[মান্দ্রাজে প্রদত্ত বক্তৃতা]
ভারতীয় মহাপুরুষগণের কথা বলিতে গিয়া আমার মনে সেই প্রাচীনকালের কথা উদিত হইতেছে, ইতিহাস যে-কালের কোন ঘটনার উল্লেখ করে না এবং ঐতিহ্য যে সুদূর অতীতের ঘনান্ধকার হইতে রহস্য-উদ্ঘাটনের বৃথা চেষ্টা করিয়া থাকে। ভারতে অসংখ্য মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন—বাস্তবিক হিন্দুজাতি সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ অসংখ্য মহাপুরুষের জন্ম দেওয়া ব্যতীত আর কি করিয়াছে? সুতরাং তাঁহাদের মধ্যে কয়েকজন যুগপ্রবর্তক শ্রেষ্ঠ আচার্যের কথা অর্থাৎ তাঁহাদের চরিত্র আলোচনা করিয়া যতটুকু বুঝিয়াছি, তাহাই তোমাদের নিকট বলিব।
প্রথমতঃ আমাদের শাস্ত্র সম্বন্ধেই আমাদের কিছু বুঝা আবশ্যক। আমাদের শাস্ত্রে দ্বিবিদ সত্য উপদিষ্ট হইয়াছে। প্রথমটি সনাতন সত্য; দ্বিতীয়টি প্রথমোক্তের ন্যায় ততদূর প্রামাণিক না হইলেও বিশেষ দেশকালপাত্রে প্রযোজ্য। সনাতন সত্য —জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ এবং উহাদের পরস্পর সম্বন্ধের বিষয় শ্রুতি বা বেদে লিপিবদ্ধ আছে। দ্বিতীয় প্রকার সত্য—স্মৃতি, মনু যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি সংহিতায় এবং পুরাণে ও তন্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে। এগুলির প্রামাণ্য শ্রুতির অধীন, কারণ স্মৃতি যদি শ্রুতির বিরোধী হয়, তবে শ্রুতিকেই সে স্থলে মানিতে হইবে। ইহাই শাস্ত্র-বিধান। তাৎপর্য এই যে, শ্রুতিতে জীবাত্মার নিয়তি ও তাঁহার চরমলক্ষ্য-বিষয়ক মুখ্য তত্ত্বসমূহের বিশদ বর্ণনা আছে, কেবল গৌণ বিষয়গুলি—যেগুলি উহাদের বিস্তার, সেগুলিই বিশেষভাবে বর্ণনা করা স্মৃতি ও পুরাণের কার্য। সাধারণভাবে উপদেশ দিতে শ্রুতিই পর্যাপ্ত; ধর্মজীবন-যাপনের সারতত্ত্ব সম্বন্ধে শ্রুতিনির্দিষ্ট উপদেশের বেশী আর কিছু বলা যাইতে পারে না, আর কিছু জানিবারও নাই। এ-বিষয় যাহা কিছু প্রয়োজন, সবই শ্রুতিতে আছে; জীবাত্মার সিদ্ধিলাভের জন্য যে-সকল উপদেশের প্রয়োজন, শ্রুতিতে সেগুলি সবই কথিত হইয়াছে। কেবল বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিধান শ্রুতিতে নাই; স্মৃতি বিভিন্ন সময়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা দিয়া গিয়াছেন। শ্রুতির আর একটি বিশেষত্ব আছে। যে-সকল ঋষি শ্রুতিতে বিভিন্ন সত্য ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশী, তবে কয়েকজন নারীরও উল্লেখ পাওয়া যায়; তাঁহাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে, যথা তাঁহাদের জন্মের সন-তারিখ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমরা অতি সামান্যই জানিতে পারি; কিন্তু তাঁহাদের সর্বোৎকৃষ্ট চিন্তা—তাঁহাদের শ্রেষ্ঠ আবিষ্ক্রিয়া বলিলেই ভাল হয়—আমাদের দেশের ধর্মসাহিত্যরূপে বেদে লিপিবদ্ধ ও রক্ষিত আছে। স্মৃতিতে কিন্তু মহাপুরুষগণের জীবনী ও কার্যকলাপই বিশেষভাবে দেখিতে পাওয়া যায়। ইঙ্গিতমাত্রে সমগ্র জগতকে নাড়া দিতে পারেন, এমন অদ্ভুত মহাশক্তিশালী মনোহরচরিত্র মহাপুরুষগণের পরিচয় পুরাণ বা স্মৃতিতেই আমরা সর্বপ্রথম পাইয়া থাকি—তাঁহাদের চরিত্র এত উন্নত যে, তাঁহাদের উপদেশাবলীও যেন উহার নিকট সামান্য বলিয়া বোধ হয়।
আমাদের ধর্মের এই বিশেষত্ত্বটি আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, আমাদের ধর্মে যে-ঈশ্বরের উপদেশ আছে, তিনি নির্গুণ অথচ সগুণ। উহাতে ব্যক্তিভাবরহিত অনন্ত সনাতন তত্ত্বসমূহের সঙ্গে অসংখ্য ব্যক্তিভাবাপন্ন অবতারের কথা প্রচারিত হইয়াছে। কিন্তু শ্রুতি বা বেদই আমাদের ধর্মের মূল—উহাতে কেবল সনাতন তত্ত্বের উপদেশ; বড় বড় অবতার, আচার্য ও মহাপুরুষগণের বিষয় সবই স্মৃতি ও পুরাণে রহিয়াছে। ইহাও লক্ষ্য করিও যে, কেবল আমাদের ধর্ম ছাড়া জগতের অন্যান্য সকল ধর্মই কোন বিশেষ ধর্মপ্রবর্তক বা ধর্মপ্রবর্তকগণের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। খ্রীষ্টধর্ম খ্রীষ্টের, মুসলমানধর্ম মহম্মদের, বৌদ্ধধর্ম বুদ্ধের, জৈনধর্ম জিনগণের এবং অন্যান্য ধর্ম অন্যান্য ব্যক্তিগণের জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ঐ-সকল ধর্মে ঐ মহাপুরুষগণের জীবনের তথাকথিত ঐতিহাসিক প্রমাণ লইয়া যে যথেষ্ট বিবাদ হইয়া থাকে, তাহা স্বাভাবিক। যদি কখনও এই প্রাচীন মহাপুরুষগণের অস্তিত্ববিষয়ে ঐতিহাসিক প্রমাণ দুর্বল হয়, তবে তাঁহাদের ধর্মরূপ অট্টালিকা ধসিয়া পড়িয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাইবে।
আমাদের ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত না হইয়া সনাতন তত্ত্বসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া আমরা এই বিপদ এড়াইয়াছি। কোন মহাপুরুষ, এমন কি, কোন অবতার বলিয়া গিয়াছেন বলিয়াই যে তোমরা ধর্ম মানিয়া চল, তাহা নহে। কৃষ্ণের কথায় বেদের প্রামাণ্য সিদ্ধ হয় না, কিন্তু বেদানুগত বলিয়াই কৃষ্ণবাক্যের প্রামাণ্য। কৃষ্ণের মাহাত্ম্য এই যে, বেদের যত প্রচারক হইয়াছেন, তাঁহাদার মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য অবতার ও মহাপুরুষ সম্বন্ধেও সেইরূপ বুঝিতে হইবে। আমরা গোড়াতেই এ-কথা স্বীকার করিয়া লই যে, মানুষের পূর্ণতালাভের জন্য, তাহার মুক্তির জন্য যাহা কিছু আবশ্যক, সবই বেদে কথিত হইয়াছে; নূতন কিছু আবিষ্কৃত হইতে পারে না। তোমরা কখনই সকল জ্ঞানের চরম লক্ষ্য পূর্ণ একত্বের বেশী অগ্রসর হইতে পার না। বেদ অনেক দিন পূর্বেই এই পূর্ণ একত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, আর অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। যখনই ‘তত্ত্বমসি’ আবিষ্কৃত হইল, তখনই আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পূর্ণ হইল; এই ‘তত্ত্বমসি’ বেদে রহিয়াছে। বাকী রহিল কেবল বিভিন্ন দেশ-কাল-পাত্র-অনুসারে সময়ে সময়ে লোকশিক্ষা। এই প্রাচীন সনাতন পথে জনগণকে পরিচালনা করা—ইহাই বাকী রহিল; সেইজন্যই সময়ে সময়ে বিভিন্ন মহাপুরুষ ও আচার্যগণের অভ্যুদয় হইয়া থাকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণের সেই সর্বজনবিদিত বাণীতে এই তত্ত্বটি যেমন পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে কথিত হইয়াছে, আর কোথাও তেমন হয় নাইঃ
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত |
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ||
যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই সাধুভাব রক্ষা করিবার জন্য আমি নিজেকে সৃষ্টি করিয়া থাকি; দুর্নীতি বিনষ্ট করিবার জন্য আমি সময়ে সময়ে আবির্ভূত হইয়া থাকি, ইত্যাদি।—ইহাই ভারতীয় ধারণা।
ইহা হইতে কি পাওয়া যায়? সিদ্ধান্ত এই যে, একদিকে সনাতন তত্ত্বসমূহ রহিয়াছে, ঐগুলি স্বতঃপ্রমাণ,—কোনরূপ যুক্তির উপর নির্ভর করে না, ঋষিগণ—যত বড়ই হউন বা অবতারগণ যত মহিমাসম্পন্নই হউন—তাঁহাদের বাক্যের উপরও ঐগুলি নির্ভর করে না। আমরা এখানে এ-কথা বলিতে পারি যে, ভারতীয় চিন্তার এই বিশেষত্ব আছে বলিয়া আমরা বেদান্তকেই একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম বলিয়া দাবী করিতে পারি, বেদান্তই জগতের একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম; কারণ উহা কোন ব্যক্তিবিশেষের মতকে প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করিতে উপদেশ দেয় না, উহা কেবল সনাতন তত্ত্বসমূহই শিক্ষা দিয়া থাকে; ব্যক্তিবিশেষের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত কোন ধর্ম সমগ্র মানবজাতি কখনও গ্রহণ করিতে পারে না। আমাদের দেশেই আমরা দেখিতে পাই, এখানে কত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন! একটা ক্ষুদ্র শহরেই দেখিতে পাই, বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মহাপুরুষকে নিজেদের আদর্শ করিয়া থাকে। সুতরাং মহম্মদ, বুদ্ধ বা খ্রীষ্ট—এরূপ কোন এক ব্যক্তি কিভাবে সমগ্র জগতের একমাত্র আদর্শস্বরূপ হইতে পারেন? অথবা সেই এক ব্যক্তির বাক্যপ্রমাণেই বা সমগ্র নীতিবিদ্যা, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও ধর্মকে সত্য বলিয়া কিরূপে স্বীকার করা যায়? বৈদান্তিক ধর্মে এরূপ কোন ব্যক্তিবিশেষের বাক্যকে প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিবার আবশ্যক হয় না। মানবের সনাতন প্রকৃতিই ইহার প্রমাণ; ইহার নীতিতত্ত্ব মানবজাতির সনাতন আধ্যাত্মিক একত্বরূপ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত; এই একত্ব চেষ্টা করিয়া লাভ করিবার নয়, উহা পূর্ব হইতেই লব্ধ।
অন্যদিকে আবার আমাদের ঋষিগণ অতি প্রাচীন কাল হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, জগতের অধিকাংশ লোকই কোন না কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর না করিয়া থাকিতে পারে না। লোকের কোন না কোন আকারে একটি ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর চাই। যে বুদ্ধদেব ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রচার করিয়া গেলেন, তাঁহার দেহত্যাগের পর পঞ্চাশ বৎসর যাইতে না যাইতে তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকেই ‘ঈশ্বর’ করিয়া তুলিল। ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে। আমরা জানি, ঈশ্বরের বৃথা কল্পনা অপেক্ষা—অধিকাংশ স্থলেই এইরূপ কাল্পনিক ঈশ্বর মানবের উপাসনার অযোগ্য—মহত্তর জীবন্ত ঈশ্বরসকল এই পৃথিবীতে সময়ে সময়ে আমাদের মধ্যেই আবির্ভূত হইয়া বাস করিয়া থাকেন। কোনরূপ কাল্পনিক ঈশ্বর অপেক্ষা—আমাদের কল্পনাসৃষ্ট কোন বস্তু অপেক্ষা অর্থাৎ আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে যতটা ধারণা করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা তাঁহারা অধিকতর পূজ্য। ঈশ্বর সম্বন্ধে তুমি আমি যতটা ধারণা করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণ অনেক বড়। আমরা আমাদের মনে যতদূর উচ্চ আদর্শের চিন্তা করিতে পারি, বুদ্ধ তদপেক্ষা উচ্চতর আদর্শ—জীবন্ত আদর্শ। সেই জন্যই সর্বপ্রকার কাল্পনিক দেবতাকেও অতিক্রম করিয়া তাঁহারা চিরকাল মানবের পূজা পাইয়া আসিতেছেন। আমাদের ঋষিগণ ইহা জানিতেন, সেইজন্য তাঁহারা সকল ভারতবাসীর জন্য এই মহাপুরুষ-উপাসনার—এই অবতার-পূজার পথ খুলিয়া দিয়া গিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, যিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ অবতার, তিনি আর একটু অগ্রসর হইয়া বলিয়া গিয়াছেনঃ
যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা |
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্ ||১৫
মানুষের মধ্যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হয়, জানিও আমি সেখানে বর্তমান; আমা হইতেই এই আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ হইয়া থাকে।
ইহা দ্বারা হিন্দুগণের পক্ষে সকল দেশের সকল অবতারকে উপাসনা করিবার দ্বার খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। হিন্দু যে-কোন দেশের যে-কোন সাধু-মহাত্মার পূজা করিতে পারে। কার্যতও দেখিতে পাই, আমরা অনেক সময় খ্রীষ্টানদের চার্চে ও মুসলমানদের মসজিদে গিয়া উপাসনা করিয়া থাকি। ইহা ভালই বলিতে হইবে। কেন আমরা এভাবে উপাসনা করিব না? আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের ধর্ম সার্বভৌম। উহা এত উদার, এত প্রশস্ত যে সর্বপ্রকার আদর্শকেই উহা সাদরে গ্রহণ করিতে পারে; জগতে যতপ্রকার ধর্মের আদর্শ আছে, সেগুলিকে এখনই গ্রহণ করা যাইতে পারে, আর ভবিষ্যতে যে-সকল বিভিন্ন আদর্শ আসিবে, সেগুলির জন্য আমরা ধৈর্যের সহিত অপেক্ষা করিতে পারি। ঐগুলিকে ঐভাবে গ্রহণ করিতে হইবে, বৈদান্তিক ধর্মই তাহার অনন্ত বাহু প্রসারিত করিয়া সবগুলিকে আলিঙ্গন করিয়া লইবে।
ঈশ্বরাবতার-সম্বন্ধে আমাদের মোটামুটি ধারণা এই। দ্বিতীয় শ্রেণীর আর এক প্রকার মহাপুরুষ আছেন; বেদে ‘ঋষি’ শব্দের পুনঃপুনঃ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, আর আজকাল ইহা একটি চলিত শব্দ হইয়া পড়িয়াছে,—ঋষিবাক্যের বিশেষ প্রামাণ্য। আমাদিগকে ইহার তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। ‘ঋষি’ শব্দের অর্থ মন্ত্রদ্রষ্টা অর্থাৎ যিনি কোন তত্ত্ব ‘দর্শন’ করিয়াছেন। অতি প্রাচীন কাল হইতেই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছিলঃ ধর্মের প্রমাণ কি? বহিরিন্দ্রিয় দ্বারা ধর্মের সত্যতা প্রমাণিত হয় না—ইহা অতি প্রাচীন কাল হইতেই ঋষিগণ বলিয়া গিয়াছেনঃ ‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’১৬—মনের সহিত বাক্যও যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে। ‘ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্ গচ্ছতি নো মনঃ ||১৭—সেখানে চক্ষু যাইতে পারে না, বাক্যও যাইতে পারে না, মনও নহে।
শত শত যুগ ধরিয়া ইহাই ঋষিদের ঘোষণা। বাহ্য প্রকৃতি আত্মার অস্তিত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, অনন্ত জীবন, মানবের চরম লক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। এই মনের সর্বদা পরিণাম হইতেছে, সর্বদাই যেন উহার প্রবাহ চলিয়াছে, উহা সসীম, উহা যেন খণ্ড খণ্ড ভাবে ভাঙিয়া চুরিয়া যায়। উহা কিরূপে সেই অনন্ত অপরিবর্তনীয় অখণ্ড অবিভাজ্য সনাতন বস্তুর সংবাদ দিবে?—কখনই দিতে পারে না। আর যখনই মানবজাতি চৈতন্যহীন জড়বস্তু হইতে এই-সকল প্রশ্নের উত্তর পাইতে বৃথা চেষ্টা করিয়াছে, ইতিহাসই জানে—তাহার ফল কতখানি অশুভ হইয়াছে। তবে ঐ বেদোক্ত জ্ঞান কোথা হইতে আসিল? ঋষিত্ব প্রাপ্ত হইলে ঐ জ্ঞানলাভ হয়,—ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয় না। ইন্দ্রিয়জ্ঞানই কি মানুষের সর্বস্ব? কে ইহা বলিতে সাহস করে? আমাদের জীবনে—আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসে, হয়তো আমাদের সম্মুখেই আমাদের কোন প্রিয়জনের মৃত্যু হইল বা আমরা অন্য কোনরূপে আঘাত পাইলাম, অথবা অতিশয় আনন্দের কিছু ঘটিল; এই-সব অবস্থায় সময়ে সময়ে মন যেন একেবারে স্থির হইয়া যায়। অনেক সময়ে এমনও ঘটে যে, মনটা শান্ত হইয়া যায়, বহির্জগতে অনাসক্ত হইয়া ভিতরে প্রবেশ করে, ক্ষণকালের জন্য অনন্তের একটু আভাস তখন আমাদের চোখে প্রকাশিত হয়; মন বা বাক্য—কিছুই সেখানে যাইতে পারে না। সাধারণ লোকের জীবনেই এইরূপ ঘটিয়া থাকে; অভ্যাসের দ্বারা এই অবস্থাকে প্রগাঢ়, স্থায়ী, পরিপূর্ণ ও নিখুঁত করিতে হইবে। মানুষ শত শত যুগ পূর্বে আবিষ্কার করিয়াছে—আত্মা ইন্দ্রিয় দ্বারা বদ্ধ বা সীমিত নহে, এমন কি চেতনা দ্বারাও নহে। আমাদের বুঝিতে হইবে যে, চেতনা সেই অনন্ত শৃঙ্খলের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম মাত্র। চেতনা সত্তার সহিত অভিন্ন নহে, উহা সত্তার একটি অংশ মাত্র। ঋষিগণ ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের অতীত ভূমিতে নির্ভীকভাবে আত্মানুসন্ধান করিয়াছেন। চেতনা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ। আধ্যাত্মিক জগতের সত্য লাভ করিতে হইলে মানুষকে ইন্দ্রিয়ের বহিরে যাইতেই হইবে। আর এখনও এমন সব লোক আছেন, যাঁহারা পঞ্চেন্দ্রিয়ের বাহিরে যাইতে সমর্থ। ইঁহাদিগকেই ঋষি বলে, কারণ ইঁহারা আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ সাক্ষাৎ করিয়া থাকেন। সুতরাং আমার সম্মুখস্থ এই টেবিলটিকে আমি যেমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা জানিয়া থাকি, বেদনিহিত সত্যসমূহের প্রমাণও সেইরূপ প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত। টেবিলটিকে আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করিয়া থাকি, আর আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ জীবাত্মার অতিচেতন অবস্থায় প্রত্যক্ষ অনুভূত হইয়া থাকে। এই ঋষিত্ব-লাভ দেশ-কাল-লিঙ্গ বা জাতিবিশেষের উপর নির্ভর করে না। বাৎস্যায়ন অকুতোভয়ে বলিয়াছেন যে, এই ঋষিত্ব বংশধরগণের, আর্য-অনার্য—এমন কি ম্লেচ্ছদেরও সাধারণ সম্পত্তি।
বেদের ঋষিত্ব বলিতে ইহাই বুঝায়; আমাদিগকে ভারতীয় ধর্মের এই আদর্শ সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, আর আমি ইচ্ছা করি যে, জগতের অন্যান্য জাতিও এই আদর্শটি স্মরণ রাখিবেন, তাহা হইলেই বিভিন্ন ধর্মে বিবাদ-বিসংবাদ কমিয়া যাইবে। শাস্ত্রপাঠ করিলেই ধর্ম লাভ হয় না; বা মতমতান্তর ও বচন দ্বারা, এমন কি যুক্তিতর্ক-বিচার দ্বারাও ধর্মলাভ হয় না। ধর্ম সাক্ষাৎ করিতে হইবে—ঋষি হইতে হইবে। বন্ধুগণ, যতদিন না তোমাদের প্রত্যেকেই ঋষি হইতেছ, যতদিন না আধ্যাত্মিক সত্য সাক্ষাৎ করিতেছ, ততদিন তোমাদের ধর্মজীবন আরম্ভ হয় নাই, জানিবে। যতদিন না অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বার খুলিয়া যায়, ততদিন তোমাদের পক্ষে ধর্ম কেবল কথার কথা মাত্র, ততদিন কেবল ধর্মলাভের জন্য প্রস্তুত হইতেছ মাত্র, ততদিন পরোক্ষ বিবরণ দিতেছ মাত্র।
এক সময়ে বুদ্ধদেবের সহিত কতকগুলি ব্রাহ্মণের তর্ক হইয়াছিল। সেই সময়ে তিনি একটি অতি সুন্দর কথা বলিয়াছিলেন, তাহা এখানে বেশ খাটে। ব্রাহ্মণেরা বুদ্ধদেবের নিকট ব্রহ্মের স্বরূপ আলোচনা করিতে আসেন। সেই মহাপুরুষ তাঁহাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন?’ ব্রাহ্মণ বলিলেন, ‘না, দেখি নাই।’ বুদ্ধদেব আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার পিতা?’ ‘না, তিনিও দেখেন নাই।’ ‘আপনার পিতামহ?’ ‘বোধ হয়, তিনিও দেখেন নাই।’ তখন বুদ্ধ বলিলেন, ‘বন্ধু, আপনার পিতৃ-পিতামহগণও যাঁহাকে দেখেন নাই, এমন পুরুষ সম্বন্ধে আপনি কিরূপে বিচার দ্বারা অন্যকে পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন?’ পৃথিবীর সকলে এইরূপই করিতেছে। বেদান্তের ভাষায় আমাদিগকেও বলিতে হইবেঃ ‘নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।’১৮ বাগাড়ম্বর দ্বারা সেই আত্মাকে লাভ করা যায় না, মেধা দ্বারাও তাঁহাকে লাভ করা যায় না, এমন কি, বেদপাঠের দ্বারাও নয়।
পৃথিবীর সকল জাতিকে লক্ষ্য করিয়া বেদের ভাষায় আমাদিগকে বলিতে হইবেঃ তোমাদের বাদ-বিসংবাদ বৃথা; তোমরা যে-ঈশ্বরকে প্রচার করিতে চাও, তাঁহাকে দেখিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক, তবে বৃথাই তোমার প্রচার; তুমি কি বলিতেছ, তাহাই তুমি জান না; আর যদি ঈশ্বরকে দেখিয়া থাক, তবে তুমি আর বিবাদ করিবে না, তোমার মুখই উজ্জ্বল রূপ ধারণ করিবে।
এক প্রাচীন ঋষি তাঁহার পুত্রকে ব্রহ্মজ্ঞানলাভের জন্য গুরুগৃহে প্রেরণ করেন। সে যখন ফিরিল, পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি শিখিয়াছ?’ পুত্র বলিল, সে নানা বিদ্যা শিখিয়াছে। পিতা বলিলেন, ‘কিছুই শেখ নাই; আবার গুরুগৃহে যাও।’ পুত্র আবার গুরুগৃহে গেল; ফিরিয়া আসিলে পিতা পূর্ববৎ প্রশ্ন করিলেন। পুত্রও পূর্ববৎ উত্তর দিল। তাহাকে আর একবার গুরুগৃহে যাইতে হইল। এবার যখন সে ফিরিল, তখন তাহার সমগ্র মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময় হইয়া গিয়াছে। তখন পিতা বলিলেন,১৯ ‘বৎস, আজ তোমার মুখমণ্ডল ব্রহ্মবিদের ন্যায় উদ্ভাসিত দেখিতেছি।’ যখন তুমি ঈশ্বরকে জানিবে, তখন তোমার মুখ, তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার সমগ্র আকৃতিই পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। তখন তুমি মানবজাতির নিকট মহাকল্যাণস্বরূপ হইবে, কেহই তোমাকে বাধা দিতে পারিবে না। ইহাই ঋষিত্ব এবং ইহাই আমাদের ধর্মের আদর্শ। অবশিষ্ট যাহা কিছু—পরস্পর কথাবার্তা, যুক্তি-বিচার, দর্শন, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, এমন কি বেদ পর্যন্ত—এই ঋষিত্বলাভের প্রস্তুতি মাত্র, ও-গুলি গৌণ। ঋষিত্বলাভই মুখ্য। বেদ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষাদি—সবই গৌণ। ‘তাহাই পরা বিদ্যা, যাহা দ্বারা আমরা সেই অক্ষর পুরুষকে জানিতে পারি।’ যাঁহারা এই তত্ত্ব সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন, তাঁহারাই বৈদিক ঋষি। ঋষি-অর্থে আমরা এক শ্রেণীর বিশেষ-অবস্থাপন্ন ব্যক্তিকে বুঝিয়া থাকি। যথার্থ হিন্দু হইতে গেলে আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের কোন এক অবস্থায় এই ঋষিত্বলাভ করিতে হইবে, আর ঋষিত্বলাভই হিন্দুর নিকট মুক্তি। কতকগুলি মতবাদে বিশ্বাস, সহস্র সহস্র মন্দির দর্শন বা পৃথিবীতে যত নদী আছে সবগুলিতে স্নান করিলে হিন্দুমতে মুক্তি হইবে না। ঋষি হইলে—মন্ত্রদ্রষ্টা হইলে তবেই মুক্তিলাভ হইবে।
পরবর্তী সময়ের কথা আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই, তখন সমগ্র জগৎ-আলোড়নকারী মহাপুরুষগণ—শ্রেষ্ঠ অবতারগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। অবতারের সংখ্যা অনেক। ভাগবতের মতে অবতার অসংখ্য; তন্মধ্যে রাম ও কৃষ্ণই ভারতে বিশেষভাবে পূজিত হইয়া থাকেন। এই প্রাচীন বীরযুগের আদর্শ—সত্যপরায়ণতা ও নীতির সাকার মূর্তি, আদর্শ তনয়, আদর্শ পতি, আদর্শ পিতা, সর্বোপরি আদর্শ রাজা রামচন্দ্রের চরিত্র অঙ্কন করিয়া মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের সম্মুখে স্থাপন করিয়াছেন। এই মহাকবি যে-ভাষায় রামচরিত্র বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা শুদ্ধ, মধুর, অথচ সহজ সরল ভাষা আর হইতে পারে না। আর সীতার কথা কি বলিব! তোমরা জগতের সমগ্র প্রাচীন সাহিত্য অধ্যয়ন করিয়া নিঃশেষ করিতে পার, জগতের ভাবী সাহিত্যসমূহও নিঃশেষ করিতে পার, কিন্তু তোমাদিগকে নিঃসংশয়ে বলিতে পারি যে, আর একটি সীতার চরিত্র বাহির করিতে পারিবে না। সীতাচরিত্র অসাধারণ; ঐ চরিত্র একবারই চিত্রিত হইয়াছে, আর কখনও হয় নাই, হইবেও না। রাম হয়তো কয়েকটি হইয়াছেন, কিন্তু সীতা আর হন নাই। ভারতীয় নারীগণের যেরূপ হওয়া উচিত, সীতা তাহার আদর্শ; নারীচরিত্রের যত প্রকার ভারতীয় আদর্শ আছে, সবই এক সীতাচরিত্র হইতেই উদ্ভূত; আর সমগ্র আর্যাবর্তে এই সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার পূজা পাইয়া আসিতেছেন। মহামহিমময়ী সীতা—সাক্ষাৎ পবিত্রতা অপেক্ষাও পবিত্রতরা, সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত আদর্শ সীতা চিরকালই এইরূপ পূজা পাইবেন। যিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রদর্শন না করিয়া সেই মহাদুঃখের জীবন যাপন করিয়াছিলেন, সেই নিত্যসাধ্বী নিত্যবিশুদ্ধস্বভাবা আদর্শ পত্নী সীতা, সেই নরলোকের—এমন কি দেবলোকের পর্যন্ত আদর্শস্বরূপা মহীয়সী সীতা চিরদিনই আমাদের জাতীয় দেবতারূপে বর্তমান থাকিবেন। আমরা সকলেই তাঁহার চরিত্র বিশেষরূপে জানি, সুতরাং উহার বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন নাই। আমাদের সব পুরাণ নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, এমন কি আমাদের বেদ পর্যন্ত লোপ পাইতে পারে, আমাদের সংস্কৃত ভাষা পর্যন্ত চিরদিনের জন্য কালস্রোতে বিলুপ্ত হইতে পারে, কিন্তু অবহিত হইয়া শ্রবণ কর, যতদিন ভারতে অতি অমার্জিত গ্রাম্যভাষাভাষী পাঁচজন হিন্দুও থাকিবে, ততদিন সীতার উপাখ্যান থাকিবে। সীতা আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় মিশিয়া গিয়াছেন, প্রত্যেক হিন্দু নরনারীর শোণিতে সীতা বিরাজমানা। আমরা সকলেই সীতার সন্তান। আমাদের নারীগণকে আধুনিকভাবে গড়িয়া তুলিবার যে-সকল চেষ্টা হইতেছে, সেগুলির মধ্যে যদি সীতা-চরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। আর প্রত্যহই আমরা ইহার দৃষ্টান্ত দেখিতেছি। ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই ভারতীয় নারীর উন্নতির একমাত্র পথ।
অতঃপর তাঁহার কথা আলোচনা করা যাউক, যিনি নানাভাবে পূজিত হইয়া থাকেন, যিনি আবালবৃদ্ধবনিতা ভারতবাসী—সকলেরই পরমপ্রিয় ইষ্টদেবতা। আমি তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াই এ-কথা বলিতেছি, ভাগবতকার যাঁহাকে অবতার বলিয়াই তৃপ্ত হন নাই, বলিয়াছেন, ‘এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।’২০—অন্যান্য অবতার সেই পুরুষের অংশ ও কলামাত্র, কিন্তু কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্।
যখন আমরা তাঁহার বিবিধভাবসমন্বিত চরিত্রের বিষয় আলোচনা করি, তখন তাঁহার প্রতি এরূপ বিশেষণ প্রযুক্ত হইয়াছে বলিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্য বোধ করি না। তিনি একাধারে অপূর্ব সন্ন্যাসী ও অদ্ভুত গৃহী ছিলেন; তাঁহার মধ্যে বিস্ময়কর রজঃশক্তির বিকাশ দেখা গিয়াছিল, অথচ তাঁহার অদ্ভুত ত্যাগ ছিল। গীতা পাঠ না করিলে কৃষ্ণচরিত্র কখনই বুঝা যাইতে পারে না; কারণ তিনি তাঁহার নিজ উপদেশের মূর্তিমান্ বিগ্রহ ছিলেন। সকল অবতারই, তাঁহারা যাহা প্রচার করিতে আসিয়াছিলেন, তাহার জীবন্ত উদাহরণস্বরূপ ছিলেন। গীতার প্রচারক শ্রীকৃষ্ণ চিরজীবন সেই ভগবদ্গীতার সাকার বিগ্রহরূপে বর্তমান ছিলেন—তিনি অনাসক্তির মহৎ দৃষ্টান্ত। তিনি অনেককে রাজা করিলেন, কিন্তু স্বয়ং সিংহাসনে আরোহণ করিলেন না; যিনি সমগ্র ভারতের নেতা—যাঁহার বাক্যে রাজগণ নিজ নিজ সিংহাসন ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, তিনি স্বয়ং রাজা হইতে ইচ্ছা করেন নাই। বাল্যকালে যিনি সরলভাবে গোপীদের সহিত ক্রীড়া করিতেন, জীবনের সকল অবস্থাতেই তিনি সেই সরল সুন্দর শ্রীকৃষ্ণ।
তাঁহার জীবনের সেই চিরস্মরণীয় অধ্যায়ের কথা মনে পড়িতেছে, যাহা অতি দুর্বোধ্য। যতক্ষণ না কেহ পূর্ণ ব্রহ্মচারী ও পবিত্রস্বভাব হইতেছে, ততক্ষণ তাহা বুঝিবার চেষ্টা করা উচিত নয়। সেই প্রেমের অপূর্ব বিকাশের কথা মনে পড়িতেছে, যাহা সেই বৃন্দাবনের মধুর লীলায় রূপকভাবে বর্ণিত হইয়াছে; প্রেমমদিরা-পানে যে একেবারে উন্মত্ত হইয়াছে, সে ব্যতীত আর কেহ তাহা বুঝিতে পারে না। কে গোপীদের প্রেম-জনিত বিরহযন্ত্রণার ভাব বুঝিতে সমর্থ যে-প্রেম প্রেমের চরম আদর্শ, যে-প্রেম আর কিছু চাহে না, যে-প্রেম স্বর্গ পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষা করে না, যে-প্রেম ইহলোক-পরলোকের কোন বস্তু কামনা করে না! হে বন্ধুগণ, এই গোপীপ্রেম দ্বারাই সগুণ ও নির্গুণ ঈশ্বর সম্বন্ধে বিরোধের একমাত্র মীমাংসা হইয়াছে। আমরা জানি, মানুষ সগুণ ঈশ্বর হইতে উচ্চতর ধারণা করিতে পারে না। আমরা ইহাও জানি, দার্শনিক দৃষ্টিতে সমগ্র জগদ্ব্যাপী ঈশ্বরে—সমগ্র জগৎ যাঁহার বিকাশ, সেই নির্গুণ ঈশ্বরে বিশ্বাসই স্বাভাবিক। এদিকে আমাদের প্রাণ একটা সাকার বস্তু চায়—এমন বস্তু চায়, যাহা আমরা ধরিতে পারি, যাঁহার পাদপদ্মে প্রাণ ঢালিয়া দিতে পারি। সুতরাং সগুণ ঈশ্বরই মানব-মনের সর্ব্বোচ্চ ধারণা। কিন্তু যুক্তি এই ধারণায় সন্তুষ্ট হইতে পারে না। ইহাই সেই অতি প্রাচীন, প্রাচীনতম সমস্যা—যাহা ব্রহ্মসূত্রে বিচারিত হইয়াছে, যাহা লইয়া বনবাসকালে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সহিত বিচার করিয়াছিলেনঃ যদি একজন সগুণ, সম্পূর্ণ দয়াময়, সর্ব্বশক্তিমান্ ঈশ্বর থাকেন, তবে এই নরককুণ্ড—সংসারের অস্তিত্ব কেন? কেন তিনি ইহা সৃষ্টি করিলেন? তাঁহাকে একজন মহাপক্ষপাতী ঈশ্বর বলিতে হইবে। এই সমস্যার কোনরূপ মীমাংসাই হয় নাই; কেবল গোপীপ্রেম সম্বন্ধে শাস্ত্রে যাহা পড়িয়া থাক, তাহাতেই ইহার মীমাংসা হইয়াছে। গোপীরা কৃষ্ণের প্রতি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করিতে চাহিত না; তিনি যে সৃষ্টিকর্তা, তিনি যে সর্বশক্তিমান্—তাহাও তাহারা জানিতে চাহিত না। তাহারা কেবল বুঝিত—তিনি প্রেমময়; ইহাই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট। গোপীরা কৃষ্ণকে কেবল বৃন্দাবনের কৃষ্ণ বলিয়া বুঝিত। সেই বহু সেনাবাহিনীর নেতা রাজাধিরাজ কৃষ্ণ তাহাদের নিকট বরাবর সেই রাখালবালকই ছিলেন।
‘ন ধনং ন জনং ন কবিতাং সুন্দরীং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ||’২১
হে জগদীশ, আমি ধন জন কবিতা বা সুন্দরী—কিছুই প্রার্থনা করি না; হে ঈশ্বর, জন্মে জন্মে যেন তোমার প্রতি আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে। ধর্মের ইতিহাসে ইহা এক নূতন অধ্যায়—এই অহৈতুকী ভক্তি, এই নিষ্কাম কর্ম; আর মানুষের ইতিহাসে ভারতক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ অবতার কৃষ্ণের মুখ হইতে সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব নির্গত হইয়াছে। ভয়ের ধর্ম, প্রলোভনের ধর্ম চিরদিনের জন্য চলিয়া গেল; নরকের ভীতি ও স্বর্গ-সুখের প্রলোভন সত্ত্বেও এই অহৈতুকী ভক্তি ও নিষ্কাম কর্ম-রূপ আদর্শের অভ্যুদয় হইল।
এ প্রেমের মহিমা কি আর বলিব! এইমাত্র তোমাদিগকে বলিয়াছি, গোপীপ্রেম উপলব্ধি করা বড়ই কঠিন। আমাদের মধ্যেও এমন নির্বোধের অভাব নাই, যাহারা শ্রীকৃষ্ণ-জীবনের এই অতি অপূর্ব অংশের অদ্ভুত তাৎপর্য বুঝিতে পারে না। আমি আবার বলিতেছি, আমাদেরই স্বজাতি এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নির্বোধ আছে, যাহারা গোপীপ্রেমের নাম শুনিলে উহা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভাবিয়া ভয়ে দশহাত পিছাইয়া যায়। তাহাদিগকে শুধু এইটুকু বলিতে চাই—নিজের মন আগে শুদ্ধ কর; আর তোমাদিগকে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যিনি এই অদ্ভুত গোপীপ্রেম বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি আর কেহই নহেন, তিনি সেই চিরপবিত্র ব্যাসতনয় শুক। যতদিন হৃদয়ে স্বার্থপরতা থাকে, ততদিন ভগবৎপ্রেম অসম্ভব; উহা কেবল দোকানদারি—আমি তোমাকে কিছু দিতেছি, প্রভু, তুমি আমাকে কিছু দাও। আর ভগবান্ও বলিতেছেন, যদি তুমি এরূপ না কর, তবে তুমি মরিলে পর তোমাকে দেখিয়া লইব, চিরকাল আমি তোমাকে দগ্ধ করিয়া মারিব। সকাম ব্যক্তির ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা এইরূপ। যতদিন মাথায় এই-সব ভাব থাকে, ততদিন গোপীদের প্রেমজনিত বিরহের উন্মত্ততা লোকে কি করিয়া বুঝিবে?
‘সুরতবর্ধনং শোকনাশনং স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠু চুম্বিতম্ | ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং বিতর বীর নস্তেঽধরামৃতম্ ||’২২
একবার, একবারমাত্র যদি সেই অধরের মধুর চুম্বন লাভ করা যায়! যাহাকে তুমি একবার চুম্বন করিয়াছ, চিরকাল ধরিয়া তোমার জন্য তাহার পিপাসা বাড়িতে থাকে, তাহার সকল দুঃখ চলিয়া যায়, তখন আমাদের অন্যান্য সকল বিষয়ে আসক্তি চলিয়া যায়, কেবল তুমিই তখন একমাত্র প্রীতির বস্তু হও।
প্রথমে এই কাঞ্চন, নাম-যশ, এই ক্ষুদ্র মিথ্যা সংসারের প্রতি আসক্তি ছাড় দেখি। তখনই—কেবল তখনই তোমরা গোপীপ্রেম কি তাহা বুঝিবে। উহা এত শুদ্ধ যে, সর্বত্যাগ না হইলে উহা বুঝিবার চেষ্টাই করা উচিত নয়। যতদিন পর্যন্ত না চিত্ত সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়, ততদিন উহা বুঝিবার চেষ্টা বৃথা। প্রতি মুহূর্তে যাহাদের হৃদয়ে কামকাঞ্চনযশোলিপ্সার বুদ্বুদ উঠিতেছে, তাহারাই আবার গোপীপ্রেম বুঝিতে চায় এবং উহার সমালোচনা করিতে যায়! কৃষ্ণ-অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেওয়া। এমন কি দর্শনশাস্ত্র-শিরোমণি গীতা পর্যন্ত সেই অপূর্ব প্রেমোন্মত্ততার সহিত তুলনায় দাঁড়াইতে পারে না। কারণ গীতায় সাধককে ধীরে ধীরে সেই চরম লক্ষ্য মুক্তিসাধনের উপদেশ দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু এই গোপীপ্রেমের মধ্যে ঈশ্বর-রসাস্বাদের উন্মত্ততা, ঘোর প্রেমোন্মত্ততাই বিদ্যমান; এখানে গুরু-শিষ্য, শাস্ত্র-উপদেশ, ঈশ্বর-স্বর্গ সব একাকার, ভয়ের ধর্মের চিহ্নমাত্র নাই, সব গিয়াছে— আছে কেবল প্রেমোন্মত্ততা। তখন সংসারের আর কিছু মনে থাকে না, ভক্ত তখন সংসারে কৃষ্ণ—একমাত্র সেই কৃষ্ণ ব্যতীত আর কিছুই দেখেন না, তখন তিনি সর্বপ্রাণীতে কৃষ্ণদর্শন করেন, তাঁহার নিজের মুখ পর্যন্ত তখন কৃষ্ণের মত দেখায়, তাঁহার আত্মা তখন কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত হইয়া যায়। মহানুভব কৃষ্ণের ঈদৃশ মহিমা!
কৃষ্ণজীবনের ছোটখাটো খুঁটিনাটি লইয়া সময় নষ্ট করিও না; তাঁহার জীবনের মুখ্য অংশ যাহা, তাহাই অবলম্বন কর। কৃষ্ণের জীবনচরিতে হয়তো অনেক ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্য আছে, অনেক বিষয় হয়তো প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে—এ সবই সত্য হইতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও ঐ সময়ে সমাজে যে-এক অপূর্ব নূতন ভাবের অভ্যুদয় হইয়াছিল, তাহার অবশ্যই ভিত্তি ছিল। অন্য যে-কোন মহাপুরুষের জীবন আলোচনা করিলেই দেখিতে পাই যে, তিনি তাঁহার পূর্ববর্তী কতকগুলি ভাবের প্রতিধ্বনিমাত্র; আমরা দেখিতে পাই, তিনি তাঁহার নিজ দেশে, এমন কি সেই সময়ে যে-সকল ভাব প্রচলিত ছিল, শুধু সেগুলিই প্রচার করিয়া গিয়াছেন। এমন কি, সেই মহাপুরুষ আদৌ ছিলেন কিনা, সে-সম্বন্ধেই গুরুতর সন্দেহ থাকিতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণের উপদেশ বলিয়া কথিত এই নিষ্কাম কর্ম ও নিষ্কাম প্রেমতত্ত্ব জগতে অভিনব মৌলিক ভাব নহে—ইহা প্রমাণ কর দেখি। যদি না পার, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, কোন এক ব্যক্তি নিশ্চয়ই এই তত্ত্বগুলি উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। ঐ তত্ত্বগুলি অপর কোন ব্যক্তির নিকট হইতে গৃহীত বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না। কারণ কৃষ্ণের আবির্ভাবকালে আকাশে বাতাসে ঐ তত্ত্ব ভাসিতেছিল বলিয়া জানা যায় না। ভগবান্ কৃষ্ণই ইহার প্রথম প্রচারক, তাঁহার শিষ্য বেদব্যাস ঐ তত্ত্ব জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিলেন। মানবভাষায় এরূপ শ্রেষ্ঠ আদর্শ আর কখনও চিত্রিত হয় নাই। আমরা তাঁহার গ্রন্থে গোপীজনবল্লভ সেই বৃন্দাবনের রাখালরাজ অপেক্ষা আর কোন উচ্চতর আদর্শ পাই না। যখন তোমাদের মস্তিষ্কে এই উন্মত্ততা প্রবেশ করিবে, যখন তোমরা মহাভাগা গোপীগণের ভাব বুঝিবে, তখনই তোমরা জানিতে পারিবে প্রেম কি বস্তু! যখন তোমাদের দৃষ্টিপথ হইতে সমগ্র জগৎ অন্তর্হিত হইবে, যখন তোমাদের অন্য সব চিন্তা লুপ্ত হইবে, যখন তোমরা শুদ্ধচিত্ত হইবে, যখন তোমাদের আর কোন লক্ষ্য থাকিবে না, এমন কি সত্যানুসন্ধানস্পৃহা পর্যন্ত থাকিবে না, তখনই তোমাদের হৃদয়ে সেই প্রেমোন্মত্ততার আবির্ভাব হইবে, তখনই তোমরা গোপীদের অহেতুক প্রেমের শক্তি বুঝিবে। ইহাই লক্ষ্য। যখন এই প্রেম লাভ করিলে, তখন সব পাইলে।
এইবার আমরা একটু নিম্নস্তরে নামিয়া গীতাপ্রচারক শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আলোচনা করিব। ভারতে এখন অনেকের মধ্যে একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়—সেটা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মত। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা—কৃষ্ণ গোপীদের সহিত প্রেমলীলা করিয়াছেন, এটা যেন কি এক রকম! সাহেবেরাও ইহা বড় পচ্ছন্দ করে না। অমুক পণ্ডিত এই গোপীপ্রেমটা বড় সুবিধা মনে করেন না। তবে আর কি? গোপীদের যমুনার জলে ভাসাইয়া দাও! সাহেবদের অনুমোদিত না হইলে কৃষ্ণ টেকেন কি করিয়া? টিকিতেই পারেন না! মহাভারতে দু-একটি গুরুত্বহীন স্থানে ছাড়া অন্য কোথাও গোপীদের কোন উল্লেখই নাই! যথা—দ্রৌপদীর স্তবের মধ্যে এবং শিশুপালের বক্তৃতায় বৃন্দাবন কথা আছে মাত্র!
এগুলি সব প্রক্ষিপ্ত! সাহেবেরা যাহা না চায়, সব উড়াইয়া দিতে হইবে! গোপীদের কথা, এমন কি কৃষ্ণের কথা পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত! যে-সকল ব্যক্তি এইরূপ ঘোরতর বণিক্মনোভাবাপন্ন, যাহাদের ধর্মের আদর্শ পর্যন্ত ব্যবসাদারি হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাদের সকলেরই মনোভাব এই যে, তাহারা ইহলোকে কিছু করিয়া স্বর্গে যাইবে। ব্যবসাদার চক্রবৃদ্ধি-হারে সুদ চাহিয়া থাকে, তাহারা এখানে এমন কিছু পুণ্য সঞ্চয় করিয়া যাইতে চায়, যাহার ফলে স্বর্গে গিয়া সুখভোগ করিবে! ইহাদের ধর্মপ্রণালীতে অবশ্য গোপীদের স্থান নাই।
আমরা এখন সেই আদর্শ প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণের কথা ছাড়িয়া আর একটু নামিয়া গীতাপ্রচারক শ্রীকৃষ্ণের কথা আলোচনা করিব। এখানেও আমরা দেখিতে পাই, গীতার মত বেদের ভাষ্য আর কখনও হয় নাই, হইবেও না। শ্রুতি বা উপনিষদের তাৎপর্য বুঝা বড় কঠিন; কারণ ভাষ্যকারেরা সকলেই নিজেদের মতানুযায়ী উহা ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। অবশেষে যিনি স্বয়ং শ্রুতির বক্তা, সেই ভগবান্ নিজে আসিয়া গীতার প্রচারকরূপে শ্রুতির অর্থ বুঝাইলেন, আর আজ ভারতে সেই ব্যাখ্যা-প্রণালীর যেমন প্রয়োজন—সমগ্র জগতে উহার যেমন প্রয়োজন, আর কিছুরই তেমন নহে। আশ্চর্যের বিষয় পরবর্তী শাস্ত্রব্যাখ্যাতাগণ—এমন কি গীতার ব্যাখ্যা করিতে গিয়াও অনেক সময়ে ভগবদুক্ত বাক্যের তাৎপর্য ধরিতে পারেন নাই। গীতাতে কি দেখিতে পাওয়া যায়? আধুনিক ভাষ্যকারগণের লেখাতেই বা কি দেখিতে পাওয়া যায়? একজন অদ্বৈতবাদী ভাষ্যকার কোন উপনিষদের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইলেন; শ্রুতিতে অনেক দ্বৈতভাবাত্মক বাক্য রহিয়াছে; তিনি কোনরূপে সেগুলিকে ভাঙিয়া চুরিয়া তাহা হইতে নিজের মনোমত অর্থ বাহির করিলেন। আবার দ্বৈতবাদী ভাষ্যকারও অদ্বৈতবাদাত্মক বাক্যগুলিকে ভাঙিয়া চুরিয়া দ্বৈত অর্থ করিলেন। কিন্তু গীতায় শ্রুতির তাৎপর্য এরূপ বিকৃত করিবার চেষ্টা নাই। ভগবান্ বলিতেছেন, এগুলি সব সত্য; জীবাত্মা ধীরে ধীরে স্থূল হইতে সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর সোপানে আরোহণ করিতেছেন, এইরূপে ক্রমশঃ তিনি সেই চরম লক্ষ্য অনন্ত পূর্ণস্বরূপে উপনীত হন। গীতায় এইভাবে বেদের তাৎপর্য বিবৃত হইয়াছে, এমন কি কর্মকাণ্ড পর্যন্ত গীতায় স্বীকৃত হইয়াছে, আর ইহা দেখান হইয়াছে যে, কর্মকাণ্ড—সাক্ষাৎভাবে না হইলেও গৌণভাবে মুক্তির সহায়, অতএব উহাও সত্য; মূর্তিপূজাও সত্য, সর্বপ্রকার অনুষ্ঠান ক্রিয়াকলাপও সত্য, শুধু একটি বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে—চিত্তশুদ্ধি। যদি হৃদয় শুদ্ধ ও অকপট হয়, তবেই উপাসনা সত্য হয় এবং আমাদিগকে চরম লক্ষ্যে লইয়া যায়, আর এই-সব বিভিন্ন উপাসনাপ্রণালীই সত্য, কারণ সত্য না হইলে সেগুলির সৃষ্টি হইল কেন? আধুনিক অনেক ব্যক্তির মত—বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায় কতকগুলি কপট ও দুষ্ট লোকে চালু করিয়াছে; তাহারা কিছু অর্থ-লালসায় এই-সকল ধর্ম ও সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। এ কথা একেবারে ভুল। তাঁহাদের ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে যতই যুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ হউক না কেন, উহা সত্য নহে; ঐগুলি ঐরূপে সৃষ্ট হয় নাই। জীবাত্মার স্বাভাবিক প্রয়োজনেই ঐগুলির অভ্যুদয় হইয়াছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানবের ধর্মপিপাসা চরিতার্থ করিবার জন্যই ঐগুলির অভ্যুদয় হইয়াছে, সুতরাং উহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া কোন ফল নাই। যে-দিন সেই প্রয়োজন আর থাকিবে না, সে-দিন সেই প্রয়োজনের অভাবের সঙ্গে সেগুলিও লোপ পাইবে, আর যতদিন প্রয়োজন থাকিবে, ততদিন তোমরা যতই তীব্র সমালোচনা কর না কেন, যতই ঐগুলির বিরুদ্ধে প্রচার কর না কেন, ঐগুলি অবশ্যই থাকিবে। তরবারি-বন্দুকের সাহায্যে পৃথিবী রক্তস্রোতে ভাসাইয়া দিতে পার, কিন্তু যতদিন প্রতিমার প্রয়োজন থাকিবে, ততদিন প্রতিমাপূজা থাকিবেই থাকিবে। এই বিভিন্ন অনুষ্ঠানপদ্ধতি ও ধর্মের বিভিন্ন সোপান অবশ্যই থাকিবে, আর আমরা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে বুঝিতে পারিতেছি, সেগুলির কি প্রয়োজন।
শ্রীকৃষ্ণের তিরোভাবের কিছুকাল পরেই ভারতের ইতিহাসে এক শোচনীয় অধ্যায় আরম্ভ হইল। গীতাতেই দূরাগত ধ্বনির মত সম্প্রদায়সমূহের বিরোধ-কোলাহল আমাদের কানে আসে, আর সেই সামঞ্জস্যের অদ্ভুত উপদেষ্টা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ মধ্যস্থ হইয়া বিরোধ মিটাইয়া দিতেন। তিনি বলিতেছেন, ‘ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।’—যেমন সূত্রে মণিগণ গ্রথিত থাকে, তেমনি আমাতেই সব ওতপ্রোত রহিয়াছে।
আমরা সাম্প্রদায়িক বিরোধের দূরশ্রুত অস্ফুটধ্বনি তখন হইতেই শুনিতে পাই। সম্ভবতঃ ভগবানের উপদেশে এই বিরোধ কিছুকাল মন্দীভূত হইয়া সমন্বয় ও শান্তি আসিয়াছিল; কিন্তু আবার বিরোধ বাধিল। শুধু ধর্মমত লইয়া নহে, সম্ভবতঃ জাতি লইয়া এ বিবাদ চলিয়াছিল; আমাদের সমাজের দুইটি প্রবল অঙ্গ—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হইয়াছিল; এবং সহস্র বৎসর ধরিয়া যে মহান্ তরঙ্গ সমগ্র ভারতকে প্লাবিত করিয়াছিল, তাহার সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় আমরা আর এক মহামহিমময় মূর্তি দেখিতে পাই। তিনি আর কেহ নহেন—আমাদেরই গৌতম শাক্যমুনি। আমরা তাঁহাকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া পূজা করিয়া থাকি, পৃথিবী এত বড় নির্ভীক নীতিতত্ত্বের প্রচারক আর দেখে নাই। তিনি কর্মযোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেই কৃষ্ণই যেন নিজের শিষ্যরূপে নিজ মতগুলি কার্যে পরিণত করিবার জন্য আবির্ভূত হইলেন। আবার সেই বাণী উচ্চারিত হইল, যাহা গীতায় শিক্ষা দিয়াছিলঃ স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ—এই ধর্মের অতি সামান্য অনুষ্ঠানও মহাভয় হইতে রক্ষা করে। স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেঽপি যান্তি পরাং গতিম্ —স্ত্রী, বৈশ্য, এমন কি শূদ্রগণ পর্যন্ত পরমগতি প্রাপ্ত হয়। গীতার বাক্যসমূহ—শ্রীকৃষ্ণের বজ্রগম্ভীর মহতী বাণী সকলের বন্ধন, সকলের শৃঙ্খল ভাঙিয়া ফেলিয়া দেয়, সকলেরই সেই পরমপদলাভের অধিকার ঘোষণা করে।
ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ ||
যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা এখানেই সংসার জয় করিয়াছেন। ব্রহ্ম সমভাবাপন্ন ও নির্দোষ, সুতরাং তাঁহারা ব্রহ্মেই অবস্থিত।
সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ |
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ||
পরমেশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি নিজে আর নিজেকে হিংসা করেন না, আত্মহিংসাশূন্য হইয়া পরমগতি লাভ করেন।
গীতার এই উপদেশের জীবন্ত উদাহরণরূপে—উহার এক বিন্দুও অন্ততঃ যাহাতে কার্যে পরিণত হয় এইজন্য—সেই গীতা-উপদেষ্টাই অন্যরূপে আবার মর্ত্যধামে আসিলেন। ইনিই শাক্যমুনি। ইনি দুঃখী দরিদ্রদের উপদেশ দিতে লাগিলেন, যাহাতে সর্বসাধারণের হৃদয় আকর্ষণ করিতে পারেন, সেজন্য ইনি দেবভাষা পর্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া সাধারণলোকের ভাষায় উপদেশ দিতে লাগিলেন, রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া ইনি দুঃখী দরিদ্র পতিত ভিক্ষুকদের সঙ্গে বাস করিতে লাগিলেন, দ্বিতীয় রামের মত ইনি চণ্ডালকে বক্ষে লইয়া আলিঙ্গন করিলেন।
তোমরা সকলেই তাঁহার মহান্ চরিত্র ও অদ্ভুত প্রচারকার্যের বিষয় অবগত আছ। কিন্তু এই প্রচারকার্যের মধ্যে একটা বিষম ত্রুটি ছিল, তাহার জন্য আজ পর্যন্ত আমরা ভুগিতেছি। ভগবান্ বুদ্ধের কোন দোষ নাই, তাঁহার চরিত্র পরম পবিত্র ও মহামহিমময়। দুঃখের বিষয়—বৌদ্ধধর্মপ্রচারের ফলে যে-সকল বিভিন্ন অসভ্য ও অশিক্ষিত জাতি আর্যসমাজে প্রবেশ করিতে লাগিল, তাহারা বুদ্ধদেব-প্রচারিত উচ্চ আদর্শগুলি ঠিক ঠিক গ্রহণ করিতে পারিল না। এই-সকল জাতি তাহাদের নানাবিধ কুসংস্কার এবং বীভৎস উপাসনা-পদ্ধতিগুলি সঙ্গে লইয়া দলে দলে আর্যসমাজে প্রবেশ করিতে লাগিল। কিছুদিনের জন্য বোধ হইল তাহারা যেন সভ্য হইয়াছে, কিন্তু এক শতাব্দী যাইতে না যাইতে তাহারা তাহাদের পূর্বপুরুষদের সর্প ভূত প্রভৃতির উপাসনা সমাজে চালাইতে লাগিল। এইরূপে সমগ্র ভারত কুসংস্কারের পূর্ণ লীলাক্ষেত্র হইয়া অত্যন্ত অবনত হইল। প্রথমে বৌদ্ধগণ প্রাণিহিংসা নিন্দা করিতে গিয়া বৈদিক যজ্ঞসমূহের ঘোর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিল। পূর্বে প্রত্যেক গৃহে এই-সকল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইত, গৃহকোণে যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি প্রজ্বালিত থাকিত, ইহাই ছিল উপাসনার যা-কিছু সাজসজ্জা। বৌদ্ধদের প্রচারে এই যজ্ঞগুলি লোপ পাইল, তৎপরিবর্তে বিরাট বিরাট মন্দির, জাঁকালো অনুষ্ঠানপদ্ধতি, আড়ম্বরপ্রিয় পুরোহিতদল এবং বর্তমানকালে ভারতে আর যাহা কিছু দেখিতেছ, সেইগুলির আবির্ভাব হইল। বুদ্ধ সম্বন্ধে যাঁহাদের আরও বেশী জ্ঞান থাকা উচিত ছিল, এমন কয়েকজন আধুনিক ব্যক্তির লিখিত গ্রন্থে পড়া যায়, বুদ্ধ ব্রাহ্মণদের পৌত্তলিকতা ধ্বংস করেন। উহা পড়িয়া আমি হাস্য সংবরণ করিতে পারি না। তাঁহারা জানেন না যে, বৌদ্ধধর্মই ভারতে পৌরোহিত্য ও প্রতিমাপূজার সৃষ্টি করিয়াছিল।
দু-এক বৎসর পূর্বে একজন রুশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি একখানি পুস্তক প্রকাশ করেন; তাহাতে তিনি যীশুখ্রীষ্টের একখানি অদ্ভুত জীবনচরিত পাইয়াছেন বলিয়া দাবী করিয়াছেন। তিনি সেই পুস্তকখানির একস্থলে বলিতেছেন, খ্রীষ্ট ব্রাহ্মণদের নিকট ধর্মশিক্ষার্থ জগন্নাথের মন্দিরে গমন করেন, কিন্তু তাঁহাদের সঙ্কীর্ণতা ও মূর্তিপূজায় বিরক্ত হইয়া তথা হইতে তিব্বতের লামাদের নিকট ধর্মশিক্ষার্থ গমন করেন এবং তাঁহাদের উপদেশে সিদ্ধ হইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। যাঁহারা ভারতের ইতিহাস কিছুমাত্র জানেন, তাঁহাদের নিকট পূর্বোক্ত বিবৃতি দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয় যে, পুস্তকখানি আগাগোড়া প্রতারণা। কারণ জগন্নাথ-মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধমন্দিরকে হিন্দুমন্দির করিয়া লইয়াছি। এইরূপ ব্যাপার আমাদিগকে এখনও অনেক করিতে হইবে। ইহাই জগন্নাথ- মন্দিরের ইতিহাস, আর সে-সময়ে সেখানে একজনও ব্রাহ্মণ ছিলেন না, তথাপি বলা হইতেছে—যীশুখ্রীষ্ট সেখানে ব্রাহ্মণদের নিকট উপদেশ লইবার জন্য আসিয়াছিলেন! আমাদের রুশীয় দিগ্গজ প্রত্নতাত্ত্বিক এই কথা বলিতেছেন!
পূর্বোক্ত কারণে বৌদ্ধধর্মের সর্বপ্রাণীতে দয়া, উহার উচ্চ নীতিতত্ত্ব ও নিত্য আত্মা আছে কি নাই—এই লইয়া চুলচেরা বিচারসত্ত্বেও সমগ্র বৌদ্ধধর্মের প্রাসাদ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল, আর চূর্ণ হইবার পর যে ভগ্নাবশেষ রহিল, তাহা অতি বীভৎস। বৌদ্ধধর্মের অবনতির ফলে যে বীভৎতা দেখা দিল, তাহা বর্ণনা করিবার সময় আমার নাই, প্রবৃত্তিও নাই। অতি বীভৎস অনুষ্ঠান-পদ্ধতিসমূহ, অতি ভয়ানক ও অশ্লীল গ্রন্থরাজি—যাহা মানুষের হাত দিয়া আর কখনও বাহির হয় নাই বা মানবমস্তিষ্ক যাহা আর কখনও কল্পনা করে নাই; অতি ভীষণ পাশব অনুষ্ঠানপদ্ধতিসমূহ, যেগুলি আর কখনও ধর্মের নামে চলে নাই—এ-সবই অবনত বৌদ্ধধর্মের সৃষ্টি।
কিন্তু ভারতের জীবনীশক্তি তখনও নষ্ট হয় নাই, তাই আবার ভগবানের আবির্ভাব হইল। যিনি বলিয়াছিলেন, ‘যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই আমি আসিয়া থাকি’, তিনি আবার আবির্ভূত হইলেন। এবার তাঁহার আবির্ভাব হইল দাক্ষিণাত্যে। সেই ব্রাহ্মণযুবক, যাঁহার সম্বন্ধে কথিত আছে যে, ষোড়শ বর্ষে তিনি তাঁহার সকল গ্রন্থের রচনা শেষ করিয়াছিলেন, সেই অদ্ভুত প্রতিভাশালী শঙ্করাচার্যের অভ্যুদয় হইল। এই ষোড়শবর্ষীয় বালকের রচনা আধুনিক সভ্য জগতের এক বিস্ময়! আর তিনিও ছিলেন বিস্ময়জনক! তিনি চাহিয়াছিলেন সমগ্র ভারতকে তাহার প্রাচীন পবিত্রভাবে লইয়া যাইতে; কিন্তু ভাবিয়া দেখ—এই কার্য কত কঠিন ও কত বিরাট! সে-সময়ে ভারতের অবস্থা যাহা দাঁড়াইয়াছিল, সে সম্বন্ধে তোমাদিগকে কিছু আভাস দিয়াছি। তোমরা যে-সকল বীভৎস আচারের সংস্কার করিতে অগ্রসর হইতেছ, সেগুলি সেই অধঃপতনের যুগ হইতে আসিয়াছে। তাতার বেলুচি প্রভৃতি দুর্দান্ত জাতিসকল ভারতে আসিয়া বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিয়া আমাদের সহিত মিশিয়া গেল, এবং তাহাদের জাতীয় আচারগুলিও সঙ্গে লইয়া আসিল। এইরূপে আমাদের জাতীয় জীবন অতি ভয়ানক পাশবিক আচারসমূহ দ্বারা কলুষিত হইল। উক্ত ব্রাহ্মণযুবক বৌদ্ধদের নিকট হইতে দায়স্বরূপ ইহাই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, আর সেই সময় হইতে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমগ্র ভারতে এই অবনত বৌদ্ধধর্ম হইতে বেদান্তের পুনর্বিজয় চলিতেছে, এখনও এ-কার্য চলিতেছে, এখনও উহা শেষ হয় নাই। মহান্ দার্শনিক শঙ্কর আসিয়া দেখাইলেন, বৌদ্ধধর্ম ও বেদান্তের সারাংশে বিশেষ প্রভেদ নাই। তবে বুদ্ধদেবের শিষ্যপ্রশিষ্যগণ তাঁহার উপদেশের তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া নিজেরা পতিত হয় এবং আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া নাস্তিক হইয়া পড়ে—শঙ্কর ইহাই দেখাইলেন; তখন বৌদ্ধেরা সকলেই তাহাদের প্রাচীন ধর্মে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। কিন্তু তাহারা যে-সকল অনুষ্ঠানপদ্ধতিতে অভ্যস্ত হইয়াছিল; সেগুলির কি হইবে—ইহাই এক মহাসমস্যা হইল।
তখন মহানুভব রামানুজের অভ্যুদয় হইল। শঙ্কর মহামনীষী ছিলেন বটে, কিন্তু বোধ হয় তাঁহার হৃদয় মস্তিষ্কের অনুরূপ ছিল না। রামানুজের হৃদয় শঙ্করের হৃদয় অপেক্ষা উদার ছিল। পতিতের দুঃখে তাঁহার হৃদয় কাঁদিল, তিনি তাহাদের দুঃখ মর্মে মর্মে অনুভব করিতে লাগিলেন। কালে যে-সকল নূতন নূতন অনুষ্ঠানপদ্ধতি দাঁড়াইয়াছিল, তিনি সেগুলি গ্রহণ করিয়া যথাসাধ্য সংস্কার করিলেন এবং নূতন নূতন অনুষ্ঠানপদ্ধতি, নূতন নূতন উপাসনাপ্রণালী সৃষ্টি করিয়া ঐগুলি যাহাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক, তাহাদিগকে সেগুলি উপদেশ দিতে লাগিলেন। অথচ তিনি ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল পর্যন্ত সকলের নিকট উচ্চতম আধ্যাত্মিক উপাসনার পথ উন্মুক্ত রাখিলেন। এইরূপে রামানুজের প্রচারকার্য চলিল। তাঁহার প্রচারের প্রভাব চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল, আর্যাবর্তে ঐ তরঙ্গের আঘাত লাগিল। সেখানে কয়েকজন আচার্য ঐভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া কাজ করিতে লাগিলেন; কিন্তু ইহা বহুদিন পরে—মুসলমান-শাসনকালে ঘটিয়াছিল। অপেক্ষাকৃত আধুনিক আর্যাবর্তবাসী আচার্যগণের মধ্যে চৈতন্যই শ্রেষ্ঠ।
রামানুজের সময় হইতে ধর্মপ্রচারে একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিও; তখন হইতে সর্বসাধারণের জন্য ধর্মের দ্বার খুলিয়া দেওয়া হয়। শঙ্করের পূর্ববর্তী আচার্যগণের যেমন ইহাই ছিল মূলমন্ত্র, রামানুজের পরবর্তী আচার্যগণেরও তাহাই হইল। শঙ্করকে কতকটা বর্জনশীল বলিয়া বর্ণনা করা হয়। কিন্তু তাঁহার লিখিত গ্রন্থে এমন কিছু দেখিতে পাই না, যাহাতে তাঁহার সঙ্কীর্ণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ভগবান্ বুদ্ধদেবের উপদেশাবলী যেমন তাঁহার শিষ্যপ্রশিষ্যবর্গ দ্বারা বিকৃত হইয়াছে, তেমনি শঙ্করাচার্যের উপদেশাবলীর উপর যে সঙ্কীর্ণতার দোষ আরোপিত হয়, সম্ভবতঃ তাহাতে শঙ্করের কোন দোষ নাই, তাঁহার শিষ্যদের বুঝিবার অক্ষমতার দরুনই এই দোষ শঙ্করে আরোপিত হইয়া থাকে।
আমি এখন এই উত্তরভারতের মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের বিষয় কিছু উল্লেখ করিয়া এই বক্তৃতা শেষ করিব। তিনি গোপীদের প্রেমোন্মত্ত ভাবের আদর্শ ছিলেন। চৈতন্যদেব স্বয়ং একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, তখনকার এক অতি বিচারশীল পণ্ডিতবংশে তাঁহার জন্ম হয়, তিনিও ন্যায়ের অধ্যাপক হইয়া তর্কে পণ্ডিতদের পরাস্ত করিয়া দিগ্বিজয়ী হন। বাল্যকাল হইতে তিনি শিখিয়াছিলেন, ইহাই জীবনের সর্ব্বোচ্চ আদর্শ। কোন মহাপুরুষের কৃপায় তাঁহার সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইয়া গেল; তখন তিনি বাদানুবাদ, তর্ক-ন্যায়ের অধ্যাপনা পরিত্যাগ করিলেন। পৃথিবীতে ভক্তির শ্রেষ্ঠ আচার্যদের অন্যতম প্রেমোন্মত্ত শ্রীচৈতন্য। তাঁহার ভক্তির তরঙ্গ সমগ্র বঙ্গদেশে প্লাবিত হইল, সকলের প্রাণে শান্তিবারি সিঞ্চিত হইল। তাঁহার প্রেমের কোন সীমা ছিল না। পুণ্যবান্ পাপী, হিন্দু মুসলমান, পবিত্র অপবিত্র, বেশ্যা পতিত—সকলেই তাঁহার ভালবাসার ভাগ পাইত, সকলকেই তিনি কৃপা করিতেন; যদিও তৎপ্রবর্তিত সম্প্রদায়ের অত্যন্ত অবনতি হইয়াছে, যেমন কালপ্রভাবে সকলেরই অবনতি হইয়া থাকে, তথাপি তাঁহার সম্প্রদায় দরিদ্র দুর্বল জাতিচ্যুত পতিত—সমাজে পরিত্যক্ত সকল ব্যক্তিরই আশ্রয়স্থল। কিন্তু আমাকে সত্যের অনুরোধে স্বীকার করিতে হইবে যে, দার্শনিক সম্প্রদায়সমূহেই আমরা অদ্ভুত উদার ভাব দেখিতে পাই। শঙ্করমতাবলম্বী কেহই এ কথা স্বীকার করেন না যে, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বাস্তবিক কোন ভেদ আছে। এদিকে কিন্তু জাতি-ব্যাপারে শঙ্কর অত্যন্ত বর্জনের ভাব পোষণ করিতেন। জাতিভেদের প্রশ্নে আমরা প্রত্যেক বৈষ্ণবাচার্যের উপদেশে অপূর্ব উদারতা দেখিতে পাই, কিন্তু ধর্মসম্বন্ধে তাঁহাদের মত সঙ্কীর্ণ।
শঙ্করের ছিল বিরাট মস্তিষ্ক, রামানুজ ও চৈতন্যের ছিল বিশাল হৃদয়। এখন এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাবের সময় হইয়াছিল, যাঁহার মধ্যে একাধারে এইরূপ হৃদয় ও মস্তিষ্ক থাকিবে, যিনি একাধারে শঙ্করের মহতী মেধা ও চৈতন্যের বিশাল অনন্ত হৃদয়ের অধিকারী হইবেন, যিনি দেখিবেন সকল সম্প্রদায় এক মহৎ ভাবে—ঈশ্বরের শক্তিতে অনুপ্রাণিত দেখিবেন প্রত্যেক প্রাণীতে সেই ঈশ্বর বিদ্যমান, যাঁহার হৃদয় ভারতে বা ভারতের বাহিরে দরিদ্র দুর্বল পতিত—সকলের জন্য কাঁদিবে, অথচ যাঁহার বিশাল বুদ্ধি এমন মহৎ তত্ত্বসকল উদ্ভাবন করিবে, যেগুলি ভারতে বা ভারতের বাহিরে বিরোধী সম্প্রদায়সমূহের সমন্বয়সাধন করিবে এবং এইরূপ বিস্ময়কর সমন্বয়ের দ্বারা হৃদয় ও মস্তিষ্কের সামঞ্জস্যপূর্ণ এক সার্বভৌম ধর্ম প্রকাশ করিবে। এইরূপ ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং আমি কয়েক বৎসর তাঁহার চরণতলে বসিয়া শিক্ষা পাইবার সৌভাগ্যলাভ করিয়াছিলাম।
এইরূপ এক ব্যক্তির জন্মগ্রহণ করিবার সময় হইয়াছিল—প্রয়োজন হইয়াছিল; আর অদ্ভুত ব্যাপার এই, তাঁহার সমগ্র জীবনের কার্য এমন এক শহরের নিকট অনুষ্ঠিত হয়, যে-শহর পাশ্চাত্যভাবে উন্মত্ত হইয়াছিল—ভারতের অন্যান্য শহর অপেক্ষা বেশী পরিমাণেই পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হইয়াছিল। পুঁথিগত বিদ্যা তাঁহার কিছুই ছিল না; মহামনীষাসম্পন্ন হইয়াও তিনি নিজের নাম পর্যন্ত লিখিতে পারিতেন না, কিন্তু প্রত্যেকে—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় উপাধিধারী ব্যক্তিগণ পর্যন্ত তাঁহাকে দেখিয়া একজন মহামনীষী বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। তিনি এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। সে অনেক কথা, আজ রাত্রে তোমাদিগের নিকট তাঁহার বিষয়ে কিছু বলিবার সময় নাই। সুতরাং আমাকে ভারতীয় সকল মহাপুরুষের পূর্ণপ্রকাশস্বরূপ যুগাচার্য মহাত্মা শ্রীরামকৃষ্ণের নামটুকু উল্লেখ করিয়াই আজ ক্ষান্ত হইতে হইবে—এই মহাপুরুষের উপদেশ আধুনিক যুগে আমাদের নিকট বিশেষ কল্যাণপ্রদ। ঐ ব্যক্তির ভিতর যে ঐশ্বরিক শক্তি খেলা করিত, সেটি লক্ষ্য করিও। ইনি দরিদ্রব্রাহ্মণ-সন্তান, বঙ্গদেশের অজ্ঞাত অপরিচিত কোন সুদূর পল্লীতে ইঁহার জন্ম। আজ ইওরোপ-আমেরিকায় সহস্র সহস্র ব্যক্তি সত্য-সত্যই ফুলচন্দন দিয়া তাঁহার পূজা করিতেছে এবং পরে আরও সহস্র সহস্র লোক পূজা করিবে। ঈশ্বরের ইচ্ছা কে বুঝিতে পারে? হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা যদি ইহাতে বিধাতার হাত না দেখিতে পাও, তবে তোমরা অন্ধ, নিশ্চিত জন্মান্ধ; যদি সময় আসে, যদি আর কখনও তোমাদের সহিত আলোচনা করিবার সুযোগ হয়, তবে তোমাদিগকে ইঁহার বিষয় আরও বিস্তারিতভাবে বলিব; এখন কেবল এইটুকু মাত্র বলিতে চাই, যদি আমার জীবনে একটিও যথার্থ তত্ত্ব কথা বলিয়া থাকি, তবে তাহা তাঁহার—তাঁহারই বাক্য; আর যদি এমন অনেক কথা বলিয়া থাকি, যেগুলি অসত্য—ভ্রমাত্মক, যেগুলি মানবজাতির কল্যাণকর নহে, সেগুলি সবই আমার, সেগুলির জন্য আমি—আমিই সম্পূর্ণ দায়ী।