দুর্য্যোধন মহাবীর, দেখিয়া না হয় স্থির,
বিস্তর পড়িল সৈন্যগণ।
মনে যুক্তি বিচারিয়া, শকুনিরে পাঠাইয়া,
আনাইল সূর্য্যের নন্দন।।
বসিয়া বিরল স্থানে, যুক্তি করে তিনজনে,
রাধেয় শকুনি দুর্য্যোধন।
কহিলেন কুরুবর, শুন কর্ণ ধনুর্দ্ধর,
মম দুঃখ করি নিবেদন।।
পাণ্ডবে জিনিবে রণে, হেন আশা করি মনে,
যুদ্ধ হেতু করিব উপায়।
তিনলোকে সবে জানি, দেবতা অসুর মুনি,
বাখানয়ে ভীষ্ম মহাশয়।।
সেনাপতি করি তাঁরে, ভাসি সুখ সরোবরে,
সমরে জিনিব বৈরিগণে।
মনে হেন করি সাধ, বিধি তাহে দেয় বাদ,
হীনবল হই দিনে দিনে।।
দ্রোণ ভীষ্ম মহাসত্ব, কৃপ শল্য সোমদত্ত
আর যত মহারাজগণ।
পাণ্ডবেরে স্নেহ করি, ক্ষত্রধর্ম্ম পরিহরি,
সবে মেলি উপেক্ষিল রণ।।
রণে পড়ে সেনাগণ, ব্যাকুল আমার মন,
আর কেহ না করে উদ্দেশ।
দেখিয়া এ সব রীত, মহাভয় উপস্থিত,
কি করিব কহ সবিশেষ।।
তুমি উদাসীন রণে, মম দুঃখ বিমোচনে,
আর কেবা সংগ্রাম করিবে।
নিবেদিনু বরাবরে, ভাল যুক্তি দেহ মোরে,
কি উপায়ে পাণ্ডবে মারিবে।।
বলে কর্ণ ধনুর্দ্ধর, শুন কুরু নরবর,
সুযুক্তি বিচারে এই হয়।
বুঝিয়া করহ কার্য্য, তবে সে পাইবে রাজ্য,
হইবে পাণ্ডব পরাজয়।।
গঙ্গাপুত্র কৃপ দ্রোণ, আর যত যোদ্ধাগণ,
না ছাড়েন পাণ্ডবের আশ।
এতেক পাণ্ডব ভক্ত, ভীষ্ম তাহে নহে শক্ত,
সেনাপতি কর্ম্মেতে উদাস।।
বসিয়া দেখুন যুদ্ধ, আমি করি কার্য্যসিদ্ধ,
পাণ্ডবেরে করিয়া সংহার।
পুনরপি চলি যাহ, ভীষ্মের অগ্রেতে কহ,
এই যে মন্ত্রণা কর সার।।
কর্ণের মন্ত্রণা শুনি, হিতবাক্য মনে গণি,
রাজা গেল ভীষ্মের শিবির।
নিবেদিল কুরুরাজ, সাধিতে আপন কাজ,
শুন পিতামহ ভীষ্মবীর।।
স্বীকার করিলা পূর্ব্বে, শত্রুগণ সংহারিবে,
এবে উপেক্ষিয়া কর রণ।
আমার ভাগ্যের বশে, চতুর্দ্দিকে শত্রু হাসে,
আজ্ঞা কর কি করি এখন।।
সেনাপতি কর্ণে কর, মারুক পাণ্ডববর,
উপেক্ষা নাহিক তার স্থানে।
করে বড় অহঙ্কার, সবান্ধব পরিবার,
পাণ্ডবে নাশিবে ঘোর রণে।।
দুর্য্যোধন বাক্যজালে, ভীষ্ম অগ্নি হেন জ্বলে,
চক্ষু পাকলিকা উঠে রোষে।
পূর্ব্বেতে বলিনুতোকে, শুনেছেন সবলোকে,
হিত না শুনিলে কর্ম্মদোষে।।
আমাকে বলিছ বৃদ্ধ, কর্ণের কি আছে সাধ্য,
বল কর্ণ কি করিতে পারে।
যখন গন্ধর্ব্ব বীরে, বান্ধিয়া লইল তোরে,
কর্ণবীর কি করিল তারে।।
উত্তর গোগ্রহ রণে, সাজিলেক সৈন্যগণে,
গোধন বেড়িলে গিয়া সবে।
একেশ্বর ধনঞ্জয়, গোধন কাড়িয়া লয়,
কর্ণবীর কি করিল তবে।।
ধর্ম্মবন্ত পঞ্চজন, মহাবল পরাক্রম,
দেবগণ প্রশংসেন যারে।
এ তিন ভুবন মাঝে, কে তার সহিত যুঝে,
কহিতে অনেক জন পারে।।
ইন্দ্র জিনিলা রণে, দহিল খাণ্ডব বনে,
অগ্নিরে তর্পিল একেশ্বর।
নিবাতকবচে জিনে, কালকেয় আদিগণে,
অর্জ্জুনে জিনিতে কেবা পারে।।
এতেক দুর্ব্বার রণে, তাঁহে সখা রাজগণে,
সমূহ পাঞ্চালগণ সাথে।
পূর্ণব্রহ্ম সনাতন, যাঁর সৃষ্টি ত্রিভুবন,
সারথি হলেন তিনি রথে।।
পূর্ব্বকথা কহি শুন, মহারাজ দুর্য্যোধন,
নন্দালয়ে ছিলেন শ্রীহরি।
যত শিশুগণ সঙ্গে, গোধন চরাণ রঙ্গে,
মহা আনন্দিত ব্রজপুরী।।
যত ব্রজবাসিগণ, করে যজ্ঞ আরম্ভন,
সুরপতি পূজার কারণ।
তা দেখিয়া জনার্দ্দন, সেই সব আয়োজন,
পর্ব্বতে করেন নিবেদন।।
শুনি ক্রূদ্ধ সুরনাথ, সর্ব্ব দেবে লয়ে সাথ,
হস্তী সহ যত মেঘগণ।
অহোরাত্র ঝড় বৃষ্টি, করিয়া মজান সৃষ্টি,
ত্রাসিত হইল সর্ব্বজন।।
যত গোপ বজ্রবাসী, কাতর হইয়া আসি,
শ্রীকৃষ্ণের শরণ লইল।
তাহা দেখি নারায়ণ, ধরিলেন গোবর্দ্ধন,
বাসবের কোপ উপজিল।।
দিবানিশি নাহি জ্ঞান, ত্রিভুবন কম্পমান,
বজ্রাঘাত সতত হইল।
সাত দিন হেনমতে, করিলেন সুরনাথে,
না পারিয়া মনে ক্ষমা দিল।।
সুরপতি যায় স্বর্গ, রক্ষা পায় গোপবর্গ,
গোকুলের ঘুচিল উৎপাত।
এবে সেই নারায়ণ, পাণ্ডবেরে অনুক্ষণ,
রক্ষা করে যেন পুত্রে তাত।।
কাহার যোগ্যতা তারে, বিনাশ করিতে পারে,
যাহার সহায় নারায়ণ।
যদি না রাখেন হরি, নিমিষে বধিতে পারি,
সসৈন্য পাণ্ডব পঞ্চজন।।
কল্য ঘোর রণ হবে, হেন অস্ত্র সঞ্চারিবে,
যাহা কেহ নিবারিতে নারে।
ভীষ্মের বচন শুনি, হরষিত কুরুমণি,
চলি গেল আপন শিবিরে।।
ব্যাস বিরচিল গাথা, অপূর্ব্ব ভারত-কথা,
শ্রুতমাত্র কলুষ বিনাশ।
কমলাকান্তের সুত, সুজনের মনঃপুত,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।