কাজেই এখন এদেশে প্রায় সকলেই পরিণামবাদী—Evolutionist. যেমন ছোট জানোয়ার বদলে বদলে বড় জানোয়ার হচ্ছে, বড় জানোয়ার কখনও কখনও ছোট হচ্ছে, লোপ পাচ্ছে; তেমনি মানুষ যে একটা সুসভ্য অবস্থায় দুম করে জন্ম পেলে, এ কথা আর কেউ বড় বিশ্বাস করছে না। বিশেষ এদের বাপ-দাদা কাল না পরশু বর্বর ছিল, তা থেকে অল্পদিনে এই কাণ্ড। কাজেই এরা বলছে যে, সমস্ত মানুষ ক্রমে ক্রমে অসভ্য অবস্থা থেকে উঠেছে এবং উঠছে। আদিম মানুষ কাঠ-পাথরের যন্ত্রতন্ত্র দিয়ে কাজ চালাত, চামড়া বা পাতা পরে দিন কাটাত, পাহাড়ের গুহায় বা পাখীর বাসার মত কুঁড়েঘরে গুজরান করত। এর নিদর্শন সর্বদেশের মাটির নীচে পাওয়া যাচ্ছে এবং কোন কোন স্থলে সে অবস্থার মানুষ স্বয়ং বর্তমান। ক্রমে মানুষ ধাতু ব্যবহার করতে শিখলে, সে নরম ধাতু—টিন আর তামা। তাকে মিশিয়ে যন্ত্রতন্ত্র অস্ত্রশস্ত্র করতে শিখলে। প্রাচীন গ্রীক, বাবিল, মিসরীরাও অনেকদিন পর্যন্ত লোহার ব্যবহার জানত না—যখন তারা অপেক্ষাকৃত সভ্য হয়েছিল, বই পত্র পর্যন্ত লিখত, সোনা রুপো ব্যবহার করত, তখন পর্যন্ত। আমেরিকা মহাদ্বীপের আদিম নিবাসীদের মধ্যে মেক্সিকো পেরু মায়া প্রভৃতি জাতি অপেক্ষাকৃত সুসভ্য ছিল, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির নির্মাণ করত, সোনা রুপোর খুব ব্যবহার ছিল (এমন কি ঐ সোনা-রুপোর লোভেই স্পানি লোকেরা তাদের ধ্বংস সাধন করলে)। কিন্তু সে সমস্ত কাজ চকমকি পাথরের অস্ত্রদ্বারা অনেক পরিশ্রমে করত, লোহার নাম-গন্ধও জানত না।
আদিম অবস্থায় মানুষ তীর ধনুক বা জালাদি উপায়ে জন্তু জানোয়ার মাছ মেরে খেত, ক্রমে চাষবাস শিখলে, পশুপালন করতে শিখলে। বনের জানোয়ারকে বশে এনে নিজের কাজ করতে লাগল। অথবা সময়মত আহারেরও জন্য জানোয়ার পালতে লাগল। গরু, ঘোড়া, শূকর, হাতী, উট, ভেড়া, ছাগল, মুরগী প্রভৃতি পশু-পক্ষী মানুষের গৃহপালিত হতে লাগল! এর মধ্যে কুকুর হচ্ছেন মানুষের আদিম বন্ধু।
আবার চাষবাস আরম্ভ হল। যে ফল-মূল শাক-সবজি ধান-চাল মানুষে খায়, তার বুনো অবস্থা আর এক রকম। এ মানুষের যত্নে বুনো ফল বুনো ঘাস নানাপ্রকার সুখাদ্য বৃহৎ ও উপাদেয় ফলে পরিণত হল। প্রকৃতিতে আপনি-আপনি দিনরাত অদলবদল তো হচ্ছেই। নানাজাতের বৃক্ষলতা পশুপক্ষী শরীর সংসর্গে দেশ-কাল-পরিবর্তনে নবীন নবীন জাতির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মানুষ-সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃতি ধীরে ধীরে তরুলতা, জীবজন্তু বদলাচ্ছিলেন, মানুষ জন্মে অবধি সে হুড়মুড় করে বদলে দিতে লাগল। সাঁ সাঁ করে এক দেশের গাছপালা জীবজন্তু অন্য দেশে মানুষ নিয়ে যেতে লাগল, তাদের পরস্পর মিশ্রণে নানাপ্রকার অভিনব জীবজন্তুর, গাছপালার জাত মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হতে লাগল।
আদিম অবস্থায় বিবাহ থাকে না, ক্রমে ক্রমে যৌনসম্বন্ধ উপস্থিত হল। প্রথম বৈবাহিক সম্বন্ধ সর্বসমাজে মায়ের উপর ছিল। বাপের বড় ঠিকানা থাকত না। মায়ের নামে ছেলেপুলের নাম হত। মেয়েদের হাতে সমস্ত ধন থাকত ছেলে মানুষ করবার জন্য। ক্রমে ধন-পত্র পুরুষের হাতে গেল, মেয়েরাও পুরুষের হাতে গেল। পুরুষ বললে, ‘যেমন এ ধনধান্য আমার’ আমি চাষবাস করে বা লুঠতরাজ করে উপার্জন করেছি, এতে যদি কেউ ভাগ বসায় তো আমি বিরোধ করব’, তেমনি বললে, ‘এ মেয়েগুলো আমার, এতে যদি কেউ হস্তার্পণ করে তো বিরোধ হবে।’ বর্তমান বিবাহের সূত্রপাত হল। মেয়েমানুষ—পুরুষের ঘটি বাটি গোলাম প্রভৃতি অধিকারের ন্যায় হল। প্রাচীন রীতি—একদলের পুরুষ অন্যদলে বে করত। সে বিবাহও জবরদস্তি—মেয়ে ছিনিয়ে এনে। ক্রমে সে কাড়াকাড়ি বদলে গেল, স্বেচ্ছায় বিবাহ চলল; কিন্তু সকল বিষয়ের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ আভাস থাকে। এখনও প্রায় সর্বদেশে বরকে একটা নকল আক্রমণ করে। বাঙলাদেশে, ইওরোপে চাল দিয়ে বরকে আঘাত করে, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে কনের আত্মীয় মেয়েরা বরযাত্রীদের গালিগালাজ করে, ইত্যাদি।