১৩. বাই ভার্বালটি মাটির খুব কাছাকাছি

বাই ভার্বালটি মাটির খুব কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। নিচে গাঢ় ধূসর রঙের পাথর, বাতাসের ঝাঁপটায় তার উপর দিয়ে বাদামি রঙের ধুলো উড়ছে। আকাশে অশরীরী এক ধরনের আলো চারদিকে এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। বাই ভার্বালের ঘোট কন্ট্রোলঘরে নিয়ন্ত্রণ সুইচটি হালকা হাতে রিশান স্পর্শ করে আছে, তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে সানি।

একটা বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে রিশান কাত হয়ে যাওয়া বাই ভার্বালটি সোজা করে নিয়ে সানির দিকে তাকাল, শিশুটির মুখে কোনো ধরনের অনুভূতি নেই। একটা ছোট শিশু কেমন করে এত নিস্পৃহ হতে পারে রিশান ঠিক বুঝতে পারে না। সে নিচু গলায় সানিকে ডাকল, সানি

সানি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।

তুমি কী ভাবছ?

আমি?

হ্যাঁ।

সানি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তোমার কি মনে হয় আমার মাকে তুমি বাঁচাতে পারবে?

আমি জানি না সানি– তোমাকে আমি মিছিমিছি আশা দিতে চাই না। তোমার মাকে বাচানোর সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। নিক্সিরল গ্যাসটি তৈরিই করা হয়েছে গ্রুনি ধ্বংস করার জন্যে, কাজেই ব্যাপারটি খুব কঠিন।

সানি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই শিশুটির ভাবভঙ্গিতে কোনো শিশুসুলভ ব্যাপার নেই। একটি শিশু মনে হয় শুধুমাত্র আরেকটা শিশুর কাছ থেকে শিশুসুলভ ভাবভঙ্গিগুলো শেখে।

রিশান আবার নিচু গলায় ডাকল, সানি

বল।

তোমাকে মনে হয় একটা জিনিস বলা দরকার।

কী জিনিস?

তুমি যাকে তোমার মা বলে সম্বোধন করছ, সে কিন্তু সত্যিকার অর্থে তোমার মা নয়।

সানি ঝট করে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলছ?

রিশান সাবধানে বাই ভার্বালের নিয়ন্ত্রণটি আয়ত্তের মাঝে রেখে নরম গলায় বলল, তুমি রাগ হোয়ো না সানি, আমার কথা আগে শোন।

না, আমি শুনতে চাই না।

তোমাকে শুনতে হবে সানি। তুমি এই গ্রহে একা একা বেঁচে আছ কেন জান?

কেন?

কারণ তোমার মা কখনো চায়নি তুমিও তার মতো হয়ে যাও। তোমার মা চেয়েছে তুমি মানুষের মতো থেকে একদি নমানুষের পৃথিবীতে ফিরে যাও।

সানি স্থির চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল; কিন্তু কোনো কথা বলল না। রিশান নরম গলায় বলল, আমি কি ভুল বলেছি সানি?

সানি রিশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।

সানি, তোমার একটা জিনিস জানতে হবে।

কী জিনিস?

তোমার মা মারা গিয়েছে। এখন যাকে তুমি তোমার মা বলছ সে তোমার মা নয়।

সে তাহলে কে?

সে তোমার মায়ের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরী একটি প্রাণী।

না– সানি হঠাৎ চিৎকার করে বলল, সে আমার মা!

তুমি যত ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে পার; কিন্তু সেটা সত্যিকে পাল্টে দেবে না। তোমার মা মারা গেছে সানি। তার মৃতদেহ মানুষের আবাসস্থলের শীতলঘরে রাখা আছে

থাকুক

রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে সানি আমরা সেটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখন আমাকে বল আমরা কি গ্রুনি কলোনির কাছাকাছি এসে গেছি?

হ্যাঁ। ওই বড় পাথরটা পার হয়ে তুমি ডান দিকে থেমে যাও।

ঠিক আছে সানি, তুমি শক্ত করে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখ।

বাই ভার্বালটা সাবধানে থামিয়ে রিশান সামনে তাকাল, যেখানে থেমেছে তার সামনে খাড়া দেয়ালের মতো একটা পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে গেছে। রিশান তার অবলাল সংবেদী চশমাটি চোখে লাগিয়ে উপরে তাকায়, পাথরের এই খাড়া দেয়ালটি কোনো একটি বিচিত্র কারণে আশপাশের সব পাথর থেকে উষ্ণ। রিশান মাথা ঘুরিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকল, সানি–

বল।

গ্রুনি কলোনিটা কোথায়?

এই পাথরের পিছনে।

কিন্তু সেখানে তুমি কেমন করে যাও?

সানি হাত দিয়ে উপরে দেখিয়ে বলল, ওই যে উপরে একটা ছোট ফুটো আছে, আমি হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাই।

ভিতরে কী আছে সানি।

সানি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেয়ালের মাঝে লেগে আছে ভিজে ভিজে এক রকম জিনিস, প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ভিতরে চলে গেছে। আমি যখন ভিতরে যাই তখন সেগুলো থরথর করে কাঁপে, হলুদ এক রকম ধোঁয়া বের হয়।

তোমার–তোমার ভয় করে না?

সানি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।

তখন তুমি কী কর?

আমি তখন আমার মাকে ডাকি।

তোমার মা আসে তোমার কাছে?

মাঝে মাঝে আসে। সাদা ধোঁয়ার মতো দেখা যায়।

তুমি কখনো কথা বলেছ তোমার মায়ের সাথে?

হ্যাঁ। বলেছি।

তোমার মা তোমার কথা বুঝতে পারে?

মনে হয় পারে।

তুমি সত্যি জান?

হ্যাঁ। আমি জানি।

চমৎকার। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, তাহলে তুমি ভিতরে যাও। এই অক্সিজেন সিলিন্ডারটা নিয়ে যাও সাথে। ভিতরে গিয়ে বলবে এই গ্রহে নিক্সিরল ছড়িয়ে দিচ্ছে–মনে থাকবে নামটি?

নিক্সিরল।

হ্যাঁ। বলবে সেটা থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা মাত্র উপায়–পুরোটা অক্সিজেন দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া। এই যে লিভারটা আছে টেনে ধরতেই অক্সিজেন বের হতে শুরু করবে। ঠিক আছে?

সানি মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

খুব সাবধান–অক্সিজেন দিয়ে কিন্তু অনেক বড় বিস্ফোরণ হতে পারে। ভিতরে কী আছে আমি জানি না–তাই কোনো স্পার্ক যেন তৈরি না হয়।

হবে না। আমি সাবধান থাকব।

যাও তাহলে। দেরি কোরো না।

তুমি আসবে না?

আমি আসছি। চারদিকে অক্সিজেনের ছোট ছোট উৎস তৈরি করে আসি। কিছু বিস্ফোরকও ফেলে আসতে হবে।

বিস্ফোরক? কেন?

তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে নিক্সিরল তত তাড়াতাড়ি অক্সিডাইজ হবে

ও।

যাও তুমি ভিতরে। আমি আসছি।

সানি ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারটা টেনে টেনে উপরে উঠতে থাকে। রিশান সেদিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় ডাকল, সানি

কী হল।

তোমার কি মনে হয় গ্রুনি কলোনি আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেবে?

কেন দেবে না?

আমি যে মানুষ! যে মানুষেরা নিক্সিরল নিয়ে এসেছে

কিন্তু তুমি তো সেরকম মানুষ নও।

তোমার তাই মনে হয়?

হ্যাঁ, রিশান।

ঠিক আছে তাহলে, তুমি যাও। সানি উপরে উঠতে শুরু করতেই রিশান আবার ডাকল, সানি

কী হল?

তোমার কি মনে হয় আমি যখন ভিতরে যাব, তখন

তখন কী?

তখন কি আমি ভয় পাব?

সানি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ রিশান তুমি ভয় পাবে।

তুমি–তুমি ভয় পাও না?

পাই। কিন্তু আমি জানি আমার মা আছে সেখানে। তোমার তো মা নেই।

ও আচ্ছা।

রিশান নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সানি ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারটি নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। একটু পরে তাকেও ওই বড় পাথরের আড়ালে অন্ধকার একটা গুহায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। ভিতরে তার জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে চিন্তা করে হঠাৎ কেন জানি তার পেটের মাঝে পাক দিয়ে ওঠে।

রিশান মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটি প্রায় ঠেলে সরিয়ে দেয়, এখন তার অনেক কাজ বাকি। অক্সিজেনের সিলিন্ডার আর বিস্ফোরকগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেবার আগে মনে হয় একবার মহাকাশযানের সাথে কথা বলে নেয়া দরকার। নিডিয়াকেও মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ। নেয়ার কথা বলা হয়েছে, নূতন কিছু জানতে পেরেছে কি না সেটাও এখন জিজ্ঞেস করে নেয়ার সময় হয়েছে। রিশান একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে উপরে তাকাল, সানি অক্সিজেন সিলিন্ডারটি নিয়ে প্রায় উপরে উঠে গিয়েছে। সেদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে। থাকতে সে তার যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করল। প্রায় সাথে সাথেই তাকে ঘিরে দুটি হলোগ্রাফিক দৃশ্য ফুটে ওঠে, একটিতে হান এবং বিটি, অন্যটিতে নিডিয়া।

রিশান হানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের হাতে আর কত সময় রয়েছে হান?

খুব বেশি নয়। সবচেয়ে প্রথম ট্যাংকটির বিস্ফোরণ হবে এখন থেকে এগার মিনিট পরে।

মাত্র এগার মিনিট?

হ্যাঁ।

তুমি কি কোনো ট্যাংকের অবস্থান বের করতে পেরেছ?

কয়েকটা পেরেছি। কিন্তু খারাপ ধরনের একটা ঝড় হচ্ছে নিচে, কাজটি খুব সহজ নয়।

ট্যাংকটির বিস্ফোরণ হবার কতক্ষণ পর নিক্সিরল এখানে পৌঁছাবে বলে মনে হয়?

সাত মিনিটের মাঝে লক্ষ শতাংশ হয়ে যাবে। বিপদসীমার অনেক উপরে।

রিশান ঘুরে নিডিয়ার দিকে তাকাল, নিডিয়া তুমি কিছু বলবে?

বলার বেশি কিছু নেই। আমি মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ নিয়েছি সেখানেও নূতন কোনো তথ্য নেই। শুধু একটা ব্যাপার তুমি বিবেচনা করে দেখতে পার।

কী?

নিক্সিরল উঁচু তাপমাত্রায় খুব সহজে অক্সিডাইজ হয়। কাজেই তুমি যদি ওই এলাকার তাপমাত্রা বাড়াতে পার হয়তো খানিকটা সময় বাঁচাতে পারবে।

আমি সেজন্যে বিস্ফোরক নিয়ে এসেছি–  

কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়। নিডিয়া মাথা নেড়ে বলল, তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়বে না। তুমি এখন যেখানে আছ তার কাছাকাছি একটা আগ্নেয়গিরি রয়েছে।

আগ্নেয়গিরি?

হ্যাঁ, কোনোভাবে সেটাতে যদি অগ্ন্যুৎপাত করানো যেত, তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যেত।

রিশান হানের দিকে তাকাল, হান

বল।

তুমি কি আগ্নেয়গিরিটা খুঁজে বের করতে পারবে?

বিটি একটা বড় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি মনিটরে মনে হয় দেখতে পাচ্ছি।

চমৎকার। একটা মাঝারি ধরনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির মাথাটা উড়িয়ে দাও, হয়তো অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যাবে!

তুমি সত্যি বলছ, না ঠাট্টা করছ?

সত্যি বলছি।

তুমি জান এটা কতটুকু বিপজ্জনক?

না, জানি না। জানতে চাইও না। কিন্তু আমি এই সৃষ্টিজগতের মানুষ ছাড়া একমাত্র অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। বিপদকে এখন ভয় পাওয়ার সময় নেই।

তোমাদের সবার প্রাণের ওপর ঝুঁকি হবে। প্রচণ্ড রেডিয়েশন

কিছু করার নেই হান। তুমি দেরি কোরো না। এখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে, শুরু করে দাও।

আমি করতে চাই না রিশান।

আমি দলপতি হিসেবে তোমাকে আদেশ দিচ্ছি হান।

.

কিছুক্ষণ পর রিশানকে দেখা গেল একটি ছোট জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে বিশাল প্রস্তর খণ্ডটির চারপাশে সময়নির্ভর অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং বিস্ফোরক বসিয়ে দিচ্ছে। সেগুলো চার্জ করে সে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। তার মনিটরে এর মাঝে বাতাসের মাঝে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যাবার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। সানি নিশ্চয়ই ভিতরে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি খুলে দিয়েছে।

রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করে নিচু গলায় ডাকল, সানি।

এক মুহূর্ত পর সানির শিশুকণ্ঠের উত্তর শোনা গেল, আমাকে ডাকছ?

হ্যাঁ। তুমি কি–তুমি কি তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছ?

সানি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

কী হল সানি? কথা বলেছ?

আমি জানি না। এখানে এখানে—

এখানে কী?

আমার ভয় করছে রিশান। তুমি আসবে?

রিশানের হঠাৎ বুক কেঁপে ওঠে। সে কাঁপা গলুম বলল, আমি আসছি সানি। আমি এক্ষুনি আসছি।

ঠিক তখন দূরে একটা চাপা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। নিক্সিরলের প্রথম ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়েছে খুব কাছাকাছি কোথাও