১৩শ অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ-কৌরবপক্ষীয় ক্ষেমধূৰ্ত্তিবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! তখন সেই প্রহৃষ্ট হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যে সঙ্কুল দেবাসুরসৈন্যসদৃশ কুরুপাণ্ডবপক্ষীয় সেনাগণ পরস্পর প্রহার করিতে লাগিল। উগ্রবিক্রম রথী, অশ্বারোহী, গজারোহী ও পদাতিগণ পরস্পরের প্রাণ ও পাপনাশার্থ পরস্পরের প্রতি আঘাত করিতে আরম্ভ করিল। প্রধান প্রধান যোধগণ অর্দ্ধচন্দ্র, ভল্ল, ক্ষুরপ্র, অসি, পট্টিশ ও পরশু দ্বারা পূর্ণচন্দ্র ও সূর্য্যের সদৃশ কান্তি এবং পদ্মতুল্য গন্ধযুক্ত নরমস্তক ছেদনপূর্ব্বক তদ্দ্বারা পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করিয়াছিলেন। মহাবাহু বীরগণের রক্তাঙ্গুলিযুক্ত আয়ুধ ও বাহুসমুদয় বিপক্ষ পক্ষের বীরগণের শরনিকরে ছিন্ন ও নিপাতিত হইয়া গরুড়বিধ্বস্ত পঞ্চাস্য [পঞ্চমুখ সাপ] ভুজঙ্গসমুদয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। পুণ্যক্ষয় হইলে স্বর্গবাসিগণ যেমন বিমান হইতে পতিত হইয়া থাকেন, তদ্রূপ বীরগণ শত্রুগণকর্ত্তৃক নিহত হইয়া হস্তী, রথ ও অশ্বসমুদয় হইতে ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। অনেকে গুরুতর গদা, পরিঘ ও মুষলসমুদয়ের আঘাতে বিপক্ষপক্ষীয় বীরগণকে চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। সেই ভয়ঙ্কর সঙ্কুলযুদ্ধে রথীগণ রথীগণকে, মত্তমাতঙ্গগণ মত্তমাতঙ্গদিগকে ও অশ্বারূঢ়গণ অশ্বারূঢ়দিগকে নিপীড়িত করিতে লাগিল। অনেকবার পদাতিগণ রথীদিগের, রথীগণ পদাতিদিগের এবং পদাতিগণ অশ্বারোহীদিগের শরে নিপতিত হইলেন। কখন বা নাগগণ রথী, অশ্বারোহী ও পদাতিগণকে, পদাতিগণ রথী, অশ্বারোহী ও গজারোহীদিগকে, অশ্বগণ রথ, পদাতি ও হস্তিগণকে এবং রথীগণ পদাতি ও মাতঙ্গগণকে বিনাশ করিতে লাগিল। পদাতি, অশ্বারোহী ও রথীগণ এইরূপে বিপক্ষপক্ষীয় পদাতি, অশ্বারোহী ও রথীগণের হস্ত, পাদ ও রথ বিবিধ অস্ত্রে ছিন্ন করিয়া ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল।
“হে মহারাজ! এইরূপে সেই সেনাগণ পরস্পরের শরে নিপীড়িত হইলে মহাবীর বৃকোদর দ্রাবিড়সৈন্যপরিবৃত ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, দৌপদীর তনয়গণ, প্রভদ্রকগণ, সাত্যকি ও চেকিতান এবং ব্যূহাবৃত পাণ্ড্য, চোল ও কেরলগণসমভিব্যাহারে আমাদের সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন বিশালবক্ষাঃ দীর্ঘর্ভুজ, উন্নত, পৃথুলোচন [স্থূলচক্ষু—বড় বড় চক্ষু], আপীড়[উষ্ণীষ—পাগড়ী]শোভিত, রক্তদন্ত, মত্তমাতঙ্গবিক্রম, বিচিত্রবসনান্বিত, গন্ধচূর্ণাবৃত, বদ্ধখড়্গ, পাশহস্ত, উভয়পক্ষীয় গজারোহী ও যুদ্ধপ্রিয়, চাপতূণীরধারী, দীর্ঘকেশ, পরাক্রান্ত পদাতি এবং ঘোররূপ পরাক্রান্ত ভীষণ অশ্বারোহিগণ মৃত্যুভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পর সংগ্রাম করিতে লাগিল। চেদি, পাঞ্চাল, কেকয়, করূষ, কোশল, কাঞ্চি ও মগধদেশীয় বীরগণ মহাবেগে সমরে ধাবমান হইলে তাহাদিগের রথী, নাগ ও প্রধান প্রধান পদাতিসকল বিবিধ বাদ্যোদ্যমে হৃষ্ট হইয়া হাস্যবদনে নৃত্য করিতে লাগিল। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন মহামাত্রগণে পরিবেষ্টিত ও গজারূঢ় হইয়া সৈন্যমধ্য হইতে কৌরবসৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। যথাবিধানে বিভূষিত তাঁহার উগ্রতর মাতঙ্গ উদিতভাস্কর উদয়াচলের অগ্রভাগের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। গজবরের অপূর্ব্বরত্নবিভূষিত লৌহনির্ম্মিত উৎকৃষ্ট বর্ম্ম শরকালীন নক্ষত্রমণ্ডিত নভোমণ্ডলের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন তোমরহস্তে সেই মাতঙ্গে অবস্থানপূর্ব্বক মধ্যাহ্নকালীন দিবাকরের ন্যায় তেজঃপ্রভাবে রিপুগণকে তাপিত করিতে লাগিলেন।
“ঐ সময় গজারূঢ় ক্ষেমধূৰ্ত্তি দূর হইতে গজবরকে অবলোকন করিয়া সন্তুষ্ট মনে তাঁহার অভিমুখে গমন করিলেন। অনন্তর সেই দ্রুমবান্ [বৃক্ষশ্রেণীযুক্ত] মহাপৰ্বতদ্বয়ের সদৃশ মহাকায় মাতঙ্গদ্বয়ের মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইল। কুঞ্জরদ্বয় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে গজারোহী বীরদ্বয়ও তীক্ষ্ণ সূৰ্য্যরশ্মিসদৃশ তোমরদ্বারা পরস্পরকে আহত করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং তৎপরে উভয়ে হস্তী হইতে অবতীর্ণ হইয়া শাসন গ্রহণপূর্ব্বক মণ্ডলাকারে বিচরণপূর্ব্বক পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিলেন। সকলেই তাঁহাদিগের সিংহনাদ, আস্ফোটন [আস্ফালন] ও শরশব্দে আহ্লাদিত হইল। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় বায়ুবিকম্পিত পতাকাযুক্ত উদ্যতশুণ্ড মাতঙ্গদ্বয়দ্বারা যুদ্ধ করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে পরস্পর পরস্পরের শরাসনছেদনপূর্ব্বক বর্ষাকালীন বারিবর্ষী জলদদ্বয়ের ন্যায় শক্তি ও তোমর বর্ষণপূর্ব্বক গর্জন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর ক্ষেমধূৰ্ত্তি ভীমসেনের বক্ষঃস্থলে এক তোমরাঘাত করিয়া সিংহনাদপরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় অতিবেগে ছয়তোমরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলে ক্রোধপ্রদীপ্ত ভীমসেন সেই অঙ্গস্থিত সপ্ততোমরদ্বারা সপ্তাশ্বযুক্ত দিবাকরের ন্যায় শোভমান হইলেন এবং যত্নপূর্ব্বক অরাতির প্রতি এক ভাস্করবর্ণ লৌহময় তোমর নিক্ষেপ করিলেন। কুলূতাধিপতি ক্ষেমধূর্তি শরাসন আকর্ষণ করিয়া দশশরে সেই তোমর ছেদনপূর্ব্বক ছয়শরে ভীমকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন এক মেঘগভীরনিঃস্বন শরাসন গ্রহণ করিয়া সিংহনাদপূর্ব্বক শরনিকরনিপাতে অরাতির কুঞ্জরকে মর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। হস্তী ভীমসেনের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া বায়ুসঞ্চালিত জলধরের ন্যায় সমরাঙ্গনে অবস্থান করিতে অসমর্থ হইল। যন্তা [চালক-মাহুত] অশেষ প্রকার যত্ন করিয়া তাহাকে স্থির করিতে পারিল না। তখন পবনপরিচালিত পয়োধর [মেঘ] যেরূপ জলদের অনুগমন করে, তদ্রূপ ভীমসেনের মাতঙ্গ সেই কুঞ্জরের অনুগমন করিতে লাগিল। প্রবলপ্রতাপ ক্ষেমধূৰ্ত্তি তদ্দর্শনে স্বীয় বারণকে নিবারণপূর্ব্বক অভিমুখাগত ভীমমাতঙ্গকে বাণবিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন আনতপর্ব্বক্ষুরদ্বারা ক্ষেমধূৰ্ত্তির শরাসন ছেদন করিয়া মাতঙ্গের সহিত তাঁহাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ক্ষেমধূৰ্ত্তি তদ্দর্শনে রোষভরে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিয়া নারাচদ্বারা তাঁহার মাতঙ্গের সমুদয় মর্ম্মস্থল ভেদ করিলেন। গজরাজ ক্ষেমধূৰ্ত্তির ভীষণশরাঘাতে ভূতলে নিপতিত হইল। ভীমপরাক্রম ভীমসেন গজনিপতনের পূর্ব্বেই ভূতলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনিও ঐ সময় গদাঘাতে ক্ষেমধূৰ্ত্তির হস্তীকে প্রোথিত করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর ক্ষেমধূৰ্ত্তি সেই নিহত নাগ হইতে লক্ষ্য প্রদানপূর্ব্বক আয়ুধ উদ্যত করিয়া আগমন করিতে লাগিলেন। রণবিশারদ বৃকোদর তাঁহার উপরেও গদাঘাত করিলেন। খড়্গধারী মহাবীর ক্ষেমধূৰ্ত্তি ভীমসেনের সেই গদাঘাতেই গতাসু ও গজসমীপে নিপতিত হইয়া বজ্রভগ্ন অচলের সমীপস্থ বজ্রাহত সিংহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার সৈন্যসকল সেই কুনূত-কুলতিলক ক্ষেমধূৰ্ত্তিকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ব্যথিতহৃদয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল।”