প্রথমেই বলিয়া রাখি যে, আমার অনেক কিছু অপূর্ণতা আপনাদের সহ্য করিতে হইবে, কারণ আমি এমন এক সাধকসম্প্রদায়ভুক্ত, যাহারা বিবাহ করে না। অতএব নারীর সহিত মাতা, জায়া, কন্যা ও ভগিনী প্রভৃতি সম্পর্কে অপরের জ্ঞান যতটা পূর্ণ, আমার ততটা না হওয়াই স্বাভাবিক। তারপর স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ভারতবর্ষ একটি বিশাল মহাদেশ—কেবল একটি দেশ নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতির তুলনায় ইওরোপের জাতিগুলি পরস্পরের নিকটতর এবং অধিকতর সাদৃশ্য-বিশিষ্ট। আপনারা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করিতে পারিবেন, যদি বলি যে, সমগ্র ভারতবর্ষে আটটি বিভিন্ন ভাষা আছে। ঐগুলি বিভিন্ন ভাষা—আঞ্চলিক ভাষামাত্র নয় এবং প্রত্যেকেরই স্বকীয় সাহিত্য আছে। এক হিন্দীই দশ কোটি লোকের ভাষা, বাঙলা প্রায় ছয় কোটি লোকের, ইত্যাদি।
যে-কোন দুইটি ইওরোপীয় ভাষার মধ্যে যতটা প্রভেদ, তাহা অপেক্ষা চারিটি উত্তর-ভারতীয় ভাষা ও দক্ষিণ-ভারতীয় ভাষারগুলির মধ্যে প্রভেদ অধিকতর। প্রত্যেকটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; আপনাদের ভাষা ও জাপানী ভাষার মধ্যে যতখানি পার্থক্য, এইগুলির মধ্যেও ততখানি পার্থক্য। আপনারা জানিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, যখন আমি দক্ষিণ-ভারতে যাই, সেখানে সংস্কৃত বলিতে পারে—এমন লোকের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে ইংরেজীতেই কথা বলিতে হয়।
অধিকন্তু ভারতের বিভিন্ন জাতির আচার, রীতি, আহার, পরিচ্ছদ এবং চিন্তাধারাতেও অনেক পার্থক্য আছে। ইহার উপর আবার বর্ণভেদ আছে। প্রত্যেকটি বর্ণ যেন একটি স্বতন্ত্র জাতিবিশেষ। যদি কেহ ভারতবর্ষে বহুদিন বাস করে, তবেই সে একজনের চালচলন দেখিয়া বলিতে পারিবে, লোকটি কোন্ বর্ণভুক্ত। আবার বর্ণগুলির ভিতরও বিভিন্ন আচরণ ও প্রথা বিদ্যমান। বর্ণগুলি প্রত্যেকে স্বতন্ত্র, মিশুক নয়; অর্থাৎ এক বর্ণ অন্য বর্ণের সহিত সামাজিকভাবে মিলিবে, কিন্তু একত্র পানাহার করিবে না বা পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবে না। এই-সব ব্যাপারে তাহারা স্বতন্ত্র। পরস্পরের সহিত আলাপ এবং বন্ধুত্ব থাকিতে পারে, কিন্তু এই পর্যন্তই।
ধর্মপ্রচারক বলিয়া অন্যান্য পুরুষ অপেক্ষা সাধারণভাবে ভারতীয় নারীকে জানিবার সুযোগ আমাদেরই বেশী। ধর্মপ্রচারককে একস্থান হইতে অন্য স্থানে নিরন্তর ভ্রমণ করিতে হয়, ফলে সমাজের সকল স্তরের সহিত তাঁহার সংযোগ। উত্তর-ভারতেও মহিলারা পুরুষদের সম্মুখে বাহির হন না, সেখানেও ধর্মের জন্য তাঁহারা বহুক্ষেত্রে এই নিয়ম ভঙ্গ করেন এবং আমাদের প্রবচন শুনিতে ও আমাদের সহিত ধর্মালোচনা করিতে কাছে আসেন। ভারতীয় নারী-সম্বন্ধে আমি সব কিছুই জানি—এরূপ বলা আমার পক্ষে বিপজ্জনক। সুতরাং আমি আপনাদের সম্মুখে আদর্শটি উপস্থাপিত করিবার চেষ্টা করিব। প্রত্যেক জাতির পুরুষ বা স্ত্রীর ভিতরে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে একটি আদর্শের রূপায়ণ ঘটে। ব্যষ্টি একটি আদর্শের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। জাতি এই-সব ব্যষ্টির সমষ্টিমাত্র, এবং জাতিও একটি মহান্ আদর্শের প্রতীক। ঐ আদর্শের উদ্দেশ্যেই জাতি অগ্রসর হইতেছে। সুতরাং ইহা যথার্থ বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে যে, একটি জাতিকে বুঝিতে হইলে প্রথমে ঐ জাতির আদর্শকে অবশ্যই বুঝিতে হইবে। কারণ প্রত্যেক জাতির একটি নিজস্ব মাপকাঠি আছে এবং সেইটি ছাড়া অন্য কিছুর দ্বারা উহার মান নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
সর্বপ্রকার উন্নতি, অগ্রগতি, কল্যাণ কিংবা অবনতি—সবই আপেক্ষিক। ইহা কোন একটি মান নির্দেশ করে; কোন মানুষকে বুঝিতে হইলে পূর্ণত্ব সম্বন্ধে তাহার স্বকীয় মানের পরিপেক্ষিতে তাহাকে বুঝিতে হইবে। জাতিগত জীবনে এইটি স্পষ্টতরভাবে দেখিতে পাইবেন। এক জাতি যাহা ভাল বলিয়া মনে করে, অন্য জাতি তাহা ভাল নাও বলিতে পারে। আপনাদের দেশে জ্ঞাতি-ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ খুবই সঙ্গত, কিন্তু ভারতে ঐরূপ বিবাহ আইন-বিরুদ্ধ; শুধু তাই নয়, উহাকে অতি ভয়ানক নিষিদ্ধ যৌন-সংসর্গ মনে করা হয়। এ দেশে বিধবা-বিবাহ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। ভারতে উচ্চবর্ণের নারীর দুইবার বিবাহ চরম মর্যাদাহানিকর। অতএব দেখিতেছেন, আমরা এত বিভিন্ন ভাবের ভিতর দিয়া কাজ করি যে, একটি জাতিকে অপর জাতির মানদণ্ডের দ্বারা বিচার করা উচিত হইবে না, ইহা সম্ভবও নয়। অতএব একটি জাতি কোন্ আদর্শকে তাহার সামনে রাখিয়াছে, তাহা জানা আমাদের কর্তব্য। বিভিন্ন জাতির প্রসঙ্গে প্রথমেই আমরা একটা ধারণা করিয়া বসি যে, সকল জাতির নৈতিক নিয়মাবলী ও আদর্শ এক। যখন অপরকে বিচার করিতে যাই, তখন ধরিয়া লই যে, আমরা যাহা ভাল বলিয়া মনে করি, তাহা সকলের পক্ষেই ভাল হইবে। আমরা যাহা করি, তাহাই উচিত কর্ম; আমরা যাহা করি না, অপরে তাহা করিলে ঘোর নীতিবিরুদ্ধ হইবে। সমালোচনার উদ্দেশ্যে আমি এ-কথা বলিতেছি না, কেবল সত্যকে আপনাদের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া ধরিতেছি। যখন শুনি পদতলে সঙ্কুচিত করার জন্য পাশ্চাত্য নারীগণ চীনা মেয়েদের ধিক্কার দেয়, তখন তাহারা চিন্তা করে না তাহাদের আঁটসাঁট কাঁচুলি ব্যবহার জাতির অধিকতর ক্ষতি করিতেছে। ইহা একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। আপনারা অবশ্যই জানেন, কর্সেট ব্যবহারে শরীরের যতটা ক্ষতি হইয়াছে বা হইতেছে, পদতল সঙ্কুচিত করায় তার লক্ষ ভাগের এক ভাগ ক্ষতিও হয় না। কারণ প্রথমোক্ত উপায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ স্থানচ্যুত হয় এবং মেরুদণ্ডটি সাপের মত বাঁকিয়া যায়। যদি মাপ নেওয়া হয়, তাহা হইলে ঐ বক্রতা লক্ষ্য করিতে পারিবেন। দোষ দেখাইবার জন্য নয়, শুধু অবস্থাটি বুঝাইবার জন্য বলিতেছি। আপনারা অন্য দেশের নারীদের অপেক্ষা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করেন এবং তাহারা আপনাদের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করে না বলিয়া তাহাদের ব্যবহারে আপনারা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হন। ঠিক একই কারণে অন্যান্য জাতির নারীগণও আপনাদের কথা ভাবিয়া শিহরিত হয়।
সুতরাং দুই পক্ষের ভিতরই একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। একটা সাধারণ মিলনভূমি, একটা সর্বজনীন বোধের ক্ষেত্র ও একটা সাধারণ মানবতা আছে, যাহা আমাদের কর্মের ভিত্তি হইবে। আমাদের সেই পূর্ণ ও নির্দোষ মানবপ্রকৃতি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, যাহা এখন শুধু আংশিকভাবে এখানে ওখানে কাজ করিতেছে। পূর্ণত্বের চরম বিকাশ একটি মানুষে সম্ভব নয়। আপনি একটি অংশকে রূপ দিন, আমিও আমার সাধ্যমত সামান্যভাবে আর একটি অংশ রূপায়িত করি। এখানে একজন একটি ক্ষুদ্র অংশ গ্রহণ করে, অন্যত্র আর একজন আর একটি অংশ গ্রহণ করে। পূর্ণত্ব হইল এই সমস্ত অংশের সমষ্টিরূপ। ব্যষ্টির ক্ষেত্রে যেমন, জাতির ক্ষেত্রেও সেইরূপ। প্রত্যেক জাতিকেই একটি ভূমিকা অভিনয় করিতে হয়; প্রত্যেক জাতিকে মানব স্বাভাবের একটি দিক্ বিকশিত করিতে হয়; এবং আমাদিগকে এই সমস্তই একসঙ্গে গ্রথিত করিতে হইবে। সম্ভবতঃ সুদূর ভবিষ্যতে এমন এক জাতির উদ্ভব হইবে, যে-জাতির ভিতর বিভিন্ন জাতিদ্বারা অর্জিত বিস্ময়কর উৎকর্ষগুলি প্রকাশিত হইবে এবং উহা আর একটি নূতন জাতিরূপে দেখা দিবে। এই জাতির মত একটি জাতির কথা মানুষ এখনও কল্পনা করিতে পারে নাই। এইটুকু বলা ছাড়া কাহারও সমালোচনা করিয়া আমার বলিবার কিছু নাই। জীবনে ভ্রমণ বড় কম করি নাই। সর্বদা চক্ষু খুলিয়া রাখিয়াছি এবং যতই আমি ঘুরি, ততই আমার মুখ বন্ধ হইয়া যায়, সমালোচনা করিতে আর পারি না।
এখন ‘ভারতীয় নারী’র প্রসঙ্গ। ভারতে জননীই আদর্শ নারী। মাতৃভাবই ইহার প্রথম ও শেষ কথা। ‘নারী’-শব্দ হিন্দুর মনে মাতৃত্বকেই স্মরণ করাইয়া দেয়। ভারতে ঈশ্বরকে ‘মা’ বলিয়া সম্বোধন করা হয়। আমাদের শৈশবে প্রতিদিন প্রাতঃকালে একপাত্র জল লইয়া মায়ের কাছে রাখিতে হয়। তিনি তাঁহার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উহাতে ডুবাইয়া দেন এবং আমরা ঐ জল পান করি।
পাশ্চাত্যে নারী জায়া। সেখানে জায়ারূপেই নারীত্বের ভাবটি কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে—নারীত্বের সমগ্র শক্তি মাতৃত্বে ঘনীভূত হইয়াছে। পাশ্চাত্যে স্ত্রীই গৃহকর্ত্রী, ভারতীয় গৃহে কর্ত্রী—জননী। পাশ্চাত্যে গৃহে যদি মা আসেন, তবে তাঁহাকে (ছেলের) স্ত্রীর অধীন হইয়া থাকিতে হইবে; ঘরকরনা স্ত্রীর। মা সর্বদা আমাদের গৃহেই বাস করেন; স্ত্রীকে তাঁহার অধীনে থাকিতেই হইবে। ভাবের এই-সব প্রভেদ আপনারা লক্ষ্য করুন।
আমি কেবল তুলনার প্রস্তাব করিতেছি। প্রকৃত তথ্য উল্লেখ করিতেছি, যাহাতে আমরা দুই দিকের তুলনা করিতে পারি। এই তুলনাটি করুনঃ যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্ত্রী-রূপে ভারতীয় নারীর স্থান কোথায়?’ এই প্রশ্নে ভারতবাসী প্রতিপ্রশ্ন করিবে, ‘জননী-রূপে মার্কিন মহিলার মার্যাদা কি?’ সেই সর্বমহিমময়ী, যিনি আমায় এই শরীর দিয়াছেন তিনি কোথায়? নয় মাস যিনি আমাকে তাঁর শরীরে ধারণ করিয়াছেন, তিনি কোথায়? কোথায় তিনি, যিনি আমার প্রয়োজন হইলে বার বার জীবন দিতে প্রস্তুত? কোথায় তিনি, আমার প্রতি যাঁহার স্নেহ অফুরন্ত—তা আমি যতই দুষ্ট ও হীনপ্রকৃতি হই না কেন? কোথায় সেই জননী—আর কোথায় স্ত্রী, যে নারী স্বামীর দ্বারা সামান্য অবহেলিত হইলে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য আদালতের আশ্রয় লয়? অহো মার্কিন মহিলাবৃন্দ, আপনাদের ভিতর কোথায় সেই জননী? আপনাদের দেশে তাঁহাকে আমি খুঁজিয়া পাই না। আপনাদের দেশে আমি এমন পুত্র দেখি নাই, যাহার কাছে জননীর স্থান সর্বপ্রথম। যখন আমরা দেহত্যাগ করি, তখনও আমরা চাই না যে, আমাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা আমাদের জননীর স্থান গ্রহণ করে। ধন্য আমাদের জননী! যদি মায়ের পূর্বে আমাদের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আবার মায়ের কোলেই মাথা রাখিয়া আমরা মরিতে চাই। কোথায় নারী? ‘নারী’ কি এমনই একটি শব্দ, যাহা কেবল স্থূল দেহের সঙ্গে যুক্ত? হিন্দু-মন সেই-সব আদর্শকে ভয় করে, যেগুলি অনুসারে দেহ দেহেই আসক্ত হইবে। না, না! নারী, দেহ-সংক্রান্ত কোন কিছুর সহিত তুমি যুক্ত হইবে না। তোমার নাম চিরকালের জন্য পবিত্র বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ‘মা’- নাম ছাড়া এমন কি শব্দ আছে, যাহাকে কোনপ্রকার কামভাব স্পর্শ করিতে পারে না, কোনপ্রকার পশুভাব যাহার নিকটে আসিতে পারে না? এই মাতৃত্বই ভারতবর্ষের আদর্শ।
আমি এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত, যাহারা অনেকটা আপনাদের রোমান ক্যাথলিক চার্চের ভিক্ষুক সাধুদের মত। অর্থাৎ পোশাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া আমাদের ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়; ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করিতে হয়, জনসাধারণ যখন চায়, তখন ধর্মকথা শুনাইতে হয়। যেখানে আশ্রয় পাই, সেখানে ঘুমাই। আমাদিগকে এই ধরনের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করিতে হয়। আমাদের সন্ন্যাসিসম্প্রদায়ের নিয়ম এই যে, প্রত্যেক নারীকে এমন কি ক্ষুদ্র বালিকাকেও ‘মা’ সম্বোধন করিতে হয়। ইহাই আমাদের প্রথা। পাশ্চাত্যে আসিয়াও আমার পুরাতন অভ্যাস ছাড়িতে পারি নাই। মহিলাদের ‘মা’ বলিয়া সম্বোধন করিলে দেখিতাম, তাঁহারা অত্যন্ত আতঙ্কিত হইয়া উঠিতেন। প্রথম প্রথম ইহার কারণ বুঝিতে পারি নাই। পরে কারণ আবিষ্কার করিলাম। বুঝিলাম ‘মা’ হইলে তাঁহারা যে ‘বুড়ী’ হইয়া যাইবেন। ভারতে নারীর আদর্শ মাতৃত্ব—সেই অপূর্ব, স্বার্থশূন্য, সর্বংসহা, নিত্য ক্ষমাশীলা জননী। জায়া জননীর পশ্চাতে থাকেন—ছায়ার মত। স্ত্রীকে মায়ের জীবন অনুকরণ করিতে হইবে। ইহাই তাহার কর্তব্য। জননীই প্রেমের আদর্শ, তিনিই পরিবারকে শাসন করেন, সমগ্র পরিবারটির উপর তাঁহার অধিকার। ভারতে সন্তান যখন কোন অন্যায় কাজ করে, পিতা তখন তাহাকে প্রহার করেন এবং মাতা সর্বদা পিতা ও সন্তানের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়ান। আর এদেশে ঠিক তাহার বিপরীত। এদেশে মায়ের কাজ ছেলেকে মারধোর করা, এবং বেচারী বাবাকে মধ্যস্থ হইতে হয়। লক্ষ্য করুন—আদর্শের পার্থক্য। বিরূপ সমালোচনা হিসাবে আমি ইহা বলিতেছি না। আপনারা যাহা করেন, তাহা ভালই; কিন্তু যুগ যুগ ধরিয়া আমাদের যাহা শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে, তাহাই আমাদের পথ। মাতা সন্তানকে অভিশাপ দিতেছেন—ইহা আপনারা কখনও শুনিতে পাইবেন না। মা সর্বদাই ক্ষমা করেন। ‘আমাদের স্বর্গস্থ পিতা’র পরিবর্তে আমরা নিরন্তন বলি ‘মা’। মাতৃ-ভাব এবং মাতৃ-শব্দ হিন্দু-মনে চিরদিন অনন্ত প্রেমের সহিত জড়িত। আমাদের এই মরজগতে মায়ের ভালবাসাই ঈশ্বর-প্রেমের নিকটতম। মহাসাধক রামপ্রসাদ বলিয়াছেনঃ করুণা কর, জননি, আমি দুষ্ট; কিন্তু ‘কুপুত্র যদ্যপি হয়, কুমাতা কখনও নয়।’
ঐ দেখ হিন্দু জননী। পুত্রবধূ আসে তাঁহার কন্যারূপে। বিবাহ হইলে কন্যা পরগৃহে চলিয়া যায়, বিবাহ করিয়া পুত্র আর একটি কন্যা ঘরে আনে এবং পুত্রবধূ কন্যার শূন্যস্থান পূরণ করে। পুত্রবধূকে সেই রাজ-রাজেশ্বরীর অর্থাৎ স্বামীর মাতার শাসন-ব্যবস্থার ভিতর মানাইয়া লইতে হইবে। আমি তো সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসী কখনও বিবাহ করে না। মনে করুন, আমি যদি বিবাহ করিতাম, এবং আমার স্ত্রী যদি আমার মায়ের অসন্তোষের কারণ হইত, তাহা হইলে আমিও আমার স্ত্রীর উপর বিরক্ত হইতাম। কেন? আমি কি আমার মাকে পূজা করি না? সুতরাং মায়ের পুত্রবধূও কেন তাঁহাকে পূজা করিবে না? যাঁহাকে আমি পূজা করি, আমার স্ত্রী তাঁহাকে কেন পূজা করিবে না? কে সে, যে আমার সহিত রূঢ় ব্যবহার করিয়া আমার মাকেও শাসন করিবে? তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইবে, যতক্ষণ না তাহার নারীত্ব পরিপূর্ণ হয়। এই মাতৃত্বই নারীত্বকে পূর্ণ করে; মাতৃত্বই নারীর নারীত্ব। এই মাতৃত্ব পর্যন্ত তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইবে, ইহার পরই সে সমান অধিকার লাভ করে। তাই হিন্দুর নিকট মাতৃত্বই নারী-জীবনের চরম লক্ষ্য। কিন্তু অহো! আদর্শের কি বিস্ময়কর প্রভেদ দেখিতেছি! আমার জন্মের জন্য আমার পিতামাতা বৎসরের পর বৎসর কত পূজা ও উপবাস করিয়াছিলেন! প্রত্যেক সন্তানের জন্মের পূর্বে মাতাপিতা ভগবানের নিকট প্রার্থনা করেন। আমাদের মহান্ স্মৃতিকার মনু আর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়া বলিয়াছেন, ‘প্রার্থনার ফলে যাহার জন্ম, সে-ই আর্য।’ প্রার্থনা ব্যতীত যে-শিশুর জন্ম হয়, মনুর মতে সে অবৈধ সন্তান। সন্তানের জন্য প্রার্থনা করিতে হয়। অভিশাপ মস্তকে লইয়া যে-সব শিশু এই জগতে আসে, তাহারা যেন এক অসতর্ক মুহূর্তে আসিয়া পড়ে, কারণ তাহাদের আসা রোধ করিতে পারা যায় নাই—এইরূপ সন্তানদের নিকট কি আশা করিতে পারা যায়? মার্কিন জননীগণ, আপনারা ইহা চিন্তা করিয়া দেখুন। আপনাদের অন্তরের অন্তস্তলে ভাবিয়া দেখুন, আপনারা কি প্রকৃত নারী হইতে প্রস্তুত? এখানে কোন জাতি বা দেশের প্রশ্ন নাই, স্বজাতি-গৌরব- বোধের মিথ্যা ভাবালুতা নাই। দুঃখ-কষ্ট-জর্জরিত জগতে আমাদের এই মরজীবনে গর্ববোধ করিতে কে সাহস করে? ঈশ্বরের এই অনন্ত শক্তির নিকট আমরা কতটুকু? তথাপি আপনাদের আজ আমি এই প্রশ্ন করিতে চাই, ভবিষ্যৎ সন্তানটির জন্য কি আপনারা সকলে প্রার্থনা করেন? মাতৃত্ব লাভ করিয়া কি আপনারা ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ? মাতৃত্বের জন্য কি আপনারা নিজেদের শুদ্ধ পবিত্র মনে করেন? নিজেদের মনকে জিজ্ঞাসা করুন। যদি আপনারা ঐরূপ না বোধ করেন, তবে আপনাদের বিবাহ মিথ্যা, মিথ্যা আপনাদের নারীত্ব; আপনাদের শিক্ষা কুসংস্কার মাত্র। আর প্রার্থনা ব্যতীত যদি আপনাদের সন্তান হইয়া থাকে, তবে তাহারা মানবজাতির অভিশাপ হইবে।
আমাদের সম্মুখে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ উপস্থিত হইতেছে, তাহা লক্ষ্য করুন। মাতৃত্ব হইতে বিরাট দায়িত্ব আসে। মাতৃত্বই ভিত্তি—আরম্ভ। আচ্ছা, মাকে এইরূপ পূজা করিতে হইবে কেন? কারণ আমাদের শাস্ত্র শিক্ষা দেয়, সন্তান ভাল বা মন্দ হইবে, তাহা স্থিরীকৃত হয়, গর্ভবাসকালীন প্রভাবের দ্বারা। লক্ষ লক্ষ বিদ্যালয়ে যান, লক্ষ লক্ষ পুস্তক পড়ুন, পৃথিবীর সব পণ্ডিতের সঙ্গ করুন—এগুলির প্রভাব অপেক্ষা জন্মকালীন শুভসংস্কারের প্রভাব বেশী। শুভ বা অশুভ উদ্দেশ্য লইয়াই আপনার জন্ম। শিশু জন্মগ্রহণ করে—হয় দেবতারূপে, নয় দানবরূপে—শাস্ত্র এই কথাই ঘোষণা করে। শিক্ষা এবং আর সব কিছু পরে আসে, ঐগুলি অতি তুচ্ছ। যে-ভাব লইয়া আপনার জন্ম হইয়াছে, তাহাই আপনার ভাব। অস্বাস্থ্য লইয়া যাহার জন্ম, পাইকারী হারে গোটাকয়েক ঔষধের দোকান খাইলেও সে কি সারাজীবন সুস্থ থাকিতে পারিবে? দুর্বল রুগ্ন পিতামাতা, যাহাদের রক্ত দূষিত, তাহাদের সন্তান কয় জন সুস্থ ও সবল? একজনও নয়! প্রবল শুভ বা অশুভ সংস্কার লইয়া হয় দেবতা, নয় দানবরূপে আমরা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করি। শিক্ষা বা আর সব কিছু অতি তুচ্ছ।
আমাদের শাস্ত্র এইরূপ বলেঃ গর্ভকালীন প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ কর। জননীকে কেন পূজা করিতে হয়? কারণ তিনি নিজেকে পবিত্র করিয়াছেন। পবিত্রতা স্বরূপিণী হইবার জন্য তিনি দুশ্চর তপস্যা করিয়াছেন। আপনারা স্মরণ রাখিবেন, ভারতবর্ষে কোন নারী কোন পুরুষকে দেহ দান করার কথা ভাবিতেই পারেন না, দেহ তাঁহার নিজস্ব। যাহাকে দাম্পত্য অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে, ইংরেজরা সমাজসংস্কার হিসাবে বর্তমান ভারতবর্ষে তাহা প্রবর্তন করিয়াছে; কিন্তু কোন ভারতবাসীই ঐ আইনের সুযোগ গ্রহণ করিবে না। পুরুষ যখন নারীর দেহ-সম্পর্কে আসে, তখন নারী কত না প্রার্থনা ও ব্রতদ্বারা ঐ মিলন পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করে! কারণ যে-পথে শিশুর আগমন, তাহা যে স্বয়ং ঈশ্বরের পবিত্রতম প্রতীক। ইহা স্বামী-স্ত্রীর মিলিত শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা, যে-প্রার্থনা প্রচণ্ড ভাল অথবা মন্দ শক্তির সম্ভাবনাযুক্ত আর একটি জীবকে এই জগতে লইয়া আসিতেছে। ইহা কি একটা হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার? ইহা কি শুধু ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি? ইহা কি দেহের পাশবিক সুখসম্ভোগ? হিন্দু বলে, ‘না, না, সহস্রবার না।’
কিন্তু এইটির অনুগামী আর একটি ভাব আছে। সর্বংসহা সর্বক্ষমাশীলা জননীর প্রতি ভালবাসার আর্দশ লইয়া আমাদের আলোচনা আরম্ভ হইয়াছিল। জননীকে যে পূজা করা হয়, তাহার উৎস এইখানেই। আমাকে পৃথিবীতে আনিবার জন্য তিনি তপস্বিনী হইয়াছিলেন। আমি জন্মাইব বলিয়া তিনি বৎসরের পর বৎসর তাঁহার শরীর-মন, আহার-পরিচ্ছদ, চিন্তা-কল্পনা পবিত্র রাখিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি পূজনীয়া। তারপর আমরা কোন্ ভাবটি পাই? মাতৃত্বের সহিত সংযুক্ত হইয়া আছে জায়াভাব।
আপনারা—পাশ্চাত্যদেশের লোকেরা—ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপরায়ণ। আমি এই কাজটি করিতে চাই, যেহেতু আমি এটি পচ্ছন্দ করি। আমি সকলকে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিব। কেন? আমার খুশি। আমি নিজের পরিতৃপ্তি চাই, সেইজন্য আমি এই নারীটিকে বিবাহ করিব। কেন? আমি তাহাকে পছন্দ করি। এই নারী আমাকে বিবাহ করিয়াছে। কেন? সে আমাকে পছন্দ করে। এইখানেই ইহার পরিসমাপ্তি। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে সে আর আমি—এই দুইজনেই আছি, আমি তাহাকে এবং সে আমাকে বিবাহ করিয়াছে। ইহাতে কাহারও কোন ক্ষতি নাই, আর কাহারও কোন দায়িত্ব নাই। আপনাদের শ্রীমান্ ও শ্রীমতীরা বনে গিয়া তাহাদের রুচিমত জীবন যাপন করিতে পারে। কিন্তু তাহাদের যখন সমাজে বাস করিতে হয়, তখন তাহাদের বিবাহ আমাদের শুভাশুভের সহিত জড়িত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাহাদের সন্তানগণ অগ্নিসংযোগকারী, হত্যাকারী দস্যু, পরস্বাপহারী, মদ্যপ, জঘন্যাচারী ও ক্রূরকর্মা—সাক্ষাৎ দানব হইতে পারে।
এখন ভারতবর্ষের সমাজ-ব্যবস্থার ভিত্তি কি? ইহা বর্ণভিত্তিক বিধান। আমার জন্ম—বর্ণ বা জাতির জন্য, তাহার জন্যই আমার জীবন। অবশ্য আমার নিজের কথা বলিতেছি না। সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার ফলে আমরা জাতি-বর্ণের বহির্ভূত। যাহারা সমাজে বাস করে, আমি তাহাদের কথা বলিতেছি। কোন এক বর্ণে জন্ম বলিয়া সেই বর্ণের ধর্মানুযায়ী আমাকে সমস্ত জীবন যাপন করিতেই হইবে। অর্থাৎ আপনাদের দেশের আধুনিক ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, পাশ্চাত্য মানব আজন্ম স্বাতন্ত্র্যবাদী, আর হিন্দু সমাজতান্ত্রিক, পুরাপুরি সমাজতান্ত্রিক। সেইজন্য শাস্ত্র বলে যে, যদি পুরুষকে তাহার মনের মত যে-কোন নারী বিবাহ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং নারীকেও তাহার মনের মত যে-কোন পুরুষকে বিবাহ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তখন কি হয়? তুমি প্রেমে পড়। মেয়েটির পিতা হয়তো উন্মাদ বা যক্ষ্মারোগী। মেয়েটি হয়তো একটি পাঁড়-মাতাল ছেলের মুখ দেখিয়া মুগ্ধ হইল। সমাজবিধি কি বলে? ধর্মের অনুশাসনে এই-সব বিবাহ অবৈধ। মদ্যপায়ী, ক্ষয়রোগী, উন্মাদ প্রভৃতির সন্তানদিগকে বিবাহ করিতে দেওয়া হইবে না। ধর্ম বলে, বিকলাঙ্গ কুব্জ বিকৃতবুদ্ধি জড়বৎ ব্যক্তিদের বিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ।
কিন্তু মুসলমানরা আরব হইতে ভারতবর্ষে আসিল, তাহাদের আছে আরবী আইন, আর আরবের মরুভূমির আইন আমাদের উপর জোর করিয়া চাপানো হইল। ইংরেজরা আসিল তাহাদের আইন লইয়া। যতদূর সাধ্য তাহাও আমাদের উপর চালু করিল। আমরা পরাজিত জাতি। ইংরেজ যদি বলে, ‘কাল তোমার ভগিনীকে বিবাহ করিব’, আমরা কি করিতে পারি?
আমাদের সমাজ-বিধানে বলে, পরস্পরের মধ্যে রক্ত-সম্পর্কের দূরত্ব যতই থাকুক না কেন, এক জ্ঞাতিগোত্রের ভিতর বিবাহ অবৈধ। কারণ ঐরূপ বিবাহের দ্বারা জাতির অধোগতি হয়, বংশ লোপ পায়। কিছুতেই এ ধরনের বিবাহ হইতে পারে না এবং এইখানেই এ প্রসঙ্গ থামিয়া যায়। সুতরাং আমার বিবাহ-ব্যাপারে আমার নিজের কোন মত নাই, আমার ভগিনীর বিবাহ-ব্যাপারে—তাহারও মতামত কিছু নাই। জাতি-বর্ণের অনুশাসনের দ্বারা সব কিছু নির্ধারিত হয়।
অনেক সময় আমাদের দেশে শৈশবেই বিবাহ দেওয়া হয়। কেন? সমাজের আদেশ। পুত্র-কন্যাদের সম্মতি ছাড়াই যদি তাহাদের বিবাহ দিতে হয়, তাহা হইলে প্রেমের উন্মেষের পূর্বে শৈশবেই বিবাহ দেওয়া উচিত। যদি তাহারা পৃথক্ভাবে বড় হয়, তাহা হইলে বালকের হয়তো অন্য আর একটি বালিকাকে ভাল লাগিতে পারে এবং বালিকাও হয়তো আর একটি বালককে পচ্ছন্দ করিতে পারে। ফলে একটা মন্দ কিছু ঘটিতে পারে। সেইজন্য সমাজ বলে যে, ঐখানেই উহা বন্ধ করিয়া দাও। আমার ভগিনী বিকলাঙ্গ সুশ্রী বা কুশ্রী, তাহা আমি গ্রাহ্যই করি না, সে আমার ভগিনী—ইহাই যথেষ্ট। সে আমার ভ্রাতা—এইটুকু জানিলেই আমার যথেষ্ট হইল। সুতরাং তাহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে। আপনারা বলিতে পারেন, ‘অনেকখানি আনন্দ হইতে তাহারা বঞ্চিত। পুরুষের পক্ষে একটি নারীর প্রেমে পড়ার এবং নারীর পক্ষে একজন পুরুষের প্রেমে পড়ার কি অপূর্ব হৃদয়াবেগ, সে আনন্দ হইতে তাহারা বঞ্চিত হয়। ইহা তো ভ্রাতা-ভগিনীর ভালবাসার মত। যেন ভালবাসিতে তাহারা বাধ্য।’ ভাল, তাহাই হউক। কিন্তু হিন্দু বলে, ‘আমরা সমাজতান্ত্রিক। একটি পুরুষ বা নারীর তীব্র সুখের জন্য আমরা শত শত লোকের মস্তকে দুঃখের বোঝা চাপাইতে চাই না।’
তাহাদের বিবাহ হইয়া যায়। স্বামীর সহিত বধূ স্বামীর ঘরে আসে—ইহাকেই বলা হয় ‘দ্বিতীয় বিবাহ।’ শৈশবকালীন বিবাহকে বলা হয় ‘প্রথমে বিবাহ’ এবং তাহারা পৃথকভাবে তাহাদের নিজ নিজ গৃহে মেয়েদের সঙ্গে—পিতামাতার সঙ্গে বাস করে। যখন তাহাদের বয়স হয়, তখন ‘দ্বিতীয় বিবাহ’ নামক আর একটি অনুষ্ঠান করা হয়। তারপর তাহারা একসঙ্গে বাস করিতে থাকে, কিন্তু পিতামাতার সহিত একত্র একই বাড়িতে। বধূ যখন জননী হয়, তখন তাহার পরিবারটুকুর সর্বেসর্বা হইবার সময় আসে।
এখন আর একটি অদ্ভুত ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার কথা বলিব। আমি এইমাত্র আপনাদিগকে বলিয়াছি যে, প্রথম দুই তিন বর্ণের ভিতর বিধবারা আর বিবাহ করিতে পারে না; ইচ্ছা থাকিলেও পারে না। অবশ্য অনেকের নিকট ইহা একটি কঠোরতা। অস্বীকার করা যায় না যে, বহু বিধবাই ইহা পছন্দ করে না, কারণ বিবাহ না করার অর্থ হইল ব্রহ্মচারিণীর জীবন যাপন করা; অর্থাৎ তাহারা কখনই মাছ-মাংস খাইবে না, মদ্য পান করিবে না এবং শ্বেতবস্ত্র ছাড়া অন্য কোন বস্ত্র পারিবে না, ইত্যাদি। এ জীবনে বহু বিধি-নিষেধ আছে। আমরা সন্ন্যাসীর জাতি, সর্বদাই তপস্যা করিতেছি এবং তপস্যা আমরা ভালবাসি। মেয়েরা কখনও মাংস খায় না। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের কষ্ট করিয়া পানাহারে সংযম অভ্যাস করিতে হইত, মেয়েদের পক্ষে ইহা কষ্টকর নয়। আমাদের মেয়েরা মনে করে, মাংস খাওয়ার কথা চিন্তা করিলেও মর্যাদাহানি হয়। কোন কোন বর্ণের পুরুষেরা মাংস খায়, কিন্তু মেয়েরা কখনও খায় না। তথাপি বিবাহ না করিতে পাওয়া যে অনেকের পক্ষে কষ্ট—এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
কিন্তু আমাদিগকে আবার মূলে ফিরিয়া যাইতে হইবে। ভারতীয়েরা গভীরভাবে সমাজতান্ত্রিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দেশের উচ্চ বর্ণের ভিতর পুরুষের সংখ্যা অপেক্ষা নারীর সংখ্যা অনেক বেশী। ইহার কারণ কি? কারণ উচ্চবর্ণের নারীরা বংশানুক্রমে আরামে জীবনে যাপন করেন। ‘তাঁহারা পরিশ্রম করেন না, সুতাও কাটেন না, তথাপি সলোমন তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচ্ছদেও তাঁহাদের মত ভূষিত হন নাই।’৫ আর বেচারী পুরুষেরা, তাহারা মাছির মত মরে। ভারতবর্ষে আরও বলা হয়, মেয়েদের প্রাণ বড়ই কঠিন, সহজে যায় না। পরিসংখ্যানে দেখিবেন যে, মেয়েরা অতি দ্রুতহারে পুরুষের সংখ্যা অতিক্রম করে। অবশ্য বর্তমানে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদেরই মত কঠোর পরিশ্রম করে বলিয়া ইহার ব্যতিক্রম দেখা যায়। উচ্চবর্ণের নারী-সংখ্যা নিম্নবর্ণের অপেক্ষা অধিক। তাই নিম্নবর্ণের অবস্থা ঠিক বিপরীত। নিম্নবর্ণের স্ত্রী-পুরুষ সকলে কঠিন পরিশ্রম করে। স্ত্রীলোকদের আবার একটু বেশী খাটিতে হয়, কারণ তাহাদের ঘরের কাজও করিতে হয়। এই বিষয়ে আমার কোন চিন্তাই আসিত না, কিন্তু আপনাদেরই একজন মার্কিন পর্যটক মার্ক টোয়েন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে লিখিয়াছেনঃ
‘হিন্দু-আচার সম্বন্ধে পাশ্চাত্য সমালোচকেরা যাহাই বলুক না কেন, আমি ভারতবর্ষে কোথাও দেখি নাই যে, লাঙ্গল টানিবার বলদের সঙ্গে বা গাড়ি টানিবার কুকুরের সঙ্গে স্ত্রীলোক জুতিয়া দেওয়া হইয়াছে, ইওরোপের কোন কোন দেশে যেমন করা হয়। ভারতবর্ষে কোন স্ত্রীলোক বা বালিকাকে জমি চাষ করিতে দেখি নাই। রেলগাড়ি ধরিয়া দুই পাশে দেখিয়াছি যে, রোদেপোড়া পুরুষ ও বালকেরা খালি গায়ে জমি চষিতেছে; কিন্তু একটি স্ত্রীলোকও চোখে পড়ে নাই। দুই ঘণ্টা রেল ভ্রমণের মধ্যে মাঠে কোন স্ত্রীলোক বা বালিকাকে কাজ করিতে দেখি নাই। ভারতবর্ষে নিম্নতম বর্ণের মেয়েরাও কোন কঠিন শ্রমসাধ্য কাজ করে না। অন্যান্য জাতির সমপর্যায়ের মেয়েদের তুলনায় তাহাদের জীবন অপেক্ষাকৃত আরামের; হলকর্ষণ তাহারা কখনই করে না।’
এইবার দেখ। নিম্নবর্ণের পুরুষের সংখ্যা স্ত্রীলোকদের অপেক্ষা অধিক। এখন কি আশা কর? পুরুষের সংখ্যা অধিক বলিয়া নারী বিবাহ করিবার অধিকতর সুযোগ পায়।
বিধবাদের বিবাহ না হওয়া প্রসঙ্গেঃ প্রথম দুই বর্ণের ভিতর স্ত্রীলোকের সংখ্যা অতিমাত্রায় অধিক; এইজন্যই এই উভয় সঙ্কট—একদিকে বিধবাদের পুনর্বিবাহ না হওয়া জনিত সমস্যা ও দুঃখ, অন্যদিকে বিবাহযোগ্যা কুমারীদের স্বামী না পাওয়ার সমস্যা। কোন্ সমস্যাটির আমরা সম্মুখীন হইব—বিধবা-সমস্যা অথবা বয়স্কাকুমারী-সমস্যা? এই দুইটির মধ্যে একটি লইতেই হইবে। এখন আসুন, ‘ভারতীয় মন সমাজতান্ত্রিক’—সেই মূল ভাবটিতে ফিরিয়া যাই। সমাজতান্ত্রিক ভারতবাসী বলে, ‘দেখ, আমরা বিধবা-সমস্যাটিকে ছোট মনে করি। কেন? কারণ তাহাদের সুযোগ মিলিয়াছিল, তাহারা বিবাহিত হইয়াছিল। যদিও তাহারা সুযোগ হারাইয়াছে, তথাপি একবার তো তাহাদের ভাগ্যে বিবাহ হইয়াছিল। সুতরাং এখন শান্ত হও এবং সেই ভাগ্যহীনা কুমারীদের কথা চিন্তা কর—যাহারা বিবাহ করিবার সুযোগ একবারও পায় নাই।’ ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। অক্সফোর্ড স্ট্রীটের একদিনের একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। তখন বেলা দশটা হইবে, শত সহস্র মহিলা বাজার করিতেছেন। এই সময়ে একজন ভদ্রলোক, বোধ হয় তিনি মার্কিন, চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘হায় ভগবান্! ইহাদের মধ্যে কয়জন স্বামী পাইবে!’ সেইজন্য ভারতীয় মন বিধবাদিগকে বলে, ‘ভাল কথা, তোমাদের তো সুযোগ মিলিয়াছিল, তোমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য সত্যই আমরা খুবই দুঃখিত; কিন্তু আমরা নিরুপায়। আরও অনেকে যে (বিবাহের জন্য) অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে।’ অতঃপর এই সমস্যার সমাধানে ধর্মের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়ে; হিন্দুধর্ম একটি সান্ত্বনার ভাব লইয়াই আসে। কারণ আমাদের ধর্ম শিক্ষা দেয়, বিবাহ একটা মন্দ কাজ, ইহা শুধু দুর্বলের জন্য। আধ্যাত্মিক সংস্কারসম্পন্ন নারী বা পুরুষ আদৌ বিবাহ করেন না। সুতরাং ধর্মপরায়ণা নারী বলেন, ‘ঈশ্বর আমাকে ভাল সুযোগই দিয়াছেন, সুতরাং আমার আর বিবাহের প্রয়োজন কি? ভগবানের নাম করিব, তাঁহার পূজা করিব।’ মানুষকে ভালবাসিয়া কি লাভ? অবশ্য ইহা সত্য যে, সকলেই ভগবানে মন দিতে পারে না। কাহারও কাহারও পক্ষে ইহা একেবারেই অসম্ভব। তাহাদের দুঃখ ভোগ করিতেই হইবে। কিন্তু তাহাদের জন্য অপর বেচারীরা কষ্ট পাইতে পারে না। আমি সমস্যাটিকে আপনাদের বিচারের উপর ছাড়িয়া দিলাম। কিন্তু আপনারা জানিয়া রাখুন, ইহাই হইল ভারতীয় মনের চিন্তাধারা।
অতঃপর নারীর দুহিতারূপে আসা যাক। ভারতীয় পরিবারে কন্যা একটি অতি কঠিন সমস্যা। কন্যা এবং বর্ণ-জাতি—এই দুইটি মিলিয়া হিন্দুকে সর্বস্বান্ত করে, কারণ কন্যার বিবাহ একই বর্ণের ভিতর দিতেই হবে, এবং বর্ণের ভিতরও আবার ঠিক একই প্রকার বংশমর্যাদার পাত্রের সহিত বিবাহ দিতে হইবে। সেইজন্য বেচারী পিতাকে কন্যার বিবাহের জন্য অনেক সময় ভিখারী হইয়া যাইতে হয়। পাত্রের পিতা পুত্রের জন্য বিরাট পণ দাবী করেন, এবং কন্যার পিতাকে কন্যার বর সংগ্রহ করিবার জন্য যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিতে হয়। সেইজন্য হিন্দুর জীবনে কন্যা যেন একটি কঠিন সমস্যা। মজার কথা ইংরেজীতে কন্যাকে বলা হয় ‘ডটর’, সংস্কৃতে উহার প্রতিশব্দ ‘দুহিতা’। ইহার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এই যে, প্রাচীনকালের পরিবারে কন্যারা গো দোহন করিতে অভ্যস্ত ছিল এবং ‘দুহিতা’ শব্দটি দোহন করা অর্থে ‘দুহ্’ ধাতু হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ‘দুহিতা’র প্রকৃত অর্থ হইতেছে দোহনকারিণী। পরে ‘দুহিতা’ শব্দটির একটি নূতন অর্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দোহনকারিণী—দুহিতা পরিবারের সমস্ত ‘দুগ্ধ’ দোহন করিয়া লইয়া যায়, ইহাই হইল দ্বিতীয় অর্থ।
ভারতীয় নারী যে-সকল বিভিন্ন সম্পর্কে সম্বন্ধ, সেগুলি বর্ণনা করিলাম। আমি আপনাদের পূর্বে বলিয়াছি যে, হিন্দুসমাজে জননীর স্থান সকলের উপরে, তাঁহার পর জায়া এবং তারপর কন্যা। এই পর্যায়ের ক্রম অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল। বহু বৎসর সে-দেশে বাস করিয়াও কোন বিদেশী ইহা বুঝিতে পারেন না। উদাহরণ-স্বরূপ, আমাদের ভাষার ব্যক্তিবাচক ‘সর্বানাম’-এর তিনটি রূপ আছে। ইহারা অনেকটা ‘ক্রিয়া’র মত কাজ করে। একটি খুবই সম্মানসূচক, দ্বিতীয়টি মধ্যম এবং সর্বনিম্নটি অনেকটা ইংরেজীর দাউ (thou) ও দী (thee)-এর মত। শিশু এবং ভৃত্যদের সম্পর্কে শেষেরটি প্রয়োগ করা হয়। মধ্যমটি সমান সমান লোকের মধ্যে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং দেখিতেছেন যে, আত্মীয়তার সর্বপ্রকার জটিল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সর্বনামগুলি ব্যবহার করিতে হয়। উদাহরণ-স্বরূপ, আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে আজীবন আমি ‘আপনি’ বলিয়া সম্বোধন করি, কিন্তু তিনি কখনও আমাকে ‘আপনি’ বলিবেন না, তিনি আমাকে ‘তুমি’ বলিবেন, ভুলক্রমেও তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলিবেন না; যদি বলেন, তাহাতে অমঙ্গল বুঝিতে হইবে।
গুরুজনদের প্রতি ভালবাসা বা শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে হইলে সেইরূপ, সর্বদা ঐ প্রকার ভাষাতেই করিতে হইবে। পিতামাতাকে তো দূরের কথা, বড় ভাই বা বোনকেও ‘তু’, ‘তুম্’ বা ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিতে আমার সাহসই হইবে না। আর মাতাপিতার নাম ধরিয়া আমরা কখনই ডাকি না। যখন আপনাদের দেশের প্রথা জানিতাম না, তখন একটি খুবই মার্জিত-রুচি পরিবারে পুত্রকে জননীর নাম ধরিয়া ডাকিতে দেখিয়া আমি গভীরভাবে মর্মাহত হইয়াছিলাম। যাহা হউক, পরে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। বুঝিলাম, ইহাই এই দেশের রীতি। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা কখনই পিতামাতার উপস্থিতিতে তাঁহাদের নাম উচ্চারণ করি না। এমন কি তাঁহাদের সামনেও ‘প্রথম পুরুষের বহুবচন’-এ উল্লেখ করি। এইরূপে আমরা দেখি যে, ভারতীয় নারী-পুরুষের সমাজ-জীবনে এবং সম্পর্কের তারতম্যে জটিলতম জাল বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে। আমাদের দেশে গুরুজনদের সম্মুখে কেহ স্ত্রীর সহিত কথা বলে না। একাকী যখন অপর কেহ থাকে না বা শুধু ছোটরা থাকে, তখনই স্ত্রীর সহিত কথাবার্তা বলা যায়। যদি আমি বিবাহ করিতাম, তাহা হইলে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রীর সামনে স্ত্রীর সহিত কথা বলিতাম, কিন্তু বড় বোন বা পিতামাতার সম্মুখে বলিতাম না। ভগিনীদের নিকট তাহাদের স্বামী সম্বন্ধে কোন কথা আমি বলিতে পারি না। ভাবটি এই যে, আমরা সন্ন্যাস-কেন্দ্রিক জাতি। এই একটি ভাবের উপর সমগ্র সমাজ-ব্যবস্থার দৃষ্টি নিবদ্ধ রহিয়াছে। বিবাহকে একটা অপবিত্র, একটা নিম্ন পর্যায়ের ব্যাপার বলিয়া মনে করা হয়। সেইজন্য প্রেমের বিষয় লইয়া কোন আলোচনা কখনও করা চলিবে না। মা, ভাই, বোন বা অপর কাহারও সামনে আমি কোন উপন্যাস পড়িতে পারি না। তাঁহারা আসিলে উপন্যাসটি বন্ধ করিয়া দিই।
পান-ভোজনের ব্যাপারেও এই একই রীতি। আমরা গুরুজনদের সম্মুখে আহার করি না। শিশু বা সম্পর্কে ছোট না হইলে কোন পুরুষের সম্মুখে আমাদের মেয়েরা কখনও আহার করে না। মেয়েরা বলে, ‘মরিয়া যাইব, তবু স্বামীর সম্মুখে কিছু চিবাইতে পারিব না।’ মাঝে মাঝে ভাই ও বোনেরা একত্র খাইতে বসিতে পারে। ধরুন আমি এবং আমার ভগিনী একসঙ্গে খাইতেছি, এমন সময় ভগিনীর স্বামী দরজার গোড়ায় আসিয়া পড়িল— তখনই ভগিনী খাওয়া বন্ধ করিয়া দিবে, আর স্বামী-বেচারা সরিয়া পড়িবে।
যে-সব প্রথা আমাদের দেশের একান্ত নিজস্ব, সেইগুলি আমি বলিলাম। ইহাদের ভিতর কতকগুলি আমি অন্যান্য দেশেও লক্ষ্য করিয়াছি। আমি কখনও বিবাহ করি নাই। বধূসম্বন্ধীয় জ্ঞান আমার সম্পূর্ণ নয়। মাতা এবং ভগিনী যে কি, তাহা আমি জানি; অপরের বধূ আমি দেখিয়াছি মাত্র, তাহা হইতে যেটুকু জ্ঞান সংগ্রহ করিয়াছি, তাহাই আপনাদের বলিলাম।
শিক্ষা এবং সংস্কৃতি নির্ভর করে পুরুষের উপর; অর্থাৎ যেখানে পুরুষেরা উচ্চসংস্কৃতিসম্পন্ন, সেখানে মেয়েরাও ঐরূপ হইবে। যেখানে পুরুষদের সংস্কৃতি নাই, সেখানে মেয়েদেরও নাই। অতি প্রাচীনকাল হইতে হিন্দুপ্রথা-অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামীণ ব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল। স্মরণাতীত কাল হইতে সমস্ত ভূমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হইয়াছিল। আপনাদের ভাষায় এগুলি ছিল সরকারের। জমির উপর কাহারও কোন ব্যক্তিগত অধিকার নাই। ভারতবর্ষে রাজস্ব জমি হইতে আসে, কারণ প্রত্যেকে সরকার হইতে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ভোগ করে। এই জমি একটি গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পত্তি, এবং পাঁচ দশ কুড়ি বা একশ-টি পরিবার একত্র ঐ জমি দখলে রাখিতে পারে। সমস্ত জমি তাহারাই নিয়ন্ত্রণ করে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব তাহারা সরকারকে দেয় এবং একটি চিকিৎসক এবং শিক্ষকের ভরণপোষণ করে, ইত্যাদি।
আপনাদের ভিতর যাঁহারা হারবার্ট স্পেন্সার পড়িয়াছেন, তাঁহাদের মনে আছে, তিনি তাঁহার শিক্ষাপদ্ধতিকে ‘মঠপদ্ধতি’ বলিয়াছেন। ইহা ইওরোপে প্রয়োগ করা হইয়াছে, কোথাও কোথাও সাফল্যমণ্ডিতও হইয়াছিল। এই পদ্ধতি অনুসারে গ্রামে একজন শিক্ষক থাকিবেন, তাঁহার ভার ঐ গ্রামকে লইতে হইবে। আমাদের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অতি সাধারণ। কারণ আমাদের পদ্ধতিও অত্যন্ত সরল। প্রত্যেক বালক একটি ছোট মাদুরের আসন লইয়া আসে। তালপাতাতে লেখা আরম্ভ হয়, কারণ কাগজের দাম অনেক। প্রত্যেকটি বালক তাহার আসন বিছাইয়া বসে, দোয়াত ও পুস্তক সঙ্গে লইয়া আসে এবং লিখিতে আরম্ভ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সামান্য পাটীগণিত, কিছু সংস্কৃত ব্যাকরণ, একটু ভাষা ও হিসাব—এই শিক্ষা দেওয়া হয়।
বাল্যকালে এক বৃদ্ধ আমাদের নীতিবিষয়ক একটি ক্ষুদ্র পুস্তক মুখস্থ করাইয়াছিলেন, উহার একটি শ্লোক এখনও আমার মনে আছেঃ ‘গ্রামের হিতের জন্য পরিবার, স্বদেশের মঙ্গলের জন্য গ্রাম, মানবতার জন্য স্বদেশ এবং জগতের হিতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করিবে।’৬ এইরূপ অনেক শ্লোক ঐ পুস্তকে আছে। আমরা ঐগুলি মুখস্থ করি, এবং শিক্ষক ব্যাখ্যা করিয়া দেন, পরে ছাত্রও ব্যাখ্যা করে। বালক-বালিকারা একত্র এগুলি শিক্ষা করে। ক্রমে তাহাদের শিক্ষা পৃথক্ হইয়া যায়। প্রাচীন সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রধানতঃ ছাত্রদের জন্যই ছিল। ছাত্রীরা কদাচিৎ সেখানে যাইত; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমও ছিল।
বর্তমানকালে ইওরোপীয় ধরনে উচ্চ শিক্ষার উপর অধিকতর ঝোঁক দেখা দিয়াছে। মেয়েরাও এই উচ্চ শিক্ষা লাভ করুক—এই দিকেই জনমত প্রবল হইতেছে। অবশ্য ভারতবর্ষে এমন লোকও আছে, যাহারা মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা চায় না; কিন্তু যাহারা চায়, তাহারাই জয়লাভ করিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় আজও ইংলণ্ডে অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমেরিকায় হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার মেয়েদের জন্য রুদ্ধ। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ বৎসরেরও অধিক হইল, নারীদের জন্য উহার দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে। আমার মনে আছে, যে বৎসর আমি বি.এ.পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, সেই বৎসর কয়েকটি ছাত্রীও ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিল। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য একই মান, একই পাঠ্যসূচী ছিল এবং পরীক্ষায় ছাত্রীরা বেশ ভালই করিয়াছিল। মেয়েদের শিক্ষা-ব্যাপারে আমাদের ধর্ম বাধা দেয় না। এইরূপে মেয়েদের শিক্ষা দিতে হইবে, এইভাবে তাহাদিগকে গড়িয়া তুলিতে হইবে, প্রাচীন পুস্তকে আমরা আরও দেখি—ছেলে ও মেয়েরা উভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিতেছে, কিন্তু পরবর্তী কালে সমস্ত জাতির শিক্ষাই অবহেলিত হইয়াছে। বৈদেশিক শাসনে কি আর আশা করা যায়? বিদেশী বিজেতারা আমাদের কল্যাণ করিবার জন্য তো আসে নাই। তাহারা ধন-সম্পদ্ চায়। আমি বারো বৎসর কঠোর অধ্যয়ন করিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বি. এ. পাস করিয়াছি; কিন্তু আমার দেশে আমি মাসে পাঁচ ডলারও উপার্জন করিতে পারি না। ইহা কি আপনারা বিশ্বাস করিবেন? ইহাই প্রকৃত অবস্থা। বিদেশী-প্রবর্তিত শিক্ষায়তনগুলির উদ্দেশ্য—বহুসংখ্যক কেরানী, পোস্টমাস্টার, টেলিগ্রাফ অপারেটর প্রভৃতি তৈরি করিয়া অল্প অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনের উপযোগী একদল কর্মদক্ষ ক্রীতদাস পাওয়া। ইহাই হইল এই শিক্ষার স্বরূপ।
ফলে, বালক-বালিকাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইতেছে। আমাদের দেশে করিবার অনেক কিছু আছে। যদি আপনারা আমাকে ক্ষমা করেন এবং অনুমতি দেন, তাহা হইলে আপনাদেরই একটি প্রবাদ বাক্য আমি বলি, ‘হংসীর যাহা খাদ্য, হংসেরও খাদ্য তাই।’৭
বিদেশী মহিলারা হিন্দু মেয়েদের কঠোর জীবন দেখিয়া কত চীৎকার করেন—কাঁদেন, কিন্তু হিন্দু পুরুষদের কঠোর জীবনের উপর আপনাদের কোনই দৃষ্টি নাই। আপনাদের চোখের জল কৃত্রিম। ছোট ছোট বালিকাদের বিবাহ হয় কাহাদের সহিত? একজনের যখন বলা হইল যে, বৃদ্ধদের সহিত এই বালিকাদের বিবাহ হয়, তখন সে বলিয়া উঠিল, ‘যুবকেরা তাহা হইলে কি করে? কি আশ্চর্য! বালিকাদের কি বৃদ্ধদের সহিত—কেবল বৃদ্ধদের সহিতই বিবাহ দেওয়া হয়?’ আমরা যে বৃদ্ধ হইয়াই জন্মগ্রহণ করি—বোধ হয় আমাদের দেশের সব লোকই ঐরূপ।
আত্মার মুক্তি ভারতবর্ষের আদর্শ। জগৎটা কিছুই নয়। উহা একটা দৃশ্য মাত্র, একটা স্বপ্ন। এই জীবন কোটি কোটি জীবনের মত একটি। সমস্ত প্রকৃতিই মায়া, একটা ছায়া, ছায়ার আগার। ইহাই হইল ভারতীয় জীবন-দর্শন। শিশুরা জীবনকে অভিনন্দিত করে, ইহাকে মধুর ও সুন্দর বলিয়া মনে করে। কিন্তু কয়েক বছর পরেই যেখান হইতে তাহারা শুরু করিয়াছিল, তাহাদিগকে সেখানেই ফিরিয়া আসিতে হইবে। কাঁদিতে কাঁদিতে জীবন আরম্ভ হইয়াছিল, কাঁদিতে কাঁদিতেই জীবন শেষ হইবে। যৌবন-মত্ত জাতিরাও ভাবে যে, তাহারা যাহা খুশি তাহাই করিতে পারে। তাহারা মনে করে, আমরাই পৃথিবীর অধিপতি— দেবতা, ভগবানের চিহ্নিত জাতি। তাহারা ভাবে—সমগ্র জগৎকে শাসন করিবার, ঈশ্বরের পরিকল্পনা রূপায়িত করিবার, তাহাদের যাহা ইচ্ছা করিবার, পৃথিবীকে ওলট-পালট করিবার আদেশপত্র সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বর যেন তাহাদিগকে দিয়াছেন; হত্যা ও লুণ্ঠন করিবার ছাড়পত্র তাহারা পাইয়াছে। ভগবান্ তাহাদিগকে এই-সব স্বাধীনতা দিয়াছেন, শিশু বলিয়াই তাহারা এই-সব অপকর্ম করে। তাই সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্যের আবির্ভাব হইয়াছে, তাহাদের কত মহিমা ও বর্ণচ্ছটা! কিন্তু তাহারা বিস্মৃতির গর্ভে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। হয়তো ধ্বংসস্তূপেই সেগুলি বিরাট!
পদ্মপত্রে জলের ফোঁটা যেমন টলমল করিয়া মুহূর্তে পড়িয়া যায়, তেমনি এই নশ্বর জীবন। যেদিকেই আমরা তাকাই, সেদিকেই দেখি ধ্বংস। আজ যেখানে অরণ্য, এক সময়ে সেখানেই ছিল বড় বড় নগরীমণ্ডিত শক্তিশালী সাম্রাজ্য। ভারতীয় মানুষের ইহাই হইল প্রধানতম চিন্তা ও মূল সুর। আমরা জানি, আপনাদের পাশ্চাত্য জাতির শিরায় তরুণ রক্ত প্রবাহিত। আমরা জানি, মানুষের মত জাতিরও সুদিন আসে। কোথায় গ্রীস? কোথায় রোম? সেদিনের সেই শক্তিধর স্পেন কোথায়? কে জানে এই-সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়া ভারতের কি হইতেছে? এইরূপেই জাতির জন্ম হয় এবং কালে তাহাদের ধ্বংস হয়; এইভাবেই তাহাদের উত্থান ও পতন। যাহাদের দুর্ধর্ষ সৈন্য-বাহিনীকে জগতের কোন শক্তি প্রতিরোধ করিতে পারে নাই, যাহারা তোমাদের সেই ভয়াবহ ‘টার্টার’ শব্দটি রাখিয়া গিয়াছে, সেই মুঘল আক্রমণকারীকে হিন্দু শৈশব হইতেই জানে। হিন্দু তাহার পাঠ শিক্ষা করিয়াছে। আজিকার শিশুদের মত সে প্রলাপ বকিতে চায় না। হে পশ্চাত্য জাতি! তোমাদের যাহা বলিবার তাহা বল। এখন তো তোমাদেরই দিন। বর্তমান কাল শিশুদের প্রলাপ বকিবার কাল। আমরা যাহা শিখিবার, তাহা শিখিয়াছি। এখন আমরা মৌন। তোমাদের কিছু ধনসম্পদ্ হইয়াছে, তাই তোমরা আমাদিগকে অবজ্ঞা কর। ভাল, এখন তোমাদেরই দিন। বেশ বেশ, শিশু তোমরা, আধ-আধ কথা বল—ইহাই হইল হিন্দুর মনোভাব।
অসার ফেনায়িত বাক্যের দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায় না। এমন কি মেধাশক্তির সহায়েও তিনি লভ্য নন। বাহুবলেও তাঁহাকে লাভ করা যায় না। পরমেশ্বর তাঁহারই কাছে আসেন, যিনি বস্তুর গোপন উৎসটি জানেন, যিনি অপর সব কিছুই নশ্বর বলিয়া জানিয়াছেন; আর কাহারও নিকট তিনি আসেন না। যুগ-যুগান্তের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া ভারতবর্ষ শিক্ষা পাইয়াছে। ভারত এখন ভগবানের অভিমুখী। ভারতবর্ষ অনেক ভুল করিয়াছে। তাহার উপর অনেক জঞ্জালের বোঝা স্তূপীকৃত হইয়াছে। তাহাতে কি হইয়াছে? আবর্জনা- পরিষ্কারে, নগর-পরিষ্কারে কি হয়? উহা কি জীবন দেয়? যাহাদের সুন্দর প্রতিষ্ঠান আছে, তাহাদেরও মৃত্যু হয়। আর প্রতিষ্ঠানের কথা না বলাই ভাল। ক্ষণভঙ্গুর এই পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠানগুলি—পাঁচদিন লাগে তাহাদের গড়িতে, আর ষষ্ঠ দিবসে সেগুলি ধ্বংস হইয়া যায়। এই-সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি একটিও একাদিক্রমে দুই শত বৎসর টিকিয়া থাকিতে পারে না। আর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে। হিন্দু বলে, ‘হ্যাঁ, আমরা প্রাচীন জাতিগুলির ধ্বংসের সাক্ষী, নূতন জাতিগুলিরও মৃত্যু দেখিবার জন্য দাঁড়াইয়া আছি। কারণ আমাদের আদর্শ ইহসংসারের নয়, ঊর্ধ্বলোকের। তোমার যেরূপ আদর্শ, তুমি সেইরূপই হইবে; আদর্শ যদি নশ্বর হয়, পৃথিবী-কেন্দ্রিক হয়, জীবনও সেইরূপ হইবে। আদর্শ যদি জড় হয়, তবে তোমরাও জড় হইবে। দেখ! আমাদের আদর্শ—আত্মা, আত্মাই একমাত্র সৎ-পদার্থ। আত্মা ছাড়া অন্য কিছুই নাই এবং আমরা আত্মারই মত চিরজীবী।