মহান্তি অতঃপর শুধায়, আপনি কি রামানুজকে প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ। তাকে দেখবার পর থেকেই বলতে গেলে। তবে সন্দেহটা ঘনীভূত হয় আপনার মুখ থেকে রেণুকার ইতিহাসটা শোনবার পর।
কেন-কেন ওকে সন্দেহ করলেন?
প্রথমতঃ ও আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি। কারণ ওকেই আমি আগের দিন বৈকালে সমুদ্রতীরে কালী সরকারের সঙ্গে যখন প্রথমে দেখি
তবে কি–
হ্যাঁ, ওই দোলগোবিন্দ সিকদার-পার্ল-মাচেন্ট! মানুষকে একবার দেখলে বড় একটা আমি ভুলি না। পরের দিন হোটেলে ওকে দেখে তাই আমি চমকে উঠেছিলাম। দ্বিতীয়তঃ, ওর মুখের সঙ্গে কালী সরকারের মুখেরও একটা ক্লোজ রিজেমব্লেন্স দ্বিতীয় দিন আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
একটু থেমে আবার বলতে থাকে কিরীটী, ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয়েছিল কোথায় যেন একটা আশ্চর্য রকমের মিল, একটা সাদৃশ্য আছে কালী সরকারের মুখের সঙ্গে ঐ রামানুজের মুখের। মনের চমকের সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি দৃষ্টিটা আমার আরও আকর্ষিত হয়। রং, চুল, চোখ সব রেণুকার মত, অথচ চেহারায় আশ্চর্য রকম আদল কালী সরকারের মত। এবং এও বুঝতে আর আমার বাকি ছিল না, রামানুজ যেই হোক, দোলগোবিন্দ সিকদার ও রামানুজ এক এবং অভিন্ন।
একটু থেমে কিরীটী একটা সিগার ধরাল-সিগারে একটা মৃদু টান দিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করে, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে একটা মিষ্টিই রয়ে গেল। কালী সরকার কেন হঠাৎ রামানুজ সম্পর্কে আমার কাছে মিথ্যে কথা বলতে গেল!
হয়তো এমনও হতে পারে, পাছে তোর মনে কোনরকম কোন কিউরিয়োসিটি রামানুজ সম্পর্কে জাগে তাই একটা মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ওর ব্যাপারটা তোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে চাপা দিতে চেয়েছিল। আমি বলি।
কথাটা যে আমারও মনে হয়নি সুব্রত তা নয়। কিন্তু কেন—কি প্রয়োজন ছিল তার? তবে সে কি তার বিপদ অ্যাপ্রিহেও করতে পেরেছিল?
হয়তো।
তাই যদি হবে তো সে সাবধান হল না কেন নিজে?
সাবধান!
হ্যাঁ, সাবধান হওয়া উচিত ছিল তার নিজের চা-পান সম্পর্কে।
কি বলতে চাস তুই কিরীটী? আমি প্রশ্ন করি।
মনে আছে নিশ্চয়ই তোদের, সেরাত্রে চা-টা রেণুকা বিশ্বাস তৈরী করে দিলেও, রামানুজ চা-টা কালী সরকারের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। হরডন বিশ্বাসের কথা থেকেই আমরা জেনেছি।
মনে আছে।
আমার মনে হয় সেই সময়ই চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয় রামানুজ।
তাহলে রেণুকা বিশ্বাস নয়? মহাতি প্রশ্নটা করে।
না, সে মিশোয়নি। আমি অবিশ্যি বুঝেছিলাম মিঃ মহান্তি-রেণুকাকে ঘিরে আপনার সন্দেহটা সবচাইতে বেশী দানা বেঁধে উঠেছিল, কিন্তু আমার তা হয়নি।
কেন?
তার কারণ রেণুকার মত এক স্ত্রীলোকের পক্ষে একজন বয়স্কি পুরুষকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। তবে হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে সে যে জড়িত সেটা তার জবানবন্দি থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানবার সঙ্গে সঙ্গে সে গিয়ে কালী সরকারের ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছিল। আসলে সে তালা দিতে চায়নি, গিয়েছিল ঘরের মধ্যে যদি কোনরকম সন্দেহজনক কিছু রামানুজ ফেলে এসে থাকে, সেটা সরিয়ে ফেলবার জন্য।
কেন?
কারণ সে ভাবতেই পারেনি, যে দেহটা তারা সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়েছে রাত্রির অন্ধকারে নির্মম ভাগ্যের ফলে সেই দেহটাই আবার নুলিয়াদের হাত দিয়ে ফেরত আসবে সমুদ্রের জল থেকে! তাই ভয় হয়েছিল তখন, যদি ব্যাপারটা হত্যা বলে কারও সন্দেহ হয় এবং পুলিস শেষ পর্যন্ত নাড়াচাড়া করে ব্যাপারটা নিয়ে, তাহলে যেন কোন প্রমাণ তারা ঘরে না পায়। চায়ের কাপটাও হয়ত সেই কারণেই সরিয়ে ফেলেছিল রেণুকা বিশ্বাস।
তারপর?
তারপর আর কি-ঘুমের ঔষধের প্রভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্চে দেখেই মধ্যরাত্রে কোন এক সময় রামানুজ গিয়ে ঘরে ঢোকে এবং নির্মমভাবে একটা চুলের রিবন গলায় ফাঁস দিয়ে নিজের জন্মদাতা বাপকে হত্যা করে মায়ের অনুরোধে। পাছে হোটেলের সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে যায়, এই ভয়েই হত্যা করাল রেণুকা কালী সরকারকে। অথচ ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস দেখ-কালী সরকার সজ্ঞানেই সে সম্পত্তি রামানুজকে দিয়ে গিয়েছিল উইল করেপাকাপোক্ত ভাবে।
রিয়ালি ইট ইজ অ্যান আইরনি অফ ফেট! মৃদুকণ্ঠে আমি বলি।
.
কিরীটীর অনুমানটা যে মিথ্যা নয়, সেটা ঐদিনই রাত্রে জানা গেল।
আমরা সকলে গিয়ে একসঙ্গে হানা দিলাম সী-সাইড হোটেলে।
রামানুজকে পুলিস দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিরীটীর পরামর্শে আগেই।
রেণুকা একটা চেয়ারে বসে হিসাব কষছিল আর হরডন একটা কান্ট্রি লিকারের বোতল নিয়ে মদ্যপান করছিল।
আমাদের দেখে ওরা অবাক!
কি ব্যাপার? এত রাত্রে মহান্তি সাহেব? রেণুকাই প্রশ্ন করে।
শুনে নিশ্চয়ই খুশি হবেন, কালী সরকারের হত্যাকারী ধরা পড়েছে মিসেস বিশ্বাস!
ধরা পড়েছে?
হ্যাঁ।
কে—কে? প্রশ্ন করে হরডন বিশ্বাস।
কালী সরকারের ছেলেই—
কি বললেন-কালী সরকারের ছেলে। সে তো বিয়েই করেনি। হরডন বলে।
সেটা অবিশ্যি সঠিক বলতে পারবেন কালীর ছেলের গর্ভধারিণী। রেণুকার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলে কিরীটী।
কালীর ছেলের গর্ভধারিণী—but who-কে?
রেণুকা–আপনার স্ত্রী।
What! চিৎকার করে ওঠে হরডন বিশ্বাস।
সত্যি কি মিথ্যা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিঃ বিশ্বাস।
সত্যি? বাঘের মত ঘুরে দাঁড়ায় হরডন রেণুকার দিকে–দুচোখে অগ্নিঝরা দৃষ্টি।
রেণুকা স্থির, বোবাযেন পাথর।
চুপ করে আছিস কেন হারামজাদী, বল–জবাব দে?
রেণুকা তথাপি নিপ।
হঠাৎ হরডন বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল রেণুকার উপরে-কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার করে নেতিয়ে পড়ল।
রেণুকা বিশ্বাস ছুরি বসিয়ে দিয়েছে হরডনের পেটে।
রক্তাক্ত ভূলুণ্ঠিত হরডনের দেহটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল রেণুকা।