১৩. পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে

পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে এল কিরীটী ও তালুকদার রাত তখন পৌনে নটা।

আগের ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়েছিল ওরা।

নতুন একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা যখন গচা লেনে ব্রজদুলাল-ভবনে এসে পৌঁছাল তখন নটা বেজে মাত্র সাত মিনিট।

ট্যাক্সির ভাড়া রাস্তা থেকেই মিটিয়ে দিয়ে কিরীটী আর তালুকদার গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এবং কয়েক পা এগুতেই ওদের নজরে পড়ল, পারলারের কাচের জানলাপথে আলো দেখা যাচ্ছে।

পারলারের দরজার দিকে এগুতেই ওদের কানে এল একটা রুক্ষ পুরুষের কণ্ঠস্বর : সেটাই তো আমি জানতে চাইছি মিঃ মল্লিক। কেন এখানে এ-সময় আমাকে ডেকে নিয়ে আসা হল? যে বাড়িতে ঘৃণায় আজ পর্যন্ত কখনও আমি পা ফেলিনি সেখানে কেন আমাকে ডেকে আনা হল?  

সুখময় মল্লিকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, কিন্তু আজ যখন আপনাদের কাকা ব্রজবাবুর মৃত্যুতে আপনারাই এ বাড়ির মালিক হচ্ছেন তখন আজ হোক কাল বা পরশুই হোক একদিন এখানে আসতেই হবে আপনাকেও।  

কে বললে আপনাকে সে কথা? যার খুশি সে আসুক, জানবেন প্রশান্ত সাহা এখানে জীবনেও পা দেবে না।

কিন্তু কেন বলুন তো প্রশান্তবাবু? এত রাগ কেন আপনার ব্রজবাবুর উপরে?

রাগ? একটা লম্পট, আউট অ্যান্ড আউট স্কাউলে, একটা।

লম্পট!

নয়? কারও জানতে আজও বাকি আছে, ঐ তাঁর সেক্রেটারী না কি সেই খ্রীস্টান মেয়েটা রেবেকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথাটা?

সে কথাটা আপনি বিশ্বাস করেন প্রশান্তবাবু?

পৃথিবীসুদ্ধ লোক করে, আর আমিই বা করব না কেন?

কিন্তু এও শুনেছি অনেক লোকই নাকি বলে কথাটা মিথ্যে। মিথ্যে?

হ্যাঁ।

 তারা জানে না।

আপনিই বা স্থিরনিশ্চিত হলেন কি করে? এ-বাড়িতে তো কখনও আসেন নি?

না, আসিনি—

তবে?

তবে আবার কি! ঐসব নোংরামি কখনও কেউ চাপা দিয়ে রাখতে পারে, না পেরেছে?

বুঝলাম। কিন্তু যা আপনি নিজে চোখে কখনও দেখেন নি, কেবলমাত্র লোকের কথা শুনে–

লোকেরাই বা তাঁর সম্পর্কে মিথ্যে রটনা করবে কেন বলতে পারেন মিঃ মল্লিক? তাদের কি স্বার্থ?

স্বার্থ হচ্ছে ঈষ। শান্ত কণ্ঠে সুখময় জবাব দেন, হ্যাঁ, একটা কথা জানবেন, কেউ কখনও আশাতিরিক্ত উন্নতি করলে তার আত্মীয়স্বজন বন্ধু ও পরিচিত জনেরাই তার আড়ালে নিন্দে করে, কলঙ্ক রটায়, এবং সেটা করে নিছক ঈষায়। এবং এ যে কত বড় গোপন ও কুৎসিত ব্যাধি আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মনে সেটা যেন আমরা জেনেও জানতে চাই না।

না, না—সে আপনি যাই বলুন মিঃ মল্লিক, তার মুখ-চোখই আমাকে বলে দিত, কি টাইপের লোক সে। যাক গে মশায়, ও নিয়ে তর্ক আমি করতে চাই না। আমাকে যেতে দিন।

কিরীটী এতক্ষণ দরজার একপাশে দাঁড়িয়েছিল, এবারে তালুকদারকে নিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। এবং কতকটা যেন অকস্মাৎই গিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।  

ওদের পদশব্দে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সুখময় মল্লিক ও প্রশান্ত সাহা দুজনেই যুগপৎ ওদের দিকে ফিরে তাকায়।

এই যে মিঃ রায় এসে গিয়েছেন, প্রশান্তবাবু আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাইছেন। সুখময় মল্লিক কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই কথাটা উচ্চারণ করেন।

ওঁরই নাম প্রশান্ত সাহা? কিরীটী সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।

হ্যাঁ, উনিই। আপনার ফোন পেয়ে তখুনিই ওঁকে আমি ফোন করি এখানে চলে আসবার জন্য। এসে দেখি আমার আগেই উনি এখানে এসে পৌঁছে গিয়েছেন।

কিরীটী প্রশান্ত সাহার দিকে চেয়ে ছিল।

সুশান্ত সাহাকে তার সুপুরুষ মনে হয়েছিল, কিন্তু, প্রশান্ত সাহা ততোধিক সুন্দর।

যেমন লম্বাচওড়া চেহারা তেমনি উজ্জ্বল গায়ের বর্ণ।

পরিধানে একটা রেয়ন সিল্কের সাদা লংস ও টেরিলিনের ঈষৎ নীলাভ রংয়ের শার্ট এবং চোখে সোনার ফ্রেমের ফ্যান্সি চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁত কামানো।

শুধু সুন্দর চেহারাই নয়, বেশভূষাও যেমন পরিচ্ছন্ন তেমনিই নিখুঁত রুচির পরিচায়ক।