১৩. সমুদ্রের নীল পানিতে

সমুদ্রের নীল পানিতে ছোট একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। চারপাশে অথই জলরাশি তার কোনো শুরু নেই কোনো শেষ নেই। নৌকার হাল ধরে নিহন মৃদু স্বরে গান গায়, বিরহিণী একটা মেয়ের গান। মেয়েটি ঘরের দরজায় মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রিয়তম নৌকা নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছে কখন ফিরে আসবে সে জানে না। আকাশ কালো করে মেঘ আসছে, সমুদ্রের নীল জল ধূসর হয়ে ফুঁসে উঠছে, কিন্তু দিগন্তে এখনো তো নৌকার মাস্তুল ভেসে উঠছে না। মেয়েটির বুকে অশুভ আশঙ্কার ছায়া, দরজায় মাথা রেখে ভাবছে তার প্রিয়তম ফিরে আসতে পারবে কি? নিহন কোথায় শিখেছে এই গানের কলি? শিখেছে কি কখনো?

অন্ধকার নেমে এলে আকাশের নক্ষত্রেরা পরম নির্ভরতায় তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চেনা নক্ষত্রগুলো পুব আকাশে উঠে সারা রাত তাকে চোখে চোখ রেখে সূর্য ওঠার আগে অদৃশ্য হয়ে যায়। তোরবেলা সূর্যের নরম আলো ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় নিহনের দিকে।

নিহন নৌকার হাল ধরে বসে থাকে। আন্তঃমহাসাগরীয় স্রোত তাকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কত দিন সে ভাসবে এভাবে?

 দরজায় শব্দ শুনে কায়ীরা চোখ মেলে তাকাল। এত রাতে কে এসেছে?

কায়ীরা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা চাঁদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে এল। অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, কায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কে?

আমি। আমি নিহন।

নিহন! কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না। কাছে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। যেন ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে। জ্যোৎস্নার মান আলোতে নিহনকে দেখার চেষ্টা করল, বলল, তুমি কখন এসেছ, নিহন।

এই তো। এখন।

তুমি কেমন ছিলে, নিহন? তোমাকে নিয়ে আমরা এত ভাবনায় ছিলাম! তোমাকে আমরা কখনো ফিরে পাব সেটা ভাবি নি, নিহন।

চাঁদের স্নান আলোতে নিহন মৃদু হাসল, বলল, আমিও ভাবি নি আমি কখনো ফিরে আসব।

তুমি কেমন করে ফিরে এসেছ?

ছোট একটা নৌকায়। আন্তঃমহাসাগরীয় স্রোতে ভেসে ভেসে।

নৌকা কেমন করে পেলে?

আমাকে একজন দিয়েছে। একটি মেয়ে।

সত্যি?

হ্যাঁ, কায়ীরা, সত্যি। সে আমাকে বলেছে আমার মতন সেও জলমানব হয়ে যেতে চায়।

কায়ীরা কোনো কথা বলল না, একটু অবাক হয়ে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন ফিসফিস করে বলল, তোমার মনে আছে, কায়ীরা, অনেক দিন আগে তুমি আমাকে বলেছিলে আমরা, জলমানবেরা আমাদের নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে টিকে আছি? সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানটুকু কী আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে বল নি।

হ্যাঁ, মনে আছে।

তুমি আমাকে বলেছিলে আমার নিজের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

হ্যাঁ বলেছিলাম।

আমি সেটা কী খুঁজে বের করেছি।

বের করেছ? সেটা কী?

জীবনের কাছাকাছি জ্ঞান হচ্ছে সত্যিকারের জ্ঞান। যদি সেটা না থাকে তা হলে যত চমকপ্রদ জ্ঞানই হাতে তুলে দেওয়া হোক সেটা ধরে রাখা যায় না।

কায়ীরা একটু হাসল, বলল, তুমি এইটুকুন ছেলে কত বড় মানুষের মতো কথা বলছ।

আমি এটা আমার জীবন থেকে শিখেছি, কায়ীরা। আমার জীবনটা ছোট হতে পারে, কিন্তু এর মাঝে অনেক কিছু ঘটেছে।

 আমি জানি।

আমরা যে ডলফিনের সাথে কথা বলি, এই জ্ঞানটুকু স্থলমানবদের মহাকাশযান তৈরি করার জ্ঞান থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কায়ীরা মাথা নাড়ল। নিহন বলল, সামুদ্রিক শ্যাওলা দিয়ে কীভাবে কাপড় বানাতে হয় সে জ্ঞান কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক শঙ্খ দিয়ে কীভাবে মস্তিষ্ক প্রদাহের ওষুধ তৈরি করতে হয় সেই জ্ঞান তাদের নিউক্লিয়ার শক্তির জ্ঞান থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেভাবে-

কায়ীরা নিহনের কাধ স্পর্শ করে বলল, নিহন, আমি বুঝতে পারছি, আমি বুঝতে পারছি তুমি কী বলতে চাইছ।

কায়ীরা নিহনকে আবার গভীর মমতায় আলিঙ্গন করে ফিসফিস করে বলল, নিহন, তুমি এখন তোমার মায়ের কাছে যাও। কত দিন থেকে তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

হ্যাঁ, যাই।

কায়ীরা নিহনকে ছেড়ে দিল, নিহন জ্যোৎস্নার আবছা আলোতে হেঁটে হেঁটে তার মায়ের কাছে যেতে থাকে।

নিহনকে স্থলমানবেরা ধরে নিয়েছিল গ্রীষ্মের শুরুতে। এখন গ্রীষ্মের শেষ। আকাশে শরতের মেঘ উঁকি দিতে রু করেছে। বাতাসে হঠাৎ হঠাৎ হিমেল বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। নিহন আবার তার আগের জীবনে ফিরে গেছে, প্রিয় ডলফিন শুশুকে নিয়ে সমুদ্রের পানিতে ছুটে বেড়ায়, সমুদ্রের গভীরে গিয়ে সেখানকার বিচিত্র জীবনে গভীর কৌতূহল নিয়ে দেখে। নীল তিমিকে পোষ মানানোর একটা পরিকল্পনা অনেক দিন থেকে সবার মাথায় কাজ করছিল, সবাই মিলে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। ডলফিনের বেলায় কাজটা সহজ ছিল, নীল তিমির বেলায় এত সহজ নয়।

নিহনের ভেতরে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে লেখাপড়ার ব্যাপারে। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে লেখাপড়া করে। নিজে যেটুকু জানে ছোটদের সেটা সে শেখায় অনেক আগ্রহ নিয়ে। সে বুঝে গেছে তাদের বেঁচে থাকার এই একটিই উপায়। যেটুকু জ্ঞান আছে সেটা ধরে রাখতে হবে, আর নূতন জ্ঞানের জন্ম দিতে হবে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো সম্পদের দরকার নেই, দরকার হচ্ছে জ্ঞান। পৃথিবীর সকল সম্পদও হোট একটু জ্ঞানের পাশে দাঁড়াতে পারে না।

.

মাঝখানে কয়দিন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, হঠাৎ করে মেঘ কেটে আকাশে সূর্য উঠেছে। নিহন ছোট ছোট কিছু ছেলেমেয়েকে নিয়ে সমুদ্রের পানিতে খেলছে, পোষা ডলফিনে উঠে সমুদ্রের নিচে চলে যাওয়ার খেলা। খেলা যখন খুব জমে উঠেছে, তখন হঠাৎ করে তার পোষা ডলফিন শুশু তার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। নিহন আদর করে শুওকে জড়িয়ে ধরে বলল, কী খবর, শুশু?

শুশু তার ভাষায় উত্তর দিল, নৌকা।

কার নৌকা?

জানি না। অনেক অনেক দূর।

নিহনের ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে, কোথা থেকে নৌকা আসছে? কেন আসছে?

কতগুলো নৌকা?

একটা।

কত বড় নৌকা?

ছোট।

নিহন ছেলেমেয়েগুলোকে নাইনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শুশুর পিঠে চেপে বসে। পেটে থাবা দিয়ে বলে, চল যাই।

শুশু মাথা নেড়ে বলল, ভয়।

কোনো ভয় নেই। শুধু দূর থেকে দেখব। চল।

শুশু নিহনকে পিঠে নিয়ে সমুদ্রের পানি কেটে ছুটে যেতে থাকে।

নৌকাটার কাছে যখন পৌঁছেছে, তখন বেলা পড়ে এসেছে। অনেক দূর দিয়ে নিন নৌকাটাকে ঘুরে দেখল। সাদাসিধে একটা নৌকা, অনেক দূর থেকে ভেসে এসেছে বলে রঙ উঠে বিবর্ণ। এটা তাদের কারো নৌকা নয়, দেখে মনে হয় স্থলমানবদের এলাকা থেকে এসেছে। ভেতরে কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। নিহন সাবধানে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করে। মনে হয় নৌকার ঠিক মাঝখানে গুটিসুটি মেরে কেউ একজন শুয়ে আছে।

নিহন এবার শুশুকে ছেড়ে নৌকার কাছে এগিয়ে যায়। সাবধানে নৌকাটাকে ধরে তার ওপর উঠে বসে। ঠিক মাঝখানে একজন সারা শরীর গুটিয়ে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। দুই হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকু রক্তহীন, ফ্যাকাসে শীর্ণ এবং বিবর্ণ। মানুষটি বেঁচে আছে কি না বোঝার উপায় নেই। নিহন সাবধানে তাকে স্পর্শ করতেই মানুষটি ঘুরে তাকাল। নিহন চমকে উঠে অবাক হয়ে বলল, কাটুস্কা!

কাটুস্কা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিহনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, নিহন, তুমি আমাকে বল, এটা স্বপ্ন নয়, এটা সত্যি।

এটা সত্যি কাটুস্কা। এটা স্বপ্ন নয়।

আমি চোখ বন্ধ করলে তুমি হারিয়ে যাবে না?

না কাটুস্কা। তুমি চোখ বন্ধ করলে আমি হারিয়ে যাব না।

কাটুস্কা তার হাতটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নিহন।

বল, কাটুস্কা।

তুমি আমাকে একবার ধর। আমি কত দিন এই নৌকায় একা একা শুয়ে আছি। শুধু তোমাকে একবার দেখার জন্য আমি কত দূর থেকে এসেছি!

নিহন এগিয়ে গিয়ে কাটুস্কার হাতটি স্পর্শ করল, শীর্ণ দুর্বল হাত। এই মেয়েটি না জানি কত দিন থেকে এই ছোট নৌকাটিতে ভেসে বেড়াচ্ছে!

কাটুস্কা ফিসফিস করে বলল, নিহন, আমি শুধু একটিবার তোমার মতো জলমানব হতে চাই। শুধু একটিবার একটা ডলফিনের পিঠে বসে সমুদ্রের পানিতে ছুটে যেতে চাই। শুধু একটিবার–

নিহন গভীর ভালবাসায় কাটুস্কাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল, কাটুস্কা! একটিবার নয়, তুমি অনন্তকাল আমাদের সাথে জলমানব হয়ে থাকবে।

কাটুস্কার চোখ হঠাৎ সজল হয়ে ওঠে। সে ফিসফিস করে বলে, তুমি আর কোনো দিন আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, ছেড়ে যাব না। কোনো দিন তোমাকে ছেড়ে যাব না।

সমুদ্রের লোনা বাতাস, সূর্যের প্রখর আলোতে জ্বলে-পুড়ে যাওয়া অভুক্ত, শীর্ণ, বিবর্ণ, রুগণ এই মেয়েটির মুখে আশ্চর্য এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। নিহন অপলকে সেই অসহায় মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখির পালকের মতো তার হালকা শরীরটি নিহন শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রাখে। তার মনে হতে থাকে এই মেয়েটিকে ছেড়ে দিলেই বুঝি সে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে।

তাকে সে আর হারিয়ে যেতে দেবে না।