পাঁচ বৎসরের হৈল হাতে খড়ি দিল।
বশিষ্ঠের বাড়ী পড়িবারে পাঠাইল।।
বালকে বালকে দ্বন্দ্ব যখন বাড়িল।
জারজ বলিয়া গালি এক শিশু দিল।।
মনে ভগীরথ দুঃখী না দিল উত্তর।
বিষাদে আইল শিশু আপনার ঘর।।
সর্ব্বদা অস্থির হয় সজল নয়ন।
শয়ন-মন্দিরে শিশু করিল শয়ন।।
আকাশে হইল বেলা দ্বিতীয় প্রহর।
মাতা বলে পুত্র কেন না আইল ঘর।।
ডম্বুর হারায়ে যেন ফুকারে বাঘিনী।
মুনি কাছে কান্দি যায় দিলীপ-কামিনী।।
বশিষ্ঠ বলেন মাতা না কর ক্রন্দন।
রোষের মন্দিরে পুত্রে পাবে দরশন।।
আসি রাণী ভগীরথে কোলে করি নিল।
নেতের আঁচলে তার মুখ মুছাইল।।
বলিতে লাগিল ভগীরথের জননী।
কোন্ দুঃখের দুঃখী তুমি কহ যাদুমণি।।
কারে বাড়াইবে কারে করিবে কাঙ্গাল।
বন্দী মুক্ত করি যদি থাকে বন্দিশাল।।
কোন্ রোগে রোগী তুমি আমি ত না জানি।
এইক্ষণে করি সুস্থ শত বৈদ্য আনি।।
ভগীরথ বলে, মাতা করি নিবেদন।
রোগ দুঃখ নহে, আজি পাই অপমান।।
বিরোধ বাধিল এক বালকের সনে।
জারজ বলিয়া গালি দিল সে ব্রাক্ষণে।।
কোন্ বংশজাত আমি কাহার নন্দন।
ইহার বৃত্তান্ত মাতা কহ বিবরণ।।
পুত্রের হইলে দুঃখ মায়ে লাগে ব্যথা।
পুত্র সম্বোধিয়া মাতা কহে সত্য কথা।।
সগরের ছিল ষাটি হাজার তনয়।
কপিল মুনির শাপে হৈল ভস্মময়।।
স্বর্গ হৈতে যদি গঙ্গা আইসেন ক্ষিতি।
তবে সে সগরবংশ পাইবে নিষ্কৃতি।।
ক্রমে তিন পুরুষ করিল আরাধন।
তবু গঙ্গা আনিতে নারিল কোন জন।।
দিলীপ তোমার পিতা গেল স্বর্গপুরে।
পাইলাম তোমা পুত্র মহেশের বরে।।
ভগে ভগে জন্ম হেতু ভগীরথ নাম।
সূর্য্যবংশে জন্ম তব অযোধ্যা-বিশ্রাম।।
শুনিয়া মায়ের কথা ভগীরথ নাম।
সূর্য্যবংশে জন্ম তব অযোধ্যা-বিশ্রাম।।
শুনিয়া মায়ের কথা ভগীরথ হাসে।
হাসিয়া কহিল কথা জননীর পাশে।।
সূর্য্যবংশে ভূপতিরা নির্ব্বোধের প্রায়।
অল্পশ্রমে গঙ্গাদেবী কে কোথায় পায়।।
যদি আমি ধরি ভগীরথ অভিধান।
গঙ্গা আনি করিব সগর বংশ ত্রাণ।।
কান্দিয়া কহিছে ভগীরথের জননী।
তপস্যায় এক্ষণে না যাহ যাদুমণি।।
মায়ের বচনে ভগীরথ না রহিল।
বশিষ্ঠের স্থানে মন্ত্রদীক্ষা সে করিল।।
যাত্রাকালে করে রাজা মায়েরে স্মরণ।
দক্ষিণ নয়ন তার করিছে স্পন্দন।।
মায়ের চরণে আসি করিয়া প্রণতি।
প্রথমে সেবিতে গেল দেব সুরপতি।।
অনাহারে ইন্দ্রমন্ত্র জপে নিরন্তর।
ইন্দ্রসেবা করে সাত হাজার বৎসর।।
মন্ত্রবশ দেবতা রহিতে নারে ঘর।
আইলেন বাসব তাহারে দিতে বর।।
কোন্ বংমে জন্ম তব কাহার তনয়।
ধর মাগি লহ যে অভীষ্ট তব হয়।।
প্রণাম করিয়া ইন্দ্রে বলিল বচন।
সূর্য্যবংশ-জাত আমি দিলীপ নন্দন।।
সগরের ছিল ষাটি সহস্র তনয়।
কপিল মুনির শাপে হৈল ভস্মময়।।
স্বর্গেতে আছিল গঙ্গা দেহ সুরপতি।
তাহে মম বংশের হইবে সদগতি।।
ইন্দ্র বলে, শুন বলি দিলীপ-কুমার।
আমা হৈতে দরশন না পাবে গঙ্গার।।
গঙ্গাকে আনিবা যদি, আমি দেই বর।
একভাবে ভজ গিয়া দেব মহেশ্বর।।
গঙ্গারে আনিলে মুক্ত হইবে পাষণ্ডে।
গুহা মুক্ত করি আমি দিব সেই দণ্ডে।।
ইন্দ্রের চরণে রাজা করিয়া প্রণতি।
কৈলাসে সেবিতে গেল দেব পশুপতি।।
ওকড়া ধুতুরা যে আকন্দ বিল্বপাত।
ইহাতেই তুষ্ট হন ত্রিদশের নাথ।।
কভু অনাহার করে কভু নীরাহার।
দৃঢ় তপ করে দশ হাজার বৎসর।।
মহেশ বলেন, শুন রাজার নন্দন।
অনাহারে এ তপস্যা কর কি কারণ।।
গঙ্গারে আনিবা তুমি আমি দিব বর।
একভাবে সেব গিয়া দেব গদাধর।।
শিবের চরণে পুনঃ করিয়া প্রণতি।
গোলোকে চলিয়া গেল যথা লক্ষ্মীপতি।।
এক দিন ভগীরথ কোটি মন্ত্র জপে।
গ্রীষ্মকালে তপ করে রৌদ্রের আতপে।।
শীত চারি মাস থাকে জলের ভিতর।
করিল এমন তপ চল্লিশ বৎসর।।
মন্ত্রবশ দেবতা রহিতে নারে ঘরে।
বর দিতে আসিয়া কহেন হরি তারে।।
তপস্যাতে তোমার আমার চমৎকার।
মাগ ইষ্টবর দিব রাজার কুমার।।
ভগীরথ বলে, প্রভু করি নিবেদন।
সগরের ছিল ষাটি হাজার নন্দন।।
কপিলের শাপেতে হইল ভস্মময়।
গঙ্গারে পাইলে তারা মুক্তিপদ পায়।।
কহিলেন সহাস্য বদনে চক্রপাণি।
গঙ্গার মহিমা বাপু আমি কিবা জানি।।
ভগীরথ বলে গঙ্গা নাহি দিবা দান।
তব পাদপদ্মেতে ত্যজিব আমি প্রাণ।।
শুনিয়া তাহারে হরি করেন আশ্বাস।
ব্রহ্মলোকে আছে গঙ্গা চল তাঁর পাশ।।
ছিল ব্রহ্মলোকেতে সামান্য যত জল।
মায়া করি হরিলেন হরি সে সকল।।
ব্রহ্মার সদনে প্রভু দিলেন দর্শন।
সম্ভ্রামে উঠিয়া ব্রহ্মা দিলেন আসন।।
পাদ্য দিতে যান ব্রহ্মা ঘরে নাহি জল।
জলহীন পাত্র মাত্র আছে অবিকল।।
কমণ্ডলু মধ্যে গঙ্গা পড়ে তাঁর মনে।
আস্তে ব্যাস্তে গিয়া ব্রহ্মা আনেন যতনে।।
গঙ্গাজলে বিষ্ণুপদ করয়ে ক্ষালন।
অঘ্রিংজা বলিয়া নাম এই সে কারণ।।
ভগীরথ রাজারে বলেন চিন্তামণি।
এই গঙ্গা লয়ে যাহ পতিতপাবনী।।
ব্রহ্মহত্যা গো-হত্যা প্রভৃতি পাপ করে।
কুশাগ্রে পরশে যদি সব পাপে তরে।।
স্নানেতে কতেক পুণ্য বলিতে না পারি।
বংশের উদ্ধার কর লৈয়া গঙ্গাবারি।।
শ্রীহরি বলেন গঙ্গা করহ প্রস্থান।
অবিলম্বে মুক্ত কর সগর-সন্তান।।
এত যদি কহিলেন প্রভু জগন্নাথ।
কান্দিয়া কহেন গঙ্গা প্রভুর সাক্ষাৎ।।
পৃথিবীতে কত শত আছে পাপিগণ।
আমাতে আসিয়া পাপ করিবে অর্পণ।।
হইয়া তাহারা মুক্ত যাবে স্বর্গবাসে।
আমি মুক্ত হৈব প্রভু কাহার পরশে।।
শ্রীহরি বলেন, যত বৈষ্ণব জগতে।
তাঁহারা আসিয়া স্নান করিবে তোমাতে।।
বৈষ্ণবের সঙ্গতি বাসনা করি আমি।
বৈষ্ণবের সঙ্গেতে পবিত্র হবে তুমি।।
গঙ্গাকে কহিয়া এই বাক্য জগৎপতি।
শঙ্খ দিয়া বলিলেন ভগীরথ প্রতি।।
আগে আগে যাহ তুমি শঙ্খ বাজাইয়া।
পশ্চাতে যাবেন গঙ্গা তোমাকে দেখিয়া।।
বিরিঞ্চি বলেন, রাজা তুমি পুণ্যবান।
তোমা হৈতে তিনলোক পাবে পরিত্রাণ।।
ভগীরথ আমার এ রথে তুমি লহ।
এই রথে চড়িয়া আগেতে তুমি যাহ।।
রথে চড়ি যায় আগে শঙ্খ বাজাইয়া।
চলিলেন গঙ্গা তাঁর পাচু গোড়াইয়া।।
স্বর্গবাসী আসি করে গঙ্গাজলে স্নান।
দেয় ভগীরথের মাথায় দূর্ব্বা ধান।।
স্বর্গে গঙ্গা মন্দাকিনী হইল আখ্যান।
আদিকাণ্ডে কৃত্তিবাস করিল বাখান।।