রতনলাল উঠে দরজাটা খুলে দিল।
মিহি শান্তিপুরের সুরু কলোপাড় ধুতি, মুগার পাঞ্জাবি ও পায়ে চকচকে নিউকাট জুতো মাঝারি দোহারা চেহারার একজন মধ্যবয়সী সুপুরুষ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল। হাতে মলাক্কা বেতের সুদৃশ্য একটা ছড়ি।
এ কি যোগানন্দ যে! হঠাৎ কি মনে করে? রতনলালই। আগন্তুককে প্রশ্ন করে।
আগন্তুক যোগানন্দ কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে কক্ষের মধে খালি দ্বিতীয় চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে নির্বিকার কণ্ঠে কেবল বললে, একটা পাত্রে কিছু ঢাল দেখি আগে বাবা, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই।
রানা ড্রয়ার থেকে আর একটা কাঁচের গ্লাস বের করে বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ জলে ঢেলে মিশিয়ে এগিয়ে দিল যোগানন্দের দিকে।
দীর্ঘ এক চুমুকে কঁচের পাত্রটি নিঃশেষ করে যোগানন্দ বললে, তারপর? তোমার রত্নমঞ্জিল কেনবার ব্যাপারটা কতদূর এগুলো বল?
ব্যাপারটা যে ক্রমেই একটু একটু করে ঘোরালো হয়ে উঠল। হে যোগানন্দ!
এর মধ্যে আবার ঘোরালো হয়ে উঠবার কি হল? বায়না পরশু তো হয়ে গিয়েছে?
তা তো হয়েই গিয়েছে। এই কিছুক্ষণ আগে দত্ত-সাহার ওখান থেকে আসছি। শালা রাঘব একটা নূতন পাঁচ কষবার মতলবে আছে।
কি রকম! মিটমিট করে তাকায় যোগানন্দ রানার মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বলছে বাড়িটা ছেড়ে দাও, মোটা টাকা খেসারত দেবী—অন্য কে এক পাটি আছে—
বটে। তা তুমি কি বললে?
আমিও রতনলাল রানা! বললাম আরো দু-পাঁচ হাজার বেশী ছাড়তে হয় আমিই ছাড়ব। ওসব মতলব ছেড়ে দাও তো যাদু।
হুঁ, তা কত বেশী দিতে চায়?
ঠিক জানি না, তবে দশ-বিশ হাজার তো মিলবেই।
বল কি! তবে ছেড়েই দাও না, মুফৎসে দশ-বিশ হাজার যদি অমনি করে এসেই যায় তবে আর ক্ষতি কি? ঘরের টাকা ঘরে এসে গেল, সঙ্গে আবার ফাউ!
কি বলছি তুমি যোগেন? তুমিই না লোভ দেখিয়ে আমাকে এ ব্যাপারে নামিয়েছ! এখন বলছি ছেড়ে দিতে!
হ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে আগাগোড়া সব কিছুই তো একটা অনিশ্চিতের ওপরে নির্ভর করছে। কিছুই একেবারে নাও তো মিলতে পারে। এতগুলো টাকা ঢেলে তখন স্রেফ বোকা বনে যেতে হবে,–কথাটা ভেবে দেখ!
উহুঁ, হাত একবার বাড়িয়েছি, ওর শেষ না দেখে ফিরছি না। ভাগ্যে যদি কেবল মাটিই ওঠে উঠবে।
কিন্তু ভেবে দেখ, পঞ্চান্ন হাজার টাকা—
লোটা কম্বল নিয়ে বাপ আমার এসেছিল এ মলুকে-ফের না হয় রাম সেই শুরু করব। শালা পুরুষের ভাগ্য ভুবতেও যতক্ষণ উঠতেও ততক্ষণ!
যোগানন্দ রানার সঙ্গে কথা বলছিল। আর মধ্যে মধ্যে কাচের পাত্র পূর্ণ করে গলাধঃকরণ করছিল। বোতলাটা প্রায় সে খালি করে আনে।
হঠাৎ বোতলের দিকে নজর পড়ায় রানা বলে, এই যোগেন, কত খাচ্ছিস।
ভয় নেই—যোগানন্দ মাতাল হয় না। মৃদু হেসে যোগানন্দ জবাব দেয়।
সত্যি যোগানন্দকে তার পরিচিতেরা কখনও যাকে বলে মদ খেয়ে মাতাল হতে দেখেনি। মদ খেয়ে মদ হজম করবার অদ্ভুত শক্তি আছে যোগানন্দের। বন্ধুবান্ধবমহলে কেউই যোগানন্দের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়টা জানত না এমন কি তার পদবীটাও জানে না। কেউ জানে না কোথায় সে থাকে—কোন বাড়িতে বা কোন পাড়ায়! সংসারে কে তার আছে বা কিভাবে তার চলে!
পরিচিতজনদের আড্ডায় সে নিয়মিত হাজিরা দেয়। মদ্যপান করে হৈ হৈ করে অধিক রাত পর্যন্ত। তারপর একসময় দিব্যি আকণ্ঠ মদ্যপান করে (সর্বক্ষেত্রেই প্রায় পরের পয়সায়) এবং এতটুকু না। টলে বের হয়ে যায় শিস দিয়ে সুর ভাঁজতে ভঁজতে। কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।
বন্ধুবান্ধবরাও যোগানন্দকে খুশিমনে মদ খাওয়ায়, বিশেষ করে ব্যবসায়ীমহল। ব্যবসায়ীমহলেই যোগানন্দের আনাগোনা এবং খাতিরও তার প্রচুর। যোগানন্দকে খাতির করবার প্রধান কারণই ছিল, সকলের খুঁটিনাটি, সমস্ত ব্যবসার বাজারদরটা সর্বদা থাকত যোগানন্দের ঠোটের আগায় এবং বাজারাদরের ওঠানামা সম্পর্কে আগে থাকতেই মতামত দেবার একটা অদ্ভুত দক্ষতা দূরদৃষ্টি ছিল যোগানন্দের। তার কথার উপরে নির্ভর করে বড় একটা কাউকেই ব্যবসায়ীমহলে তেমন ঠিকতে হত না।
ঐ দালালী করাটা ছিল তার প্রধান জীবিকা। অথচ ব্যবসায়ীমহলে ঐ শ্রেণীর লোকেরা দালাল বলে সাধারণতঃ যে ব্যবহার পায়, যোগানন্দ কারো কাছ হতে সে ধরনের ব্যবহার পায়নি। বরং সে পেয়ে এসেছে সকলের কাছ হতেই একটা বিশিষ্ট সম্মানের ও প্রীতির আসন। এবং সেই কারণেই হয়ত তাকে সকলেই প্রায় সানন্দে মদ খাওয়াত। যোগানন্দের বিশেষ মদ্য প্রীতিটা কারো কাছেই অজ্ঞাত ছিল না।
যোগানন্দই রতনলালকে ‘রত্নমঞ্জিল’টা কেনবার জন্য উৎসাহিত করে তোলে। রতনলাল মিথ্যা বলেনি। এবং খুব সম্ববত যোগানন্দের উৎসাহ না পেলে শেঠ রতনলাল এতদূর অগ্রসর হতো। কিনা সন্দেহ।
রানার অফিসঘরের ওয়াল-ক্লকটিয় রাত্রি আটটা ঢং ঢেং করে ঘোষণা করল।
যোগানন্দ উঠে দাঁড়ায়, তবে চললাম হে শেঠ!
এর মধ্যেই? বাস না—আর একটা বোতল খুলি! রানা বলে। না।
একটা কাজ আছে। এক জায়গায় যেতে হবে। যোগানন্দ মাথা নেড়ে বলে।
বল কি হে যোগানন্দ এত শীঘ্ৰ অমৃতে অরুচি! সবে তো শুরু করলে!
না হে, কাজ আছে। চলি—
সত্যি-সত্যিই যোগানন্দ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সিঁড়িপথে একটা টিমটিমে কম পাওয়ারের বালব জ্বলছে। স্বল্পালোকে সমস্ত সিঁড়িপথটা একটা আধো আলোছায়া, বিশ্ৰী স্তব্ধতায় যেন থমথম করছে।
যোগানন্দ বাইরের রাস্তায় নেমে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি চলে দেখে নিল। এ রাস্তটা ঐ সময় সাধারণতঃ একটু নির্জনই হয়ে পড়ে। ফুটপাত ধরেই যোগানন্দ এগিয়ে চলল। শ্লথমন্থর পদবিক্ষেপে। রানার কাছে রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে প্রাপ্ত সংবাদটা সত্যিই যোগানন্দকে যেন একটু চিন্তিত করে তুলেছে।
যে টোপ সে ফেলেছিল মাছ সে টোপ গিললেও বঁড়শীটা ঠিক মাছের গলায় গেঁথেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। টেনে তুলতে গেলে যদি ফসকে যায়। আশপাশে আবার এদিকে অন্য মাছ ঘাই দিচ্ছে, খবর পেয়েছে সে।
অনিলেরও বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। গত এক মাস ধরে হঠাৎ কোথায় যে সে ড়ুব? দিল, একেবারে কোন পাত্তাই নেই।
ঘটনাটা যে কোন দিকে গড়াচ্ছে ঠিক যেন বোঝা যাচ্ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে যোগানন্দ বৌবাজারে এল। শিয়ালদার দিকে বৌবাজার স্ট্রট ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে ডান দিককার একটা অপরিসর গলির মধ্যে একসময় ঢুকে পড়ল। গলিটা এত সরু যে দুজন লোকের স্বচ্ছন্দে রাত্রির অন্ধকারে পাশাপাশি হাঁটাই কষ্টকর। গলিটা ব্লাইন্ড। একটা মাত্র করপোরেশনের গ্যাসবাতি সমস্ত গলিপথটার জন্য। তাই আলোর চাইতে মনে হয়। অন্ধকার যেন বেশী। স্যাঁতসেঁতে নোংরা। হাওয়াটা বন্ধ হওয়ায় একটু ভাপসা ভাব। যোগানন্দ গলিটার মধ্যে প্রবেশ করে দ্রুতপদে এগিয়ে গিয়ে বাঁ-হাতি একটা তিনতলা পুরাতন বাড়ির বন্ধ কবাটের কড়াটা ধরে বার-দুই নাড়া দিতেই ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এল, কে?
যোগানন্দর ডাকে কোনরূপ সাড়া না দিয়ে আবারও দরজার কড়াটা ধরে বার-দুই নাড়া দিল এবং এবারে সঙ্গে-সঙ্গেই দরজাটা খুলে গেল।
বয়স বোধ করি ত্রিশ-পয়ত্রিশ হবে, একটি মহিলা দরজা খুলে দিতে এসেছিলেন। পরিধানে সাধারণ কালোপাড় একটি মিলের শাড়ি, হাতে একগাছি করে শাঁখা। রোগাটে একহারা দেহের গড়ন। সিঁথিতে সিন্দুর ও কপালে একটি গোলাকার সিন্দুরের টিপা।
ভদ্রমহিলার চেহারা এমনিতে কুশ্ৰী নয়, কিন্তু দারিদ্র্য যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও শ্ৰীকে লেহন করে নিয়েছে। শুধু দারিদ্রই নয়, সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চোখে মুখে একটা ক্লান্তি! মহিলার হাতে একটি হ্যারিকেন বাতি ছিল। তিনি আগে আগে চললেন। যোগানন্দ তাকে অনুসরণ করে।
মহাবীর কোথায়? তাকে দেখছি না! যোগানন্দ প্রশ্ন করে।
বাজারে গিয়েছে। মহিলা জবাব দিলেন।
আর নারাণী?
নারাণী তো আজ চারদিন হল কাউকে না বলে চলে গিয়েছে কোথায়—
আমারই অন্যায় হয়েছে দিদি। কাজের ঝ ঞাটে কদিন এদিকে আসতে পারি নি। এক এক ঐ বাড়িতে মহাবীরকে নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার খুব কষ্ট হয়েছে!
না ভাই, কষ্ট আর কি–
ভয় করেনি?
ভয়! মহিলা মৃদু হাসলেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না, ভয় কি! সারাদিন ধরে টিনের ফ্যাক্টরীতে কাজ চলে—ঠং ঠেং শব্দ। বরং সন্ধ্যার পর ফ্যাক্টরী বন্ধ হলে একটু আরামই পাওয়া যায়। তাছাড়া মহাবীর তো আছেই।
ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে দুজনে একটা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। বহু পুরাতন আমলের বাড়ির নিচের তলার ঘর। ছোট ছোট জানালা। অন্ধকার চাপা তাই আলো-বাতাসের অভাবে কেমন যেন! ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের বাহুল্যও তেমন নেই। একাধারে একটি চৌকির ওপরে সাধারণ একটি শয্যা বিছানো। আর এক কোণে একটি ছোট আকারের স্টীলের ট্যাঙ্ক।
একটি মাদুর পেতে দিয়ে মহিলা বললেন, বাস।
পরিধানে সুটি থাকায় কোনমতে কষ্টেসৃষ্টি পা গুটিয়েই যোগানন্দ মদুরের ওপরে বসে পড়ল।
এই দারিদ্র্যের মধ্যে তুমি আস—আমারই লজ্জা করে যোগেন!
ওকথা ভাবেন কেন দিদি? ভাই আসবে দিদির বাড়িতে, সেখানে দারিদ্র্য যদি কিছু থাকেই তাতে লজ্জার আবার কি! ওরকম ভাবলে কিন্তু আমার আর আসাই হবে না। কিন্তু মহাবীরটারও তো আচ্ছা আক্কেল! কতক্ষণ গিয়েছে?–
তা আধা ঘণ্টা তো হবেই—
এক আপনি বাড়িতে আছেন, সে খেয়ালও নেই নাকি?
না, ওর কোন দোষ নেই। ওর নিজের কি কাজ আছে, তাই বলে দিয়েছি। একেবারে কাজ সেরে আসতে।
মহাবীরকে বলেননি কেন দিদি একটা ঝি খুঁজে আনতে?
কি হবে! একা মানুষ কাজকর্মও বিশেষ কিছু নেই। আবার একটা ঝি দিয়ে কি হবে?
ঠিক সেজন্য নয় দিদি। মহাবীর পুরুষমানুষ, আর এক আপনি এখানে স্ত্রীলোক-অন্য একজন স্ত্রীলোকের থাকা খুবই প্রয়োজন।
চিরকাল তো এইভাবেই কাটিয়েছি বাণী আর আমি। তোমার দাদা কালেভদ্রে কখনও ক্কচিৎ। আসতেন—
দাদার আমলে যা হয়েছে হয়েছে—
কিন্তু থাক সেকথা। তাদের কোন সন্ধান পেলে?
না, এখনো কোন সন্ধানই পাইনি। তবে আপনি ভাববেন না, তারা ফিরে আসবেই। তারপর একটু থেমে বলে, চলুন না দিদি, আপনি আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন।
না ভাই, তা হয় না।
কেন হয় না? একা একা এখানে পড়ে থাকেন—মহাবীর তো এখানে রইলই, তারা ফিরে এলে মহাবীরই তো আমাদের সংবাদ দিতে পারে। আপনি আমার ওখানে থাকলে আমিও নিশ্চিত থাকতে পারি।
তুমি আমার জন্যে চিন্তা করো না ভাই।
বাইরের দরজার কড়া নড়ে উঠল।—মহাবীর ফিরে এল বোধ হয়! সবিতা বললেন।
আমি যচ্ছি, দরজা খুলে দিয়ে আসছি। যোগানন্দ ওঠবার চেষ্টা করে। কিন্তু মহিলা বাধা দেন, না না, অন্ধকারে তুমি পথ ঠিক করতে পারবে না। তুমি বসো, আমি দরজা খুলে দিয়ে আসছি। সবিতা অন্ধকারেই দ্রুতপদে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
একটু পরেই মহাবীরের জুতোর শব্দ দরজার বাইরে শোনা গেল।
তোমার বাবু এসেছেন মহাবীর! শোনা গেল মহিলার কণ্ঠস্বর।
মহাবীরের বয়স হয়েছে। পঞ্চাশের উর্ধ্বে। কিন্তু দেহের গঠন এখনও অটুট আছে।