সিন্ধুতলে মুক্তো কুড়ুনো
এই রহস্যময় মানুষটির কথা যত ভাবি, তত মনে হয়, এঁকে ছুঁতে পারি এমন সাধ্য আমার নেই। কে ইনি? কোন দেশের মানুষ? কোন গভীর ক্ষত তিনি লুকিয়ে রেখেছেন বুকের ভিতর? কেন সমস্ত মনুষ্য সমাজের প্রতি তাঁর বিরাগ আর বিতৃষ্ণা এমন প্রবল? (এ-সব প্রশ্নের উত্তর জুল ভেন-এর বিখ্যাত উপন্যাস মিস্টিরিয়াস আইল্যাণ্ড-এ দেওয়া হয়েছে।) অথচ তার বুকের মধ্যে যে ভালোবাসার এক অফুরন্ত প্রসবণ আছে তা তো কাল সারা রাত অর্গ্যানের অফুরন্ত কান্নায় উপচে উঠছিলো! কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, বিদ্রোহী, যোদ্ধা—কোমলে ও কঠোরে তুলনাহীন এই মানুষটিকে কোনোদিনই আমি বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না। আর তাই আমাদের মাপকাঠিতে তাঁকে বিচার করবার কথাও আমি ভাবতে পারি না।
পরের দিন ভোরবেলায় একটি পরিচারক এসে আমাকে ক্যাপ্টেন নেমোর কাছে ডেকে নিয়ে গেলো। সমুদ্রের নিচে মুক্তোর খেত দেখতে যেতে ইচ্ছুক কি, তিনি জিগেস করলেন। দেখে কে বলবে এই মানুষটিই কাল অমন আর্ত ও ব্যথিত হয়ে উঠেছিলেন।
নেড আর কোনসাইল তো এই লোভনীয় প্রস্তাব শুনেই আনন্দে নৃত্য করে উঠলো। সেই ডুবুরি-পোশাক পরে ছুরি সম্বল করে শুরু হলো আমাদের অভিযান। নেড কিন্তু কিছুতেই হারপুন না-নিয়ে যেতে রাজী হলো না। হারপুন ছাড়া জলের প্রাণীদের মুখোমুখি দাঁড়াতে সে নাকি কিছুতেই রাজী নয়।
ভারত মহাসাগরের এই অঞ্চলে এমন অনেক সামুদ্রিক জীব দেখা গেলো, যাদের কোনো দিন এভাবে দেখতে পাবো বলেও কল্পনা করিনি। তার মধ্যে মস্ত ও ভীষণ একটি কঁকড়াকে দেখে যে-ভয় পেয়েছিলুম, তাও কোনো দিন ভুলবো না।
সমুদ্রতলের মতো রোমাঞ্চকর জায়গা আর নেই। পাহাড় গম্ভীর, বিস্ময়কর, অচঞ্চল–কিন্তু সমুদ্র যেন পৃথিবীর অশান্ত হৃৎপিণ্ড-কোন-এক অধীর আবেগে প্রতি মুহূর্তেই চঞ্চল হয়ে আছে। কোন-এক রহস্যময় ভাষায় সে যেন সবসময়েই কী বলতে চাচ্ছে অসীমকে।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর মুক্তো খেতে গিয়ে পৌঁছোলুম। খেতই বটে। যেখানেসেখানে ঝিনুক পড়ে আছে; বাদামি তন্তুর বাঁধনে বন্দী তারাবন্দী, মৃত, ব্যাধিগ্রস্ত। কোন এক অদ্ভুত রোগে যখন তাদের দেহ থেকে ক্ষরণ হতে থাকে অবিরাম, তখন তা-ই জমে জমে ক্রমে এই অমূল্য সিন্ধু-রূপান্তর ঘটিয়ে দেয়; শুক্তির মধ্যে কোনো অধীর অশ্রুর মতো ঝকমক করে ওঠে মুক্তোর দানা। কত যে ঝিনুক পড়ে আছে তার কোনো সীমাসংখ্যা নেই। নেড তো দু-হাতে লুঠ করতে লাগলো-দেখতে দেখতে তার থলি বোঝাই হয়ে গেলো।
ক্যাপ্টেন নেমো তারপরে আমাদের পথ দেখিয়ে মস্ত একটা গুহায় নিয়ে গেলেন। সিন্ধুতলের এই গুহার খোঁজ যে তিনি ছাড়া আর-কেউ রাখে না তা
স্পষ্ট বোঝা গেলো। বড়োবড়ো থামের উপর গুহার ছাদটা দাড়িয়ে আছে, আর আশপাশে সমুদ্রের জীবরা যেন অনধিকার প্রবেশে ক্ষুব্ধ হয়ে অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে আমাদের। এক জায়গায় এসে ক্যাপ্টেন নেমো থেমে পড়ে আঙুল বাড়িয়ে যা দেখালেন তাতে দস্তুরমতে তাজ্জব হয়ে গেলুম।
গুহাটা সেখানে কুয়োর মত গভীর হয়ে গেছে, আর তারই একেবারে তলায় শুয়ে আছে বিশাল একটি শুক্তি। এত বড়ো ঝিনুক আমি এমনকি নটিলাস-এর সংগ্রহশালাতেও দেখিনি। স্থির শান্ত জলে কত বছর ধরে যে এই ঝিনুকটি বেড়ে উঠেছে তা কে জানে ক্যাপ্টেন নেমো যে এই বিশেষ ঝিনুকটির কথা আগে থেকেই জানতেন, তা তক্ষুনি বোঝা গেলো। ঝিনুকের বিশাল ডালা দুটি বন্ধ হয়ে আসছিলো কিন্তু চকিতে ক্যাপ্টেন নেমো তার ছোরাটা তার ফাকে রাখতেই ভালা দুটি আর পুরোপুরি বন্ধ হতে পারলো না। আর সেই ফাকের মধ্য দিয়ে ভিতরের জিনিশটি দেখেই আমি হতবাক হয়ে গেলুম।
মুক্তো যে কোনো নারকোলের মতো এত বড় হতে পারে, তা আমি নিজের চোখে না-দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না! নটিলাস-এর সিকেও এত বড়ো মুক্তো আমি দেখিনি। আমি হাত বাড়াতে যেতেই নেমো বাধা দিয়ে ছোরাটা টেনে নিলেন, অমনি ঝিনুকের ডালা দুটি বন্ধ হয়ে গেলো। বছরের পর বছর ধরে এই গোপন গুহায় এইভাবেই বড়ো হয়ে চলবে মুক্তোটা, তারপর একদিন ক্যাপ্টেন নেমো তা সংগ্রহ করে এনে তার বিচিত্রাভবনে সাজিয়ে রাখবেন।
সেই গুহা থেকে বেরিয়ে এসে অনির্দিষ্টভাবে এদিক ওদিক ঘুরছি, হঠাৎ ক্যাপ্টেন নেমো আমাকে টান দিয়ে একটা পাহাড়ের আড়ালে দাড় করিয়ে দিলেন।
একটু দূরেই জলের মধ্যে চলমান একটি ছায়ামূর্তি দেখে তার কারণ বোঝা গেলো। হাঙর; না ওই জাতীয় কোনো হিংস্র সিন্ধু প্রাণী? না, কিছুই নয়। আসলে সে সিংহলের একটি মুক্তো-ডুবুরি, জলের উপরে তার ছোট্ট ডিঙি নৌকো ভাসছে। লোকটা একেকবার নিচে নেমে দ্রুত হাতে ঝুলিভর্তি করে মুক্তো তুলছে, তারপর চট করে উপরে উঠে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার নতুন ঝুলি নিয়ে আসছে।
হঠাৎ লোকটা যেন কোনো দারুণ ভয়ে আঁৎকে উঠলো। পরক্ষণেই তার মাথার উপরে ভেসে এলো মস্ত একটা রুপোলি ছায়া-হাঙরের পেট। হাঙরের উম্মুক্ত দাতের সারি আর ক্রুর নিষ্ঠুর চোখ দেখেই সে বুঝতে পারলে কেন তাকে সিন্ধুনেকড়ে বলে। প্রথম আক্রমণটা লোকটা কৌশলে এড়িয়ে গেলো বটে, কিন্তু পরের বারেই হাঙরটির ল্যাজের ঝাঁপটে সে উল্টে পড়ে গেলে নিচে। অমনি হাঙরটা তীব্রবেগে ঘুরে নিচে নেমে এলো-এই বুঝি তার ওই চোখা লোভী নিষ্ঠুর পঁতের ফঁাকে লোকটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়!
এক লাফে সামনে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন নেমো। হঠাৎ নতুন শত্রু দেখে তার দিকে তেড়ে এলো হাঙরটা। উদ্যত ছোরা হাতে তিনি তার জন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। যেই রাক্ষুসে মাছটা কাছে এগিয়ে এলো, অমনি চট করে এক পাশে সরে গিয়ে ছোরাটা তিনি আমূল তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
কে যেন লাল রঙ ছিটিয়ে দিলে জলে। হাঙরটার একটা পাখনা আঁকড়ে তখনো বারেবারে ছোরা চালাচ্ছেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁকেও এক ঝাঁপটায় ছিটকে পড়তে হলো-হাঙরটা হা করে তার দিকে নেমে গেলো তৎক্ষণাৎ।
এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেলো।
কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে একটা হারপুন এসে বিঁধলো সেই সিন্ধুনেকড়ের হৃৎপিণ্ডে-ক্যাপ্টেন চট করে একপাশে সরে গেলেন।
নেড-নেড ল্যাণ্ডই তার হারপুন ছুঁড়ে ক্যাপ্টেন নেমোকে বাচিয়ে দিলে।
তৎক্ষণাৎ ক্যাপ্টেন নেমে সেই সিংহলী ডুবুরিকে নিয়ে জলের উপর ভেসে উঠলেন। ডিঙির উপরে উঠে অল্প চেষ্টাতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে এতগুলো অদ্ভুত পোশাকপরা লোককে তার উপরে ঝুকে থাকতে দেখে লোকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। ক্যাপ্টেন নেমো তাকে একখানি মুক্তো উপহার দিলেন।
নটিলাস-এ ফিরে এসে নাবিকদের সাহায্যে এই বিষম পোশাক খুলে ফেলে ক্যাপ্টেন নেমো প্রথম কথাটিই বললেন নেভ-এর উদ্দেশে : ধন্যবাদ, নেড ল্যাণ্ড। তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
শোধবোধ হলল, ক্যাপ্টেন, নেড ল্যাণ্ড বললে, প্রথম ধন্যবাদটা আমারই জানানো উচিত ছিলো।
ক্যাপ্টেনের মুখে সূক্ষ্ম একটু হাসির রেখা খেলে গেলো।
পৃথিবী থেকে, মানবজাতির কাছ থেকে, নিজেকে যিনি অমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে এনেছেন, নিজের জীবন বিপন্ন করেও তারই একজন প্রতিনিধিকে তিনি যে কেন বাঁচাতে গেলেন, তার কোনো উত্তর পাওয়া সত্যি কঠিন। ক্যাপ্টেন নেমো যা-ই বলুন না কেন, তিনি নিজের হৃদয়কে এখনো সম্পূর্ণ হত্যা করতে পারেননি। বাইরে থেকে তাঁকে পাষাণ মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তিনি ঠিক তার উল্টো, এই কথাটি তাঁকে বলতেই ঈষৎ আবেগভরে তিনি বললেন, প্রফেসর, ওই ভারতীয়টি অতি শোষিত ও অত্যাচারিত দেশের অধিবাসী। আর আমিও, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত, তা-ই থাকব।
এ-কথাব অর্থ কি এই যে তিনি একটি পরাধীন জাতির প্রতিনিধি? আর সেই জন্যেই ওই সিংহলীটির প্রতি তার এত দরদ? না কি আক্ষরিকভাবেই তিনি ভারত নামক উপমহাদেশের অধিবাসী? রহস্যটা মোটেই পরিষ্কার হলো না বটে, কিন্তু এটা বোঝা গেলো এই বিদ্রোহী মানুষটি যে-কোনো পরাধীন জাতির জন্য আত্মবিসর্জন করতে পারে।