মালঞ্চ হত্যারহস্য আরো ঘনীভূত হল এবং তার আভাস পাওয়া গেল দিন দুই পরে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে।
শহরের কোন এক নামকরা ডাক্তার ও কোন এক কোম্পানির বড় অফিসারের ব্যাঙ্কের লকার থেকে প্রচুর গিনি ও কারেন্সী নোট পাওয়া গিয়েছে। যে অর্থের কোন বিশ্বাসযোগ্য এক্সপ্লানেশান ওই দুজনের একজনও দিতে পারেননি, ওঁরা দুজনেই নিহত মালঞ্চ দেবীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত ছিলেন।
আরো একটি সংবাদমালঞ্চ দেবী পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড ছিলেন। হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির একটি তালাবন্ধ ঘরে তল্লাসী চালিয়ে পুলিস-বহু টাকার নিষিদ্ধ নেশার বস্তু পেয়েছে। ঐ হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিস মালঞ্চ দেবীর পেয়ারের দাসী মানদা দাসীকে গ্রেপ্তার করেছে।
দিন দুই পরে আবার সংবাদ বেরুল কাগজে কাগজে–
শহরের এক নামকরা অ্যাড়ভভাকেট জগৎ চৌধুরী, মানদার জামিনের জন্য আদালতে আবেদন রেখেছিলেন কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটার সদানন্দ মিত্র তার বিরোধিতা করেন। জজ আরো তদন্ত সাপেক্ষে মানদার জামিন অনুমোদন করেননি। তাকে জেলহাজতে রাখার নির্দেশ জারী করেছেন। সুরজিৎ ঘোষালের জামিনের প্রশ্ন নিয়ে জজসাহেব বিবেচনা করবেন আগামী মঙ্গলবার।
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে সোমনাথ ভাদুড়ী তাঁর চেয়ারে বসে কিরীটীর সঙ্গে ঐ মামলার ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলেন।
কিরীটী বলছিল, মানদা যে অনেক কিছুই জানে ভাদুড়ী মশাই, সেটা অনুমান করেই আমি সুশীলকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওকে গ্রেপ্তার করতে।
—আমারও মনে হয় কাজটা ভালই হয়েছে রায়মশাই, আপনার কাছে যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে, হত্যাকারীকে নানাভাবে ঐ মানদার সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু মানদার জামিনের ব্যাপারে আমাদের জগৎ চৌধুরীকে কে ব্রিফ দিয়েছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
—যার বেশী interest নিঃসন্দেহে সে-ই দিয়েছে—কিরীটী মৃদু হেসে বলল।
—কিন্তু কে সে? কাকে আপনার সন্দেহ হয় বলুন তো?
–সন্দেহ যার ওপরেই হোক, একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু নিশ্চিত হয়েছি ভাদুড়ী মশাই-কিরীটী বলল, মানদা অনেক কিছুই জানে আর তাই বোধহয় আমার অনুমান, হত্যাকারী মানদার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে জানে না ঐ রকমের চরিত্রের এক মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করে কত বড় ভুল সে করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো মানদার হাত দিয়েই ফাঁসির দড়িটা তার গলায় এঁটে বসবে।
—আপনিই তো একটু আগে বলেছিলেন রায়মশাই, সুশান্ত মল্লিক নাকি ঐ মানদা সম্পর্কে বলেছিল, she is a dangerous woman!
-হ্যাঁ, বলেছিল, কিন্তু you cant count much upon him! একটা মেরুদণ্ডহীন মাতাল—নিজের স্ত্রীকে অন্যের রক্ষিতা জেনেও তারই আশ্রয়ে যে পড়ে থাকে এবং তারই টাকায় নেশা করে, আর যাই হোক তাকে বোধহয় পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না।
—আচ্ছা রায়মশাই, ঐ চিত্রাভিনেত্রীটিকে আপনার কি রকম মনে হয়?
—গোলমালটা হয়তো সেখানেও থাকতে পারে ভাদুড়ি মশাই।
—হ্যাঁ, এটা তো বুঝতে পারা গিয়েছে দীপ্তেন ভৌমিককে মালঞ্চ ভালবাসত, তাই হয়তো সে ডলি দত্তর প্রতি দীপ্তেনের আকর্ষণটা ভাল চোখে দেখত না। এবং ডলি দত্তও মালঞ্চকে অনুরূপ সুনজরে দেখত না। ফলে সম্ভবত পরস্পরের প্রতি একটা jealousy হয়তো দেখা দিয়েছিল দীপ্তেন ভৌমিককে ঘিরে। আর কে বলতে পারে, সেই ঈর্ষাকে মন্থন করেই হয়তো হলাহল উঠে এসেছিল, যে হলাহল মালঞ্চর মৃত্যু ঘটিয়েছে।
—আর ঐ ডাক্তারটি?
—আমার যতদূর মনে হয় সে ভদ্রলোকও চোরাকারবারে একজন অংশীদার, এবং সেক্ষেত্রে ঐ মাকড়শার জালে তারও জড়িয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।
-আচ্ছা রায়মশাই, আপনার কি মনে হয় মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত মল্লিকও ঐ চোরাকারবারে—
—অংশীদার সে হয়তো ঐ চোরাকারবারে ছিল না—আর সেটা সম্ভবও নয়।
–কেন?
—আর যাই করুক না কেন মালঞ্চ, ঐ আশ্রিত ও পোষ্য স্বামীকে যে তার চোরাকারবারের মধ্যে নেবে—সেটা সম্ভব নয়। তবে একই বাড়িতে যখন ছিল লোকটা তখন তার পক্ষে ব্যাপারটা অনুমান করা এমন কিছু অসম্ভব নয়।
–আচ্ছা রায়মশাই, আপনার কি মনে হয় আমার ক্লায়েন্ট সুরজিৎ ঘোষাল ঐ চোরাকারবারের মধ্যে ছিল?
–মনে হয় না চোরাকারবারের সঙ্গে তার কোন যোগ ছিল। তবে জোর করে কিছুই এই মুহূর্তে বলা যায় না ভাদুড়ী মশাই।
—বাঁচালেন। আমারও তাই ধারণা রায়মশাই।
কিরীটী মৃদু হাসল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, মালঞ্চর মৃত্যুর কারণ দুটোই হতে পারে—হয় ঈর্ষার হলাহল নতুবা চোরাকারবারের বিষময় পরিণাম।
ভাদুড়ী বললেন, সত্যি রায়মশাই, আজকের সমাজের মানুষগুলো কি ভাবে যে বদলে যাচ্ছে দিনকে দিন, মরাল বা নীতির কোন বালাই নেই।
-কোথা থেকে থাকবে ভাদুড়িমশাই, আজকের জীবনযাত্রা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে কেবল ছুটবার নেশা এসেছে। একটা অস্থিরতা, আর সেই অস্থিরতার জন্যেই তারা তৃপ্তির অনুসন্ধান করছে মদ, মেয়েমানুষ, ঘোড়দৌড়, চোরাকারবার আর কালো টাকা জমানোর মধ্যে। ঐ মালঞ্চ মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে দেখুন না, স্বামী। থাকতেও সে আর একজনের রক্ষিতা হয়েছিল। কিন্তু হতভাগিনী জানত না, লালসা লালসাকেই বাড়িয়ে তোলে, ওর মধ্যে তৃপ্তি নেই, আছে কেবল একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার বিষই আজ আনছে হত্যা ধর্ষণ চোরাকারবার আর কালো টাকার নেশা। আচ্ছা, রাত অনেক হলো, এবার উঠি ভাদুড়ীমশাই কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
লেক রোডে দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে তার শোবার ঘরে মুখোমুখি বসে ছিল দীপ্তেন আর ডলি দত্ত।
তারা জানত না যে তারা যে সব কথা বলছে, সব কিছু একটা অদৃশ্য শক্তিশালী মাইক্রোফোনের সাহায্যে টেপ হয়ে যাচ্ছে।
কিরীটীর পরামর্শেই ব্যবস্থাটা ডি.সি. ডি.ডি. চট্টরাজ করেছিলেন দীপ্তেনের গৃহভৃত্য বামাপদকে হাত করে। দীপ্তেনের গৃহভৃত্য বামাপদকে পুলিসের হাত করতে কষ্ট হয়নি।
বামাপদ বৎসরখানেক হল দীপ্তেনের কাছে কাজ করছে।
বয়স অল্প, বছর বত্রিশ-তেত্রিশ হবে। কালো মতন রোগা চেহারা, কিন্তু বোঝা যায় বেশ চালাকচতুর? সুশীল চক্রবর্তীর কথায় সেটা বুঝতে পেরেই কিরীটী বামাপদকে পুলিসের দলে টানতে পেরেছিল।
ব্যাচিলার মানুষ দীপ্তেন, বামাপদ ছিল তার একাধারে কুক এবং সার্ভেন্ট, আবার কেয়ারটেকারও বটে। বামাপদকে পেয়ে দীপ্তেন নিশ্চিত ছিল।
বামাপদকে আলাদা ভাবে জেরা করে সুশীল চক্রবর্তী থানায় নিয়ে এসে অনেক কথাই দীপ্তেন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।
ডলি দত্ত যে ইদানীং প্রায় প্রতি রাত্রেই দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে আসে, তারপর মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে যায়, সে কথা বামাপদর কাছ থেকেই সুশীল চক্রবর্তী প্রথম জানতে পেরেছিলেন। এবং বামাপদর কাছ থেকেই আরো শুনেছিলেন মালঞ্চ দেবী আগে প্রায়ই আসত দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে, তবে ইদানীং কেন যেন সে বড় একটা আসত না।
তারপর একদিন সুশীল চক্রবর্তী দীপ্তেন ভৌমিকের অনুপস্থিতিতে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
সুশীল বলেছিলেন, শোন বামাপদ, পুলিসকে যদি তুমি সাহায্য না কর পুলিস তোমাকে গ্রেপ্তার করে চালান দেবে। পুলিস সংবাদ পেয়েছে তোমার বাবুর সঙ্গে তুমি চোরাকারবার কর।
—দোহাই হুজুর, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না—
–জানি না বললেই তো আর তোমাকে পুলিস ছেড়ে কথা বলবে না বামাপদ।
বামাপদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। বলেছিল, বিশ্বাস করুন হুজুর, আমি কিছুই জানি না।
–ঠিক আছে, তুমি পুলিসকে যদি সাহায্য কর—তবে আমি তোমাকে বাঁচাব–
–বলুন হুজুর কি করতে হবে—আমি সব কিছু করব আপনার হুকুমমত।
—বেশ, তাহলে আগে কয়েকটা কথার জবাব দাও আমার।
—বলুন হুজুর।
—তোমার বাবুর ঘরে একটি মেয়ে আসত?
—কার কথা বলছেন হুজুর, সেই যে সিনেমায় নামে?
–না, সে নয়, আর একজন, মালঞ্চ তার নাম—
–মালা দিদিমণি? কিন্তু তিনি তো অনেকদিন আর এখানে আসেন না।
—আসবেন কি করে, তিনি কি আর বেঁচে আছেন, তাকে খুন করা হয়েছে।
–খুন! কি বলছেন হুজুর?
–হ্যাঁ, তাকে খুন করা হয়েছে।
—হুজুর, আপনারা কি আমার বাবুকে সন্দেহ করছেন? আমি হলফ করে বলতে পারি হুজুর, আমার বাবু ঐ দিদিমণিকে খুন করেননি।
–কি করে বুঝলে যে তোমার বাবু
—কি বলছেন হুজুর, ঐ দিদিমণিকে আমার বাবু খুব ভালবাসতেন। আর দিদিমণিও বাবুকে–
—জানি বামাপদ, সেইজন্যই তো আসল লোককে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর আমাদের ধারণা সেই লোকটা তোমার বাবুর কাছে আসা-যাওয়া করে। হ্যাঁ, তাকে আমরা ধরতে চাই, আর তাতে তোমার সাহায্য চাই আমরা।
—নিশ্চয় হুজুর আমি আপনাদের সাহায্য করব, আমাকে কি করতে হবে বলুন।
-বেশী কিছু না, তোমার বাবুর বসবার আর শোবার ঘর আমরা একটু দেখব, যদি সে লোকটার কোন হদিস পাই!
—বেশ তত বাবু, দেখুন।
–হ্যাঁ দেখছি, কিন্তু আমি একা একা দেখব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে না।
—ঠিক আছে, আমি দাঁড়াচ্ছি।
সুশীল চক্রবর্তী ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একটা ভারী সোফার নীচে মাইক্রোফোন আর ছোট টেপ রেকর্ডারটা ফিট করে মিনিট কুড়ি বাদে ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে এলেন।
—দেখলেন হুজুর?
–হ্যাঁ, পাঁচ-সাতদিন বাদে আবার আসব, তুমি কিন্তু তোমার বাবুকে একেবারেই বলবে না যে আমি এখানে এসেছিলাম। তোমার বাবু জানতে পারলে যদি বেফাঁস কথাটা বলে ফেলেন তাহলে সে সাবধান হয়ে যাবে, বুঝেছ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
সুশীল ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এসেছিলেন।