১৩. ডুয়ার্সের বৃষ্টি সম্পর্কে

ডুয়ার্সের বৃষ্টি সম্পর্কে পন্ডিতরাও কোনও পূর্বাভাস দিতে পারেন না। ওরা যখন আজ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, তখন আকাশ পরিষ্কার। গাছপালা এখনও ভেজা, কিন্তু পায়ের তলায় জল জমেনি। সুন্দর আগে-আগে যাচ্ছিল।

বাংলো থেকে ওরা একসঙ্গে জঙ্গলে ঢোকেনি। মেজর এবং অর্জুন যেমন বেড়াতে যায় তেমনই একটু আগেভাগে বেরিয়েছিল। নুড়ির রাস্তাটা ধরে কিছুটা এগিয়ে ওরা জঙ্গলে পা রেখেছিল। অমল সোম এসেছিলেন মিনিট দশেক পরে। প্রত্যেকেই সঙ্গে একটা ব্যাগ অথবা প্যাকেট নিয়ে এসেছে। তাতে দু-একদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে। মেজর বেশ উত্তেজিত। সুন্দরের কথা তিনি জানতেন না। একটু আগে অর্জুনের মুখে সব শুনে মাথা নাড়লেন, মুশকিলে ফেললে আমাকে?

কেন? অর্জুন বুঝতে পারল না।

যেভাবেই হোক একবার না একবার ওই সুন্দরের মাথায় মারতে হবে আমাকে। মার খেয়ে হজম করে যাচ্ছিলাম কে মেরেছে জানি না বলে। জানার পর বদলা না নিলে নিজেকেই অসম্মান করব।

অসম্মান?

হ্যাঁ, মনে হবে আমি খুব ফালতু, শক্তিহীন, মুখ বুজে মার খেয়ে যাই।

কিন্তু সুন্দর তো জেনেশুনে আপনাকে মারেনি। অন্ধকার জঙ্গলে আপনাকে শত্রু ভেবে সে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। পরে আপনার জ্ঞানহীন শরীরটাকে পাহারা দিয়েছে। আমরা আপনাকে খুঁজতে গেলে সেই জায়গাটা চিনিয়ে দিয়েছে। এটা ভাবুন।

মাথা নাড়লেন মেজর, সব ঠিক, কিন্তু…দেখি।

শেষ পর্যন্ত বিকেল হয়ে এল। মাঝে মাঝে জঙ্গল এত ঘন যে, চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। তবে ভুটানের পাহাড় কাছে এসে পড়েছে, চোখেই দেখা যাচ্ছে। অমল সোম সুন্দরের সঙ্গে তাল রেখে চলছিলেন। অর্জুন তাদের পায়ে-পায়ে, মেজব মাঝে মাঝেই পিছিয়ে পড়ছেন। তাঁর পিছিয়ে পড়ার কারণ নাকি বুটজোড়া। ওটা তিনি আফ্রিকার জঙ্গলে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতেন। আজ জঙ্গলে অভিযান জেনে পায়ে গলিয়েছিলেন কিন্তু ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে যে আফ্রিকার জিনিস অচল, তা জানতেন না।

অর্জুন লক্ষ করছিল এতটা দূর জঙ্গল ভেঙে আসতে তেমন কোনও বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়নি। কয়েকটা বনমুরগি, খরগোশ এবং দুটো শেয়াল ছাড়া কেউ ওদের সামনে আসেনি। গতকালের বৃষ্টির জন্য আজ ওরা যে-যার ডেরায় লুকিয়ে আছে কিনা কে জানে! কিন্তু উলটোটাই তো হওয়া উচিত।

অমল সোম বললেন, দিন শেষ হওয়ার আগে আমরা যতটা সম্ভব পাহাড়ের কাছাকাছি চলে যেতে চাই। এসব জায়গায় রাত কাটানো মোটেই আরামদায়ক হবে না।

সুন্দর বলল, সাহেব ঠিক বলেছেন। তা ছাড়া রাত্রে বৃষ্টিতে ভেজা খুব কষ্টের।

মেজর চোখ বড় করলেন, আকাশ দেখে মনে হচ্ছে না তিন দিনের মধ্যে বৃষ্টি হবে। তবে আপনি যখন বলছেন মিস্টার সোম, তখন আমাদের হাঁটতে হবেই।

আপনি কি টায়ার্ড?

টায়ার্ড আমি কখনও হই না, একটু খিদে খিদে ভাব হয়েছে এই যা।

অমল সোম তাঁর ব্যাগে হাত ঢোকালেন। ব্যাগটা বেশ ভারী। তা থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলেন, খেয়ে নিন।

আমি একা খাব কি! মেজর লজ্জিত হলেন।

যার-যার খিদে পেয়েছে, খাবে। জঙ্গলে সঙ্কোচের কোনও মূল্য নেই। নিজেকে সুস্থ রাখাই বড় কথা। বিস্কুটের প্যাকেটের মুখ খুলে নিজে একটা নিয়ে মেজরের হাতে ধরিয়ে দিলেন। দেখা গেল খিদে কারও কম পায়নি।

খানিকটা এগোতেই গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। সম্ভবত ট্রাক চলছে। অমল সোম তাকালেন সুন্দরের দিকে, এদিকে মোটরের রাস্তা আছে নাকি?

মাটির রাস্তা। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লরি চলে।

কতদূর গিয়েছে?

আমি দেখিনি।

চলো, একবার দেখা যাক, ট্রাকে কী যাচ্ছে?

শর্টকাট পথ করে ওরা মিনিট পাঁচেক যেতেই রাস্তাটাকে দেখতে পেল। বোঝাই যাচ্ছে, ওই রাস্তা সচরাচর ব্যবহার করা হয় না। তারপরেই ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। দেখা গেল একটা খালি ট্রাক ফিরে যাচ্ছে। ড্রাইভার এবং খালাসি ছাড়া গাড়িতে কেউ নেই।

অমল সোম নিচু স্বরে বললেন, খালি ট্রাক ফিরে যাচ্ছে। ওদের তো কাঠ বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার কথা। এমনি বেড়াতে নিশ্চয়ই আসেনি।

অর্জুন বলল, কোনও জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল হয়তো!

হ্যাঁ। কোথায় গিয়েছিল?

দৌড়ে গেলে ট্রাকটাকে ধরা যায়।

নাঃ। তাতে কিছু লাভ হবে না। উলটে আমাদের অস্তিত্ব জানিয়ে দেওয়া হবে। চলল।

মেজর চুপচাপ শুনছিলেন, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না।

কী? অমল সোম তাকালেন।

এইরকম একটা রাস্তা থাকতে আমরা এত কষ্ট করে জঙ্গল ভেঙে এলাম কেন? একটা ট্রাক বা জিপ ভ করে অনেক কম সময়ে চলে আসতে পারতাম।

পারতাম, যদি রাস্তাটার কথা জানা থাকত। জঙ্গলের ম্যাপে এই রাস্তাটার কোনও হদিস নেই। ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং। অবশ্য থাকলেও ওই রাস্তা না ব্যবহার করে আমরা ভাল করেছি। মেজর, কষ্ট করলেও তো কেষ্ট মেলে। চলুন।

একটু আগেও ওরা ভোলা মনে হাঁটছিল। অর্জুন গুনগুন করে গানও গেয়েছে। কিন্তু ওরা এখন নিঃশব্দে সতর্ক-পায়ে হাঁটছিল। ভুটানের পাহাড়ের প্রায় গায়ে পৌঁছাতেই অন্ধকার নেমে এল জঙ্গলে। সুন্দর চটপট তল্লাশি করে একটা জায়গা বাছল। সমতল থেকে জঙ্গল উঠে গেছে পাহাড়ে। ভূটান এবং ভারতবর্ষের মধ্যে কোনও দেওয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া নেই। এ-দেশের মানুষ ওদেশে চলে যাচ্ছে পাসপোর্ট ছাড়াই। পাহাড়ের নীচে একটা চওড়া পাথর পড়ে ছিল। পাথরটার ওপরের দিক বেশ মসৃণ। ফুট-দশেক হবে পাথরটা। মাথার ওপর একটা ঝাঁকড়া গাছ আছে।

অমল সোমেরও পছন্দ হল পাথরটা। রাত্রিবাসের পক্ষে ভালই। অল্প বৃষ্টি হলে গাছ তাদের রক্ষা করবে, আবার মাটিতে ঘোরা জীবজন্তু সহজে নাগাল পাবে না। তিনি মেজরকে বললেন, প্রাকৃতিক কাজকর্ম সেরে উঠে পড়ুন ওপরে।

মেজর বললেন, আগে জানলে তাঁবু সঙ্গে আনতাম।

অর্জুন বলল, সেটা আনলে মন্দ হত না। তাঁবুতে থাকা একটা দারুণ ব্যাপার।

মেজর বললেন, তোমাকে নিয়ে একবার আফ্রিকায় যাব। দেখবে কী থ্রিল।

ওপরে উঠতে মেজরের একটু কষ্ট হল। ভারী শরীরটাকে টানাহ্যাঁচড়া করে তুলতে অর্জুনের সাহায্য নিতে হল। ওঠার পর হাত-পায়ের জড়তা ছাড়াতে কয়েকবার শুন্যে ছুঁড়ে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক। শুধু যদি চাঁদ উঠত আজ রাত্রে।

অর্জুন দেখল আকাশের নীল এখন হারিয়ে যাচ্ছে। পাতলা মেঘের আস্তরণ ছড়াতে শুরু করেছে। বৃষ্টি যতক্ষণ না থামছে ততক্ষণ এই পাথরের বিছানা বেশ আরামদায়ক। নীচে একটা আড়াল দেখে আগুন জ্বালিয়েছে সুন্দর। অমল সোমের সঙ্গে তর্ক চলছে তার। অর্জুন পাথরের ধারে এসে কান পাতল। সুন্দর বলছে, সাহেব, আপনি আমাকে আধঘণ্টা সময় দিন, আমি চারটে মুরগি ধরে আনছি। এই মুরগিগুলো রাত্রে ভাল দেখতে পায় না। এদিকে মানুষজন আসে না বলে ওদের পেতে অসুবিধে হবে না।

অমল সোম বললেন, কোনও দরকার নেই। আমার সঙ্গে ড্রাই ফুডের কৌটো রয়েছে। টিন-ফিশের কৌটো খুলে একটু গরম করে নিলে দিব্যি চলে যাবে। সঙ্গে একটু কফি করে নেওয়া যাক।

অর্জুন বলল, অমলদা, ও যখন বলছে ধরে আনতে পারবে, তখন টিন-ফিশগুলো কালকের জন্যে থাকলে মন্দ হয় না।

অমল সোম ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রাণী-হত্যা করতে চাও?

বাংলোয় বসেও তো আমরা মুরগি খেয়েছি।

ঠিক আছে। একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক।

অমলদার ব্যাগে যে কফি বানাবার সরঞ্জাম ছিল, অর্জুন জানত না। প্লাস্টিকের গ্লাসে লাল গরম কফি খুব ভাল লাগল। আগুন নিভিয়ে দিয়ে নিজের ঝোলা নিয়ে সুন্দর ঢুকে গেল জঙ্গলে। অমল সোম পাথরের ওপরে উঠে এলেন, জায়গাটা দেখছি ভালই।

শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাসটা ফেলে দিতে গিয়ে সামলে নিলেন মেজর। পাশে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা ঠিক কীসের অভিযানে এসেছি মিস্টার সোম?

এটাকে কি অভিযান বলা যায়!

তো কী? জঙ্গলে রাত কাটানো, মাইলের পর মাইল হাঁটা। আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি কিন্তু বিষাক্ত ফুল খুঁজতে আমাকে সাহায্য করছেন না।

কীভাবে করব সেটাই তো বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা, এখানে কেউ বলল না ওরকম ফুলের কথা আগে শুনেছে। জঙ্গলে তো অনেক ঘোরাঘুরি হল, সেই রকম ফুলের অস্তিত্ব নজরে পড়ল না। আমার মনে হয় কেউ মনগড়া গল্প প্রচার করেছে।

তার কী লাভ? মেজর প্রতিবাদ করলেন।

গুজব যারা ছড়ায়, তারা কি সব সময় নিজের লাভের কথা চিন্তা করে?

আমি কিন্তু এত সহজে ছাড়ছি না। সমস্ত পৃথিবীর লোক ভগবান ভগবান করে মরছে, ভগবানকে কেউ চোখে দ্যাখেনি বলে সেটাকে মিথ্যে বলে বাদ দিচ্ছে না তো!

ভয়ে।

ভয়ে, মানে?

ভগবান না থাকলে মানুষের আর কিছুই থাকবে না।

মেজর গুম মেরে গেলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা ক দিন জঙ্গলে থাকব?

কালই ফিরে যেতে পারি। আমি একটা সেরাও ধরতে চাই।

সেরাও? মেজর অবাক হলেন।

হ্যাঁ। পাহাড়ি ছাগল। খুব বিরল প্রজাতির। ওর আঞ্চলিক নাম থর। যেহেতু ওরা আমাদের বনাঞ্চলে কম আসে, তাই বনবিভাগ সরাসরি কিছু করতে পারছে না। ওরা সাধারণত ভুটানের পাহাড়ের নীচের দিকে ঘোরাফেরা করে। হঠাৎ এই নিরীহ প্রাণীটির চাহিদা পশ্চিমের বাজারে বেড়ে গিয়েছে। ফলে আমাদের দেশের লোভী মানুষেরা আরও বড়লোক হওয়ার নেশায় মেতে উঠেছে। ভুটানের রাজাও চাইছেন ওদের রক্ষা করতে। কিন্তু ওদের সংখ্যা কত, ঠিক কোথায় থাকে, তাও কারও জানা নেই। আর জায়গাটা যেহেতু দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চল, তাই বিধিনিষেধের বেড়া টপকানো মুশকিল হয়ে গিয়েছে। আমি, যদি কপালে থাকে, একটা সেরাও ধরব। তারপর তাদের দলের সন্ধান পেতে অসুবিধে হবে না। অমল সোম বললেন।

অর্জুন বলল, ওদের তো অনেক দল থাকতে পারে।

অনেক হলে তো সংখ্যায় ভারী হবে। দল কত তা জানা যাচ্ছে না।

আপনাকে কী করতে হবে?

একটা রিপোর্ট দিতে হবে। সেরাওদের কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং চোরাশিকারিদের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় কী, তা জানাতে হবে সরকারকে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা যখন সরকারি, তখন তো আপনি প্রকাশ্যে দলবল নিয়ে আসতে পারতেন। এই রিপোর্ট দুটোর জন্যে গোপনীয়তার কোনও দরকার ছিল কী?,

ছিল। প্রথমত… অমল সোম থেমে গেলেন। জঙ্গলে তখন গভীর অন্ধকার নেমে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেই অজস্র জোনাকি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। পাখিরাও চুপ করে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু মাঝে মাঝেই অদ্ভুত ডাক ভেসে আসছে। এই ডাক কোনও পরিচিত জানোয়ারের নয়। কী রকম গা ছমছমে হয়ে উঠছিল পরিবেশ।

হঠাৎ মেজর ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ল্যাঙ্গো।

সেটা কী জিনিস? অর্জুন জানতে চাইল।

অদ্ভুত জীব। একে আমি দেখেছি ব্রাজিলে। ড়ুয়ার্সে এ এল কী করে?

কী রকম দেখতে?

শেয়াল, হায়েনা, নেকড়ে পাঞ্চ করলে যেমন দাঁড়ায়, মুখটা কিছুটা বুলড়গের মতো।

বুনো কুকুর?

তা বলতে পারো। খুব হিংস্র হয়। বড় দলে থাকলে বাঘও ওদের এড়িয়ে চলে। চোয়াল খুব শক্ত। এই পাথরের ওপর লাফিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না।

অমল সোম বললেন, আপনার কলমটাকে হাতের কাছে রাখুন। দরকার হলে পুড়িয়ে দেবেন। একটা পুড়লে আর কেউ আসবে না।

ল্যাঙ্গো ডেকে যাচ্ছিল। বেশ করুণ ডাক। সম্ভবত সঙ্গীদের সন্ধান করছে। অর্জুনের মনে হল রাত না নামলে জঙ্গল রহস্যময় হয় না। কিন্তু সুন্দর তো এখনও ফেরেনি। সে যদি ওই ল্যাঙ্গোর সামনে পড়ে? তার মনে অস্বস্তি ঢুকল।

অমল সোম বললেন, হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। প্রথমত, সরকারি দল আমাকে ইচ্ছেমতন সেরাও দেখাতে পারত না। ওরা জনপদ এড়িয়ে চলে। দুই, চোরাশিকারিরা আমাদের অস্তিত্ব জেনে যেতই এবং নিজেদের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ রাখত। তাই আমি এখানে এসে একজন লোকাল লোকের খোঁজ করছিলাম, যে কখনও সেরাও দেখেছে। ডি এফ ও বলেছিলেন হদিস দেবেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত সে রকম কারও সন্ধান তিনি পাননি। তখন ভাবলাম, নিজেরাই জঙ্গলে ঘুরব। এই সময় তোমার সুন্দরবাবুর খবর পেলাম।

এই চোরাশিকারিদের, যারা সেরাও এক্সপোর্ট করতে পারে, তাদের সন্ধান পেয়েছেন?

না। অনুমানের ওপর নির্ভর করে আমি কখনও সিদ্ধান্ত নিইনি।

তা হলে সুন্দরকে পেয়ে আমাদের লাভ হয়েছে, বলুন।

অবশ্যই।

সুন্দর পাখি ধরত, বিক্রি করত। আমার কথা শোনার পর লোকটার মধ্যে সত্যিই পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু নীলবাবু ওকে অন্য একটি কাজের দায়িত্ব দিলেন। ওকে সেরাও ধরতে হবে। বুঝতেই পারছেন বিদেশে সেরাও এক্সপোর্ট করা নীলবাবুর পক্ষে সম্ভব।

এসব হয়তো সত্যি, কিন্তু প্রমাণ করতে পারবে না। সুন্দর যে বানিয়ে বলছে না, তারই বা প্রমাণ কী? কোনও অন্যায় করে ও হয়তো জঙ্গলে লুকিয়ে আছে।

কার কাছে অন্যায় করবে?

আমি জানি না। শুধু বলতে চাইছি প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছু কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। অমল সোম চুপ করতেই পাতার শব্দ হল। মেজর হাত উঁচু করলেন। অন্ধকারেও বোঝা গেল সেই হাতের মুঠোয় কলমটি ধরা রয়েছে।

কে, সুন্দর? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, সাহেব। দুটো ধরেছি। বেশ বড়সড়, চারজনের হয়ে যাবে।

কোথায় পেলে?

ওই পাহাড়ের খাঁজে। সিকি মাইল দূরে। কিন্তু সাহেব, আপনারা আস্তে কথা বলুন। আমি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম।

কেন?

জঙ্গলে লোক ঢুকেছিল। এখনও আছে কিনা জানি না, আমি এই প্যাকেটটা কুড়িয়ে পেয়েছি পাহাড়ের গায়ে। খেয়ে দেখুন, একেবারে টাটকা। হয়তো কারও পকেট থেকে পড়ে গিয়েছে। সুন্দর প্যাকেটটা ওপরে ছুঁড়ে দিল। অর্জুন কোনওমতে ধরে ফেলল। যত অন্ধকারই হোক আকাশ একটু চোরা আলো পাঠায়। মেজর চাপা গলায় বললেন, শাবাশ।

প্যাকেটটা দেখে অর্জুন বলল, ডানহিল। অর্ধেকের বেশি সিগারেট আছে।

অমল সোম বললেন, হুঁ। এদিকের লোকের ডানহিল পাওয়ার কথা নয়।

ওদিকে সুন্দর বসে গিয়েছে মুরগি নিয়ে। অত দ্রুত মুরগি ছাড়িয়ে কাউকে আগুন জ্বালাতে দেখেনি সে। দুটো লম্বা কাঠির মধ্যে একটা কাঠি আড়াআড়ি পেতে তার তলায় আগুন জ্বালিয়ে দিল সুন্দর। তারপর মুরগি দুটোকে আড়াআড়ি কাঠির মধ্যে কায়দা করে ঝুলিয়ে দিল। দিয়ে বলল, বড্ড জোঁক হয়েছে জঙ্গলে। কাল জল হওয়ায় ওদের বাড় বেড়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে ওরা তিনজন নিজেদের প্যান্ট-শার্ট-জুতো পরীক্ষা করতে লাগল। না, জোঁক কারও শরীরে হানা দেয়নি। নিবিষ্ট হয়ে মুরগি ঝলসাচ্ছিল সুন্দর। বেশ পাকা হাতের কাজ। মিনিট কুড়ি লাগল। তারপর এক-একটা মুরগি দুটুকরো করে ওপরে চালান করে দিয়ে বলল, নুন কম লাগবে। তা আর কী হবে।

অমল সোম বললেন, আমার সঙ্গে নুন আছে। যার যেমন ইচ্ছে মাখিয়ে নাও।

সুন্দর ওপরে উঠে এল। প্রায় পাঁচশো গ্রাম ঝলসানো মুরগির মাংসে কামড় দিয়ে অর্জুনের মনে হল, এর চেয়ে ভাল রোস্টেড চিকেন সে কখনও খায়নি।

ঠিক তখনই কয়েক হাত দূরে বীভৎস ডাকটা আচমকা শোনা গেল।