সুবীর যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
থানার ওসি’র কড়া নির্দেশ, আপাতত তারা কেউ বাড়ি থেকে পুলিসের বিনানুমতিতে বের হতে পারবে না।
পরের দিন দুপুরের দিকে সুবীর সুবিনয়ের ঘরে এসে বলে, দিস ইজ সিমপ্লি টরচার সুবিনয়!
সুবিনয় চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। সুবীরের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
সুবীর আবার বলে, এভাবে আমাদের এখানে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দি করে রাখার মানেটা কি? কাকার মৃত্যুর ব্যাপারে কি ওরা আমাদের সন্দেহ করেছে নাকি? ডু দে সাসপেক্ট আস!
কিছু তো সেটা অস্বাভাবিক নয় সুবীরদা! মৃদু কণ্ঠে সুবিনয় জবাব দেয়।
হোয়াট ডু উই মিন?
ভেবে দেখ না।
কি ভাবব?
আমরা কজন ছাড়া তো এ বাড়িতে কেউ পরশু রাত্রে ছিলাম না! কাজেই আমাদের ওপরে যদি পুলিসের সন্দেহ পড়েই–
আমরা আমাদের কাকাকে হত্যা করেছি! হাউ ফ্যান্টাস্টিক! বাট হোয়াই? কেন–আমরা তাকে হত্যা করতে যাব কেন!
আজ সকালে মিঃ সেন–মামার সলিসিটার এসে কি বললেন শুনেছ তো তুমি! মামার
সম্পত্তি ও টাকাকড়ি নেহাৎ কম নয়!
কোম্পানির শেয়ার, ইনসুরেন্স, নগদ টাকা ব্যাঙ্কের ও এই বাড়ি সব মিলিয়ে লাখ দুয়েকের বেশী–
তাই সেই অর্থের জন্য আমরা কাকাকে হত্যা করেছি।
না করলেও লোকে তাই ভাববে সহজেই, কেননা ঐ ধরনের ঘটনা তো বিরল নয়।
তার জন্য হত্যা করবো তাকে? ওর যা-কিছু তো সব আমরাই পেতাম।
না।
তার মানে?
আর দুটো দিন দেরি হলে কিছুই পেতাম না। শুনলে না মিঃ সেন বলছিলেন, মামা একটা উইল করেছিলেন। তাঁর সব কিছু শমিতা দেবীকে দেবার মনস্থ করেছিলেন এবং সেই উইলে এমন কি তাঁর একমাত্র ছেলেকেও বঞ্চিত করে–
দ্যাট বিচ্! দ্যাট হারলট! সুবীর বললে, ঐ মেয়েমানুষটাই যত নষ্টের মূল!
সুবিনয় মৃদু হেসে বললে, মামা তাকে বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন।
কি করে বুঝলে?
আমার তাই ধারণা।
খুব হয়েছে। হি গট হিজ রিওয়ার্ড। কিন্তু তাই যদি হয় তো আমাকে তারা এভাবে নজরবন্দী করেছে কেন? আমি তো আর সেরাত্রে এ বাড়িতে ছিলাম না।
তাতেই বা কি?
তার মানে?
পুলিস হয়ত ভাবতে পারে—
কি? কি ভাবতে পারে?
কোন এক ফাঁকে নিমন্ত্রণ–বড়ি থেকে এসে—
ডোন্ট টক ননসেন্স!
তা তুমি ছটফট করছ কেন সুবীরদা? কটা দিন আমাদের নজরবন্দী করে রাখলেই বা ওরা। চিরদিন তো কিছু আর আমাদের এভাবে রাখতে পারবে না।
কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোন ভদ্রলোক চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দী হয়ে থাকতে পারে?
উপায় কি বল! আচ্ছা সুবীরদা?
কি?
রামদেওটা হঠাৎ কোথায় গেল বল তো?
আমার মনে হয় কি জান সুবিনয়!
কি?
ঐ ব্যাটারই কাজ। টাকাপয়সার ব্যাপার নয়–ওর তৃতীয় পক্ষের তরুণী স্ত্রী ঐ রুক্মিণীর সঙ্গে কাকার নটঘট দেখে ও বেটা নিশ্চয়ই ক্ষেপে গিয়েছিল। তারপরই শেষ করে দিয়েছে সুযোগমত কাকাকে।
কিন্তু–
সুবীর বলে, তুমি দেখে নিও সুবিনয়, আমি যা বলছি তাই। ঐ বেটাই দিয়েছে মামাকে খতম করে। তারপর গা-ঢাকা দিয়েছে।
অবিশ্যি অসম্ভব নয় কিছু।
কাকার যেমন রুচি। একটা চাকরের বৌ, তাকে নিয়েও কিনা—
তুমি কি সত্যই মনে কর সুবীরদা, মামার সঙ্গে রুক্মিণীর কোন একটা অবৈধ সম্পর্ক হয়েছিল?
হয়েছিল মানে! চব্বিশ ঘণ্টাই তো ঐ মাগীটা কাকার ঘরে থাকত!
কি জানি! আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
লক্ষ্য করে দেখেছ ইদানীং ঐ মাগীটার বেশভূষা–হ্যাকন—ঢ্যাকন—
ওদের কথা শেষ হয় না, বাহাদুর এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!
কি হয়েছে?
জ্যাকি তো কিছু খাচ্ছে না। আজ দুদিন থেকে সাহেবের ঘরের সামনে বসে আছে, ওঠে না।
বেচারী! অবোধ প্রাণী–প্রভুর শোকটা ভুলতে পারছে না কিছুতেই। সুবিনয় বলে।
কি করব বাবুজী? না খেয়ে থাকলে তো ও মরে যাবে।
সুবীরদা?
কি?
তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ না।
আমি? আমার হাতে ও খেয়েছে নাকি কোনদিন?
চেষ্টা করে একবার দেখতে ক্ষতি কি?
বাইরে ঐ সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল একজোড়া। সুবিনয় আর সুবীর দরজার দিকে তাকাল। অরূপ ও কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। অরূপের হাতে একটা ঝোলা।
সুবীর অরূপের দিকে তাকিয়ে বলে, এই যে অরূপবাবু! আমাদের আর এভাবে কতদিন খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রাখবেন বলুন তো?
জবাব দিল কিরীটী, আপনারা যে মুহূর্তে সব সত্যি কথা অকপটে বলবেন তখুনি পুলিসপ্রহরা এখান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে সুবীরবাবু।
কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই, সব সত্য কথা এখনও আপনারা স্পষ্ট করে বলছেন না কেন?
কোন্ কথাটা আবার বলিনি? সুবীর বলে।
সে-রাত্রে আপনি রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন সুবীরবাবু?
বলেছি তো আমার বন্ধুর বোনের বিয়েতে—
আপনার বন্ধু অরিন্দমবাবু বলেছেন—
কি বলেছেন?
রাত সাড়ে নটা নাগাদ আপনি বরযাত্রীদের দেখাশোনা করবার জন্য দুটো বাড়ির পরের বাড়িতে যেখানে বরযাত্রীরা উঠেছিল সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আপনি পাঁচ-দশ মিনিটের বেশী ছিলেন না।
কে বললে?
আমরা খবর পেয়েছি।
বাজে কথা। আমি রাত পৌনে বারোটা পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। সুবীর দৃঢ়কণ্ঠে বলে।
না, ছিলেন না।
আপনি যদি জোর করে বলেন মশাই যে আমি ছিলাম না—
জিতেনবাবুকে আপনি চেনেন? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে।
কোন্ জিতেন? কে সে?
জিতেন ভৌমিক। আপনার অফিসের সহকর্মী।
হ্যাঁ, চিনি।
তিনি আপনাকে সেরাত্রে দশটা থেকে সোয়া দশটার সময় পার্ক স্ট্রীটের একটা হোটেলে দেখেছে। কি, কথাটা মিথ্যে?
সুবীর চুপ।
আপনি হোটেল থেকে কখন বের হয়ে যান?
সুবীর চুপ।
কি সুবীরবাবু, জবাব দিচ্ছেন না কেন?
হ্যাঁ, আমি হোটেলে গিয়েছিলাম।
কেন?
ড্রিঙ্ক করতে।
বেশ। কিন্তু সেরাত্রে হোটেল থেকে কখন আপনি বের হয়ে যান?
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ।
না। তার আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। কিরীটী শান্তকঠিন গলায় প্রতিবাদ জানায়। বলুন কখন বের হয়ে গিয়েছিলেন হোটেল থেকে?
মনে নেই।
বেশ। তাহলে বলুন এবার হোটেল থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলেন? বিয়েবাড়িতে।
না। আবারও আপনি সত্য গোপন করছেন। থাকলে কিরীটী অরূপের দিকে তাকিয়ে বললে, অরূপ, জুতোজোড়াটা তোমার ঝোলা থেকে বের কর তো!
কিরীটীর নির্দেশে অরূপ ঝোলা থেকে একজোড়া কালো রংয়ের ক্রেপ সোলর জুতো বের করল। সুবীর আর সুবিনয় জুতোজোড়ার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জুতোর সোলে কাদা শুকিয়ে আছে।
ঐ জুতোজোড়া কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন সুবীরবাবু? এই বাড়ির পিছনে একটা গাছের নীচে বাগানের মালির ঘরটার কাছে যে ঘরে জ্যাকিকে আটকে রাখা হয়েছিল–এ জুতোর ছাপও সেই ঘরটার কাছেই বাগানের মাটিতে পাওয়া গিয়েছে। ধর্মের কল কেমন বাতাসে নড়ে দেখুন! সেদিন দুপুরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে বাগানের মাটি নরম হয়ে গিয়েছিল এবং মাটিতে জুতোর ছাপ যেমন পড়েছে তেমনি জুতোতেও কাদা লেগেছে।
সুবিনয় ও সুবীর দুজনের কারো মুখেই কোন কথাই নেই। দুজনেই যেন একেবারে বোবা।
কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, আপনারা কেউ চিনতে পারছেন এ জুতোজোড়া, সুবিনয়বাবু?
না।
সুবীরবাবু, আপনি?
না।
বাহাদুর! তুমি চিনতে পারছ?
জী সাব।
কার এ জুতো?
সাহেবের।
গগনবাবুর?
জী হাঁ।
অরূপ, এবার কোটটা বের কর।
অরূপ ঝোলা থেকে একটা কালো টেরিউলের প্রিন্স কোট বের করল।
বাহাদুর, এ কোটটা কার জান?
জী।
কার?
সাহেবের।
সুবীরবাবু, সুবিনয়বাবু–এটাও বাগানে পাওয়া গিয়েছে এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এই কোটের গায়ে ও হাতায় রক্ত শুকিয়ে ছিল। সে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে গগনবিহারীর রক্ত বলে।
এতক্ষণে সুবিনয়ই কথা বলে, আপনি এসব কথা আমাদের বলছেন কেন মিঃ রায়? আপনার কি ধারণা আমাদেরই মধ্যে কেউ মামাকে হত্যা করেছি?
না। সেজন্য নয়।
তবে?
আচ্ছা আপনারা সেরাত্রে এ ব্যাপারে কোন চিৎকার বা চেঁচামেচি শোনেননি?
না। তাছাড়া সেরকম কিছু হলে জ্যাকি কি ডাকত না? চুপ করে থাকত?
পুয়োর জ্যাকি ওয়াজ ড্রাগড়! তাকে খাদ্যবস্তুর সঙ্গে কোন ওষুধ খাইয়ে আগে থাকতেই নিস্তেজ করে ফেলা হয়েছিল।
কিন্তু সে তো কারে হাতে খায় না। সুবিনয় বলে, জ্যাকি তো মামা ও রামদেওর হাতে ছাড়া আর কারো হাতেই খেত না।
খেত না ঠিকই। আর সেই যুক্তিতেই হয়ত হত্যাকারী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার সুযোগ খুঁজবে। কিন্তু একটা কুকুরকে কোন কৌশলে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিস্তেজ করা এমন কিছুই কষ্ট নয় সুবিনয়বাবু।
আমার মনে হয়—
কি বলুন?
আপনার কথাই যদি সত্যি হয় তো রামদেওই সে কাজ করেছিল। তার পক্ষেই সেটা বেশী সম্ভব ছিল।
তা ঠিক।
এবং নিশ্চয়ই এখনও তার কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি?
না। তাহলেও তাকে খুঁজে বের করতে পুলিসের অসম্ভব হবে না।
তাই তো আমি ভাবছি, রামদেও নামক রংয়ের তাসটি যখন হঠাৎ টেবিলের উপর এসে পড়বে তখন সত্যিকারের হত্যাকারীর যে বাঁচার আর কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।