সাবধানে বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে জোনস আর হিলারি। আগের দিন যে সিঁড়িটা দিয়ে উঠেছিল রবিন, সেটা দেখে ফেলল জোনস। ওঠা অনেক সহজ হয়ে গেল তার জন্যে।
হিলারির কাছে বোধহয় অতটা সহজ লাগছে না। ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
উঠে আসছে দুজনে। জানে না, ওদের মাথার ওপরেই লুকিয়ে রয়েছে যাদেরকে খুজছে।
কিশোর, এবার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
এখনও হাত-পা কাঁপছে কিশোরের। তবে মগজটা ঠিকমতই কাজ করছে। বেরিয়ে থাকা একটা গাছের শেকড় ধরে টান দিল। কিছু হল না। আরও জোরে টানল। উঠে এল শেকড়, সাথে করে নিয়ে এল ধুলো, মাটি, পাথর।
ওপর দিকে তাকাল জোনস আর হিলারি। কয়েকটা পাথর গড়িয়ে গেল ওদের দিকে। সাথে করে নিয়ে নামতে লাগল আলগা পাথর আর মাটি। বাড়ি লেগে বড় পাথরও নড়ে উঠল। আরেকবার বাড়ি লাগতেই খসে গিয়ে ধসের সৃষ্টি করল।
তাড়াতাড়ি দুপাশে সরে গেল দুজন লোক।
ধসটা নেমে গেল ওদের মাঝখান দিয়ে।
বস… শুরু করতে যাচ্ছিল হিলারি, ওর গলা কাঁপছে। নিশ্চয় হাতও কাঁপছে।
হয়েছে, আর উঠতে হবে না, জোনস বলল। এখানে ওঠেনি ওরা। ওঠার উপায় নেই। যে হারে ধস নামে! নিশ্চয় বনের মধ্যে লুকিয়েছে। আজ রাতটা নদীর কিনারে কাটাব আমরা। কাল সকালে আবার খুঁজতে বেরোব।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছেড়ে বুক খালি করল রবিন। তারপর বলল, বাঁচালে, কিশোর!
নেমে যাচ্ছে জোনস আর হিলারি।
ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। তারপর উঠে এগিয়ে চলল শৈলশিরা ধরে। যতই এগোচ্ছে, চওড়া হচ্ছে শিরাটা। ওপর থেকে এখন উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে, ঘন সবুজ।
সূর্য ডুবছে। লম্বা লম্বা ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে উপত্যকার ওপর। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদীটা, বেশ চওড়া হয়ে। দুধারে গজিয়ে উঠেছে লম্বা ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়। এখানে ওখানে বাষ্প উড়ছে, নিশ্চয় গরম পানির অনেক ঝর্না রয়েছে ওখানে। উপত্যকার আরেকটা প্রান্ত এত দূরে, চোখেই পড়ে না।
রবিনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, তোমার চোখ তো লাল। আমার কি অবস্থা?
কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। একেবারে গায়ের লোকের মত। কি যেন মনে পড়তে বলল, এই শোনা শোনো, জনের চোখ কিন্তু লাল ছিল না। যেদিন আমরা তাকে দেখেছি সেদিন গাঁয়ের বাইরে থেকে এসেছিল। মনে হচ্ছে গন্ধই ওদের ক্ষতিটা করে। ওরা রয়েছে ভাটিতে, নদীর কিনারে। বাতাস গন্ধকের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় সোজা ওদের দিকে।
তা নেয়, কিশোর বলল। তবে যে হারে অসুস্থ, মনে হয় শুধু গন্ধকের গন্ধে নয়। আরও কোন কারণ আছে। তার হাত-পায়ের কাপুনি এখনও রয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামার কথা ভাবতেই মুখ কালো হয়ে গেল। ইস, রাতটা এখানেই থেকে যেতে পারলে ভাল হত! কিন্তু উপায় নেই। আবার নামতে আরম্ভ করল। রবিনের পিছু পিছু। ওঠাটা যত কঠিন, নামা ততটা নয়, তাই কোন রকম বিপদ না ঘটিয়ে নিরাপদেই পা রাখতে পারল নিজের ঘাসে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বস্তির।
নেমেই চারপাশে চোখ বোলাল সে। কাছাকাছি যে কটা ফার্ন জাতীয় গাছ দেখল, সবগুলোর পাতা, ডাল, ফুল বাদামি হয়ে গেছে। নদীর পানির রঙ ধূসর, তীরের কাছে পানিতে পাতলা সরের মত জমে রয়েছে।
দেখো, রবিনকে বলল সে।
দেখল রবিন। কি মনে হচ্ছে?
অস্বাভাবিক লাগে, তাই না?
পানির দুষণ?
হতে পারে। আমার চোখ জ্বালা করছে। চলো এখান থেকে চলে যাই।
উঁচু পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিয়েছে সূর্য। সোনালি রশ্মি আর ঢুকতে পারছে না, এখানে। ঠাণ্ডা, কালো কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে নদীর ধার ধরে এগোল দুজনে। পানির ধারে ঘন হয়ে জন্মে থাকা ঘাস, লতাপাতা, ঝোপ সব বাদামী হয়ে গেছে, পানির একেবারে লাগোয়াগুলো মরেই গেছে প্রায়।
ঢালের ওপরেই রয়েছে ওরা, তবে এত কম ঢালু, অন্য প্রান্তের দিকে না, তাকালে বোঝাই যায় না। ওপাশটা এখান থেকে উঁচুতে। পাহাড়ের পাথুরে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে অগণিত ধসের ঘষায়।
এখন তো মনে হচ্ছে, আমাদের প্লেন অ্যাক্সিডেন্টটাও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, ঘটানো হয়েছে। পকেট থেকে একটা ক্যাণ্ডি বের করে খেতে লাগল সে।
তা কি করে হয়? পানি খাওয়ার জন্যে বোতলের মুখ খুলল রবিন।
তা-ই হয়েছে। প্রথমে ইলেকট্রিক সিসটেম নষ্ট হয়ে গেল, ক্যাণ্ডি চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর। নামতে বাধ্য হলাম আমরা। তোমার বাবাকে কিডন্যাপ করার জন্যে তৈরি হয়ে ছিল ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস।
তাই তো! চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন। তার মানে স্যাবোটাজ করা হয়েছে প্লেনটাকে?
হ্যাঁ। জোনস কিংবা তার কোন সহকারী করেছে কাজটা।
নীরবে খেল কিছুক্ষণ দুজনে। তারপর রবিন জিজ্ঞেস করল, এখন কি করা? বাবাকে বের করতেই হবে।
আপাতত হাঁটতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস, উপত্যকাটা উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো। তার মানে কাঠ পারাপারের রাস্তাটা রয়েছে সামনে। গেলে হয়তো মুসার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের। কিংবা ফরেস্ট সার্ভিসের সঙ্গে।
তা ঠিক। এদিক দিয়ে গেলে অবশ্য আরেকটা সুবিধে, জোনস আমাদের পিছু নিতে পারবে না। দেয়াল ডিঙানোর সাহস নেই ওর।
আরেকটা কাজ হতে পারে, যোগ করল কিশোর, হয়তো জানতে পারব কি কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে ইনডিয়ানরা।
খাওয়া শেষ করে ক্যাণ্ডির মোড়কগুলো পকেটে রেখে দিল ওরা। বুনো এলাকার প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় না, যেমন আছে তেমনি থাক।
অন্ধকার হয়ে আছে উপত্যকা। ওপরে তারা ঝিলমিল করছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কিনারে উঁকি দিল বিশাল চাঁদ।
পরিশ্রমে ভেঙে পড়ছে শরীর, কিন্তু বিশ্রামের উপায় নেই। চাঁদের আলোয়। পথ দেখে দেখে এগিয়ে চলল ওরা। নদীর ধার ধরে। সামনে বড় পাথর কিংবা ঝোপঝাড় পড়লে সেগুলো ঘুরে এসে আবার আগের রাস্তা ধরছে। আধ মাইল মত চলার পর একটা জলাভূমি পড়ল, সরে আসতে বাধ্য হলো ওরা, একদিকের দেয়ালের কাছে। জলাভূমি শেষ হয়ে গেছে কিছুটা এগিয়ে, আবার নদীর দিকে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন রবিন। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল স্থির হয়ে। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।
কি হয়েছে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন। ফুট বিশেক দূরে মাটিতে পড়ে জ্বলছে সাদা সাদা কি যেন।
কিশোরের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।
আমি যা ভাবছি তা-ই ভাবছ? তোতলাতে শুরু করল রবিন।
কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে এগোল ওরা। যতই কাছে এগোল আরও ভাল করে দেখতে পেল, সাদা জিনিস অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঘাস আর ঝোপের ভেতর থেকে ফুটে বোরোচ্ছে ফেকাসে আলো। বাতাস বয়ে গেলে ঘাসে ঢেউ জাগে, তাতে মনে হয় ভেতরের সাদা রঙটাই বোধহয় কাঁপছে।
আরেকটু এগিয়ে থামল দুজনে। থরথর করে কাঁপছে রবিন। কিশোরেরও কাঁপুনি শুরু হয়েছে, তবে সেটা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছে সে।
ওদের প্রায় পায়ের কাছেই পরে রয়েছে একচিলতে সাদা রঙ, দূর থেকে এটাকেই দেখেছিল।
দে-দেখ, কত লম্বা! কোনমতে বলল রবিন।
একটা টিবিয়া, হাড়টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বয়স্ক লোকের। ইনডিয়ানদের সমাধিতে চলে এসেছি আমরা।
দেখার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার! বিকৃত হয়ে গেছে রবিনের কণ্ঠ। ধসটস নেমে বোধহয় মাটির নিচ থেকে বের করে দিয়েছে হাড়গুলোকে। কতগুলো আছে, আন্দাজ করতে পারো? পাথর আর মাটির একটা বড় স্কুপের কাছে জড় হয়ে আছে হাড়গুলো, ধসটা নেমেছিল পাশের পাহাড় থেকে।
ওই আরেকটা ঢিবিয়া, কিশোর বলল। ওই যে ওটা ফিমার, ওগুলো পাজরের হাড়, ওটা মেরুদণ্ড ভাঙা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে হাড়গুলো। পুরো একটা কঙ্কালই বোধহয় রয়েছে এখানে।
ওই যে খুলিটা! গায়ে কাটা দিল রবিনের।
খুলির চোখের জায়গায় কালো কালো বড় দুটো গর্ত। ছোট কালো একটা তিনকোনা গর্ত, নাক ছিল যেখানটায়। হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, দুই সারি দাঁত নীরব বিকট হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।
দাঁড়াও তো দেখি! এগিয়ে গিয়ে ঝকঝকে একটা জিনিস তুলে নিল কিশোর। কোমরের বেল্টের রূপার একটা বাকস, মাঝখানে ইয়া বড় এক নীলকান্তমণি বসানো।
দেখেটেখে রবিন বলল, একেবারে জনেরটার মত দেখতে।
কঙ্কালটা তার হারিয়ে যাওয়া চাচারও হতে পারে, বাকলসটা পকেটে রেখে দিল কিশোর।
কিন্তু চাচা তো নিখোঁজ হয়েছে একমাস আগে। এত তাড়াতাড়ি হাড়ের এই দশা…
জানোয়ারে খেয়ে সাফ করে দিয়ে যেতে পারে।
খুলিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভয়টা চলে গেছে। তার জায়গায়। ঠাই নিয়েছে বিষণ্ণতা। অসুস্থ বোধ করছে সে। এটা দেখো। গোল একটা ছিদ্র দেখাল সে।
বুলেটের ছিদ্র?,
হ্যাঁ। খুন করা হয়েছে লোকটাকে।
.
এগিয়ে চলেছে মুসা। ক্লান্ত হয়ে আসছে ক্রমেই। শেষে আর পারল না। খোলা রাস্তা থেকে সরে চলে এল বনের ভেতরে। স্পেস ব্লাংকেটটা বের করে গায়ে। জড়িয়ে শুয়ে পড়ল একটা পাইনের গোড়ায়। একটু পরেই কানে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দ। এগিয়ে চলেছে ভুল দিকে, যেদিক থেকে সে এসেছে, পর্বতের দিকে। ওদিকে কেন? ডায়মণ্ড লেক তো ওদিকে নয়?
উঠে বসল সে। পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেল ট্রাক। হেডলাইট নিভানো। আবার শুয়ে পড়ল সে, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। সেই অবস্থায়ই ভাবল, হেডলাইট জ্বালেনি কেন? শুধু পার্কিং লাইট জ্বেলে চলেছে?
মনে হলো সবে চোখ মুদেছে, এই সময় আবার শুনতে পেয়েছে ট্রাকের শব্দ। হাতের ডিজিটাল ঘড়ি দেখল। মধ্যরাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়েছে ভালমতই।
উঠে দাঁড়াল সে। এইবার ট্রাকগুলো ঠিক দিকেই চলেছে, হাইওয়ের দিকে। চলে যায় মিস্টার মিলফোর্ড, রবিন আর কিশোরের সাহায্য…ভাবতে ভাবতে দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল সে। স্পেস ব্লাংকেটটা নেড়ে চিৎকার করতে লাগল, থামো! থামো!
সামনের ট্রাকটার গতি কমে গেল। ফলে পেছনেরগুলোও কমাতে বাধ্য হলো।
উত্তেজিত হয়ে ট্রাকের কাছে ছুটে এল মুসা।
আগের ট্রাকটা থেমে গেছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা।
রানিং বোর্ডে লাফিয়ে উঠল সে।
ভেতরে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল। সোজা তার কপালের দিকে তাক করে রয়েছে এম-১৬ রাইফেলের নল। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ নেমে গেল। তার। মনে পড়ল কিশোরের কথা জানোয়ার নয়, মানুষ শিকারের কাজে ব্যবহর হয় এম-১৬।
ঢোকো! নেকড়ের মত গরগর স্বর বেরোল ডকের গলা থেকে, শয়তানী হাসি ফুটেছে ঠোঁটে। তোমার বন্ধুরা কোথায়?
.
আর পারা যায় না, এবার বিশ্রাম নিতেই হবে, ঠিক করল রবিন আর কিশোর। কুঙ্কালটা যেখানে পেয়েছে তার কাছ থেকে দূরে উজানে এসে স্পেস ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল। আগুন জ্বালতে সাহস করল না জোনসের লোকদের ভয়ে।
ভোরের আগেই উঠে পড়ল আবার। খিদেয় মোচড় দিচ্ছে পেট, কিন্তু সাথে রয়েছে কেবল পপকর্ন, সেদ্ধ করারও ব্যবস্থা নেই। অনেক ধরনের গাছ জন্মে রয়েছে, ফুলফল সবই আছে, তবু খেতে সাহস করল না। বুনো অঞ্চলের মানুষের জন্যে সেই পুরানো প্রবাদ; যেটা তুমি চেনো না, সেটা খেয়ো না। খেয়ে মরার। চেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। কাজেই খিদেটা সহ্য করতে লাগল ওরা।
আবার এগিয়ে চলা। নদীটা বাঁয়ে রেখে হাঁটছে দুজনে। পথ নেই, ঘাস আর রুক্ষ পাথরের ছড়াছড়ি, ফলে গতি হয়ে যাচ্ছে ধীর। গন্ধকে বোঝাই গরম পানির ঝর্না পেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক, পার হওয়ার সময় দম বন্ধ করে রাখে, দৌড়ে পার হয়ে যায় যত দ্রুত সম্ভব। নদীর পানিতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে ধূসর রঙের সর, কোথাও কোথাও ভাসমান তেল।
একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল ওরা।
থামল। অনেক কষ্টে অবশেষে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, মনে হলো। সামনে ছড়িয়ে রয়েছে উপত্যকার অন্য প্রান্ত, সবুজ ঝলমল করছে দুপুরের রোদে। উপত্যকাটা অনেক চওড়া। ধীরে ধীরে উঠে গেছে ওপর দিকে। গাছপালায় ছাওয়া। ওখান থেকেই নেমে আসছে সরু নদী।
ওই যে, রাস্তা! টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল রবিন।
পাহাড়ের যেখান থেকে জলধারাটা বেরিয়েছে, সেই একই ফাঁক দিয়ে পাশাপাশি বেরিয়েছে সরু পথটা। কয়েক শো গজ এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। সমতল একটা জায়গায়।
কাঠ বয়ে নেয়ার রাস্তা বলে তো মনে হচ্ছে না, রবিন বলল, মালটি যেটার কথা বলেছিল।
না।
সরু নদীটার কাছে চলে এল ওরা। ভয়াবহ দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পানিতে দেখা গেল কালো আলকাতরার মত জিনিস। আটকে রয়েছে নদীর কিনারে এসে ছোট ছোট খাড়িতে। খাড়ির কিনারের উদ্ভিদ হয় মরে গেছে, কিংবা মরছে।
নোংরা পানির দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। ঝর্নার পানি যে রকম টলটলে থাকার কথা সে রকম নয়, বরং পুকুরের বদ্ধ পানির মত ময়লা। তেল ভাসছে। রোদ লেগে চিকচিক করছে রামধনুর সাত রঙ সৃষ্টি করে।
বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওরা। বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে ফুসফুস। ওই বাতাসে শ্বাস নেয়া যায় না। তাড়াতাড়ি সরে চলে এল সেখান থেকে।
তেল অথবা অ্যাসফল্ট, রবিন বলল। কিংবা হয়তো দুটোই আছে।
অন্য কিছু। দুর্গন্ধটা বেশি খারাপ, কিশোর বলল। জঘন্য।
তোমার একটা পরীক্ষার কথা মনে পড়ছে, কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে করেছিলে। সেটা থেকেও এরকমই গন্ধ বেরোচ্ছিল।
জটিল একটা থার্মো-রিঅ্যাকটিভ এক্সপেরিমেন্ট ছিল সেটা, কিশোর বলল। হাসি ফুটল পরক্ষণেই। মনে পড়ে, স্যার কি রকম কুঁকড়ে গিয়েছিলেন, ফেটে গিয়ে জিনিসটা যখন ছড়িয়ে গিয়েছিল?
হাসতে লাগল দুজনেই। চলে এল সরু পথের শেষ মাথায় চ্যাপ্টা গোলাকার জায়গাটাতে। চাকার অসংখ্য দাগ দেখা গেল।
ট্রাক! নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা সিগারেটের গোড়া কুড়িয়ে নিল রবিন, কিশোর যে দুটো পেয়েছিল সেরকম।
গম্ভীর হয়ে মাথা ঝকাল কিশোর। হ্যাঁ, চালানের কথা বলেছিল না জোনস?
নদী, ঝোপ, গাছপালা আর শৈলশিরার দিকে তাকাতে লাগল ওরা। গোলাকার সমতল জায়গাটা থেকে আরেক দিকে আরেকটা পথ বেরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে উত্তর-পশ্চিমের বার্চ আর পাইন গাছে ভরা একটা বনের ভেতর।
দেখো, হাত তুলে দেখাল কিশোর।
গোলাকার জায়গাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শৈলশিরার নিচে পাহাড়ের গায়ে কতগুলো গুহা। ওগুলোর কাছে এগিয়ে গেছে চাকার দাগ। সেদিকে রওনা হলো দুজনে।
বাবা! চিৎকার করে ডাকল রবিন। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছে।
গুহার সারির কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। ভেতর থেকে আসছে দুর্গন্ধ। চোখে জ্বালা ধরাল। ঝাজ লাগল গলায়। কাশতে শুরু করল ওরা, সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাঁচি। শেষে আর টিকতে না পেরে ফিরে আসতে লাগল আগের জায়গায়।
পথের ধারে আরেকটা গুহামুখ দেখে ওটার সামনে দাঁড়াল।
কিশোর বলল, এটার গন্ধ এত খারাপ না।
ভেতরে উঁকি দিল রবিন। জানাল, চারকোনা গুহা।
ঢুকে পড়ল দুজনে। ভেতরে আলো খুবই কম, চোখে সয়ে আসার সময় দিল। ওরা। দেখতে পেল অবশেষে। দেখে হা হয়ে গেল। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত একটার ওপর আকেরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে শত শত ৫৫-গ্যালনের ড্রাম।
লেবেলে পড়ল কিশোর, পিসিবি এস।
রবিন পড়ল আরেকটার, অ্যাসিড।
পড়তে থাকল কিশোর, অ্যালকালাইন, অক্সিডাইজারস, সালফার স্লাজ।
আতঙ্ক ফুটেছে দুজনের চোখে। রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ! মারাত্মক বিষাক্ত!
সহসা ছায়া ঘন হল গুহার ভেতরে, সূর্যের মুখ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। যেন। ঝট করে ফিরে তাকাল ওরা। গুহামুখে এসে দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ, আলো আসা ঢেকে দিয়েছে। আটকা পড়ল ওরা!