নেয়া জালটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে শুরু করে, টুনা মাছগুলো হুটোপুটি শুরু করে তার সাথে সাথে ডলফিনগুলোও আতংকিত হয়ে লাফ দিতে শুরু করে।

সেরিনা তখন আরেকটু এগিয়ে গেলো, তার কোমরে টাইটেনিয়ামের একটা চাকু বেঁধে রাখা আছে। সে যখন সমুদ্রে লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন শামীম তাকে এই চাকুটা দিয়েছে, টাইটেনিয়ামের বিশেষ ধরণের একটা চাকু, সমুদ্রের পানিতেও জং ধরে যাবে না। সমুদ্রের কতো রকমের প্রাণী সবারই নিজেকে রক্ষা করার জন্যে কিংবা অন্যকে আক্রমণ করার জন্যে ধারালো দাঁত বা অন্য কিছু একটা আছে, সেরিনার কিছু নেই। তার একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে তার মাথার বুদ্ধি আর টাইটেনিয়ামের এই চাকুটা।

সেরিনা চাকুটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল তারপর জালটার উপর থেকে নিচে অনেকখানি কেটে দিল। কাটা অংশ দিয়ে টুনাগুলো বের হতে লাগল আর তাদের দেখে হঠাৎ করে ডলফিন বুঝে গেল বের হওয়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, দেখতে দেখতে সবগুলো ডলফিন বের হয়ে আসতে থাকে। তাদের বের হতে সাহায্য করার জন্যে সেরিনা কাটা জালটা টেনে ধরে রেখে জায়গা করে দিল।

মাছ ধরার জালটা যখন উপরে টেনে তুলেছে তখন ডলফিনের সাথে সাথে বেশীরভাগ টুনাও বের হয়ে গেছে। জাহাজের মানুষগুলোকে নিচ থেকে দেখার উপায় নেই কিন্তু সেরিনা অনুমান করতে পারল মানুষগুলো নিশ্চয়ই তাদেও ফাটা জাল দেখে খুবই অবাক হয়ে গেছে।

ডলফিনগুলো চলে গেল না, সেরিনার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল, বোঝাই যাচ্ছে তারা সেরিনাকে তাদের নিজেদের মতো করে ধন্যবাদ জানাতে চাচ্ছে। ডলফিন স্তন্যপায়ী প্রাণী, পানিতে থাকলেও তাদের উপরে উঠে নিশ্বাস নিতে হয়, তাদের মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি। আটকে পড়া ডলফিনগুলোকে সেরিনা কীভাবে ছুটিয়ে এনেছে তারা ঠিক বুঝতে পেরেছে। একটা ডলফিন খুব কাছে এসে সেরিনার মুখ স্পর্শ করল, মনে হলো তার গালে চুমু দেবার চেষ্টা করছে। পিছনে ছোট একটা ডলফিনের বাচ্চা, সেরিনা বুঝতে পারল বাচ্চাটা ভেতরে আটকা পড়েছিল, এখন ছাড়া পেয়েছে বলে মা’টা সেরিনাকে তার মত করে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

সেরিনা ডলফিনটাকে ধরে একটু আদর করে দিল এবং সেই মুহূর্ত থেকে সে এই ডলফিনের দলের একজন সদস্য হয়ে গেল। ছোট ডলফিনটা তার খুবই ন্যাওটা হয়ে গেছে, সেরিনা তার নাম দিয়েছে টুশকি। প্রতিদিন ভোরেই ঘুম থেকে উঠে টুশকি তার কাছে চলে আসে। আজকেও এসেছে।

.

কিছুক্ষণের মাঝেই ডলফিনের দলটা অগ্রসর হতে শুরু করে। এরা যখন মাছ ধরতে যায় তখন একসাথে না থেকে অনেক দূরে দূরে ছড়িয়ে যায়। ডলফিনগুলো পানির ভেতর দিয়ে যেভাবে সাঁতার কাটতে পারে ঠিক সেরকম লাফ দিয়ে পানি থেকে বের হয়ে আসে। ডলফিনগুলোর পাশাপাশি সাঁতার কেটে যেতে যেতে সে যদি কখনো পিছিয়ে পড়ে তখন ডলফিনগুলো তার জন্যে অপেক্ষা করে। সেরিনা কখনো কখনো আরেকটা ডলফিনের পিঠে চেপে বসে সেটি তাকে নিয়ে সাঁতারে যেতে থাকে।

টুশকির পাশে পাশে সাঁতরে যেতে যেতে সেরিনা টের পেলো সামনে তারা একটা মাছের ঝাঁক পেয়েছে। ডলফিনগুলো চারদিক থেকে মাছের আঁকটাকে ঘিরে ফেলে তারপর মাছের আঁকটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘূরপাক খেতে থাকে। ডলফিনগুলো ধীরে ধীর বৃত্তটাকে ছোট করে আনে যখন বৃত্তটা মাছগুলো ধরার মতো ছোট হয়ে আসে তখন ডলফিনগুলো মাছ ধরে খেতে শুরু করে। এগুলো স্মেল্ট মাছ, বেশি বড় নয়। সেরিনা ডলফিনের মতো মাছ খেতে শিখে গেছে। ডলফিনগুলো সরাসরি মুখ দিয়ে খাচ্ছে সেরিনা মাঝে মাঝে উলফিনের মতো চেষ্টা করে দেখেছে, খুব সুবিধে করতে পারে না। তাকে সবসময়েই হাত দিয়ে ধরে নিতে হয়। গোটা তিনেক স্মেল্ট খেয়েই তার পেট ভরে গেল। সে যেভাবে কাঁচা মাছ ধরে খাচ্ছে তার আব্বু দেখলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যেতো। সমুদ্রে আসার পর এটাই সে প্রথমে শিখেছে। প্রথম প্রথম গন্ধে নাড়ী উল্টে আসতো আজকাল বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে। চিংড়ি, কাঁকড়া আর ওয়েস্টার তার প্রিয় খাবার। ডলফিন স্কুইড খেতে পছন্দ করে সেও তাদের মতো স্কুইড খাওয়া শিখে গেছে। কাঁচা মাছ খুবই বিচিত্র খাবার হতে পারে না, জাপানীরা সুশী খায় সুশী তো কাঁচা মাছ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথম প্রথম তার খাওয়াটা ছিল বেঁচে থাকার জন্যে আজকাল যখন খুব খিদে লাগে তখন খাওয়াটা সে রীতিমত উপভোগ করতে শুরু করেছে।

মাছের ঝাঁক থেকে মাছ খেয়ে ডলফিনের দলটা সমুদ্রের পানিতে ছোটাচ্চুটি করতে লাগল। হঠাৎ এক সময় একটা ডলফিন শীষের মতো শব্দ করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, ঠিক কী জন্যে সতর্ক করেছে সেরিনা বুঝতে পারল না, সে আশে পাশে তাকালে তখন দেখল দূর থেকে একটা হাঙ্গর মাছ আসছে। এই প্রাণীটাকে সেরিনা আসলেই ভয় পায়। সে নিঃশব্দে পানিতে ভেসে থাকল, কখন এটি কাকে আক্রমণ করে বসবে ঠিক নেই, এর মুখটা দেখেই আতংক হয়, সেটা কেমন জানি হিংস্র, ধারালো দাঁত দিয়ে মুহূর্তের মাঝে যে কোনো কিছু দু টুকরা করে ফেলতে পারে। আগেও তার মাঝে মাঝে হাঙ্গর মাছের সাথে দেখা হয়েছে, প্রতিবারই সে নিঃশব্দে ভেসে থেকেছে, হাঙ্গর মাছটি তখন পাশ দিয়ে, সাঁতরে চলে গেছে। চুপচাপ থাকলে মনে হয় হাঙ্গর মাছ সেটাকে ভালো দেখতে পায় না।

সেরিনা সাবধানে তার চাকুটা ধরে রাখল, সত্যি সত্যি তাকে আক্রমণ করলে এমনি এমনি সে ছেড়ে দেবে না। হাঙ্গরটা তাকে আক্রমণ করল না, ডলফিনগুলোকেও ধরার চেষ্টা করল না, লেজটা ডানে বায়ে নাড়তে নাড়তে আরো গভীর পানির দিকে নেমে গেল।

হাঙ্গরটা চলে যাবার পর ডলফিনগুলোও আবার খেলতে শুরু করে। সমুদ্রে থাকা শুরু না করলে সে কোনোদিন জানতে পারতো না ডলফিন এতো হাসিখুশি প্রাণী! মাঝে মাঝে মনে হয় এদের বুঝি মানুষের মতোই বুদ্ধি! সে যদি একবার তার আব্বুকে এনে এই ডলফিনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতো তাহলে কী মজাই না হতো!

সে বলতো, “আব্বু এই হচ্ছে টুশকিকে।“

টুশকি একটা ছোট লাফ দিতো আর আব্বু বলতো, “কী খবর টুশকি?”

তখন সে টুশকির মাকে দেখিয়ে বলতো, “আব্বু, এই হচ্ছে টুশকির মা। আমি এর দুধ খাই।”

আব্বু বলতো, “আমার মেয়েকে দেখেশুনে রাখার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ টুশকির মা!”

সেরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে, মাঝে মাঝে তার খুব আব্বুর কথা মনে হয়।

সেরিনা প্রথম যেদিন তিমি মাছ দেখেছিল সেই দিনটার কথা সে ভুলতে পারবে না। ডলফিন যেরকম হাসিখুশি বাচ্চাদের মতো তিমি মাছ ঠিক সেরকম গম্ভীর বয়স্ক মানুষের মতো। প্রথমবার যখন একটা তিমি মাছ দেখেছিল সে অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল। একেবারে ট্রেনের মতো বিশাল একটা প্রাণী ধীরে ধীরে যাচ্ছে। তিমি মাছটার একটা বাচ্চা, সেটাও বড় একটা বাসের মতো বড়, তার মায়ের পিছু পিছু যাচ্ছে। বিশাল একটা লেজ ধীরে ধীরে উপরে আর নিচে নামে। তিমি মাছও স্তন্যপায়ী প্রাণী এটাকেও নিশ্বাস নিতে হয়, মাঝে মাঝে মাথাটা পানির উপরে তুলে নিশ্বাস নেয় তারপর মাথার যে ফুটোটা আছে সেটা দিয়ে বাতাসটা বের করে দেয়।

সেরিনা তিমি মাছটার পিছু পিছু অনেকদূর গিয়েছিল। তিমি মাছ এতো বড় যে সেটাকে কেউ আক্রমণ করবে তার সাহস নেই। তিমি মাছ নিজেও সেটা খুব ভালো করে জানে, তাই সেটা যখন পানির নিচে দিয়ে যায় তখন ডানে বামে কোনোদিকে তাকায় না। সেরিনা জানতো না তিমি মাছ গান গাওয়ার মতো করে ডাকতে পারে। অনেকদূর থেকে যখন কান্নায় মতো শব্দ করে তিমি মাছ ডাকতে থাকে সেটা শুনে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।

এতো বড় তিমি মাছ কিন্তু সেরিনা কখনো তিমি মাছটাকে কিছু খেতে দেখে নি! মনে হয় পানির শ্যাওলা প্রাংকটন এগুলো খেয়েই থাকে। ডলফিনের মতো মাংশাসী নয়, নিরমিষাশী।  

ডলফিনের সাথে সেরিনার যে রকম এক ধরণের বন্ধুত্ব হয়েছে তিমি মাছদের সাথে সেরকম বন্ধুত্ব না হলেও এক ধরণের পরিচয় হয়েছে। তিমি মাছের কৌতূহলী বাচ্চাটা সেরিনাকে দেখলেই তার দিকে এগিয়ে আসে, তাকে উল্টে পাল্টে দেখে। মা তিমি মাছটা তখন চোখের কোণ দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কিন্তু একদিন তিমি মাছদের সাথে তার একধরণের ঘনিষ্ঠতা হলো। ঘটনাটা ছিল খুবই ভয়ংকর একটা ঘটনা।

.

১৪.

কয়দিন থেকেই সেরিনা একটা জাহাজের শব্দ শুনছিল। জাহাজের প্রপেলারে শব্দ বাড়ে আবার কমে। মনে হয় জাহাজটা কোনো কাজে এ দিকে এসে ঘুরোঘুরি করছে। তিমি মাছের একটা বড় দলও এদিকে ঘুরোঘুরি করছে। দেখে মনে হয় এগুলো অন্য কোনো একটা এলাকা থেকে এদিকে এসেছে। শীতের সময় যেরকম এক এলাকার পাখী অন্য এলাকায় চলে আসে অনেকটা সেরকম। জাহাজটা যে তিমি মাছ মারার জন্যে এসেছে সেটা সেরিনা মোটেও অনুমান করতে পারে নি।

ব্যাপারটা সেরিনা বুঝতে পারল যখন একদিন সে দেখল জাহাজের উপর থেকে একটা হারপুন দিয়ে বিশাল একটা তিমি মাছকে গেঁথে ফেলা হল। তিমি মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তার বিশাল শরীরটা নিয়ে পানির ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকে আর জাহাজের উপর থেকে হারপুনের দড়ি ছাড়তে থাকে। হারপুনটা তিমি মাছের শরীরে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে সেটা আর খুলে আসার উপায় নাই। হারপুনের দড়িতে বাঁধা থেকে তিমি মাছটা পানি তোলপাড় করে ছটফট করতে থাকে। রক্তে পানিটা টকটকে লাল হয়ে যায়। তিমি মাছটা নিশ্বাস নেবার জন্য একবার উপরে উঠে আবার ডুবে যায়। পানির নিচে ছটফট করতে থাকে। তিমি মাছটা যখন শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে নির্জীব হয়ে যায় তখন হারপুনের দড়ি টেনে টেনে তিমি মাছটাকে বিশাল জাহাজের কাছে নিয়ে আসে তারপর সেটাকে তখন ক্রেন দিয়ে টেনে টেনে জাহাজের উপর তুলে ফেলে। রক্তের গন্ধ পেয়ে একটু পরেই অনেকগুলো হাঙ্গর মাছ চলে এসে ঘোরাঘুরি করতে থাকে সেরিনা তখন তাড়াতাড়ি সরে গেল।

এই জাহাজটা এই এলাকায় রয়ে গেছে। তিমি মাছগুলো এদিক দিয়ে যাচ্ছে আর জাহাজ থেকে একটার পর একটা তিমি মাছ মেরে যাচ্ছে। সেরিনা একদিন খুব সাবধানে পানি থেকে মাথা বের করে দূর থেকে জাহাজটা দেখল। জাহাজের ঠিক সামনে হারপুন ছোঁড়ার কামানটা বসানো সেখান থেকে একজন মানুষ একটা তিমি মাছের দিকে তাক করে হারপুন ছুঁড়ে, তীব্রগতিতে হারপুনটা ছুটে গিয়ে তিমি মাছটাকে গেঁথে ফেলে। বিশাল একটা নিরীহ তিমি মাছ যন্ত্রণায় ছটফট করে, পানিকে তোলপাড় করে ছুটতে থাকে কিন্তু রক্ষা পায় না। সমুদ্রের পানি রক্তে লাল হয়ে যায় আর খুব ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাওয়া তিমি মাছটাকে ধীরে ধীরে জাহাজের কাছে টেনে আনে। কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার, দেখে সেরিনার ভেতরে অন্ধ রাগ পাক খেয়ে উঠতে থাকে।

একদিন সে খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলল। জাহাজ থেকে হারপুন ছুঁড়ে যখন মাঝারী একটা তিমি মাছকে গেঁথে ফেলেছে, মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে তখন তার ভেতরে সে তিমি মাছটার কাছে গিয়ে তার ধারালো চাকুটা দিয়ে হারপুনের দড়িটা কেটে দিল। শক্ত নাইলনের দড়ি, সেটা কাটা মোটেও সহজ ছিল না, কিন্তু তারপরেও কীভাবে কীভাবে জানি সে শেষ পর্যন্ত দড়িটা কেটে ফেলতে পারল। সাথে সাথে হারপুন গাঁথা তিমি মাছটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ছুটে পালিয়ে গেল।

জাহাজের তিমি শিকারীরা খুব অবাক হয়ে দড়িটা গুটিয়ে আনে, অবাক হয়ে লক্ষ্য করে নাইলনের দড়িটা নিখুঁতভাবে কেটে দেয়া হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব তারা কেউ বুঝতে পারল না।

ঘণ্টা খানেক পর দ্বিতীয় বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটল, সেরিনা অবাক হয়ে দেখল হারপুন গাঁথা তিমি মাছটা তার কাছে এসে তার মুখ দিয়ে ঠেলে তাকে হারপুনটার কাছে পাঠাচ্ছে, তাদের নিজেদের ভাষায় প্রায় কান্নায় মতো এক ধরণের শব্দ করছে। আরো কয়েকটা তিমি মাছ তাকে ঘিরে ঘুরছে। ইঙ্গিতটা খুবই স্পষ্ট, সেরিনাকে হারপুনটা খুলে দিতে হবে।

সেরিনা জীবনেও একটা হারপুন নিজের চোখে দেখে নি, যখন একটা তিমি মাছের শরীরে একটা হারপুন গেঁথে যায় তখন সেটাকে আদৌ টেনে বের করা সম্ভব কী না সে জানে না। কিন্তু যখন পাহাড়ের মতো তিন চারটা তিমি মাছ সেরিনার মতোন ছোট একটা মানুষকে ঘিরে মুখ দিয়ে ঠেলে হারপুনটা খুলে দেয়ার জন্যে ঠেলে দিতে থাকে তখন তার আর কিছু করার থাকে না। তার এই ছোট জীবনে সে এর মাঝে এতোকিছু করেছে তার সাথে না হয় আরো একটা ঘটনা যুক্ত হোক। সে তার কোমর থেকে টাইটেনিয়ামের ধারালো চাকুটা নিয়ে কাজে লেগে যায়।

সত্যি সত্যি সেরিনা হারপুনটা খুলে আনতে পারবে, নিজেও বিশ্বাস করে নি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা সে করতে পারল। তিমি মাছের শরীরে অনেক চর্বি, সেই চর্বি কেটে ভেতরে গিয়ে সেরিনা হারপুনের ধারালো ফলাগুলো ছুটিয়ে সাবধানে বের করে আনে। পুরো পানিটা রক্তে লাল হয়েছিল বলে তার দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুমান করতে হচ্ছিল হারপুনে ফলাটা কোনদিকে। পুরো সময়টা তিমি মাছটা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, অন্য তিমি মাছগুলো তখন তার আশেপাশে থেকে তাকে শান্ত করে রেখেছে।

শেষ পর্যন্ত যখন হারপুনটা খুলে আনতে পেরেছে তখন তিমি মাছগুলো এক ধরণের আনন্দের শব্দ করল। যে তিমি মাছটার শরীরে হারপুন গেঁথে ছিল সেটি ঘুরে এসে খুব কাছ থেকে সেরিনাকে দেখলো, তার চোখটা এতো জীবন্ত যে সেরিনা এক ধরণের শিহরণ অনুভব করে। তারপর তার মুখ দিয়ে সেটি সেরিনাকে স্পর্শ করল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটা পদ্ধতি।

তিমি মাছেরা নিশ্চয়ই নিজেরা নিজেদের ভেতর কথা বলতে পারে কারণ এই ঘটনার পর সেরিনা আবিষ্কার করল, বিশাল বিশাল তিমি মাছ তাকে দেখলেই থেমে যেতে শুরু করেছে। মাথা ঘুরিয়ে তার কাছে এসে মুখ দিয়ে তাকে স্পর্শ করছে, ফ্লিপারটি তার শরীরের উপর বুলিয়ে নিচ্ছে, মুখ দিয়ে নরম কোমল এক ধরণের শব্দ করছে। নিশ্চয়ই তিমি মাছেরা নিজেদের ভেতর সেরিনাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করছে, একজন অন্যজনকে জানিয়ে দিচ্ছে মানুষের মতো দেখতে ছোট একটা প্রাণী তিমি মাছের বন্ধু সেই মানুষটি তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই তিমি মাছগুলো তাকে দেখলে একটু থেমে গিয়ে তার সাথে একটু ভাব বিনিময় করে যায়।

কয়দিন পর আরো বড় একটা জাহাজ এল তিমি মাছ মারার জন্যে। একটি দুটি তিমি মাছকে মেরেও ফেলল। এরা শুধু যে হারপুন দিয়ে গেঁথে ফেলে তা না, তারপর শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে গুলি করে তিমি মাছগুলোকে দ্রুত মেরে ফেলে। সেরিনা চেষ্টা করেও কোনো তিমি মাছ। রক্ষা করতে পারল না।

রাতে জাহাজটা নোঙ্গর ফেলেছে। তখন সেরিনা ঘুরে ঘুরে জাহাজটাকে খুব ভালো করে দেখল। সারাদিন কাজ শেষ করে তিমি শিকারীরা ঘুমানোর আগে স্ফূর্তি করছে, তাদের হই হল্লা অনেকদূর থেকে শোনা যায়।

জাহাজের গলুইয়ে লাগানো হারপুন ছোঁড়ার কামানটা দেখা যাচ্ছে, কোনোভাবে যদি এটাকে নষ্ট করে দেয়া যেতো তাহলে এরা আর তিমি মাছ মারতে পারতো না। হারপুন ছোঁড়ার কামানটা দেখতে দেখতে হঠাৎ সেরিনার মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি দিয়ে গেল। তিমি মাছদের ব্যবহার করে সে কী এই কামানটাকে উপড়ে ফেলতে পারে না?

সেরিনা পানি থেকে মাথা বের করে কামানটাকে আরো ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, নিচ থেকে ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না তাই সে রাত গম্ভীর হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

এক সময় তিমি শিকারীদের হল্লা থেমে গেল, সেরিনা বুঝতে পারল সবাই নিশ্চয়ই এখন ঘুমিয়ে গেছে। সে তখন খুব সাবধানে জাহাজের গলুই বেয়ে উপরে উঠে আসে। সাবধানে রেলিং টপকে জাহাজের পাটাতনে নেমে এল, তারপর কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে অপেক্ষা করল। যখন দেখল কেউ নেই তখন সে পা টিপে টিপে হারপুন ছোঁড়ার কামানটার কাছে এগিয়ে যায়।

বড় বড় স্কু দিয়ে কামানটা পাটাতনের সাথে লাগানো আছে, ভিতর থেকে কয়েক ফুট উপরে উঠে এসেছে, সেখানে একটা ধাতব সিলিন্ডার হারপুনটা এর ভেতরে ঢোকানো থাকে। হরপুনের সাথে দড়ি লাগানো। দড়িটা কামানের পিছনে সাবধানে বৃত্তাকারে পেঁচিয়ে রাখা আছে। হারপুনটা যখন ছুটে যায় তখন এই দড়িগুলো পাক খুলতে খুলতে যেতে থাকে।

পুরো কামানটা উপড়ে নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। নাইলনের দড়ি যত শক্তই হোক এক সময় ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু হারপুন ছোঁড়ার ব্যারেলটা মনে হয় বাঁকা করে দেয়া যেতে পারে। তাহলেই এটা অচল হয়ে যাবে। সেরিনা তখন সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে গেল। হারপুনের দড়ি দিয়েই হারপুন ছোঁড়ার ব্যারেলটা ভালো করে বেঁধে দিল। বাড়তি দড়ি দিয়ে সে কামানটাকেও বেঁধে ফেলল শুধু একটা দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে বলে সে কয়েক প্রস্থ দড়ি ব্যবহার করে, তারপর দড়ির মাথাগুলো পানিতে ফেলে দিল। তার আপাতত কাজ শেষ, এখন একটা তিমি মাছকে রাজী করাতে হবে এই দড়িটা ধরে টেনে নিতে! তিমি মাছেরা আনন্দের সাথে রাজী হবে কিন্তু বিষয়টা বোঝানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

জাহাজের গলুই থেকে নেমে যাবার আগে সে জাহাজটা একটু ঘুরে দেখতে গিয়ে রাইফেলগুলো আবিষ্কার করলো। একটা স্ট্যান্ডের মাঝে সুন্দর সাজানো আছে। সেরিনা রাইফেলগুলো নিয়ে একটা একটা করে সবগুলো সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিল। তারপর জাহাজ থেকে নেমে পানিতে ডুবে গেল।

পানিতে নেমে সে একটা তিমি মাছ খুঁজতে থাকে। তিমি মাছগুলো এই পথ দিয়ে যায়, সেজন্যেই তিমি শিকারীগুলো এখানে আস্তানা গেড়েছে তাই কিছুক্ষণেই সে একটা তিমি মাছের দলকে পেয়ে গেল। পানির নিচ অন্ধকার, তার মাঝেই বিশাল একটা তিমি মাছ তাকে দেখে চিনতে পেরে তার কাছে এগিয়ে আসে, তাকে মুখ দিয়ে স্পর্শ করে, ফ্লিপার দিয়ে তার শরীর বুলিয়ে দেয়। সেরিনা তখন তিমি মাছটার একটা ফ্লিপার ধরে তাকে টানতে থাকে, প্রথমে তিমি মাছটা ঠিক বুঝতে পারছিল না সেরিনা কী চাইছে, একটু পরে মনে হলো বুঝতে পারল, তখন সেরিনার সাথে সাথে সেটি জাহাজটার কাছে যেতে থাকে। জাহাজের কাছে যাবার পর সেরিনা হারপুনের দড়িটা তিমি মাছটার মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে আবার তার ফ্লিপারটা ধরে টানতে থাকে।

তিমি মাছটা বুঝতে পারল তাকে এই দড়িটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতে হবে এবং সে সত্যি সত্যি হ্যাঁচকা টান দিল, দড়ির টানে হারপুন ঘোড়ার পুরো কামানটি উপড়ে এসে জাহাজের রেলিংয়ে আটকে গেল। দ্বিতীয়বার হ্যাঁচকা টান দিতেই কামানটির ধাতব সিলিন্ডারটা প্রচণ্ড চাপে বাঁকা হয়ে যায়, সাথে সাথে ভেতরে রাখা বিস্ফোরকটা শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়ে গেল।

সেরিনা তখন দড়িটা তিমি মাছের মাথা থেকে খুলে নেয়, তারপর তিমি মাছের বিশাল দেহটাকে একবার আলিঙ্গন করে তাকে বিদায় দিয়ে দেয়। তিমি মাছটা জাহাজের চারপাশে একবার পাক খেয়ে তার গন্তব্যের দিতে যেতে থাকে।

সেরিনা জাহাজের কাছে এসে উপরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করল। বিস্ফোরণের শব্দে জাহাজের অনেকের ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তারা জাহাজের গলুইয়ে ছুটে এসেছে, হারপুন ছোঁড়ার পুরো কামানটা উপড়ে গিয়ে জাহাজের রেলিংয়ে পড়ে থাকতে দেখে মানুষগুলো হতবুদ্ধি হয়ে গেল, এরকম একটা ব্যাপার কেমন করে ঘটতে পারে তারা কোনোভাবে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না।

পরদিন জাহাজটা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেল।