[লণ্ডনে প্রদত্ত-৫ই নভেম্বর, ১৮৯৬]
আমরা পূর্বে যে কঠোপনিষদের আলোচনা করিতেছিলাম তাহা এখন যাহার আলোচনা করিব, সেই ছান্দোগ্য উপনিষদের অনেক পরে রচিত হইয়াছিল। কঠোপনিষদের ভাষা অপেক্ষাকৃত আধুনিক, উহার চিন্তাপ্রণালীও সর্বাপেক্ষা অধিক প্রণালীবদ্ধ। প্রাচীনতর উপনিষদ্গুলির ভাষা আর একরূপ, অতি প্রাচীন—অনেকটা বেদের সংহিতাভাগের ভাষার মতো। আবার উহাদের মধ্যে—অনেক সময় অনেক অনাবশ্যক বিষয়ের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া তবে ভিতরের সার মতগুলিতে আসিতে হয়। এই প্রাচীন উপনিষদটিতে বেদের কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট প্রভাব আছে—এই কারণে ইহার অর্ধাংশের বেশী এখনও কর্মকাণ্ডাত্মক। কিন্তু অতি প্রাচীন উপনিষদ্গুলি পাঠ করিলে একটি পরম লাভ হইয়া থাকে। লাভ এই যে, ঐগুলি অধ্যয়ন করিলে আধ্যাত্মিক ভাবসমূহের ঐতিহাসিক বিকাশ বুঝিতে পারা যায়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদ্গুলিতে আধ্যাত্মিক ভাবগুলি একত্র সংগৃহীত ও সজ্জিত—উদাহরণস্বরূপ আমরা ভগবদ্গীতার উল্লেখ করিতে পারি। এই ভগবদ্গীতাকে সর্বশেষ উপনিষদ্ বলিয়া ধরা যাইতে পারে, উহাতে কর্মকাণ্ডের লেশমাত্র নাই। গীতার প্রতি শ্লোক কোন নাকোন উপনিষদ্ হইতে সংগৃহীত—যেন কতকগুলি পুষ্প লইয়া একটি তোড়া নির্মিত হইয়াছে। কিন্তু উহাতে তুমি ঐ-সকল তত্ত্বের ক্রমবিকাশ দেখিতে পাইবে না।
এই আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ক্রমবিকাশ বুঝিবার সুবিধাই অনেকে বেদপাঠের একটি বিশেষ উপকারিতা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বাস্তবিক ইহা সত্য কথা; কারণ বেদকে লোকে এত পবিত্র চক্ষে দেখে যে, জগতের অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের ভিতর যেমন নানাবিধ গোঁজামিল আছে, বেদে তাহা নাই। বেদে অতি উচ্চ চিন্তা, আবার অতি নিম্ন চিন্তার সমাবেশ—সার, অসার, অতি উন্নত চিন্তা, আবার সামান্য খুঁটিনাটি—সবই সন্নিবেশিত আছে, কেহই উহার কিছু পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করিতে সাহস করে নাই। অবশ্য টীকাকারেরা আসিয়া ব্যাখ্যার বলে অতি প্রাচীন বিষয়সমূহ হইতে অদ্ভুত অদ্ভুত নূতন ভাব বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন বটে, সাধারণ অনেক বর্ণনার ভিতরে তাঁহারা আধ্যাত্মিক তত্ত্বসকল দেখিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু মূল যেমন তেমনই রহিয়া গেল—এই মূলের ভিতর ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয় যথেষ্ট আছে। আমরা জানি, লোকের চিন্তাশক্তি যতই উন্নত হইতে থাকে, ততই তাহারা প্রত্যেকটি ধর্মের পূর্বভাব পরিবর্তিত করিয়া তাহাতে নূতন নূতন উচ্চ ভাবের সংযোজন করিতে থাকে। এখানে একটি, ওখানে একটি নূতন কথা বসানো হয়—কোথাও বা এক-আধটি কথা উঠাইয়া দেওয়া হয়—তারপর টিকাকারেরা তো আছেনই। সম্ভবতঃ বৈদিক সাহিত্যে এরূপ কখন করা হয় নাই—আর যদি হইয়া থাকে, তাহা ধরাই যায় না। আমাদের ইহাতে লাভ এই যে, আমরা চিন্তার মূল উৎপত্তিস্থলে যাইতে পারি—দেখিতে পাই, কি করিয়া ক্রমশঃ উচ্চ হইতে উচ্চতর চিন্তার, কি করিয়া স্থূল আধিভৌতিক ধারণা হইতে সূক্ষ্মতর আধ্যাত্মিক ধারণাগুলির বিকাশ হইতেছে—অবশেষে কিভাবে বেদান্তে ঐগুলি চরম পরিণতি লাভ করিয়াছে। বৈদিক সাহিত্যে অনেক প্রাচীন আচার-ব্যবহারেরও আভাস পাওয়া যায়, তবে উপনিষদে ঐ-সকল বর্ণনা বড় বেশী নাই। উহা এমন এক ভাষায় লিখিত, যাহা খুব সংক্ষিপ্ত এবং খুব সহজে মনে রাখা যাইতে পারে।
এই গ্রন্থের লেখকগণ যেন কেবল কতকগুলি ঘটনা মনে রাখিবার উপায়-স্বরূপ লিখিতেছেন; তাঁহাদের যেন ধারণা—এ-সকল কথা সকলেই জানে; ইহাতে মুশকিল হয় এইটুকু যে, আমরা উপনিষদে লিখিত গল্পগুলির বাস্তবিক তাৎপর্য সংগ্রহ করিতে পারি না। ইহার কারণ এই—ঐগুলি যাঁহাদের সময়ে লেখা, তাঁহারা অবশ্য ঘটনাগুলি জানিতেন, কিন্তু এখন সেগুলির কিংবদন্তী পর্যন্ত নাই—আর সামান্য যেটুকু আছে, তাহা আবার অতিরঞ্জিত হইয়াছে। ঐগুলির এত নূতন ব্যাখ্যা হইয়াছে যে, যখন আমরা পুরাণে ঐ-সকলের বিবরণ পাঠ করি, তখন দেখিতে পাই সেগুলি উচ্ছ্বাসাত্মক কাব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
পাশ্চাত্য জাতিগুলির রাজনীতিক উন্নতির বিষয়ে আমরা একটি বিশেষ ভাব লক্ষ্য করি যে, তাহারা কোনপ্রকার স্বেচ্ছাতন্ত্র বা একনায়কত্ব সহ্য করিতে পারে না; সর্বপ্রকার বন্ধনের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম করিয়া তাহারা ক্রমশঃ উচ্চ হইতে উচ্চতর গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে অগ্রসর হইতেছে, বাহ্য স্বাধীনতার উচ্চ হইতে উচ্চতর ধারণা লাভ করিতেছে; ভারতেও ঠিক সেইরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে, তবে দর্শন ও আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষেত্রে—এইমাত্র প্রভেদ। বহুদেববাদ হইতে ক্রমশঃ মানুষ একেশ্বরবাদে উপনীত হয়—উপনিষদে আবার যেন এই একেশ্বরের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হইয়াছে। জগতের অনেক শাসনকর্তা তাঁহাদের অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন, শুধু এই ধারণাই তাঁহাদের অসহ্য হইল তাহা নহে, একজন তাঁহাদের অদৃষ্টের বিধাতা হইবেন, এ ধারণাও তাঁহারা সহ্য করিতে পারিলেন না। উপনিষদ্ আলোচনা করিতে গিয়া এইটিই প্রথমে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ধারণা ধীরে ধীরে বাড়িয়া অবশেষে চরম পরিনতি লাভ করিয়াছে। প্রায় সকল উপনিষদের শেষেই দেখিতে পাই—জগতের ‘একেশ্বর’ সিংহাসনচ্যুত!
ঈশ্বরের সগুন ধারণা দূর হইয়া নির্গুন ধারণা উপস্থিত হয়। ঈশ্বর আর জগতের শাসনকর্তা একজন ব্যক্তি নন, তিনি আর অনন্তগুনসম্পন্ন মনুষ্যধর্মবিশিষ্ট কেহ নন, তিনি তখন ভাব-মাত্র, এক পরম তত্ত্বমাত্ররূপে জ্ঞাত হন—আমাদের ভিতর, জগতের সকল প্রাণীর ভিতর, এমন কি সমুদয় জগতে সেই তত্ত্ব ওতপ্রোতভাবে বিরাজিত। আর অবশ্য যখন ঈশ্বরের সগুণ ধারণা হইতে নির্গুণ ধারণায় পৌঁছানো গেল, তখন মানুষও আর সগুণ থাকিতে পারে না। অতএব মানুষের সগুণত্বও তিরোহিত হইল, মানুষেরও একটি ভাবরূপ গড়িয়া উঠিল। সগুণ ব্যক্তি বাহিরে দৃশ্যমান, প্রকৃত তত্ত্ব অন্তরে। এইরূপে উভয় দিক হইতেই ক্রমশঃ সগুণভাব চলিয়া যাইতে থাকে এবং নিগুণ ভাবের আবির্ভাব হয়। সগুণ ঈশ্বর ক্রমশঃ নির্গুনের কাছে আসিতে থাকেন; এবং সগুণ মানুষও নির্গুণ মানুষভাবের কাছে আসিতে থাকে; তারপর নির্গুণ মানুষভাব ও নির্গুণ ঈশ্বর-ভাব ক্রমশঃ অগ্রসর হইয়া কয়েকটি স্তরের অনুভূতির পর মিলিত হয়। আর এই দুইটি ধারা যে-যে ক্রমে অগ্রসর হইয়া মিলিত হয়, উপনিষদ্ তাহার বর্ণনায় পরিপূর্ণ এবং প্রত্যেক উপনিষদের শেষ বাণী—’তত্ত্বমসি’। একমাত্র নিত্য আনন্দময় পুরুষই আছেন, এবং সেই পরমতত্ত্বই এই জগৎরূপে—বহুভাবে প্রকাশিত হইয়াছেন।
এইবার দার্শনিকেরা আসিলেন। উপনিষদের কার্য এইখানেই ফুরাইল—দার্শনিকেরা তাহার পর অন্যান্য প্রশ্ন লইয়া বিচার আরম্ভ করিলেন। উপনিষদে মুখ্য কথাগুলি পাওয়া গেল—বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিচার দার্শনিকদিগের জন্য রহিল। স্বভাবতই পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত হইতে নানা প্রশ্ন মনে উদিত হয়। যদিই স্বীকার করা যায়, এক নির্গুণভাবই পরিদৃশ্যমান নানারূপে প্রকাশপাইতেছে, তাহা হইলে এই জিজ্ঞাস্য—’এক’ কেন ‘বহু’ হইল? এ সেই প্রাচীন প্রশ্ন—যাহা মানুষের অমার্জিত বুদ্ধিতে স্থূলভাবে উদিত হয়ঃ জগতে দুঃখ—অশুভ রহিয়াছে কেন? সেই প্রশ্নটিই স্থূলভাব পরিত্যাগ করিয়া সূক্ষ্মমূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। এখন আর আমাদের বাহ্যদৃষ্টি বা ইন্দ্রিয়ানুভূতি হইতে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইতেছে না, এখন ভিতর হইতে—দার্শনিক দৃষ্টিতে ঐ প্রশ্নের বিচার। সেই এক তত্ত্ব কেন বহু হইল? আর উহার উত্তর—শ্রেষ্ঠ উত্তরভারতবর্ষে প্রদত্ত হইয়াছে। ইহার উত্তর—মায়াবাদ; বাস্তবিক সেই এক তত্ত্ব বহু হয় নাই, বাস্তবিক উহার প্রকৃত স্বরূপের কিছুমাত্র হানি হয় নাই এই বহুত্ব আপাত-প্রতীয়মান মাত্র, মানুষ আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তি বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছ, কিন্তু তাহার প্রকৃত স্বরূপ নির্গুণ। ঈশ্বরও আপাততঃ সগুণ বা ব্যক্তিরূপে প্রতীয়মান হইতেছেন, বাস্তবিক তিনি এই সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত নির্গুণ পুরুষ।
এই উত্তরও একেবারে আসে নাই, ইহারও বিভিন্ন সোপান আছে। এই উত্তর সম্বন্ধে দার্শনিকগণের ভিতর মতভেদ আছে। মায়াবাদ ভারতীয় সকল দার্শনিকের সম্মত নয়। সম্ভবতঃ তাঁহাদের অধিকাংশই এ মত স্বীকার করেন না। দ্বৈতবাদীরা আছেন—তাঁহাদের মত দ্বৈতবাদ, অবশ্য তাঁহাদের ঐ মত বড় উন্নত বা মার্জিত নয়। তাঁহারা এই প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করিতে দিবেন না—ঐ প্রশ্নের উদয় হইতে না হইতে তাঁহারা উহাকে চাপিয়া দেন। তাঁহারা বলেন : তোমার এরূপ প্রশ্ন জিজ্ঞসা করিবার অধিকার নাই—কেন এরূপ হইল, ইহার ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করিবার তোমার কিছুমাত্র অধিকার অধিকার নাই। উহা ঈশ্বরের ইচ্ছা—শান্তভাবে আমাদিগকে উহার নিকট আত্ম-সমর্পণ করিতে হইবে। জীবাত্মার কিছুমাত্র স্বাধীনতা নাই। সবই পূর্ব হইতে নির্দিষ্ট—আমরা কি করিব, আমাদের কি কি অধিকার, কি কি সুখ-দুঃখ ভোগ করিব—সবই পূর্ব হইতে নির্দিষ্ট আছে; আমাদের কর্তব্য—ধীরভাবে সেইগুলি ভোগ করিয়া যাওয়া। যদি তাহা না করি, আমরা আরও বেশী কষ্ট পাইব। কেমন করিয়া তুমি ইহা জানিলে?—বেদ বলিতেছেন। তাঁহারাও বেদের শ্লোক উদ্ধৃত করেন; তাঁহাদের মতানুযায়ী বেদের অর্থও আছে; প্রমাণ বলিয়া তাঁহারা সেইগুলিই সকলকে মানিতে বলেন এবং তদনুসারে উপদেশ দেন।
আরও অনেক দার্শনিক আছেন, তাঁহারা মায়াবাদ স্বীকার না করিলেও তাঁহাদের মত মায়াবাদী ও দ্বৈতবাদিগণের মাঝামাঝি। তাঁহারা পরিণাম-বাদী। তাঁহারা বলেন : সমুদয় জগৎ যেন ভগবানের শরীর। ঈশ্বর সমগ্র প্রকৃতির ও সকল আত্মার আত্মা। সৃষ্টির অর্থ ঈশ্বরের স্বরূপের বিকাশ—কিছুকাল এই বিকাশ চলিয়া আবার সঙ্কোচ হইতে থাকে। প্রত্যেক জীবাত্মার পক্ষে এই সঙ্কোচের কারণ অসৎকর্ম। মানুষ অসৎকার্য করিলে তাহার আত্মার শক্তি ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হইতে থাকে—যতদিন না সে আবার সৎকর্ম করিতে আরম্ভ করে, তখন আবার উহার বিকাশ হইতে থাকে। ভারতীয় এই-সকল বিভিন্ন মতের ভিতর—এবং আমার মনে হয়, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে জগতের সকল মতের ভিতরই—একটি সাধারণ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়, আমি উহাকে ‘মানুষের দেবত্ব’ বলিতে ইচ্ছা করি। জগতে এমন কোন মত নাই, এমন কোন যথার্থ ধর্ম নাই, যাহা কোন-না-কোনরূপে—পৌরাণিক বা রূপকভাবে হউক অথবা দর্শনের মার্জিত সুস্পষ্ট ভাষায় হউক, এই ভাব প্রকাশ না করে যে, জীবাত্মা যেই হউক অথবা ঈশ্বরের সহিত তাহার সম্বন্ধ যাহাই হউক, উহা স্বরূপতঃ শুদ্ধ ও পূর্ণ। জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আনন্দ ও শক্তি—দুঃখ ও দুর্বলতা নয়। এই দুঃখ কোনরূপে তাহাতে আসিয়া পড়িয়াছে। অমার্জিত মতগুলি এই দুঃখকে মূর্তিমান্ অশুভ, শয়তান বা আহ্রিমান বলিয়া কল্পনা ও ব্যাখ্যা করে পারে। অন্যান্য মত একাধারে ঈশ্বর ও শয়তান দুইয়ের ভাব আরোপ করিতে পারে এবং কোনরূপ যুক্তি না দিয়াই বলিতে পারে, তিনি কাহাকেও সুখী, কাহাকেও বা দুঃখী করিতেছেন। আবার অপেক্ষাকৃত চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ ‘মায়াবাদ’ প্রভৃতি দ্বারা উহা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিতে পারেন। কিন্তু একটি বিষয় সকল মতেই অতি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত—উহা আমাদের প্রস্তাবিত বিষয়—আত্মার মুক্তস্বভাব। এই-সকল দার্শনিক মত ও প্রণালী কেবল মনের ব্যায়াম—বুদ্ধির চালনামাত্র। একটি মহৎ উজ্জ্বল ধারণা—যাহা আমার নিকট অতি স্পষ্ট বলিয়া বোধ হয় এবং যাহা সকল দেশের ও সকল ধর্মের কুসংস্কাররাশির মধ্য দিয়া প্রকাশ পাইতেছে, তাহা এই যে, মানুষ দেবস্বভাব, দেবভাবই আমাদের স্বভাব—আমরা ব্রহ্মস্বরূপ।
বেদান্ত বলেন, অন্য যাহা কিছু তাহা উপাধি মাত্র। কিছু যেন তাঁহার উপর আরোপিত হইয়াছে, কিন্তু তাঁহার দেবভাবের কিছুতেই বিনাশ হয় না। অতি সাধু প্রকৃতিতে যেমন, অতিশয় পতিত ব্যক্তিতেও তেমনি উহা বর্তমান। ঐ দেবস্বভাবের উদ্বোধন করিতে হইবে, তবেই উহার কার্য হইতে থাকিবে। আমাদের ঐ দেবভাবকে আহবান করিতে হইবে, তবেই উহা নিজে নিজেই প্রকাশিত হইবে। প্রাচীনেরা ভাবিতেন, চকমকি-পাথরে আগুন ঘুমাইয়া থাকে, সেই আগুনকে বাহির করিতে হইলে কেবল ইস্পাতের ঘর্ষণ আবশ্যক। আগ্নি দুই খণ্ড শুষ্ক কাষ্ঠের মধ্যে বাস করে, উহাকে প্রকাশ করিবার জন্য কেবল ঘর্ষণ আবশ্যক। অতএব এই অগ্নি—এই স্বাভাবিক মুক্তভাব ও পবিত্রতা প্রত্যেক আত্মার স্বভাব, আত্মার গুণ নহে; কারণ গুণ উপার্জন করা যাইতে পারে, সুতরাং উহা আবার নষ্টও হইতে পারে। মুক্তি বা মুক্তস্বভাব বলিতে যাহা বুঝায়, আত্মা বলিতেও তাহাই বুঝায়—এইরূপ সত্তা বা অস্তিত্ব এবং জ্ঞানও আত্মার স্বরূপ—আত্মার সহিত অভেদ। এই সৎ-চিৎ-আনন্দ আত্মার স্বভাব—আমাদের জন্মগত অধিকার; আমরা যে-সকল অভিব্যক্তি দেখিতেছি, সেগুলি আত্মার স্বরূপের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র—উহা কখন নিজেকে মৃদু, কখন বা উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করিতেছে। এমন কি, মৃত্যু বা বিনাশও সেই প্রকৃত সত্তার প্রকাশমাত্র। জন্ম মৃত্যু, ক্ষয় বৃদ্ধি, উন্নতি অবনতি—সকলই সেই এক অখণ্ড সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। এইরূপ আমাদর সাধারণ জ্ঞানও—উহা বিদ্যা বা অবিদ্যা যেরূপেই প্রকাশিত হউক না, সেই চিৎ-এর—জ্ঞানস্বরূপেরই প্রকাশ মাত্র; উহাদের বিভিন্নতা প্রকারগত নয়, পরিমাণগত। ক্ষুদ্র কীট, যাহা তোমার পায়ের নিকট বেড়াইতেছে, তাহার জ্ঞান এবং স্বর্গের শ্রেষ্ঠ দেবতার জ্ঞানে প্রভেদ প্রকারগত নয়, পরিমাণগত। এই কারণে বৈদান্তিক মনীষিগণ নির্ভয়ে বলেন যে, আমাদের জীবনে আমরা যে-সকল সুখভোগ করি, এমন কি অতি ঘৃণিত সুখ পর্যন্ত আত্মার স্বরূপ সেই এক ব্রহ্মানন্দের প্রকাশমাত্র।
এই ভাবটিই বেদান্তের সর্বপ্রধান ভাব বলিয়া বোধ হয়; আর আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমার বোধ হয়, সকল ধর্মেরই এই মত। আমি এমন কোন ধর্মের কথা জানি না, যাহার মূলে এই ভাব নাই। সকল ধর্মের ভিতরেই এই সার্বভৌম ভাব রহিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বাইবেলের কথা ধর—উহাতে রূপকভাবে বর্ণিত আছে, প্রথম মানব আদম অতি পবিত্র ছিলেন, অবশেষে পাপকার্যের দ্বারা তাঁহার ঐ পবিত্রতা নষ্ট হইল। এই রূপক-বর্ণনা হইতে প্রমাণিত হয়, ঐ গ্রন্থলেখক বিশ্বাস করিতেন যে, আদিম মানবের—অথবা তাঁহারা উহা যে ভাবেই বর্ণনা করুন না কেন—অথবা প্রকৃত মানবের স্বরূপ প্রথম হইতেই পূর্ণ ছিল। আমরা যে-সকল দুর্বলতা দেখিতেছি, আমরা যে-সকল অপবিত্রতা দেখিতেছি, সেগুলি উহার উপর আরোপিত আবরণ বা উপাধিমাত্র এবং খৃষ্টধর্মেরই পরবর্তী ইতিহাস ইহা দেখাইতেছে—খৃষ্টানরা সেই পূর্ব অবস্থা পুনরায় লাভ করিবার সম্ভাবনায়, শুধু তাহাই নহে, তাহার নিশ্চয়তায় বিশ্বাস করেন। পুরাতন ও নূতন টেস্টামেন্ট লইয়া সমগ্র বাইবেলেরও এই ইতিহাস। মুসলমানদের সম্বন্ধেও এইরূপ। তাঁহারাও আদম ও আদমের জন্মের পবিত্রতায় বিশ্বাসী, আর তাঁহাদের ধারণা—মহম্মদের আগমনের পর হইতে সেই লুপ্ত পবিত্রতার পুনরুদ্ধারের উপায় হইয়াছে। বৌদ্ধদের সম্বন্ধেও তাহাই; তাঁহারাও নির্বাণনামক অবস্থাবিশেষে বিশ্বাসী; উহা এই দ্বৈতজগতের অতীত অবস্থা। বৈদান্তিকেরা যাহাকে ব্রহ্ম বলেন, ঐ নির্বান অবস্থাও ঠিক তাই;আর বৌদ্ধদের সমুদয় উপদেশের মর্ম এই-সেই বিনষ্ট নির্বান-অবস্থা পুনরায় লাভ করিতে হইবে। এইরূপে দেখা যাইতেছে, সকল ধর্মেই এই এক তত্ত্ব পাওয়া যাইতেছে—যাহা তোমার নয়, তাহা তুমি কখন পাইতে পার না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাহারও নিকট তুমি ঋণী নও। তুমি তোমার নিজের জন্মগত অধিকারই প্রার্থনা করিবে। একজন প্রধান বৈদান্তিক আচার্য এই ভাবটি তাঁহার নিজকৃত কোন গ্রন্থের নামপ্রদানচ্ছলে বড় সুন্দরভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন। গ্রন্থখানির নাম ‘স্বারাজ্যসিদ্ধি’ অর্থাৎ আমার নিজের রাজ্য, যাহা হারাইয়াছিল, তাহার পুনঃপ্রাপ্তি। সেই রাজ্য আমাদের; আমরা উহা হারাইয়াছি, আমাদিগকে পুনরায় উহা লাভ করতে হইবে। তবে মায়াবাদী বলেন, এই রাজ্যনাশ একটি ভ্রমমাত্র, তুমি কখনও রাজ্যভ্রস্ট হও নাই—এই মাত্র প্রভেদ।
যদিও সকল ধর্মপ্রণালীই এই বিষয়ে একমত যে, আমাদের যে রাজ্য ছিল, তাহা আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি, তথাপি তাঁহারা উহা ফিরিয়া পাইবার উপায় সম্বন্ধে বিভিন্ন উপদেশ দিয়া থাকেন। কেহ বলেন, বিশেষ কতকগুলি ক্রিয়াকলাপ করিয়া প্রতিমাদির পূজা-অর্চনা করিলে এবং নিজে কোন বিশেষ নিয়মে জীবনযাপন করিলে সেই রাজ্যের উদ্ধার হইতে পারে। আবার কেহ কেহ বলেন, ‘প্রকৃতির অতীত কোন পুরুষের সম্মুখে তুমি যদি পতিত হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, তবে তুমি সেই রাজ্য ফিরিয়া পাইবে।’ আবার কেহ কেহ বলেন, ‘তুমি যদি ঐরূপ পুরুষকে সর্বান্তকরণে ভালবাসিতে পারো, তবে তুমি ঐ রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবে।’ উপনিষদে এ বিভিন্ন রকমের উপদেশই পাওয়া যায়। ক্রমশঃ যত তোমাদিগকে উপনিষদ্ বুঝাইব, ততই ইহা বুঝিতে থাকিবে। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ শেষ উপদেশ এই : রোদনের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। তোমাদের এই-সকল ক্রিয়াকলাপের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কি করিয়া রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবে, সে চিন্তারও তোমাদের কিছুমাত্র আবশ্যকতা নাই, কারণ তোমাদের রাজ্য কখন নষ্ট হয় নাই। যাহা তোমরা কখনই হারাও নাই, তাহা পাইবার জন্য আবার চেষ্টা করিবে কি? তোমরা স্বভাবতঃ মুক্ত, তোমরা স্বভাবতঃ শুদ্ধস্বভাব। যদি তোমরা নিজদিগকে মুক্ত বলিয়া ভাবিতে পারো, তোমরা এই মুহূর্তেই মুক্ত হইয়া যাইবে; আর যদি নিজেদের বদ্ধ বলিয়া বিবেচনা কর, তবে বদ্ধই থাকিবে। শুধু তাহাই নহে; এইবার যাহা বলিব, তাহা আমাকে অতি সাহসের সহিত বলিতে হইবে—এই-সকল বক্তৃতা আরম্ভ করিবার পূর্বেই তোমাদিগকে সে-কথা বলিয়াছি। ইহা শুনিয়া তোমাদের ভয় হইতে পারে, কিন্তু তোমরা যতই চিন্তা করিবে এবং প্রাণে প্রাণে অনুভব করিবে, ততই দেখিবে আমার কথা সত্য কিনা। মনে কর, মুক্ত ভাব তোমাদের স্বভাবসিদ্ধ নয়; তবে তোমরা কোনরূপেই মুক্ত হইতে পারিবে না। মনে কর, তোমরা মুক্ত ছিলে, এখন কোনরূপে সেই মুক্তভাব হারইয়া বদ্ধ হইয়াছ, তাহা হইলে ইহাই প্রমাণিত হইতেছে, তোমরা প্রথম হইতে মুক্ত ছিলে না। যদি মুক্ত ছিলে, তবে কিসে তোমায় বদ্ধ করিল? যে স্বতন্ত্র, সে কখন পরতন্ত্র হইতে পারে না; যদি হয়, তবে প্রমাণিত হইল, সে কখন স্বতন্ত্র ছিল না—এই স্বাতন্ত্র-প্রতীতিই ভ্রম ছিল।
তাহা হইলে এই দুই পক্ষের কোনটি গ্রহণ করিবে? উভয় পক্ষের যুক্তিপরম্পরা বিবৃত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়: যদি বলো, আত্মা স্বভাবতঃ শুদ্ধস্বরূপ ও মুক্ত, তবে অবশ্য সিদ্ধান্ত করিতে হইবে, জগতে এমন কিছুই নাই, যাহা আত্মাকে বদ্ধ করিতে পারে। কিন্তু যদি জগতে এমন কিছু থাকে, যাহা আত্মাকে বদ্ধ করিতে পারে, তবে অবশ্য বলিতে হইবে আত্মা মুক্তস্বভাব ছিলেন না, সুতরাং তুমি যে আত্মাকে মুক্তস্বভাব বলিয়াছিলে, তাহা তোমার ভ্রমমাত্র। অতএব অবশ্যই তোমাকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে যে, আত্মা স্বভাবতই মুক্ত। অন্যরূপ হইতে পারে না। মুক্তস্বভাবের অর্থ—বাহ্য সকল বস্তুর অধীনতা হইতে মুক্ত। অর্থাৎ বাহিরের কোন বস্তুই উহার উপর কারণরূপে কোন কার্য করিতে পারে না। আত্মা কার্যকারণ-সম্বন্ধের অতীত, ইহা হইতেই আত্মা সম্বন্ধে আমাদের উচ্চ উচ্চ ধারণা আসিয়া থাকে। আত্মার অমরত্বের কোন ধারণা স্থাপন করা যাইতে পারে না, যদি না স্বীকার করা যায় যে, আত্মা স্বভাবতঃ মুক্ত অর্থাৎ বাহিরের কোন বস্তুই আত্মার উপর কার্য করিতে পারে না। কারণ মৃত্যু আমার বহিস্থঃ কোন কিছু র দ্বারা কৃত কার্য। ইহাতে বুঝাইতেছে যে, আমার শরীরে উপর বহিস্থ অপর কিছু কার্য করিতে পারে; আমি খানিকটা বিষ খাইলাম, তাহাতে আমার মৃত্যু হইল—ইহাতে বোধ হইতেছে, আমার শরীরের উপর বিষনামক বহিঃস্থ কোন বস্তু কার্য করিতে পাতে । যদি আত্মা সম্বন্ধে ইহা সত্য হয়, তবে আত্মাও বদ্ধ। কিন্তু যদি ইহা সত্য হয় যে, আত্মা মুক্ত-স্বভাব, তবে ইহাও স্বতঃসিদ্ধ যে, বাহিরের কোন বস্তুই উহার উপর কার্য করিতে পারে না, কখনও পারিবে না। তাহা হইলে আত্মা কখনও মরিবেন না, আত্মা কার্যকারণ-সম্নন্ধের অতীত। আত্মার মুক্তভাব,অমরত্ব এবং আনন্দ সকলই এই ভাবের উপর নির্ভর করিতেছে যে আত্মা কার্যকারণ সম্বন্ধের অতীত,মায়ার অতীত। ভাল কথা; যদি বলো, আত্মার স্বভাব প্রথমে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল, এখন বদ্ধ হইয়াছে; তাহাতে ইহাই বোধ হয়, বাস্তবিক উহা মুক্তস্বভাব ছিল না। তুমি যে বলিতেছ, উহা মুক্তস্বভাব ছিল, তাহা অসত্য। কিন্তু অপর পক্ষে পাইতেছি, আমরা বাস্তবিক মুক্তস্বভাব; এই যে বদ্ধ হইয়াছি বোধ হইতেছে, ইহাই ভ্রান্তিমাত্র। এই দুই পক্ষের কোন্ পক্ষ লইব? হয় বলিতে হইবে—প্রথমটি ভ্রান্তি, নতুবা দ্বিতীয়টিকে ভুল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। আমি অবশ্য দ্বিতীয়টিকে ভ্রান্তি বলিব। ইহাই আমার সমুদয় ভাব ও অনুভূতির সহিত অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ। আমি সম্পূর্নরূপে জানি, আমি স্বভাবতঃ মুক্ত; বদ্ধভাব সত্য ও মুক্তভাব ভ্রমাত্মক—ক্ষণকালের জন্যও আমি এ-কথা মানিয়া লইতে পারি না।
সকল দর্শনেই স্থূলভাবে এই বিচার চলিতেছে। এমন কি, খুব আধুনিক দর্শনেও এই আলোচনার সূচনা দেখিতে পাওয়া যায়। দুই দল আছেন; এক দল বলিতেছেন, আত্মা বলিয়া কিছুই নাই, আত্মার ধারণা ভ্রান্তিমাত্র। এই ভ্রান্তির কারণ জড়কণাগুলির পুনঃ পুনঃ স্থানপরিবর্তন; এই সংহতি—যাহাকে তোমরা শরীর মস্তিষ্ক প্রভৃতি নামে অভিহিত করিতেছে, তাহারই স্পন্দন, তাহারই গতিবিশেষ এবং উহার মধ্যস্থ অংশগুলির ক্রমাগত স্থান-পরিবর্তনে এই মুক্তস্বভাবের ধারণা আসিতেছে। কয়েকটি বৌদ্ধসম্প্রদায় ছিলেন, তাঁহারা বলিতেন—একটি মশাল লইয়া চতুর্দিকে দ্রুত ঘুরাইতে থাকিলে একটি আলোকের বৃত্ত দেখা যাইবে। বাস্তবিক এই আলোকবৃত্তের কোন অস্তিত্ব নাই, কারণ ঐ মশাল প্রতি মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করিতেছে। সেইরূপ আমরাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর সমষ্টিমাত্র, উহাদের দ্রুত ঘূর্ণনে এই ‘অহং’-ভ্রান্তি জন্মিতেছে।
অতএব একটি মত হইল এই যে, শরীরই সত্য, আত্মার অস্তিত্ব নাই। অপর মত এই যে, চিন্তাশক্তির দ্রুত স্পন্দনে জড়রূপ এক ভ্রান্তির উৎপত্তি হইতেছে, বাস্তবিক জড়ের অস্তিত্ব নাই। এই দুই পক্ষ আধুনিক কাল পর্যন্ত চলিতেছে—একজন বলিতেছেন আত্মা ভ্রমমাত্র, অপরে আবার জড়কে ভ্রম বলিতেছেন। কোন্ মতটি লইব? অবশ্যই আত্মবাদের পক্ষ গ্রহণ করিয়া জড়বাদ অস্বীকার করিব। যুক্তি দুইদিকেই সমান, কেবল আত্মার নিরপেক্ষ অস্তিত্বের দিকে যুক্তি অপেক্ষকৃত প্রবল; কারণ জড় কি, তাহা কেহ কখন দেখে নাই। আমরা কেবল নিজদিগকেই অনুভব করিতে পারি। আমি এমন লোক দেখিনাই, যিনি নিজের বাহিরে গিয়া জড়কে অনুভব করিতে পারিয়াছেন। কেহ কখন লাফাইযা নিজ আত্মার বাহিরে যাইতে পারে না। অতএব আত্মার দিক যুক্তি একটু দৃঢ়তর হইল। দ্বিতীয়তঃ আত্মবাদ জগতের সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে পারে, জড়বাদ পারে না। অতএব জড়বাদের দিক হইতে জগতের ব্যাখ্যা অযৌত্তিক । পূর্বে যে আত্মার স্বাভাবিক মুক্ত ও বদ্ধভাব-সম্বন্ধীয় বিচারের প্রসঙ্গ উঠিয়াছিল, জড়বাদ ও আত্মবাদের তর্ক তাহারই স্থূলভাব মাত্র। দর্শণসমূহকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করিলে দেখিবে, তাহাদের মধ্যেও এই দুইটি মতে সংঘর্ষ চলিয়াছে। খুব আধুনিক দর্শণসমূহে ও আমরা অন্য আকারে সেই প্রাচীন বিচারই দেখিতে পাই। এক দল বলেন, মানবের তথাকথিত পবিত্র ও মুক্ত স্বভাব ভ্রমমাত্র—অপরে আবার বদ্ধভাবকেই ভ্রমাত্মক বলেন। এখানেও আমরা দ্বিতীয় দলের সহিত একমত, বদ্ধভাব যে ভ্রমাত্মক—আমরা এই মতই পোষণ করি।
অতএব বেদান্তের সিদ্ধান্তই এই— আমরা বদ্ধ নই, আমরা নিত্যমুক্ত। শুধু তাই নয়, আমরা বদ্ধ—এই কথা বলা বা ভাবাই অনিষ্টকর, উহা ভ্রম—উহা নিজেকে নিজে সম্মোহিত করে মাত্র। যখনই তুমি বলো আমি বদ্ধ, আমি দুর্বল, আমি অসহায়, তখনই তোমার দুর্ভাগ্য আরম্ভ, তুমি নিজের পায়ে আর একটি শিকল জড়াইতেছ মাত্র। এরূপ বলিও না, এরূপ ভাবিও না।
আমি এক ব্যক্তির কথা শুনিয়াছি—তিনি বনে বাস করিতেন এবং দিবা-রাত্র ‘শিবোহহং, শিবোহহং’ উচ্চারণ করিতেন। একদিন এক ব্যাঘ্র তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া হত্যা করিবার জন্য টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। নদীর অপর পারের লোকে ইহা দেখিল আর শুনিল—সেই ব্যক্তির কন্ঠনিঃসৃত ‘শিবোহহং শিবোহহং’ ধ্বনি। যতক্ষণ তাঁহার কথা কহিবার শক্তি ছিল, ব্যাঘ্রের কবলে পড়িয়াও তিনি ‘শিবোহহং’ উচ্চারণ করিতে বিরত হন নাই। এরূপ অনেক ব্যক্তির কথা শুনা যায়। এমন অনেক ব্যক্তির কথা শুনা যায়, যাঁহারা শত্রু কর্তৃক খণ্ড-বিখণ্ড হইয়াও তাহাকে আশীর্বাদ করিয়াছেন। ‘সোহহং সোহহং’—আমি সেই, আমি সেই, তুমিও সেই। আমি নিশ্চয়ই মুক্ত পূর্ণস্বরূপ, আমার সকল শত্রুও তাই। ‘তুমিই তিনি; আমিও তিনি’—ইহাই বীরের কথা।
তথাপি দ্বৈতবাদীদের ধর্মে অনেক অপূর্ব মহৎ ভাব আছে—প্রকৃতি হইতে পৃথক্ আমাদের উপাস্য ও প্রেমাস্পদ সগুণ ঈশ্বরবাদ অতি অপূর্ব—অনেক সময় এগুলি প্রাণ শীতল করিয়া দেয়; কিন্তু বেদান্ত বলেন, প্রাণের এই শীতলতা আফিং-এর নেশার মতো অস্বাভাবিক। ইহা আবার দুর্বলতা আনয়ন করে, আর পূর্বে যত না প্রয়োজন ছিল, এখন তদপেক্ষা বেশী প্রয়োজন এই বলসঞ্চার—শক্তিসঞ্চার। বেদান্ত বলেন, দুর্বলতাই সংসারের সমুদয় দুঃখের কারণ, দুর্বলতাই দুঃখভোগের একমাত্র কারণ। আমরা দুর্বল বলিয়াই এত দুঃখভোগ করি। আমরা দুর্বল বলিয়াই চুরি ডাকাতি মিথ্যা জুয়াচুরি বা অন্যান্য পাপ করিয়া থাকি। দুর্বল বলিয়াই আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হই। যেখানে আমাদিগকে দুর্বল করিবার কিছুই নাই, সেখানে মৃত্যু বা কোনরূপ দুঃখ থাকিতে পারে না। আমরা ভ্রান্তিবশতই দুঃখভোগ করিতেছি। এই ভ্রান্তি ত্যাগ কর, সব দুঃখ চলিয়া যাইবে। ইহা তো খুব সহজ সাদা কথা। এই-সকল দার্শনিক বিচার ও কঠোর মানসিক ব্যায়ামের ভিতর দিয়া আমরা সমুদয় জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজ ও সরল আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম।
অদ্বৈত বেদান্ত যে ভাবে আধ্যাত্মিক সত্য প্রকাশ করেন, তাহাই সর্বাপেক্ষা সহজ ও সরল। ভারতে এবং অন্যত্র এ-বিষয়ে একটি গুরুতর ভুল হইয়াছিল। বেদান্তের আচার্যগণ স্থির করিয়াছিলেন, এই শিক্ষা সর্বজনীন করা যাইতে পারে না, কারণ তাঁহারা যে-সিদ্ধান্তসমূহে উপনীত হইয়াছিলেন, সেইগুলির দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া যে-প্রণালীতে তাঁহারা ঐ-সকল সিদ্ধান্ত লাভ করিয়াছিলেন, সেই প্রণালীর দিকেই বেশী লক্ষ্য রাখিলেন—অবশ্য ঐ প্রণালী অতিশয় জটিল। এই ভয়ানক দার্শনিক ও নৈয়ায়িক উক্তিগুলি দেখিয়া তাঁহারা ভয় পাইয়াছিলেন। তাঁহারা সর্বদা ভাবিতেন, এগুলি প্রাত্যহিক কর্মজীবনে শিক্ষা করা যাইতে পারে না, আর এরূপ দর্শনের আবরণে অত্যন্ত নৈতিক শিথিলতা দেখা দিবে।
কিন্তু আমি আদৌ বিশ্বাস করি না যে, জগতে অদ্বৈততত্ত্ব প্রচারিত হইলে দুর্নীতি ও দুর্বলতার প্রাদুর্ভাব হইবে। বরং ইহা বিশ্বাস করিবার কারণ আছে যে, ইহাই দুদুর্নীতি ও দুর্বলতা নিবারণ করিবার একমাত্র ঔষধ। ইহাই যদি সত্য হয়, তবে যখন নিকটে অমৃতের স্রোত বহিতেছে, তখন লোকে পঙ্কিল জল পান করিতেছে কেন? যদি ইহাই সত্য হয় যে, সকল শুদ্ধস্বরূপ, তবে এই মুহূর্তেই সমুদয় জগৎকে এই শিক্ষা দাও না কেন? সাধু-অসাধু, নর-নারী, বালক-বালিকা, বড়-ছোট—সকলকেই বজ্রনির্ঘোষে ইহা শিক্ষা দাও না কেন? যে-কোন ব্যক্তি জগতে দেহধারণ করিয়াছে, যে-কেহ করিবে—সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজা, ঝাড়ুদার, ধনী, দরিদ্র—সকলকেই ইহা শিক্ষা দাও না কেন?—আমি রাজার রাজা, আমা অপেক্ষা বড় রাজা নাই। আমি দেবাতার দেবতা, আমা অপেক্ষা বড় দেবতা নাই।
এখন ইহা বড় কঠিন কার্য বলিয়া বোধ হইতে পারে, অনেকের পক্ষে ইহা বিস্ময়কর বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু তাহা কুসংস্কারের জন্য, অন্য কারণে নহে। সকল প্রকার কদর্য ও দুষ্পাচ্য খাদ্য খাইয়া এবং উপবাস করিয়া করিয়া আমরা নিজদিগকে সুখাদ্য খাইবার অনুপযুক্ত করিয়া ফেলিয়াছি। আমরা শিশুকাল হইতে দুর্বলতার কথা শুনিয়া আসিতেছি। এ ঠিক ভূত-মানার মতো। লোকে সর্বদা বলিয়া থাকে আমরা ভূত মানি না—কিন্তু খুব কম লোক দেখিবে, যাহাদের অন্ধকারে একটু গা ছমছম না করে। ইহা কুসংস্কার। ঠিক এইরূপেই লোকে বলিয়া থাকে, আমরা ইহা মানি না, উহা মানি না ইত্যাদি, কিন্তু কার্যকালে অবস্থাবিশেষে অনেকেই মনে মনে বলিয়া থাকেন—যদি কেহ দেবতা বা ঈশ্বর থাকো, আমায় রক্ষা কর। বেদান্ত হইতে এই অদ্বৈত ভাব পাওয়া যায়, এবং এই ভাবটিই চিরদিন থাকিবে। বেদান্তগ্রন্থগুলি কালই নষ্ট হইয়া যাইতে পারে। এই তত্ত্ব প্রথমে হিব্রুদের মস্তিষ্কে অথবা উত্তরমেরুনিবাসীদের মস্তিষ্কে উদিত হইয়াছিল, তাহাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ইহা সত্য, আর যাহা সত্য তাহা সনাতন, আর সত্য আমাদিগকে ইহাই শিক্ষা দেয় যে, উহা কোন ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। মানুষ পশু দেবতা—সকলেই এই এক সত্যের অধিকারী। তাহা দিগকে এই সত্য শিখাও, জীবনকে দুঃখময় করিবার প্রয়োজন কি? লোককে নানাপ্রকার কুসংস্কারে পড়িতে দাও কেন? কেবল এখানে(ইংলান্ড) নয়, এই তত্ত্বের জন্মভূমিতেই তুমি যদি লোককে বেদান্তের উপদেশ দাও, তাহারা ভয় পাইবে। তাহারা বলে : ইহা সন্ন্যাসীদের জন্য—সংসার ত্যাগ করিয়া যাহারা বনে বাস করে, তাহাদের পক্ষে ইহা ঠিক; কিন্তু আমরা সামান্য গৃহস্থ লোক; ধর্ম করিতে গেলে আমাদের কোন না কোন প্রকার ভয়ের দরকার, আমাদের ক্রিয়াকাণ্ডের দরকার ইত্যাদি।
দ্বৈতবাদ অনেক দিন জগৎকে শাসন করিয়াছ, আর ইহাই তাহার ফল। ভাল, একটি নূতন পরীক্ষা কর না কেন? হয়তো সক ব্যক্তির ইহা ধারণা করিতে লক্ষ বৎসর লাগিবে, কিন্তু এখণই আরম্ভ কর না কেন? যদি আমরা আমাদের জীবনে কুড়িটি লোককে ইহা বলিতে পারি, আমরা খুব বড় কাজ করিলাম।
ভারতবর্ষে আবার একটি মহতী শিক্ষা প্রচলিত আছে, যাহা পূর্বোক্ত তত্ত্বপ্রচারের বিরোধী বলিয়া বোধ হয়। তাহা এই : ‘আমি শু্দ্ধ, আমি আনন্দস্বরূপ; এ কথা মুখে বলা বেশ, কিন্তু জীবনে তো আমি সর্বদা ইহা দেখাইতে পারি না।’ এ কথা আমরা স্বীকার করি। আদর্শ সকল সময়েই বড় কঠিন। প্রত্যেক শিশুই আকাশকে নিজের মস্তকের অনেক উপরে দেখে, কিন্তু তাই বলিয়া সে আকাশে পৌঁছিতে পারে না, এই জন্যই কি আমরা সে দিকে যাইতে চেষ্টা করিব না? কুসংস্কারের দিকে গেলেই কি সব ভাল হইবে? যদি অমৃতত্ব লাভ করিতে না পারি, তবে কি বিষপান করিলেই মঙ্গল হইবে? আমরা সত্য কখনই অনুভব করিতে পারিতেছি না বলিয়া কি অন্ধকার, দুর্বলতা ও কুসংস্কারের দিকে গেলেই মঙ্গল হইবে?
নানাপ্রকারের দ্বৈতবাদ সম্বন্ধে আমার কোন আপত্তি নাই, কিন্তু যে-কোন উপদেশ দুর্বলতা শিক্ষা দেয়, তাহাতে আমার বিশেষ আপত্তি। নর-নারী, বালক-বালিকা যখন দৈহিক মানসিক বা আধ্যাত্মিক শিক্ষা পাইতেছে, আমি তাহদিগকে এই এক প্রশ্ন করিয়া থাকি—তোমরা কি বল পাইতেছ? কারণ আমি জানি, একমাত্র সত্যই বল বা শক্তি প্রদান করে। আমি জানি, সত্যই একমাত্র প্রাণপ্রদ, সত্যের দিকে না গেলে আমরা কিছুতেই বীর্যবান্ হইব না, আর বীর না হইলে সত্যেও যাওয়া যাইবে না। এইজন্যই যে-কোন মত, যে-কোন শিক্ষাপ্রণালী মনকে ও মস্তিষ্ককে দুর্বল করিয়া ফেলে, মানুষকে কুসংস্কারাবিষ্ট করিয়া তোলে, যাহাতে মানুষ অন্ধকারে হাতড়াইয়া বেড়ায়, যাহাতে সর্বদাই মানুষকে সকলপ্রকার বিকৃতমস্তিষ্কপ্রসূত অসম্ভব আজগুবি ও কুসংস্কারপূর্ণ বিষয়ের অন্বেষণ করায়—আমি সেই প্রণালীগুলি পছন্দ করি না, কারণ মানুষের উপর তাহাদের প্রভাব বড় ভয়ানক, আর সেগুলিতে কিছুই উপকার হয় না, সেগুলি নিতান্ত নিষ্ফল।
যাঁহারা ঐগুলি লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছেন, তাঁহারা আমার সহিত এ বিষয়ে একমত হইবেন যে,ঐগুলি মনুষ্যকে বিকৃত ও দুর্বল করিয়া ফেলে-এত দুর্বল করে যে, ক্রমশঃ তাহার পক্ষে সত্যলাভ করা ও সেই সত্যের আলোকে জীবনযাপন করা একরূপ অসম্ভব হইয়া উঠে। অতএব আমাদের আবশ্যক একমাত্র বল বা শক্তি। শক্তি এই পার্থিব দুর্ভোগের একমাত্র মহৌষধ। দরিদ্রগণ যখন ধনিগণের দ্বারা পদদলিত হয়, তখন শক্তিই দরিদ্রদের একমাত্র ঔষধ। মূর্খ যখন বিদ্বানের দ্বারা উৎপীড়িত হয়, তখনও শক্তিই মুর্খের একমাত্র ঔষধ।আর যখন পাপীরা অন্য পাপীদের দ্বারা,উৎপীড়িত হয়,তখনও শক্তিই একমাত্র ঔষধ। আর অদ্বৈতবাদ যেরূপ বল, যেরূপ শক্তি প্রদান করে, আর কিছুই সেরূপ করিতে পারে না। অদ্বৈতবাদ আমাদিগকে যেরূপ নীতিপরায়ণ করে, আর কিছুই সেরূপ করিতে পারে না। যখন সকল দায়িত্ব আমাদের উপর পড়ে, তখন আমরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়া যত ভালভাবে কাজ করিতে পারি, আর কোন অবস্থাতেই তেমন পারি না। আমি তোমাদের সকলকেই আহবান করিতেছি, বলো দেখি, যদি একটি ছোট শিশুকে তোমাদের হাতে দিই, তোমরা তাহার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিবে? মুহূর্তে তোমাদের জীবন বদলাইয়া যাইবে। তোমাদের স্বভাব যেমন হউক না কেন, তোমরা অন্ততঃ সেই সময়ের জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হইয়া যাইবে। তোমাদের উপর দায়িত্ব চাপাইলে তোমাদের পাপবৃত্তি সব পলায়ন করিবে, তোমাদের চরিত্র বদলাইয়া যাইবে। এইরূপ যখনই সমুদয় দায়িত্ব আমাদের উপর পড়ে, তখনই আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাবের স্ফুরণ হইবে; যখন আমাদের সমুদয় দোষ অপর কাহারও উপর চাপাইতে হয় না, যখন শয়তান বা ঈশ্বর—কাহাকেও আমরা আমাদের দোষের জন্য দায়ী করি না, তখনই আমরা যথাশক্তি ভালভাবে কাজ করি। আমিই আমার অদৃষ্টের জন্য দায়ী। আমিই নিজের শুভাশুভের কর্তা, আমিই শুদ্ধ ও আনন্দস্বরূপ। বিরোধী ভাবগুলি বর্জন করিতে হইবে।
ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ব মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম।
ন বন্ধুর্ন মিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।।
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রং ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ণ ভোক্তা চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।।১
বেদান্ত বলেন, এই স্তবই সাধারণের একমাত্র অবলম্বনীয়। ইহাই সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছিবার একমাত্র উপায়—নিজেকে এবং সকলকে বলা যে, আমিই সেই। পুনঃ পুনঃ এইরূপ বলিতে থাকিলে শক্তি আসে। যে প্রথমে খোঁড়াইয়া চলে, সে ক্রমশঃ পায়ে বল পাইয়া মাটির উপর পা সোজা রাখিয়া চলিতে থাকে। ‘শিবহহং’-রূপ এই অভয়বাণী ক্রমশঃ গভীর হইতে গভীরতর হইয়া আমাদের হৃদয় অধিকার করে—পরিশেষে আমাদের প্রতি শিরায়—প্রতি ধমনীতে—শরীরের প্রত্যেক অংশে পরিব্যাপ্ত হইয়া জ্ঞান-সূর্যের কিরণ যতই উজ্জ্বল হইতে উজ্জ্বলতর হইতে থাকে, ততই মোহ চলিয়া যায়, অজ্ঞানরাশি দূর হয়—ক্রমশঃ এমন এক সময় আসে, যখন সমুদয় অজ্ঞান একেবারে চলিয়া যায় এবং একমাত্র জ্ঞান-সূর্যই অবশিষ্ট থাকে।
অবশ্যই এই বেদান্ততত্ত্ব অনেকের পক্ষে ভয়ানক বলিয়া বোধ হইতে পারে, কিন্তু তাহার কারণ যে কুস্ংস্কার, তাহা আমি পূর্বেই বলিয়াছি। এই দেশেই (ইংলণ্ডেই) এমন অনেক লোক আছেন, তাঁহাদিগকেই আমি যদি বলি শয়তান বলিয়া কেহ নাই, তাঁহারা ভাবিবেন, যাঃ—সব ধর্ম গেল। অনেক লোক আমাকে বলিয়াছেন, শয়তান না থাকিলে ধর্ম কিরূপে থাকিতে পারে? তাঁহারা বলেন, আমাদিগকে পরিচালিত করিবার কেহ না থাকিলে আর ধর্ম কি হইল? কেহ আমাদিগকে শাসন করিবার না থাকিলে আমরা জীবনযাত্রা নির্বাহ করিব কিরূপে? বাস্তবিক কথা এই , আমরা ঐভাবে নিয়ন্ত্রিত হইতে চাই। আমরা এইভাবে থাকিতে অভ্যস্ত হইয়াছি, সুতরাং ইহা আমাদের ভাল লাগে। প্রতিদিন কেহ না কেহ আমাদের তিরস্কার না করিলে আমরা সুখী হইতে পারি না। সেই কুসংস্কার! কিন্তু এখন ইহা যত ভয়ানক বলিয়া বোধ হউক, এমন এক সময় আসিবে, যখন আমরা সকলেই অতীতের ইতিহাস স্মরণ করিয়া, শুদ্ধ অনন্ত আত্মাকে যে-সকল কুসংস্কার আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল, সেগুলির প্রত্যেকটি স্মরণ করিয়া হাসিব, এবং আনন্দ ও দৃঢ়তার সহিত সত্যই বলিব—আমিই তিনি, চিরকাল তাহাই ছিলাম এবং সর্বদা তাহাই থাকিব।
———-
১ নির্বাণষট্কম্—শঙ্করাচার্য