আস্তে-আস্তে দূরে মিলিয়ে গেলো নীলনদ আর তার আশপাশের অঞ্চল। তারপরে হাওয়া এলো প্রবল, আর কালো রাত চোখের সামনে সব ঢেকে দিলে। মস্ত একটা গাছের উপর নোঙর করা হলো বেলুন। যথারীতি ন-টা থেকে বারোটা পর্যন্ত পাহারা দিলেন ফার্গুসন, নির্দিষ্ট সময়ে কেনেডিকে ঘুম থেকে তুলে সাবধান করে দিলেন, খুব হুঁশিয়ার থেকো কিন্তু।
কেন বলোতো! সন্দেহের কিছু কারণ ঘটেছে নাকি?
না, তবে গাছের ঠিক নিচে কিরকম-একটা শব্দ শুনেছি একবার। কিন্তু শব্দটা যে কীসের তা বুঝতে পারিনি।
দোলনার রেলিঙ ধরে ঝুঁকে পড়ে কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন ডিক। একবার যেন শো-দুই গজ দূরে আলোর এক ফুলকি জ্বলে উঠলো, পরক্ষণেই তা মিলিয়ে গেলো আবার। ছোট্ট সেই স্ফুলিঙ্গ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে আর্ত এক চীৎকার স্তব্ধ রাতটাকে চিরে দিলে। কোনো জন্তুর গলার আর্তনাদ? না কোনো রাত-জাগা পাখির? মানুষের গলাও কি হতে পারে?
চোখে দুরবিন লাগিয়ে ডিক অন্ধকারের মধ্যে দেখবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুই তার চোখে পড়লো না। হঠাৎ মনে হলো কতগুলো কালো-কালো ছায়া যেন তাদের গাছের দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। এমন সময় মেঘ একটু পাৎলা হয়ে গেলো, আর ছেড়া-ঘেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে একটু জ্যোৎস্না এসে ছড়িয়ে পড়লো। ডিক স্পষ্ট দেখতে পেলেন কতগুলো লোক এসে তাঁদের গাছের নিচে জড়ো হয়েছে। তক্ষুনি তিনি ফার্গুসনকে জাগিয়ে তুললেন।
চুপ! ডিক সাবধান করে দিলেন ফার্গুসনকে, আস্তে কথা বলো 1 জো আর আমি মই বেয়ে বেলুন থেকে গাছটায় নেমে যাই।
তা-ই ভালো। ফাণ্ডসন তার প্রস্তাবে সায় দিলেন, আমি বেলুনে থেকে চট করে যাতে আকাশে উড়ে যেতে পারি, তার ব্যবস্থা করে রাখবো। কিন্তু সাবধান, নেহাৎ বেগতিক না-দেখলে বন্দুক চালিয়ো না। খামকা এদের কাছে আমাদের উপস্থিতি জানিয়ে কোনো লাভ নেই।
প্রথমে কেনেডি নামলেন চুপিসাড়ে, তাঁর পেছন-পেছন নামলে জো, তেমনি নিঃশব্দে। গাছের মগডালেই একটা সুবিধাজনক জায়গা ঠিক করে ভালোভাবে জোকে নিয়ে বসলেন কেনেডি। কান পেতে যা শুনলেন, তাতে বুঝতে পারলেন যে কতগুলো লোক গাছে উঠে আসছে। বুনো পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে গায়ে তেল মেখে এসেছে তারা, তার বোঁটকা দুর্গন্ধে নাক জ্বলে গেলো তার।
হঠাৎ একটু পরে কেনেডির হাত টিপলো জো। সাপের মতো আস্তে, নির্ভুলভাবে, লোকগুলো চারপাশ দিয়ে ডালে-ডালে এগিয়ে আসছে। যখন দুটি মাথা কাছে এসে পড়লো, ডিক নির্দেশ দিলেন, গুলি চালাও!
মাথা দুটি লক্ষ্য করে গর্জে উঠলো দু-জনের বন্দুক। সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা আর্তনাদ উঠলো, চটপট অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো লোকগুলো, আর সেই ধাবমান পদশব্দের মধ্যে আবার মমঘাতী আর্তনাদ উঠলো, কে যেন ফরাশিতে বলছে,বাঁচাও! বাঁচাও!
ফার্গুসন বেলুন থেকে উত্তেজিত গলায় বললেন, ডিক, শুনছো, কোনো-এক ফরাশি বিপদে পড়েছে। নির্ঘাৎ ওই জংলিগুলোর হাতে পড়েছে! তাকে উদ্ধার নাকরে আমরা কিছুতেই নড়বো না!
কিন্তু ওই ভীষণ জংলিদের তাড়াবো কী করে?
এখন যেমনভাবে তাড়ালে! ওরা যে আগ্নেয়াস্ত্রে অভ্যস্ত নয়, তা তো স্পষ্টই বুঝতে পারছে। ওদের সেই ভয়-পাওয়ার সুযোগই নিতে হবে আমাদের। সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হবে অবশ্য, কেননা এই অন্ধকারে ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানে হয় না। এরই মধ্যে আমাদের একটা ফন্দি বার করতে হবে, কী করে এই ফরাশিকে মুক্ত করা যায়।
এদিকে যদি আজ রাতেই জংলিরা ওঁকে মেরে ফ্যালে?
তা তারা করবে না। এ-সব জয়গায় জংলিরা সাধারণত দিনের বেলাতেই তাদের বন্দীদের হত্যা করে থাকে।
আজ রাতেই তো সুবিধে বেশি। জংলিরা এখন নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে দূরে সরে গেছে-এক্ষুনি কি আর সে-ভয় কাটিয়ে তারা ফিরবে? এদিকে সেই ফরাশি লোকটা হয়তো মিথ্যেই ঘাবড়ে থাকবে।
তার আর কী আছে? এক্ষুনি তাকে আমি আশ্বাস দিচ্ছি। এই বলে ফাণ্ডসন সেই সাহায্যপ্রার্থীকে উদ্দেশ করে ফরাশিতে চেঁচিয়ে বললেন, আপনি যে-ই হোন, নির্ভয়ে থাকুন। এখানে আপনার তিন বন্ধু আপনার সাহায্যের জন্যে তৈরি হয়ে আছে।
বন্দীর কাছ থেকে কোনো উত্তর এলো না, বরং হঠাৎ মিলিত কণ্ঠে জংলিরা উৎকট চেঁচিয়ে উঠলো।
সর্বনাশ! ডিক বললেন, জংলিরা নির্ঘাৎ একে এক্ষুনি সাবাড় করে দেবে।
কিন্তু কীই-বা করবে তুমি এই অন্ধকারে? কিছুই তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
এবার জো বললে, এই অন্ধকারকে আলো করে দেবার কোনো উপায় নেই। কি?
ফার্গুসন সরাসরি এ-প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কী যেন ভাবলেন একটু পরে বললেন, ঠিক আছে, তবে তা-ই হোক। বন্দুক হাতে তৈরি থেকো তোমরা–হয়তো গুলি চালাতে হবে আমাদের। জো, তুমি পাথরভরা থলে ধরে থাকবে, ইশারা করলেই তা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। আর ডিক-তোমার হাতে বন্দীকে তুলে নিয়ে আসার ভার। কিন্তু মনে রেখো, আমার নির্দেশ ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবে না। জো, তুমি নিচে গিয়ে চট করে নোঙরটা খুলে দিয়ে দেলনায় ফিরে এসো।
নিমেষে তার কর্তব্য পালন করলে জো। চুল্লির বৈদ্যুতিক ব্যটারিতে দুটি তামার তার ব্যবহার করা হচ্ছিলো, ফার্গুসন সে-দুটিকে হাতে নিয়ে দুটো কয়লার টুকরো চেঁছেচেঁছে তাদের মুখ ছুঁচলো করে দিলেন, তারপর দুটিকেই তারের মুখে বাঁধলেন। ব্যবস্থা শেষ হলে, দোলনায় দাঁড়িয়ে দু-হাতে অঙ্গারদুটি ধরে একসঙ্গে ছুঁইয়ে দিলেন। অমনি চোখ-ধাঁধানো এক শাদা আলো জ্বলে উঠে আশপাশের কালো অন্ধকারকে দূর করে দিলে।
সেই আলোয় দেখা গেলো, একটি খোলা মাঠের মাঝখানে মস্ত এক বাওবাব গাছের ডগায় তাঁদের বেলুন বাঁধা। দূরে, মাঠের এক প্রান্তে, কতগুলি নড়বোড়ে নিচু খোড়ো বাড়ি, তার চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক; আর, বেলুনের ঠিক নিচেই দেখা গেলো মাটিতে পড়ে আছে বছর তিরিশ বয়সের এক শ্বেতাঙ্গ, শতছিন্ন তার জামাকাপড়, সারা শরীরে বহু ক্ষতের চিহ্ন, তা থেকে দরদর করে রক্ত ঝরছে।
তার পোশাক দেখেই জো চীৎকার করে উঠলো, একজন মিশনারি দেখছি! এঁকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। দৃঢ় গলায় ফার্গুসন বলে উঠলেন।
লোকগুলো সম্ভবত বেলুনকে ভেবেছিলো মস্ত এক ল্যাজ-ঝোলা জ্বলন্ত ধুমকেতু বলে। ফার্গুসন তার হাতের আলোকে কুটিরগুলোর দিকে ফেরাতেই তারা ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
বেলুনের দোলনা মাটিতে ঠেকতেই ডিক নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে দু-হাতে ফরাশি ভদ্রলোককে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন, আর তক্ষুনি জো নুড়ি-ভরা বস্তাটা ছুঁড়ে ফেলে দিতেই বেলুন সবশুন্ধু ভীষণ দুলে উঠলো, এক ঝাঁকুনিতে প্রায় হাজার ফিট ওপরে উঠে এলো। ফার্গুসন তামার তার দুটিকে আলাদা করে দিলেন। চারদিক আবার কালো অন্ধকারে ড়ুবে যাবার আগে পলকে তিনি কজিঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন : রাত তখন একটা।
দোলনায় উঠেই ফরাশি ভদ্রলোকটি হতচেতন হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ফিরতেই ফার্গুসন তার দিকে ঝুঁকে পড়ে জানালেন, আর-কোনো ভয় নেই আপনার।
হ্যাঁ, খুব বেঁচে গেছি, ভাঙা ইংরেজিতে অবসন্ন গলায় সেই ফরাশি ভদ্রলোক বললেন, ভীষণ মৃত্যুর হাত থেকে দৈব আমাকে বাঁচিয়েছে। আপনারা ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছেন—আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তাহলেও আর আমি বাঁচবো না, আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। একটু পরেই যে আমার মৃত্যু হবে, তা আমি ঠিক জানি। এ-কথা বলেই তিনি ফের জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
সেই রক্তাপ্লুত শীর্ণ দেহকে একটি কম্বলের উপর শুইয়ে দেয়া হলো; ফাণ্ডসন দ্রুত হাতে তার ক্ষতস্থলে পট্টি বেঁধে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন।
এরপরে যখন তাঁর জ্ঞান হললা, ফরাশি ভাষাতেই তিনি তার কাহিনী বলে গেলেন। তিনি জন্মেছিলেন গরিবের ঘরে। ছেলেবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিলো ধর্মযাজক হবেন, সেইজন্যে তিনি রোমান ক্যাথলিক চার্চে যোগদান করেন; আফ্রিকায় যখন তিনি এলেন, তার বয়স মাত্র কুড়ি। বহু বিপদ ও উৎপাত সহ্য করে শেষকালে নীলনদের উৎসস্থলের কাছাকাছি এসে হাজির হন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে, তার ধর্মকে আর তার সহৃদয়তাকে মোটেই ভালো চোখে দ্যাখেনি, ফলে এই নিষ্ঠুরদের হাতে দু-বছর তাকে বন্দীভাবে কাটাতে হয়, তার ওপর চলতে থাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার। তবু তাদের জন্যে তিনি দিনরাত প্রার্থনা করেন, অনবরত সদুপদেশ দেন, শোনান সুসমাচারের গভীর বাণী। শেষে একদিন গৃহযুদ্ধের শেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো; তারপর তারা সেখান থেকে নতুন আস্তানার খোঁজে বেরুলো—যাবার সময় তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে গেলো। একটু সুস্থ হয়ে আবার তিনি আত্মনিয়োগ করলেন ধর্মপ্রচার ও মানবসেবার কাজে। তার মতে সভ্যতার যা সবেচেয়ে বড়ো উপঢৌকন, তিনি যে-ভেট নিয়ে এসেছেন এই অজ্ঞাত মহাদেশে, সেই প্রীতির বাণীই তিনি নানা স্থানে ঘুরে-ঘুরে প্রচার করতে লাগলেন। আফ্রিকার সবচেয়ে হিংস্র আদিবাসী যারা, সেই নিয়াম-নিয়ামদের সঙ্গে পর্যন্ত তিনি বছরখানেক বসবাস করেন। এমন সময় হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তাদের সর্দারের মৃত্যু হয়, সেই মৃত্যুর জন্যে তারা তাকেই দায়ী করে, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। গত চল্লিশ ঘণ্টা ধরে অবিরাম নানাপ্রকার অত্যাচার চলে তার ওপর। যদি অভিযাত্রীরা তাকে না-বাঁচাতেন, তাহলে আজ রাত দুপুরেই তার হত্যাকাণ্ড সমাধা হতো।
কোনো খেদ নেই আমার, ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বললেন, মরতে বসেছি বলে কোনো পরিতাপ নেই। কখনও আমি বিলাপ করিনি আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে, মনস্তাপে বা সন্তাপে কখনও বিচলিত হয়ে পড়িনি। মৃত্যুর আগে এই-যে আমার শ্বেতকায় দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে দেখা হলো আর জীবনের শেষ মুহূর্তে এই-যে মাতৃভাষায় দুটো কথা কইতে পারলাম, এর মধ্যে কি ঈশ্বরের অসীম করুণা প্রচ্ছন্ন নেই? আমার অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে শেষবার আমি প্রার্থনা করবো আপনাদের যাত্রা যাতে নিরাপদ ও সার্থক হয়। দয়া করে আমাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিন।
তাঁর অন্তিম প্রার্থনা পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না তিনি, কেনেডির কোলে তার নিপ্রাণ দেহ লুটিয়ে পড়লো। নীরবে দাঁড়িয়ে শোকার্ত অভিযাত্রীগণ এই করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন।
এই দেশের জন্যেই বহু রক্তক্ষরণ হয়েছে এর। এখানেই একে আমরা সমাহিত করবো। ফার্গুসন ফিশফিশ করে বললেন।
পরদিন কঙ্গোর উত্তর-সীমান্তের কিছু দূরে নেমে এই ফরাশি ধর্মযাজকের অন্ত্যেষ্টি সমাপন করা হলো। কবরের উপরে কাঠের ক্রুশ বসিয়ে দিয়ে ফার্গুসন খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
কী ভাবছো?
ভাবছি? কিছু না। অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন ফার্গুসন।ভাবছি প্রকৃতির কী নিমর্ম পরিহাস! আজীবন অসীম দারিদ্র্য আর দুঃখের মধ্যে কাটিয়ে তিনি কিনা অন্তিম শয়নে শুলেন সোনার ওপর!
সোনা। বলো কী?
হ্যাঁ, সোনার খনি! এই যে-সব পাথরের টুকরো তোমরা পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে, এগুলোর ভিতর রেণুর মতো ছড়িয়ে আছে সোনা। তার পরিমাণ কত হবে জানো?–এখানে যত সোনা ছড়িয়ে আছে, তাতে শুধু গোটা অস্ট্রেলিয়া আর ক্যালিফর্নিয়াকেই ধনী করা যায় না, অনেক মরুভূমিকেও ভরিয়ে তোলা যায়।