১৩. সকালবেলা আরো তিনজন মানুষ

সকালবেলা আরো তিনজন মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিল, তাদের সবার চোখে-মুখে এক ধরনের দিশেহারা ভাব। তারা কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে এসেছে সেটি নিয়ে কারো মাঝে কোনো কৌতূহল নেই। সবাই এক ধরনের স্থির নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, আমিও মনে হয় একইভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনজন খুবই ব্যাকুলভাবে সবার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করল, কেউ তাদের কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করল না–কারণটি সহজ, উত্তর দেবার মতো সে রকম কিছু নেই।

দুপুরবেলার দিকে আমাদের জন্য একজন ডিটিউন করা তরুণী খাবার নিয়ে এল। খাবারের কার্টটা ঠেলে ঠেলে সে হলঘরের মাঝখানে এনে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আমরা দেখেছি, একেবারে নিঃশব্দে সে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর খালি কার্টটাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বের হয়ে যায়। ডিটিউন করা এই তরুণীটির পেছনে পেছনে একজন সশস্ত্র মানুষ থাকে, এই মানুষটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি সবার দিকে তাক করে রাখে। এই মানুষটি ডিটিউন করা নয়, কিন্তু তবু সে কারো সাথে কথা বলে না। মানুষটির মুখে এমন একটা নিষ্ঠুরতার ছাপ রয়েছে যে কেউ তার সাথে কথা বলার সাহস করে না।

আজকে দুপুরবেলা যখন ডিটিউন করা বিষণ্ণ তরুণীটি এবং তাকে পাহারা দিয়ে নিষ্ঠুর চেহারার সশস্ত্র মানুষটি খাবার নিয়ে এল তখন টিশা হলঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্যমনস্কভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি টিশাকে খুব ভালো করে চিনি তাই আমি বুঝতে পারলাম টিশা মোটেও অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে নেই, সে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে এই দুজনকে দেখছে, সে কিছু একটা ভাবছে, কিছু একটা পরিকল্পনা করছে।

আমার অনুমান সত্যি, কারণ ঘণ্টা খানেক পর যখন ডিটিউন করা তরুণীটি খাবারের কার্ট ঠেলে ঠেলে বের হয়ে গেল তখন টিশা আমাকে ডাকল, বলল, “রিহি, আমি কি তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি?”

আমি টিশার পাশে বসে বললাম, “কী বিষয় নিয়ে কথা বলবে?”

“বিজ্ঞানী লিংলিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি কিছু একটা করতে চাই।”

শুনে আমি চমকে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। টিশা বলল, “বিজ্ঞানী লিংলি আমাদেরকে এমনিতেই শেষ করে দেবে। শুধু শুধু তাকে আমাদের শেষ করতে দেব কেন? কোনো একটা ঘরে আমাদের শরীরটা ফেলে রেখে আমাদের মস্তিষ্কটা ব্যবহার করবে। কেন তাকে আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে দেব? আমি বিজ্ঞানী লিংলিকে আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে দেওয়ার চেয়ে সেটাকে থেঁতলে নষ্ট করে দেব।”

আমি কিছুক্ষণ টিশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি কী করতে চাও?”

“প্রথমে এই ঘর থেকে বের হতে চাই।”

“কেমন করে বের হবে?”

“এখান থেকে বের হওয়ার একটাই পথ। ডিটিউন করা মেয়েটা আর সশস্ত্র মানুষটা যখন এখানে আসবে তখন তাদের কাবু করে আমরা এখান থেকে বের হয়ে যাব।”

আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, “কাবু করে?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কাবু করতে পারবে?”

“আমি একা করব না। তুমি আমাকে সাহায্য করবে।”

“আমরা দুজন মিলে কাবু করব?”

টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ আমরা দুজনে মিলে চেষ্টা করব। কেন সবকিছু চেষ্টা না করে ছেড়ে দেব?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আর কী চেষ্টা করবে?”

“এখান থেকে বের হয়ে ক্রেনিপিউটারটা খুঁজে বের করব। তারপর সেটা ধ্বংস করব।”

“ধ্বংস করতে পারবে?”

টিশা বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, “একটা জিনিস তৈরি করা খুব কঠিন, সেটাকে ধ্বংস করা খুব সোজা।”

আমি মাথা নাড়লাম, মনে হয় টিশা খুব ভুল কথা বলেনি। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “আমরা দুজন কি অস্ত্র হাতের মানুষটা কাবু করতে পারব?”

টিশা বলল, “কেন পারব না? তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ কেন?”

“কী জিনিস?”

“মনে নেই মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে আমরা কতগুলো ক্রেনিয়াল টিউব চুরি করে এনেছি? এর মাঝে একটা হচ্ছে কুকুরের টিউব। সেই টিউব ক্রেনিয়ালে লাগিয়ে দিতেই মানুষটা চোখের পলকে কুকুর হয়ে যায় মনে আছে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“তার মানে বুঝেছ?”

আমি তখনো টিশা কী বলতে চাচ্ছে বুঝিনি, মাথা নেড়ে বললাম, “বুঝিনি।”

“তার মানে কেউ যদি সাহায্য নাও করে শুধু তুমি আর আমি মিলে মানুষটাকে কাবু করতে পারব।”

আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে?”

“মনে করো, তুমি গিয়ে তার অস্ত্রটা খপ করে ধরে ফেললে, কিছুতেই ছাড়বে না, মানুষটা তখন অস্ত্রটা তোমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যখন হুটোহুটি হতে থাকবে তখন আমি পেছন থেকে তার মাথার ক্রেনিয়ালে ঘ্যাচ করে কুকুরের টিউবটা ঢুকিয়ে দেব। সেকেন্ডের মাঝে ভয়ংকর সশস্ত্র গার্ড হয়ে যাবে একটা নেড়ি কুকুর।”

আমি চিন্তা করে দেখলাম, টিশা খুব ভুল কথা বলেনি। আমাদের কাছে যে বেশ কয়েকটা ক্রেনি-টিউব আছে সেটা কেউ জানে না। আমরা যে পেছন থেকে কারো ক্রেনিয়ালে একটা ক্রেনি-টিউব ঢুকিয়ে দিতে পারি সেটা কেউ সন্দেহ করবে না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তোমার বুদ্ধিটা খারাপ না টিশা। খুবই বিপজ্জনক কিন্তু খারাপ না।”

টিশা বলল, “যে কোনো বুদ্ধি বিপজ্জনক! তা ছাড়া এখন বিপদের ভয় করার সময় চলে গেছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ডিটিউন করা মেয়েটি নিয়ে কী করবে?”

“ঐ মেয়েটি তো কিছু বোঝে না, তাকে নিয়ে তো কোনো ভয় নেই।”

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “আমাদের কাছে বেশ কয়েকটা ক্রেনি-টিউব আছে, তাই না?”

“হ্যাঁ আছে।”

“তার মাঝে একটা নিউট্রাল টিউব রয়েছে মনে আছে?”

টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে। আমরা রিয়ানাকে একটা দিয়েছিলাম।”

“হ্যাঁ। ঐ নিউট্রাল টিউবটা যদি আমরা ডিটিউন করা মেয়েটার মাথায় লাগিয়ে দিই তাহলে কী হবে? সে কি ঠিক হয়ে যাবে?”

টিশাকে মুহূর্তের জন্য একটু বিভ্রান্ত দেখায়, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছ রিহা। একজনকে ডিটিউন করার সময় তার মস্তিষ্কের ভেতর কী করে আমরা জানি না, যদি সেটা অক্ষত থাকে তাহলে নিউট্রাল টিউব দিয়ে নিশ্চয়ই ঠিক করা যাবে! রিহি, তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছ! যদি এটা কাজ করে তাহলে আমরা সব ডিটিউন করা মানুষকে ঠিক করে ফেলতে পারব।”

“তার আগে আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে।”

“হ্যাঁ।” টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “আগে এখান থেকে বের হতে হবে।”

আমি তখন আশেপাশের সব মানুষকে দেখিয়ে বললাম, “আমার মনে হয় আমরা কী করতে চাচ্ছি সেটা সবাইকে জানিয়ে রাখা ভালো। তারা আমাদের সাহায্য যদি নাও করে বাধা যেন না দেয়।”

টিশা বলল, “হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ।”

এখানে যারা আছে মানসিকভাবে সবাই এত বিপর্যস্ত যে তাদের ভেতরে কোনো ধরনের আগ্রহ কৌতূহল বা অনুভূতি নেই। তাদেরকে কিছু বলার জন্য ডেকে একত্র করা যাবে বলে মনে হয় না। তাই টিশা

তার চেষ্টা করল না, সে হলঘরের মাঝখানে একটা চেয়ার এনে তার উপর দাঁড়িয়ে রইল।

ঘরে যারা ছিল তারা ধীরে ধীরে টিশার সামনে জড় হলো। যখন বেশ কয়েকজন এসে একত্র হয়েছে তখন টিশা গলা উঁচিয়ে বলল, “তোমরা কারা কারা এখান থেকে বের হতে চাও?”

যারা সামনে দাঁড়িয়েছিল তারা কেমন যেন চমকে উঠল, একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে টিশার দিকে তাকাল। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। টিশা বলল, “তাহলে তোমরা কেউ এখান থেকে বের হতে চাও না?”

মধ্য বয়স্ক একজন বলল, “তুমি নিশ্চয়ই তামাশা করছ। তোমার মতো একজন বাচ্চা মেয়ে আমাদেরকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে?”

টিশা এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“কীভাবে?”

“আমি এখন সেটা তোমাদের বলব না। তোমরা নিজেরাই দেখবে। তবে–”

“তবে কী?”

“আমরা যখন আমাদের কাজ শুরু করব, তোমরা এমন কিছু করবে না যার জন্য আমাদের ঝামেলা হয়।”

পেছনে দাঁড়ানো একজন বলল, “তুমি এখানে যা বলছ তার সবকিছু বাইরে থেকে দেখছে, বাইরে থেকে শুনছে। এক্ষুনি কেউ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”

টিশা বলল, “না। নেবে না।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“আমি জানি। আমি পরীক্ষা করেছি। এই ঘরটি গোপন ঘর–বিজ্ঞানী লিংলি ছাড়া আর কেউ এই ঘরের খবর রাখে না।”

টিশা তার চেয়ার থেকে নেমে আবার হলঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। আমি তার পাশে গিয়ে বসার পর টিশা আমাদের ব্যাগটা খুলে ব্যাগের লাইনিংগুলোর ভেতর লুকানো ক্রেনি-টিউবগুলো বের করল। আমরা সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে কুকুরের ক্রেনি-টিউবটি বের করে আলাদা করে রাখলাম। টিশা সেটা তার পকেটে ভরে নেয়, তারপর আমরা অপেক্ষা করতে থাকি।

কী হবে আমরা জানি না, এক ধরনের উত্তেজনায় আমার বুকটা ধক ধক করতে থাকে।

ঘণ্টা খানেক পর দরজাটা খুলে গেল, ডিটিউন করা মেয়েটি এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে খাবারের কার্টটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসতে থাকে। তার পেছনে সশস্ত্র গার্ডটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি আলগোছে ধরে রেখে একটু এগিয়ে আসে। কয়েকজন খাবার নেওয়ার জন্য কার্টের কাছে এগিয়ে যায়। আমিও তাদের সাথে এগিয়ে গেলাম, সশস্ত্র গার্ডটির কাছে গিয়ে আমি হঠাৎ ঘুরে গার্ডটির হাতে ধরে রাখা অস্ত্রটি খপ করে ধরে ফেলোম।

সশস্ত্র গার্ডটি এর জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাকে দেখে মনে হলো সে ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি অস্ত্রটি ছাড়লাম না, সেটা ধরে রেখে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। গার্ডটিও তার অস্ত্রটি ছাড়ল না–স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঝটকা মেরে আমার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল। এক ধরনের হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল, কিন্তু এরকম অবস্থায় যেটা খুবই স্বাভাবিক-চিৎকার এবং চেঁচামেচি সেটা হলো না। আমি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করলাম না আর গার্ডটিও এতটুকু উত্তেজিত হলো না, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করল না। আমাদের আশেপাশে যারা ছিল তারা সরে গেল এবং আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম টিশা ক্রেনি-টিউবটি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে।

টিশাকে সাহায্য করার জন্য আমি গার্ডের পায়ে লাথি মেরে নিচে পড়ে গেলাম, গার্ডটাও আমার উপর পড়ে গেল। অস্ত্রটি আমার বুকের উপর চেপে বসেছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু আমি সব সহ্য করে দুই হাতে অস্ত্রটি ধরে নিশ্চল হয়ে রইলাম। গার্ডটি অস্ত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু উঠতে পারছে না। আমি দেখলাম ক্রেনি-টিউবটা হাতে নিয়ে টিশা গার্ডটির পেছনে দাঁড়িয়েছে। তারপর ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে গার্ডের মাথার ক্রেনিয়ালে টিউবটি ঢুকিয়ে দিল।

গার্ডটি প্রথমবার যন্ত্রণার একটা তীব্র চিৎকার করে উঠল, তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। গার্ডটি ধরে রাখা অস্ত্রটি ছেড়ে দিয়ে আমার উপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। দুই হাত আর দুই পা ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে গার্ডটি কাঁপতে থাকে। আমি অস্ত্রটি হাতে নিয়ে গার্ডটির দিকে তাক করে ধরে রাখলাম।

আমাদের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দূরে সরে গিয়েছিল, এবার তারা আস্তে আস্তে কৌতূহলী চোখে কাছে এগিয়ে আসে। তাদের মুখ দেখে বোঝা যায় তারা এখনো পুরো বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছে না।

গার্ডটির কাঁপুনি ধীরে ধীরে থেমে যায়, তখন আস্তে আস্তে সে উঠে বসে, হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে পশুর মতো সে একটু ঘুরে আসে, নাক দিয়ে মাটিতে পুঁকে তারপর উপরের দিকে মুখ করে অবিকল কুকুরের মতো শব্দ করে করুণ সুরে ডেকে ওঠে। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করে পেছনে সরে যায়। টিশা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তোমাদের বিশ্বাস হয়েছে?”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এর কী হয়েছে?”

টিশা বলল, “কিছু হয়নি। ওর মাথায় কুকুরের সিস্টেম লোড করা হয়েছে। মানুষটার সাথে এখন একটা কুকুরের কোনো পার্থক্য নেই। গলায় দড়ি বেঁধে কোথাও আটকে রাখ।”

টিশা একটু এগিয়ে গার্ডটার মাথায় হাত রাখল, গার্ডটা তখন অবিকল কুকুরের মতো কুঁই কুঁই শব্দ করে টিশার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। টিশা গার্ডটার গলায় ঝোলানো কার্ডটা খুলে নিল, পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেখানে যা যা আছে পরীক্ষা করার জন্য বের করে আনল।

আমি এগিয়ে একটা প্লেট নিয়ে তার মাঝে কিছু খাবার দিয়ে সেটা গার্ডটার সামনে ঠেলে দিলাম। গার্ডটা উঠে বসে দুই হাত এবং পায়ে ভর দিয়ে বসে খাবারগুলো চেটে চেটে খেতে শুরু করল। দৃশ্যটি অস্বস্তিকর-তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে কেমন যেন শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

.

ঘরের মাঝে এত কিছু ঘটেছে কিন্তু ডিটিউন করা মেয়েটি তার কিছুই লক্ষ করল না। সে খাবারের কার্টের সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই রইল, ডানে বা বামে একবার ঘুরেও তাকাল না। আমি টিশাকে বললাম, “টিশা এই ডিটিউন করা মেয়েটিকে ঠিক করার চেষ্টা করা যাক।”

টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। চেষ্টা করে দেখি, কাজ করবে কি জানি না।”

আমি ক্রেনি-টিউবগুলো থেকে নিউট্রাল টিউবটা বের করে টিশার দিকে এগিয়ে দিলাম। টিশা টিউবটা হাতে নিয়ে ডিটিউন করা মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাতটি ধরল। মেয়েটি টিশার দিকে না তাকিয়েই অন্য হাতটি দিয়ে টিশার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। টিশা তাকে ছাড়ল না তাকে ধরে রেখে ক্রেনি টিউবটি তার মাথার পিছনে ক্রেনিয়ালে ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে মেয়েটির সারা শরীর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। মনে হতে থাকে সে বুঝি মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে। আমি ছুটে গিয়ে তার অন্য হাতটা ধরে তাকে পড়ে যেতে দিলাম না। মেয়েটির চোখ বন্ধ হয়ে আসে এবং শব্দ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আমরা তখন সাবধানে তাকে মেঝেতে বসিয়ে দিলাম। মেয়েটি নিজের হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ধীরে ধীরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

আমি আর টিশা কী করব বুঝতে পারলাম না। নিউট্রাল টিউবটি ক্রেনিয়ালে লাগিয়ে মেয়েটিকে ঠিক করা গেছে, নাকি আরো খারাপ কিছু হয়ে গেছে আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আমি আর টিশা মেয়েটির দুই পাশে বসে অপেক্ষা করতে থাকি।

মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় মুখ তুলে তাকাল এবং সাথে সাথে আমরা বুঝে গেলাম মেয়েটি আর ডিটিউন করা বোধ শক্তিহীন একটি মানুষ নয়। তার চোখে সেই ভয়ংকর শূন্য দৃষ্টি নেই। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময়, কৌতূহল এবং বিষণ্ণতা। আমাদের দিকে তাকাল তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”

টিশা বলল, “তুমি আমাদের সাথে আছ।”

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা?”

টিশা বলল, “আমার নাম টিশা আর ও হচ্ছে রিহি। তোমার নাম কী?”

মেয়েটা বলল, “এক সময়ে আমার নাম ছিল লিরিনা।”

টিশা বলল, “লিরিনা, তোমার কী হয়েছিল মনে আছে?”

লিরিনা নামের মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে।”

“কী মনে আছে?”

লিরিনা কেমন জানি শিউরে উঠল, বলল, “মনে আছে আমি বিজ্ঞানী লিংলির সাথে কথা বলছি, ঝগড়া করছি, আমি তাকে বলছি, তুমি যত বড় বিজ্ঞানীই হও, তুমি এটা করতে পার না।”

“কী করতে পার না?”

“মানুষকে ব্যবহার করে ক্রেনিপিউটার বানানো।”

“তারপর?”

“তারপর আমাকে ধরে নিয়ে গেল একটা অপারেশন থিয়েটারে। সেখানে আমাকে কী করল আর মনে নেই।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি জান ক্রেনিপিউটারটা কোথায়?”

লিরিনা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ জানি। করিডোর ধরে হেঁটে গেলে একেবারে শেষে।”

“সেখানে পাহারা আছে?”

“না, কোনো মানুষ পাহারা দেয় না। কিন্তু কেউ ভেতরে যেতে পারে না। দরজায় পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে।”

টিশা মাথা নাড়ল, আমি চিন্তিত মুখে বললাম, “আমরা কেমন করে ভেতরে যাব?”

টিশা বলল, “নীল সবুজ চার চার তিন দুই।”

আমি একটু চমকে উঠলাম, নীল সবুজ চার চার তিন দুই হচ্ছে একজন সুপার গণিতবিদের ক্রেনিটিউব। টিশার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ক্রেনি-টিউব দিয়ে কী পাসওয়ার্ড ভাঙা যাবে?”

“চেষ্টা করতে দোষ কী? লিরিনার ক্রেনিয়ালে লাগাব।”

লিরিনা একটু অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আমার মাথায় কী লাগাবে?”

টিশা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোমাকে আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে। তুমি কি সাহায্য করবে?”

লিরিনা একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “তোমরা আমাকে ডিটিউন থেকে মুক্ত করেছ, অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করব। আমাকে কী করতে হবে বলো।”

“আমাদের ক্রেনিপিউটারের কাছে নিয়ে যাবে। তারপর তোমার ক্রেনিয়ালে একটা ক্রেনি-টিউব লাগিয়ে ক্রেনিপিউটারের কোড ভেঙে আমাদের ভেতরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে দেবে।”

“আমি পারব?”

“নিশ্চয়ই পারবে!”

“ঠিক আছে তাহলে। কখন যেতে চাও?”

“এখনই। দেরি করতে চাই না।”

লিরিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো তাহলে যাই।”

টিশা উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যাচ্ছি। আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো যেন আমরা ক্রেনিপিউটার ধ্বংস করে আসতে পারি।”

মানুষগুলো এখন আর আগের মতো হতাশ আর নির্জীব নয়। একজন বলল, “আমি তোমাদের সাথে যেতে চাই।”

তখন এক সাথে অনেকেই বলে উঠল, “আমরাও যেতে চাই।”

আমি বললাম, “এখনই সবার যাওয়া ঠিক হবে না। বাইরে কী আছে আমরা জানি না। আগে আমরা যাই। প্রয়োজন হলে পরে তোমাদের নিতে আসব।”

মানুষগুলো মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে। আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব।”

কিছুক্ষণের ভেতর আমি আর টিশা লিরিনাকে নিয়ে দরজার কাছে গেলাম। গার্ডের কার্ডটি দরজার সামনে ধরতেই দরজা খুলে গেল।

আমরা ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এলাম। ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ঘাড়ে নিয়ে আমি আর টিশা লিরিনার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি।

সামনে কী আছে জানি না। কী হবে তাও জানি না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে কী হবে তাতে কিছু আসে যায় না! আমাদের চেষ্টা করতে হবে–চেষ্টা করার একটা সুযোগ এসেছে।