তিতুনি ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। দুপুরবেলার দিকে তাদের বাসার সামনে একটা ট্রেইলার এনে রাখা হয়েছে, তিতুনি আগে কখনো ট্রেইলার দেখেনি, এটা আসলে চাকা লাগানো একটা বাসা। এই ট্রেইলারের উপরে-নিচে, ডানে-বামে সব দিক দিয়ে নানা রকম যন্ত্রপাতি বের হয়ে আছে। ট্রেইলারের দরজা দিয়ে লোক ভেতরে ঢুকছে এবং বের হচ্ছে। একসময় সে দেখল তার আব্ব, আম্মু, টোটন আর এলিয়েন তিতুনি সেখানে ঢুকল। সে খুবই উত্তেজিত হয়ে কী হয় দেখার জন্যে তাকিয়ে রইল। যে এলিয়েন তিতুনিকে ধরার জন্য এত আয়োজন সেই এলিয়েন তিতুনি নিজেই এই ট্রেইলারে ঢুকেছে। তিতুনি অনেকক্ষণ প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে জানালার পাশে ঘাপটি মেরে ট্রেইলারের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর তিতুনি দেখল এলিয়েন তিতুনি বেশ হেলতে-দুলতে ট্রেইলার থেকে বের হয়ে এলো। তার মানে এই মহা ধুরন্ধর এলিয়েন তিতুনি সবাইকে বোকা বানিয়ে রেখেছে। এত দুঃখের মাঝেও তিতুনির একটু হাসি পেয়ে গেল।
তিতুনি দেখল এলিয়েন তিতুনি বাসার চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বাসার দিকে আসছে, তার মতলবটা কী কে জানে? বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠে তালাটা খুলল, তারপর গলা উঁচু করে ডাকল, “তিতুনি।”
তিতুনি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে উত্তর দিল, “কী হয়েছে?”
“তুমি বের হয়ে এসো।”
“কেন?”
“সবাই তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
“কেন?”
“এরা আগে কখনো এলিয়েন দেখে নাই। এলিয়েন দেখতে চায়।”
তিতুনি প্রায় বলেই ফেলছিল, “এলিয়েন কী আমি না তুমি? কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না, এই ধুরন্ধর মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনো চালাকি আছে। বলল, “ঠিক আছে আসছি। জামাটা বদলে আসি।”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “না না জামা বদলাতে হবে না। যেভাবে আছ সেভাবে বের হয়ে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে। আব্ব, আম্মু আর টোটনও তোমাকে দেখতে চায়।”
মেয়েটার কথা শুনে তিতুনির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার অবস্থা, তার নিজের আব্বু, আম্মু আর ভাই নাকি তাকে দেখতে চায়। একবার নিরিবিলি পেয়ে নিক তখন এই মেয়েটাকে সে বোঝাবে মজা।
যদিও এলিয়েন তিতুনি বলেছে যেভাবে আছে সেভাবেই যেন বের হয়ে আসে কিন্তু তিতুনি তারপরও চুলটা আঁচড়ে নিল, তার লাকি টি শার্টটা পরে নিল (এই টি-শার্ট পরে থাকলে সাধারণত তার বিপদ আপদ কম হয়)। বাসা থেকে বের হয়ে দেখল এলিয়েন তিতুনি সিঁড়ির উপর বসে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে ইচ্ছে করলেই বাসার ভেতরে ঢুকতে পারত, কিন্তু ঢুকেনি। এর পিছনে কোনো কারণ আছে কি না কে জানে।
তিতুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই এলিয়েন তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “দেখেছ, তোমাকে দেখার জন্যে সবাই কীভাবে অপেক্ষা করছে?”
“আমাকে দেখার জন্যে?”
“হ্যাঁ।” এলিয়েন তিতুনি হাত দিয়ে দেখাল, “কত যন্ত্রপাতি তোমার দিকে তাক করে রেখেছে দেখেছ?”
তিতুনি মাথা নাড়ল, এই মেয়েটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সে যেন কোনো বেস কথা বলে না ফেলে, এই যন্ত্রপাতি দিয়ে শুনে ফেলবে। তিতুনি তাই কোনো কথা বলল না। মুখ শক্ত করে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। এলিয়েন তিতুনি বলল, “চলো যাই।”
“চলো।”
তারা হেঁটে হেঁটে ট্রেইলারের দিকে যেতে থাকে। ট্রেইলারের দরজার কাছে আম্মু প্রায় ছুটে এসে তিতুনিকে ধরলেন, চোখ বড় বড় করে বললেন, “মা, তুই কোন দূর গ্রহ থেকে এসেছিস এখানে আমার বাসায়, একবার আমাকে সেই কথাটা বলবি না? তিতুনির বুদ্ধি শুনে শুনে তুই সারাক্ষণ ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকলি? কী খেয়েছিস, কোথায় ঘুমিয়েছিস কিছু জানি না মা–”
তিতুনির ইচ্ছে হলো বলে, “আম্মু, আমি মোটেও দূর গ্রহ থেকে আসিনি, আমি তোমার সত্যিকারের মেয়ে তিতুনি। যে ফাজিল মেয়েটাকে তুমি তোমার নিজের মেয়ে ভাবছ সে হচ্ছে ধুরন্ধর এলিয়েন, সবাইকে ঘোল খাওয়াচ্ছে”-কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর এই কথাগুলো বলা সম্ভব না, তাই মুখের মাঝে একটা এলিয়েন এলিয়েন ভাব ধরে রেখে দাঁড়িয়ে রইল।
আবু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “মা, তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো?” আবু সারা জীবন তিতুনিকে তুই করে বলে এসেছেন, এখন তুমি করে বলছেন। কপাল আর কাকে বলে। টোটন কোনো কথা না বলে চোখ বড় বড় করে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল।
নাহার তখন তাদের তাড়া দিল, বলল, “সবাই ট্রেইলাইরের ভিতর চলে আসেন।”
আম্মু তিতুনির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে থাকলেন, বললেন, “কী আশ্চর্য মা, তুই কেমন করে হুবহু আমার মেয়ের মতো হয়ে গেলি? এক বিন্দু পার্থক্য নাই, ঘাড়ে তিলটা পর্যন্ত আছে।”
তিতুনি মনে মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সারা জীবন এই তিলটা ছিল, সেটি এখন কোথায় যাবে? আম্মুকে এই মুহূর্তে সেটা বোঝাবে কেমন করে?
ট্রেইলারের ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি চালু হয়ে গেল। বিচিত্র শব্দ করতে শুরু করল। শামীম তিতুনিকে ট্রেইলারের এক কোনায় যন্ত্রপাতি দিয়ে বোঝাই একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বলল। তিতুনি মাথা ঘুরিয়ে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকাল, এলিয়েন তিতুনি সাথে সাথে বলল, “যাও। বসো চেয়ারটাতে। আমি সবার সাথে কথা বলে রেখেছি, কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।”
তিতুনি চেয়ারটাতে বসল, দেখে বোঝা যায় না কিন্তু চেয়ারটাতে বসতে খুব আরাম। আশেপাশে চারিদিকে নানা রকম যন্ত্রপাতি। শামীম উপর থেকে টেনে একটা হেলমেট নিচে নামিয়ে এনে তার মাথার মাঝে পরিয়ে দিল, সাথে বাইরের নানা ধরনের শব্দ কমে গিয়ে শুধু শোঁ শোঁ একটা শব্দ শুনতে পায়। চেয়ারের হাতলে তিতুনির দুটো হাত রাখা ছিল, দুটো যন্ত্র এসে হাত দুটোকে হাতলের সাথে আটকে ফেলল। তিতুনি টের পেল তার পা দুটোকেও একই কায়দায় আটকে দেয়া হয়েছে। বুকের উপর দুই পাশ থেকে দুটো চতুষ্কোণ যন্ত্র এসে আড়াআড়িভাবে তাকে আটকে ফেলেছে। তিতুনির বুকটা ধুকপুক করতে থাকে, এখান থেকে সে ছুটে বের হতে পারবে তো? সে নিজে বের হতে না পারলে এলিয়েন মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে বের করে নিবে।
তিতুনি টের পেল তার শরীরের সবকিছু পরীক্ষা করতে শুরু করেছে, হেডফোনে নানা ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, চোখের সামনে নানা রঙের আলো খেলা করছে, শরীরের নানা জায়গায় আলাদা আলাদাভাবে কম্পন টের পাচ্ছে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মাঝে বুঝে যাবে সে মোটেই এলিয়েন নয়, একজন খুবই ফালতু মানুষ, তখন তারা কী করবে?
তিতুনি দেখল বিদেশি মানুষ দুইজন অন্যদের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে, তখন তারা আব্বু-আম্মু আর অন্যদের কাছে এসে দাঁড়াল। নাহার বলল, “আমরা এখন এই এলিয়েন মেয়েটির উপর কিছু টেস্ট করব, এই সময়টাতে আপনাদের এই ট্রেইলারে থাকা ঠিক হবে না।”
আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
এলিয়েন তিতুনি জিজ্ঞেস করল, “টর্চার করবেন নাকি?”
নাহার জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না, না। টর্চার করব কেন? টেস্টগুলো করার সময় এলিয়েনের মনোযোগ এক জায়গায় থাকতে হবে। ট্রেইলারে পরিবারের সবাই থাকলে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।”
আম্মু জানতে চাইলেন, “কতক্ষণ টেস্ট করবেন?”
“আমরা তো চাইব ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। শুরুতে আধা ঘণ্টার একটা সেশান নেব।”
“আমরা বাসায় অপেক্ষা করি?”
শামীম বলল, “না। আপনারা বাসায় যেতে পারবেন না। আপনাদের বাসা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।”
টোটন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী করে রাখা হয়েছে?”
“কোয়ারেন্টাইন। কেউ যেতে-আসতে পারবে না। বাসা সিল করে দেয়া হয়েছে।”
আব্বু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমার সাথে কথা না বলে আমার বাসা সিল করে দেয়া হয়েছে মানে?”
শামীম মুখ শক্ত করে বলল, “এখানে যে টিম এসেছে তারা কত পাওয়ারফুল আপনারা বুঝতে পারছেন না। ড. গার্নার আর ড. ক্লাইডকে প্রোটেকশান দেওয়ার জন্য ইউএস মেরিনকে এয়ারলিফট করা হচ্ছে।”
আব্বু বললেন, “আমার সেটা জানার প্রয়োজন নাই। আমার বাসাকে সিল করে দেয়ার আগে আমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে। যখন আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
নাহার মুখ সুচালো করে বলল, “ড, গার্নার আর ড. ক্লাইডের ডিসিশান।”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “ড. গার্নার আর ড. ক্লাইডের খেতা পুড়ি। তাই না আব্বু?”
আব্বু এলিয়েন তিতুনিকে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই কেন বড়দের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস?”
আম্মু আব্বুকে বললেন, “এরা যখন চাইছে না আমরা এখানে থাকি তাই চলো আমরা বাইরে যাই।”
আব্বু বললেন, “বাইরে কোথায় যাব? জার্নি করে এসেছি, হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার ব্যাপার আছে। বাচ্চারা কিছু খায়নি।”
নাহার বলল, “পাশে আরেকটা ট্রেইলার আছে, সেখানে বাথরুম আছে, স্ন্যাকস আছে, চা-কফি আছে, রেস্ট নেয়ার ব্যবস্থা আছে, দরকার হলে শুতেও পারবেন। আপনাদের সেখানে রেস্ট নেয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
জটিল যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা চেয়ারে তিতুনিকে রীতিমতো বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে তিতুনি করুণ চোখে আব্বু আম্মু আর টোটনের দিকে তাকাল। এলিয়েন তিতুনি তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মুখে একটা ফিচলে হাসি। তিতুনির মনে হলো এই হইচইয়ের মাঝেই সে সূক্ষ্মভাবে একবার চোখ টিপে দিয়েছে সেটাই ভরসা। দরকার হলে এই ধুরন্ধর মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে উদ্ধার করবে।
ট্রেইলার থেকে বের হয়ে যখন আব্ব, আম্মু, টোটন আর এলিয়েন তিতুনি পাশের ট্রেইলারের দিকে যাচ্ছে তখন টোটন গলা নামিয়ে
এলিয়েন তিতুনিকে বলল, “তিতুনি–”
“বলো ভাইয়া।“
“আমি কি তোর সাথে একটু নিরিবিলি কথা বলতে পারি?”
“আমার সাথে?” এলিয়ে তিতুনি একটু অবাক হয়ে টোটনের দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ। আয় আমাদের বাসার সিঁড়িতে গিয়ে বসি।”
“চলো।” তখন দুইজন হেঁটে হেঁটে গিয়ে তাদের সিঁড়িতে গিয়ে বসল। টোটন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল, তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করে বলল, “এই যে পৃথিবীতে একটা এলিয়েন চলে এসেছে এইটা অনেক বড় একটা ঘটনা, চিন্তার বাইরের ঘটনা। তুই ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ সেটা জানত না। তুই নিশ্চয়ই খুব ভালো করে সবকিছু করেছিস, সে জন্যে এলিয়েনের সাথে তোর এত খাতির হয়েছে। এত বন্ধুত্ব হয়েছে।”
টোটন কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার শুরু করল, “তুই একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, গতকাল আমরা ঢাকা গিয়েছি, এই ট্রিপে অনেক কিছু ঘটেছে কোনোটাই ঠিক স্বাভাবিক না? পাগল ড্রাইভারের কারণে আমরা আরেকটু হলে মরেই যেতাম, মাইক্রোবাসটা রেললাইনে আটকে গিয়েছিল, একেবারে শেষ মুহূর্তে কী রকম হঠাৎ করে যেন ছুটে এলো। মনে আছে?”
অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল। টোটন বলল, “আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসটা সরিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, তারপর ধর ড্রাইভারের ব্যাপারটা। হঠাৎ করে সে ড্রাইভিং ভুলে গেল। এটা কি কখনো সম্ভব যে একজন মানুষের অন্য সব কিছু মনে আছে কিন্তু শুধু ড্রাইভিংটা ভুলে গেছে? দেখে কি মনে হয় না
যে কেউ একজন তার মাথার ভেতরে ঢুকে শুধু ড্রাইভিংয়ের অংশটা মুছে দিয়েছে?”
অন্য-তিতুনি মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।
টোটন বলতে থাকল, “তারপর ধর সি.এন.জি. স্টেশনে সেই মানুষটার কথা। ডিম বিক্রি করা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার পর তাকে আচ্ছামতন একটা শাস্তি দিল কে? অনেকগুলো কাক। এটা কি সম্ভব? সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। বুঝেছিস?”
অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”
টোটন কয়েক সেকেন্ড অন্য-তিতুনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এরপর ধরা যাক বড় ফুপুর বাসার ঘটনা। পৃথিবীতে কেউ কখনো শুনেছে একটা কম্পিউটার গেম যখন খেলা হচ্ছে তখন খেলার মাঝখানে সেটা পাল্টে গিয়ে অন্য রকমভাবে খেলতে শুরু করেছে? সব গ্রাফিক্স পর্যন্ত বদলে গেছে? এটা কি কখনো সম্ভব? সম্ভব না, কিন্তু বড় ফুপুর বাসায় এটা ঘটেছে। আমাদের চোখের সামনে সেটা ঘটেছে। নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস না করে উপায় কী?
টোটন এক সেকেন্ড থামল, তারপর কেমন যেন অপরাধীর মতো ভান করে বলল, “এর পরের ব্যাপারটা আমাদের করা উচিত হয় নাই। তোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আমরা প্ল্যান করে ডাইনিং টেবিলে তোর প্লেটে এক খাবলা লবণ দিয়ে দিলাম আর সেই লবণ সব হাজির হলো আমার প্লেটে। শুধু যে হাজির হলো তাই না-একশ’ গুণ বেশি তিতা হয়ে হাজির হলো। কীভাবে হলো এটা?”
অন্য-তিতুনি কোনো কথা না বলে টোটনের দিকে তাকিয়ে রইল। টোটন চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আবার কথা শুরু করল, বলল, “এর পরের ঘটনাটা খুবই লজ্জার। চিন্তা করলেই লজ্জায় আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সেই কাজটা করার চেষ্টা করা আমাদের একেবারেই ঠিক হয় নাই। আমি, নাদু আর দিলু মিলে ঠিক করলাম রাত্রে তুই যখন ঘুমিয়ে থাকবি তখন আমরা তোর বিছানায় এক গ্লাস পানি ঢেলে দিব, যেন তুই বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছিস। আসলে হলো কী? ঘুমানোর আগে আমাদের তিনজনের পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেল। সে কী পানির তৃষ্ণা। এক গ্লাস না, দুই গ্লাস
-তিন তিন গ্লাস পানি খেয়ে তখন শান্তি। তারপর কী হলো? একজন না দুইজন না তিন তিনজন রীতিমতো বড় মানুষ একই সাথে বিছানায় পেশাব করে দিলাম। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? এটা কি কখনো হতে পারে?”
অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল, স্বীকার করে নিল যে এটা হতে পারে না। টোটন তখন ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই দেখেছিস এইবার কতগুলি এইরকম অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে?”
অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “দেখেছি।” তারপর টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখান থেকে তুমি কী বলতে চাইছ ভাইয়া?”
“আমি বলতে চাইছি–”, টোটন মাথা চুলকে বলল, “আমি জানি কথাটা খুবই হাস্যকর শোনাবে, তবুও বলি। আমি বলতে চাইছি। আসল তিতুনিকে বাসায় রেখে এলিয়েন তিতুনি আমাদের সাথে ঢাকা গিয়েছিল।”
অন্য-তিতুনির মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, “মানে—”
“মানে তুই হচ্ছিস এলিয়েন। আর ট্রেইলারের ভিতর আসল তিতুনি এখন ভুজুংভাজুং করে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে।”
অন্য-তিতুনি কিছুক্ষণ টোটনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া, তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি আসলে এলিয়েন।”
টোটন কেমন যেন শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, “আসলেই তুই-মানে তুমি-মানে আপনি–”
অন্য-তিতুনি হি হি করে হেসে বলল, “ভাইয়া, আমাকে তোমার আপনি করে বলতে হবে না। আমি আসলে একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট তিতুনির কপি, বলতে পারো আগে একটা তিতুনি ছিল এখন দুইটা।”
টোটন কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে অন্য-তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তার মানে আসলে আমি বিছানায় পিশাব করি নাই-তুমি মানে তুই আমাকে পিশাব করিয়েছিস?”
“হ্যাঁ। আমি করিয়েছি।”
টোটন চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “তার মানে অন্য একটা গ্যালাক্সি থেকে আসা একটা এলিয়েনের বড় কোনো কাজ নাই? তার কাজ হচ্ছে।”
অন্য-তিতুনি হি হি করে হেসে বলল, “ভাইয়া, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ। এখানে আসার পর এলিয়েনটা আর এলিয়েন নাই, সে তিতুনি হয়ে গেছে। তিতুনির মতো দেখতে একটা প্রাণী না, পুরোপুরি তিতুনি। এখানে তিতুনির যে কাজ সেটা হয়ে গেছে এলিয়েনের কাজ। আসল তিতুনি অনেক কিছু পারে না, আমি পারি। এই হচ্ছে পার্থক্য।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ এলিয়েন তিতুনি থেমে গেল। হাত তুলে বলল, “এক সেকেন্ড।”
“কী হয়েছে?”
“ট্রেইলারের ভেতরে ঐ ফাজিল মানুষগুলো তিতুনিকে একটা বাজে ইনজেকশান দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি ইনজেকশানটাকে নিউট্রালাইজ করে দিই।”
টোটন ভয়ে ভয়ে বলল, “কী ইনজেকশন?”
“ওরা বলছে টুথ সিরাম। এটা দিলে মনের জোর ভেঙে যাবে, যেইটাই বলবে তিতুনিকে সেটাই করতে হবে। ফাজলেমি পেয়েছে?”
এক সেকেন্ড পরে এলিয়েন তিতুনি টোটনের দিকে তাকাল তারপর বলল, “হ্যাঁ, নিউট্রাল করে দিয়েছি। এখন বরং উল্টা কাজ হবে, তিতুনির ভেতরে কোনো ভয়-ডর থাকবে না।”
টোটন কেমন যেন হাঁ করে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কী আশ্চর্য। আমি একটা এলিয়েনের পাশে বসে আছি! এলিয়েন! সত্যিকারের এলিয়েন!”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “এখন তুমি কী করবে? আমাকে ধরিয়ে দেবে?”
টোটন গলা উঁচিয়ে বলল, “ধরিয়ে দেব? ধরিয়ে দেব কেন? এইটা সত্যি এত দিন আমি তিতুনিকে কোনো পাত্তা দেই নাই, উঠতে-বসতে জ্বালিয়েছি। আর আমার এই বোকাসোকা বোনটা একটা এলিয়েনের সাথে খাতির করে সারা পৃথিবীর সবাইকে বোকা বানাচ্ছে, আর আমি তাকে ধরিয়ে দেব? তুই আমাকে তাই ভাবলি?”
এলিয়েন তিতুনি তখন কোনো কথা না বলে তার ডান হাতটা উপরে তুলল, টোটন তখন সেখানে একটা হাই ফাইভ দিল। প্রথমবার ভাই-বোনে বন্ধুত্ব হয়ে গেল, যদিও অরিজিনাল না তবুও তো ভাই বোন।
টোটন কিছুক্ষণ একা একা বসে বসে হাসল, তারপর বলল, “তুই এখন কী করবি?”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “চলে যাব।”
টোটন কেমন যেন চমকে উঠল, বলল, “চলে যাবি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? চলে যাবি কেন?”
“সব জানাজানি হয়ে গেছে, এখন আর থাকা যাবে না। এটা আমাদের নিয়ম, কোথাও গেলে সেখানে জানাজানি হতে পারবে না।”
“কিন্তু–”, টোটন প্রায় হাহাকার করে বলল, “কোন গ্যালাক্সি থেকে এসে পৃথিবীর কিছুই দেখলি না জানলি না, আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করে সময় কাটিয়ে দিলি–”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “কে বলেছে কিছু দেখি নাই; এই পৃথিবীর সবচেয়ে দরকারি জিনিসগুলি জেনে গেছি।”
“কী দরকারি জিনিস?”
“এই যে মানুষ কীভাবে চিন্তা করে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে, আসলে ভেতরে ভেতরে ভালোবাসে। কোনো কারণ ছাড়া হি হি করে হাসে। কী অদ্ভুত।”
“কিন্তু পৃথিবীর কত রকম যন্ত্রপাতি কত আবিষ্কার—”
এলিয়েন তিতুনি বলল, “ধুর! এইগুলা কোনো আবিষ্কার নাকি? সব খেলনা। সেই খেলনা নিয়ে কী অহঙ্কার! ট্রেইলারের ভেতরে ছাগলগুলো ভাবছে তিতুনিকে আটকে ফেলে তার কাছ থেকে সবকিছু বের করে ফেলবে। এই কাঁচকলা।” বলে তিতুনি তার হাত দিয়ে কাঁচকলা বানিয়ে দেখাল।
টোটন বলল, “তুই চলে যাবি?”
“হ্যাঁ।”
“কখন?”
“এই তো কয়েক মিনিটের ভেতরে।”
টোটন চিৎকার করে উঠল, “কয়েক মিনিটের ভেতর?”
“হ্যাঁ, আমি আমার স্পেসশিপে যোগাযোগ করেছি। তারা ব্যবস্থা করছে।”
টোটন কেমন যেন অবাক হয়ে এলিয়েন তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, প্রায় কান্না কান্না গলায় ফিসফিস করে বলল, “তুই চলে যাবি?”
“হ্যাঁ ভাইয়া। তিতুনি থাকবে, শুধু আমি চলে যাব। আমি তো আরেকটা তিতুনি ছাড়া কিছু না, সেই তিতুনি তো আছেই।”